ভিখুরামের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিদ্যাধরী নদির পারে, কানমারীর ঘাটে। আম্ফানধ্বস্ত সুন্দরবনের নানা দ্বীপে মেডিকেল ক্যাম্প করতে যাই তখন। দেশজুড়ে লকডাউনে থমকে গেছে জীবন। ভয়ে আর আতঙ্কে শহুরে মানুষ দিশেহারা। মাস্ক পরে নি কেন জানতে চাইতেই যে হাসিটা হাসল ভিখুৱাম, তেমন হাসি আজকাল লাখ টাকা দিয়েও কিনতে পাওয়া যায় না।
ভিখুৱাম মান্ডিরা তখন সবে একশ দিনের কাজে বাঁধ সারাচ্ছে। "বাড়ি সারাইতে, মাটি কাইটতেই দিন কাটি যায়... উসব করুনা টরুনা মুগো হবে না"। একদিকে করোনা, অন্যদিকে আম্ফান, রোজ সকাল হলেই কাজে ঝাঁপ দিতে হত গত বছরের এই দিনগুলোয়। পরপর দুদিন হাসপাতাল, পরের দিন সুন্দরবনের কোনো দ্বীপে মেডিকেল ক্যাম্প। সারাদিন ক্যাম্প করে বিকেলে মধ্যাহ্নভোজ। বাউনিয়ার যৌথ রান্নাঘরে কেউ মাস্ক পরে নেই। যত্ন করে খাওয়ালো টগরি আর ওর সঙ্গিনীরা।
এক বছরে যত মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হলেন তার মধ্যে আপনার আমার মতো মধ্যবিত্তের সংখ্যা ভিখুৱাম, টগরি, মেহেরুন্নিসা বা ঝর্ণার মতো নিম্নবিত্তের তুলনায় অনেক বেশি। পরিসংখ্যান? থাকা জরুরি ছিল, তবু নেই। তবে গতবছর সেই ক্রান্তিকালে গ্রামে গঞ্জে হাইওয়ের দুপাশে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেছেন, যারা এবারও একই কাজ করছেন, একের পর এক মেডিকেল ক্যাম্প করেছিলেন যাঁরা, তারাও বলছেন একই কথা।
নিম্নবিত্তের গরম ভাত ছাড়া হারানোর কিছু ছিল না কোনকালেই, আজও নেই। সামান্য শরীর খারাপ নিয়ে মাথা ঘামালে পেটে কিল মেরে বসে থাকতে হয় ওদের। ওদের কম আক্রান্ত হবার পেছনে কম জনঘনত্ব হয়তো হয়তো মূল কারণ। উপসর্গহীন মৃদু সংক্রমণ, টেস্ট হয় নি, একটা কারণ হতে পারে। আর একটা বড় কারণ হতে পারে খোলা মাঠঘাট, শস্যখেতে ওদের দিনভর বিচরণ, খোলা হাওয়ায়, রোদে জলে। প্রকৃতির কাছাকাছি আছেন যারা তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের মতো প্রকৃতিধ্বংসী কংক্রীটসর্বস্ব মানুষের চাইতে বেশি হবেই। খোলা হাওয়া, খোলামেলা পরিবেশে থাকা যে করোনা সংক্রমণের আশংকা কমায়, এ নিয়ে সংশয় নেই আর।
এরপরও এসি ছাড়া ঘুমাতে পারব না আমরা, অফিসে অফিসে সেন্ট্রাল এসি বসবে পটাপট, সব মাটি ঢেকে যাবে কাজলকালো পিচে, গাছ লাগাব তো নাই, যত পারি কাটব! সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞের প্রেসাক্রিপশন মেনে আগেরবার এইচসিকিউ এস খেয়েছেন, এবার? ডক্সিসাইক্লিন, জিঙ্ক, ভিটামিন সি মায় আইভার্মেকটিন! ওষুধের দোকানে দীর্ঘ লাইন, ওগুলো খেলেই নাকি আটকে যাবে কোভিড! মাস হিস্টিরিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে আত্মঘাতী শহুরে বাঙালি। 'প্রতি পলে পলে ডুবে রসাতলে, কে তারে উদ্ধার করিবে!' পাতিলেবুতে ভিটামিন সি আছে পর্যাপ্ত, সব ভিটামিন মেলে ভাত রুটি ডাল ভাত মাছ ডিম সবজি ফলের আহারে, বলতে গেলে মার খাওয়ার আশঙ্কা প্রবল! আড়ালে আছে কালিচরণ! ঘাপটি মেরে, ঘোলা জলে বেনেরা মাছ তোলে চিরকাল।
ভিখুরামের খবর পেলাম কাল রাতে। ভেড়ি পাহারা দিচ্ছে। ঝর্ণা কাজে গেছে। আতঙ্ক টাটঙ্কের ধার ধারে না ওরা। এদিকে কলকাতা বা মফসসলে বাড়িতে কারো জ্বর হলেই হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে একজন রোগীর সঙ্গে ছুটছেন পাঁচ পাঁচজন। তিনজনের মাস্ক থুতনির নীচে, একজন লাইন ভাঙার চেষ্টা করে গুঁতো খাচ্ছেন বারবার! অন্যজন মাস্ক পকেটে পুরে কানে আয়তাকার ফোন লাগিয়ে ফিভার ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের চতুর্দশ প্রজন্মের পিন্ডি চটকানোর অন্তিম চেষ্টায় মগ্ন! বাজার করতে বেরিয়ে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ছোট্ট অক্সিজেন সিলিন্ডার বগলে পুরে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে পায়রার খুপড়িতে ঢুকতে যাচ্ছেন রাঘববাবু। বাড়িতে কারো হল নাকি? না, এখনো হয় নি, হতে কতক্ষণ! আগে থাকতেই স্টক করে রাখলাম, বুঝলেন না রামবাবু!
একটু বাদেই রাঘব পাকরাশির পোস্ট ভেসে উঠবে ফেসবুকের অনন্ত দেয়ালে। "অক্সিজেন অমিল, দেশটা রসাতলে চলে গেল "! সঙ্গে সঙ্গে কমেন্ট রাপ্তি রায়ের, "বিকোজিঙ্ক, ভিটামিন সি, ডক্সি খেয়ে যান রোজ, ইনবক্সে ডিটেল দিলাম "! একটু বাদেই নরহরি কবিরাজের নিদান, "রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে হোস্টেলের ছাত্রদের পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাওয়াতেন। কালমেঘ, নিম, নিশুন্দি, গুলঞ্চ, কাবাবচিনি একসঙ্গে থেঁতো করে খান। করোনা বাড়ির রাস্তা থেকে পালাবে!" "দাদু বুঝি রবিন্দরনাথ! গোমূত্রটা বাদ দিলেন কেন?", লিখবে 'আমি বেকার '।
বাঙালি এতকাল ভোটমগ্ন ছিল। ঘুম ভাঙছে এতদিনে! যখন বলা হচ্ছিল, মহারাষ্ট্র দিল্লি গুজরাট মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা ট্রেনের যাত্রী দের সবাইকে অন্তত 'ৱ্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট' করে ট্রেনে ওঠানো হোক, সবাই ভোটধ্যানে ছিলেন। আগেরবারের অভিজ্ঞতা বলছে, একমাস আগে থেকে এবার অন্তত এয়ারপোর্টে টেস্ট করানো বাধ্যতামূলক হলে এত রোগ ছড়াতে পারত না বাঙলায়। এসব বলতে গিয়ে 'জিঙ্গল বেল আইটি সেল' এর খাতায় নাম তুললেন যারা, তাদের গাল দিন মনের সুখে। শুধু মাথায় রাখুন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
মাস্ক না - পরে, দূরত্ববিধি না মেনে যারা ঘুরে বেড়িয়েছি যত্রতত্র, দিল্লি বাঙলা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে গেলেন যারা, সঙ্গে আনা বহু স্ট্রেনের করোনা ভাইরাস তাদের অনেককেই রেয়াত করবে না। 'ভাইরাসের স্মৃতি নেই', বিলকুল ঠিক, তবে ভাইরাসটা কিন্ত মানুষ মারতে আসে নি, এসেছে নিজেদের বাঁচাতে। নিজে বাঁচতে মরণকামড় এবারও হয়তো দেবে না, এখনো পর্যন্ত সংক্রমিত মানুষের মৃত্যুহার কুড়ি সালের তুলনায় সামান্য বেশি, খুব বেশি নয়। তবে, এই ঢেউই শেষ নয়, লাইনে আছে আরও অনেক বাস্তুচ্যুত ভাইরাস, গোটা বিশ্ব জুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে একের পর এক স্ট্রেন, কোনটা নবজাতক, কোনটা হাইব্রিড, বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন ভাইরাস নিয়ে কাজ করে চলা বিজ্ঞানীরা ।
ভয় পেয়ে ভাইরাস তাড়ানো যায় না। সচেতনতার, দায়িত্বশীল হবার বিকল্প হতে পারে একটাই। নির্বিকল্প সমাধি! স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্য লড়াই করা ছাড়া হারানোর কিছু নেই। অনেকেই চলে যাব আমরা, তবু দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসুক এই ঢেউ। চেতনা ফিরুক বাঙালির। কমবয়েসী ডাক্তারের জীবন বাঁচানো অনেক বেশি জরুরি। দরকার হলে আমাকে ভেন্টিলেশন থেকে বার করে এনে ওকে দেওয়া হোক।
"ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও, আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।"
তিক্ত কথায় পাঁচন, কিন্ত সঠিক।
শেষ লাইনের প্রার্থনায় গলা মেলালাম।
করোনাক্রান্তিতে বেঁচে থাকাই যেন বিস্ময়।
খবরে দেখলাম, এপারে ঢাকার রায়েরবাজারে আগাম গণকবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে। আর দিল্লিতে চলছে গণচিতায় দাহ।
চণ্ডাল খবরেরই লোক। তবুও এইসব খবরে এখনও মাথা ভোঁতা হয়ে যায়। সভ্যতার বিশাল সব অর্জনকে খুব খেলো বলে মনে হয়।
খুব ভালো
ভালো লাগলো।
গ্রামের মুনি চাচা কে মাস্ক পরনি কেন জিজ্ঞেস করায় বলেছিল ও গুলা তোদের শহরে ফেলাটা বাড়ির লোকের অসুখ আমাদের না।আমরা রোদে খাটি,পান্তা খাই, মাটিতে ঘুম যাই,কুরোনা আমাদের ভয় পায়। হয়ত ও-ই মুখ্য সরল মানুষ টার কথা খানিক টা হলেও সত্যি!!
আচ্ছা, বস্তিতে অসুস্থতা কম হওয়ার কারণ তো প্রকৃতি খোলামেলা হাওয়া রোদ হবেনা?
TIFR, এর আগের সার্ভেতে দেখিয়েছিল বস্তির মধ্যে ৫৭% র আন্টিবডি এসে গেছে। সেই ২০২০ র জুলাইতেই। কিন্তু কেস ফাটালিটি রেট কম। সিম্পটোমেটিক কেসও।
সেক্ষেত্রে নানারকম জীবাণুতে বেশি এক্সপোজার হয়ে বেশি ইম্যুনিটি থাকা কি ব্যাখ্যা? রোদে বেশি এক্সপোজারের জন্য ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত থাকা? ভিটামিন ডি র সঙ্গে কোভিডের লিনক তো অনেক স্টাডি দেখিয়েছে। জিনক, সি র সঙ্গেও। সেক্ষেত্রে কেউ এই সাপ্লিমেন্ট নিলে ক্ষতিই বা কী? লাভ হোক না হোক।
খুব জানতে ইচ্ছে করে ...... করোনা 'র জন্ম কি করে হলো ?এটা কি কোনো মনুষ্য সৃষ্ট রোগ না অন্য কিছু !! শুধু একটা ভাইরাস বলে চালিয়ে দেয়া হলো কিন্তু কার বা কাদের অবহেলায় এই ভাইরাস ? শুধু একটা জন্তু কে দোষ দিচ্ছি ,পরিবেশ ধংস ?? ইন্ডাস্ট্রি পলিউশন ??প্রাকৃতিক জীবন যাপন ছুড়ে ফেলে বিশ্বায়ন ইত্যাদি কে আপন করে নেয়া ।...অস্ত্র প্রতিযোগিতা করা দেশগুলো ??এরা দায়ী নয় ??