ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ। ইংরেজ আমল। 1854 সালের বড়ি বন্দর থেকে থানে পরীক্ষামূলক ট্রেনের পরে ট্রেন লাইন পাতা হচ্ছে দেশের দিকবিদিকে। 1870 সালে পাতা হয়েছে হাওড়া এলাহাবাদ মুম্বাই লাইন। জুড়ে গেছে ভারতের দুই প্রান্ত। সেই সময়ে কোলহাপুর থেকে কলকাতায় বদলী হয়ে এলেন পোস্টমাস্টার গোপাল বিনায়ক জোশী। চৌঠা এপ্রিল। 1881। সঙ্গে ষোল বছরের বৌ। আনন্দী।
সে বছরই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়তে চেয়ে আবেদন করলেন দুটি কন্যা। ডি আবরু আর অবলা বোস। অনুমতি না পেয়ে তারা চলে গেলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে। মেয়েদের জন্য তারা দরজা খুলেছে 1875 সালে। আমাদের গল্পের আরেক কন্যা কাদম্বিনী তখন বেথুনের বি এ ক্লাসের ছাত্রী। অঙ্ক নিয়ে লড়াই চলছে। কে বলেছে মেয়েরা অঙ্ক পারে না?
আনন্দীরও মেডিক্যাল পড়ার শখ। অবশ্য সে শখ দুঃখ জাত। মাত্র বছর দুয়েক আগেই তার একমাত্র সন্তানটি মারা গেছে। সন্তানহারা মায়ের ধারণা হাতের কাছে হিন্দু মেয়ে-ডাক্তার পেলে সে শিশুটি বাঁচত। অবশ্য স্বপ্নের আদি বীজ বপন করেছেন গোপালরাও। পাঁচ বছর বয়স থেকেই আনন্দীর পড়াশোনার ভার তার হাতেই। ন বছরে বিয়ে, ছেলের তরফে একটাই শর্ত যে মেয়েকে পড়াশোনা চালাতে হবে। বৌ এর পড়ার উপরে এতটাই নজরদারি যে রান্নাঘরে কাজ করতে গেলেও একসময় আনন্দীর কপালে জুটেছে বেধড়ক মার। কেন সে পড়াশোনা বন্ধ করে রান্না করতে গেছে! অবশ্য সন্তান জন্মের ব্যাপারটা ঠেকান যায় নি তাতেও।
কাদম্বিনীর অবশ্য কেন মেডিক্যাল পড়ার শখ হয়েছিল তা জানতে পারি নি। আমার কেমন মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্খার চেয়েও এই ইচ্ছার পিছনে অচলায়তনে চিড় ধরানোর ইচ্ছেই বেশি প্রবল ছিল। আর কাদম্বিনীর উচ্চশিক্ষার ইচ্ছার পিছনে তাঁর ছোটবেলার স্কুলের শিক্ষক, এবং পরবর্তী কালের স্বামী দ্বারকানাথের হাতটি স্পষ্ট। যে দলের চেঁচামেচির ফলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ মেয়েদের জন্য দরজা খোলে, তিনি তাঁদের অন্যতম।
আনন্দীর ইচ্ছেতে গোপালের পূর্ণ সমর্থন। 1878 সালের 4th September গোপাল কোলহাপুরের প্রেসবাইটেরিয়ন মিশনারীদের চিঠি লেখেন, আমেরিকায় কাজ পাওয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে, যাতে তাঁরা আমেরিকায় গিয়ে আনন্দীর মেডিক্যাল পড়ার স্বপ্ন সফল করতে পারেন। মিশনারীরা ধর্মত্যাগে নারাজ জোশি দম্পতিকে সাহায্য করেন নি। তবে পরোক্ষে সেই চিঠিই আনন্দীর পথ খুলে দেয়। সেই চিঠির সূত্রেই কার্পেন্টার পরিবারের সঙ্গে আনন্দীর পরিচয় ও এক নতুন সম্পর্কের সূচনা। এঁরাই আমেরিকায় তাঁকে আসতে আহবান করেন।
এই খানে একটা প্রশ্ন জাগে অবশ্যই। কেন আনন্দীর পৃথিবীর সব জায়গা ছেড়ে আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে হল। উত্তর মেলে না সঠিক। তবে একটা সম্ভাব্য কারণ হয়ত সেই সময় আমেরিকায় মেডিক্যাল শিক্ষার খুব একটা আটসাট বাঁধন ছিল না। আর কতটা সঠিক জানি না, তবে আনন্দীর ফরমাল স্কুল এডুকেশনের বাবদে তার জীবনী থেকে যেটুকু খবর পাই, তার স্থায়িত্ব মাত্রই এক বছরের। যদিও 1883 সালে আলফ্রেড জোন্সকে পাঠানো তার কলেজে ভর্তির আবেদনে তিনি ঝরঝরে ইংলিশে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন যে তিনি ডিভিশন অবধি অঙ্ক জানেন, ইংরাজী গ্রামার জানেন, গোটা সাতেক ভাষা পড়তে ও বলতে পারেন। তবু হয়ত এদেশের ফরমাল এডুকেশন ব্যবস্থায় তিনি জায়গা পেতেন না। তাতেও পুরো উত্তর মেলে না হয়তো কারণ বোম্বেতে ইউনিভার্সিটি পাস না করা মেয়েদের জন্যও মেডিক্যাল শিক্ষার দরজা খোলা হয় 1883 নাগাদই।
মনমোহন ঘোষের আত্মীয়া কাদম্বিনীর অবশ্য এই সমস্যা ছিল না। বরং বলা যেতে পারে ভারতের মেয়েদের ফরমাল উচ্চশিক্ষার পথটি তিনিই তৈরি করেছেন। ফরমাল স্কুলিং এর মাধ্যমে প্রথম এন্ট্রান্স পাশ। 1878 সালে। তাকে পড়ানোর জন্যই বেথুন স্কুল থেকে কলেজ হয়। ( চন্দ্রমুখী কাদম্বিনীর আগে এন্ট্রান্স দিয়েছিলেন, তিনি দেন প্রাইভেটে. 1876 সালে। )। এরপর বেথুনের থেকেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা পাস। আর তারপর তো 1883 সালে দেশের প্রথম মহিলা গ্ৰাজ্যুয়েট। চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী। সেবছরই ভর্তি হওয়া মেডিক্যাল কলেজে। দরজা খুলতে বাধ্য করেছেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিভার্স থম্পসন। 29th জুন, 1883।
আনন্দী সেই জুন মাসেই আমেরিকা পৌঁছে গেছেন। একা। হাজার লোকের হাজার বাজে কথায় পাত্তাও না দিয়ে। সব বিরোধিতাকে "due to tender hearts, fearful minds and foolish superstitions" বলে উড়িয়ে দিয়ে। যাওয়ার আগে অবশ্য আর একটা কাজ করেছিলেন। 24 শে ফেব্রুয়ারী শ্রীরামপুর কলেজে একটি প্রকাশ্য মিটিং এ ব্যাখ্যা করেন তিনি কেন আমেরিকা যেতে চান। এবং সেখানেই তিনি "কেন আমেরিকা" প্রশ্নের উত্তরও দেন। তাঁর মতে, এখানকার শিক্ষা ডিফেক্টিভ, নট সাফিসিয়েন্ট, পুরুষ-শিক্ষকরা রক্ষণশীল ও জেলাস। আরও বলেন যে হিন্দু মেয়েদের জন্য এদেশে ধর্ম মেনে থাকা আর একই সঙ্গে স্কুলে যাওয়া খুব সমস্যা। বিশেষত বাঙালী বাবুদের রাস্তাঘাটে একা মেয়ে দেখলে অসভ্য ব্যবহার অসহ্য। সেই সব এড়ানোর জন্যই আমেরিকা। প্রসঙ্গত কলকাতা বা বাঙালী সমাজ আনন্দীর কোনদিনই পোষায় নি। এখনকার মেয়েদের রাস্তায় বেরোনর অনভ্যাস, পর্দা প্রথা মানা, বিশেষত অন্য প্রদেশের আচার ব্যবহারের প্রতি অসহিষ্ণুতা তাকে পদে পদে বিরক্ত করছে। সেই সভায় এই সঙ্গে আনন্দী ঘোষণা করেন "I shall go as a Hindu, and come back here to live as a Hindu. "। আমেরিকায় পৌঁছে ভর্তি হলেন উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, ফিলাডেলফিয়াতে।
আনন্দীর পড়াশোনা ভালই চলছিল। কলেজের ডিন ও অন্যরা তাকে পছন্দ করতেন। অন্ততঃ কাদম্বিনীর মত নারী শিক্ষার বিরোধীদের হাতে তাকে হেনস্থা হতে হয় নি। কাদম্বিনীকে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়েছে। এমনকি মেয়েদের মেডিক্যাল শিক্ষার ঘোর বিরোধী মেডিসিনের প্রফেসর রাজেন্দ্র চন্দ্র চন্দ তাঁকে মেডিসিনের পেপারে ফেল করান। ফলে লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি ডিগ্রি কাদম্বিনীর পাওয়া হয় না। কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে তাঁর জোটে একটি স্পেশাল ডিগ্রি। গ্র্যাজুয়েট অফ মেডিক্যাল কলেজ অফ বেঙ্গল। 1886 সালে। মাস জানা নেই। এরপর তিনি ইডেন হাসপাতালে যোগ দেন, আর অল্পদিনের মধ্যেই ডাফরিন হাসপাতালে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে পূর্ণ ডাক্তারের মর্যাদা তখনও অধরা।
অন্যদিকে 11th মার্চ 1886 আনন্দীবাই সমাবর্তনে ডিগ্রি পান। অবশেষে এমডি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোলাপুরের হাসপাতালে চাকরীর অফার পান। কথা ছিল তিনি পরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরবেন। কিন্তু প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষে অক্টোবরেই জাহাজে ওঠেন। আর সুস্থ হন নি। দেশে ফিরে, ফেব্রুয়ারি মাসে পুনায় মারা যান। ডাক্তারি করা আর হয় নি। আনন্দীবাই জোশী nee Yamuna Joshee 31st March 1865 - 26th February 1887।
আনন্দীবাই "হিন্দু মহিলা ডাক্তার" হতে চেয়েছিলেন। আমেরিকায় থাকাকালীন তিনি সব হিন্দু আচার বিচার, নিয়ম কানুন মেনে চলেছেন। সর্বদা শাড়ী পরিহিতা। শুধু শীতের কামড় এড়াতে শাড়ী জড়ানোর মারাঠী ধরণ ছেড়ে ছিলেন। দীর্ঘ তিন বছরে শুধু নিরামিষ খাবারই ভরসা। তাঁর পাতিব্রত্য নড়ে চড়ে নি। এমনকি তাঁর ডিগ্রি থিসিস এর বিষয় " Obstetrics among the Aryan Hindoos" । তাঁর হিন্দুয়ানায় মুগ্ধ বালগঙ্গাধর তিলক কেশরিতে লিখলেন, " lives in the shadow of her husband and does not transgress the boundary of the world that is appropriate for the female community" . হিন্দু নারীত্বের পরাকাষ্ঠা।
কাদম্বিনীর লড়াই কিন্তু চলতেই থাকে। মেয়ে হয়ে ডাক্তারি পড়তে চাওয়ার স্পর্ধার জন্য বঙ্গবাসি তাকে "বাইজি" বলেছে। অবশ্য দ্বারকানাথ সেজন্য তাদের কোর্টে টেনে নিয়ে গেছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তবু ডিগ্রির অভাবে কাজের জায়গায় তাঁকে প্রায় নার্সের কাজ করতে হয়। তাই সন্তানদের কলকাতায় রেখে, কাদম্বিনী চললেন এডিনবরা। 1893 সাল। আরেকটি প্রথম। LRCP, LRCS আর LFPS পাশ করে দেশে ফিরলেন। দেশে ফেরার পরে 1894 সালে তিনি গাইনকলজি ও অবসটেট্রিক্স এর প্রফেসর হিসেবে ক্যাম্পবেল (এখনকার NRS) হাসপাতালে যোগ দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম। হিন্দু অহিন্দু নির্বিশেষে। তবে অন্তঃপুরবাসিনী হিন্দু মেয়েরাই সব থেকে বেশি উপকৃত হলেন বোধহয় এই ব্রাহ্ম মহিলার থেকে। শুধু তো ডাক্তারী না, যতদিন না তাঁর মৃত্যু হয় 1923 সালে, ততদিন বিবিধ ভাবে দেশের কাজও করেছেন। A life fully lived. কাদম্বিনী গাঙ্গুলী nee Basu, 18th July 1861 - 3rd October 1923.
আনন্দীবাইর অকালমৃত্যু তাঁকে পূর্ণতা পেতে দেয় নি, সেটাই দুঃখের।
( ২০২0 সালের সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে একটা বিজ্ঞাপনে আনন্দীবাইকে প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার বলা হয়েছিল । আমার জ্ঞানমতে কাদম্বিনী আর আনন্দীবাই প্ৰথম দুজন ভারতীয় মহিলা যারা পশ্চিমি চিকিৎসা বিদ্যায় শিক্ষিত , ডিগ্রি প্রাপ্ত। তবে কেমন একটা সন্দেহ হয় যে কাদম্বিনী তাঁর নিরন্তর বিদ্রোহ নিয়ে যেন দক্ষিণপন্থী সংখ্যাগুরুর কাছে একটু কম আকর্ষণীয়।
এদিকে ফেসবুক, ইন্টারনেটে বার বার দেখি লোকে বলছেন ফুলে দম্পতির 1848 সালের স্কুল ভারতের প্রথম ভারতীয়দের তৈরি মেয়েদের স্কুল। জোর গর্জনে চাপা পড়ে যায় 1847 সালে প্যারীচরণ সরকারের স্থাপিত বারাসতের কালীকৃষ্ণ স্কুল। যে স্কুল ফুলে দম্পতির স্কুলের একবছর আগেই স্থাপিত, আর আজও চলছে। আমি ফুলে দম্পতির প্রতি কম শ্রদ্ধাবান নই, তাঁদের অবদান নিঃসন্দেহে বিরাট। কিন্তু প্যারীচরণেরও কৃতিত্ব কম না। বাঙালীর গলার জোর কম বলে তিনি বিস্মরণে চলে যাবেন? এই উদাহরণ দেখে ভয় পেয়ে এই পাশাপাশি ঘটনা তুলে ধরলাম। আনন্দীবাই জোশী আর কাদম্বিনী দুজনেই যেন পাশাপাশি ভাস্বর হয়ে থাকেন ।)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।