#পুস্তকালোচনা -- #তোপসের_নোটবুক -- #কৌশিক_মজুমদার
বইয়ের নাম = তোপসের নোটবুক - ফেলুদার সংক্ষিপ্ত বংশপরিচয় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
লেখক = কৌশিক মজুমদার
প্রকাশক = বুক ফার্ম
পৃষ্ঠা সংখ্যা = ১১৮
মুদ্রিত মূল্য = ১৫০ টাকা (দ্বিতীয় মুদ্রণ)
অনেকেই হয়তো জানতে চাইবেন যে আমি "তোপসের নোটবুক"-এর সাথে বাস্তব অথবা সত্যজিৎ রায়ের লেখা কাহিনী অথবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কাহিনী মিলিয়ে দেখছি কেন। তার জবাবটা প্রথমেই দিয়ে রাখি।
Goodreads নামক Website-এ লেখক / প্রকাশক বইটি সম্পর্কে জানিয়েছেন - "
শার্লক হোমসকে নিয়ে ব্যারিং গুল্ড, মিশেল হার্ডউইক বা লেসলি ক্লিংগার যে জীবনী নির্মান করেছেন সেখানে হোমস সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ। কিন্তু বাঙালীর ঘরের ছেলে ফেলুদাকে নিয়ে এমন আখ্যান নেই। ফেলুর পরিবারের উৎস, বংশ পরিচয় কিংবা তাঁর বেড়ে ওঠা নিয়ে নানা সূত্র ছেড়ে গেছেন লেখক সত্যজিৎ। রেখে গেছেন বিটুইন দ্য লাইন এক সমান্তরাল ইতিহাস রচনার মালমশলা। আর সেই সব নিয়ে বাস্তব আর কল্পনাকে মিশিয়ে উপন্যাসের ঢঙে তৈরি হয়েছে তোপসের নোটবুক - ফেলুদার এক অন্যরকম জীবন আলেখ্য। এতে স্বচ্ছন্দে এসেছেন তারিণীখুড়ো, প্রফেসর শঙ্কু, ব্যোমকেশ বক্সীরা। আবার চরিত্র হিসেবে আছেন নেতাজী, উপেন্দ্রকিশোরও। এই বইতে আলো ফেলা হয়েছে ফেলুদার অজানা কেস- চন্দননগরের জোড়া খুন, লখাইপুরের হত্যাকান্ড বা ফরডাইস লেনের খুনের ঘটনাতে। এ এক আশ্চর্য ইতিহাস যার শুরু ফেলুর জন্মের বহু আগে অতীশ দীপঙ্করের সময়ে আর শেষ একেবারে বর্তমান কালে। সব ফেলুদাপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই বইটি।
"
অর্থাৎ লেখক নিজেই বার বার বাস্তবের ঘটনাগুলি সাথে তার কাহিনীতে জুড়ে দিয়েছেন (যেমন - উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড, নেতাজির ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন, অভিনেতা উত্তমকুমারের নায়ক সিনেমা মুক্তি পাওয়া ইত্যাদি।)। ফলে বাস্তবের সাথে এই কাহিনী কতটা মিলছে সেটা দেখার প্রয়োজন অবশ্যই আছে।
অন্যদিকে বইটির নাম "তোপসের নোটবুক" এবং এখানে ক্রমাগতভাবে ফেলুদার এবং তার সাথেই তোপসে, লালমোহন বাবু, সিধুজ্যাঠা প্রভৃতি প্রধান চরিত্রগুলির উল্লেখ হয়েছে। কাজেই এই কাহিনী পড়তে গেলেই মনোযোগী পাঠকের প্রতিটি তথ্য উল্লেখের সাথে মূল লেখার সাথে মিলিয়ে দেখার একটা ইচ্ছা থাকবেই।
আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
আর আমি ফেলু-ভক্ত নই, হলে পড়তে পড়তে বার বার মনে হতো - "বিস্তর গন্ডগোল রে তোপসে।"!
বইটির সম্পর্কে এইরকম লেখার কারণগুলি চলুন এক-দুই-তিন করে ক্রমান্বয়ে দেখে নিই —
১) ফেলুদার সাথে অত ঘোরাঘুরি করেও তোপসে কবে Commerce নিয়ে পড়লেন বা কবে Accountancy শিখলেন সেটা মূল কাহিনী কেন, এই বইতেও কোথাও সঠিকভাবে বলা নেই (বইয়ের শেষে একটি বাক্য আছে যদিও কিন্তু সেখানেও অসম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে, পরে এই নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে)। অথচ তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় হিসাবরক্ষক হিসেবে ৬০ বছর অবধি কাজ করতেন বলে জানা যাচ্ছে।
মাথায় গোবর না থাকলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে, ফেলুদার পাশে থাকার ফলেই এই অসামান্য Pathetic, থুড়ি Telepathic প্রতিভা থাকা সম্ভব হয়েছে!
২) ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মানো উত্তমকুমার প্রায়ই ফেলুদার বাড়িতে আসতেন এবং ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মানো ফেলুদার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তার উপর নিজের বারো বছরের ছোট ফেলুদাকে খুব Admire করতেন।
কী বলছেন? ফেলুদার কোনো কাহিনীতে ফেলুদার সাথে এইরকম অসমবয়স্ক মানুষের বন্ধুত্ব হয় নি?
আপনার চোখে "দশসংস্কারচূর্ণ" পড়েছে নাকি!
৩) তবে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, এই বইয়ের কাহিনী অনুযায়ী, ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নায়ক চলচ্চিত্র দেখেই ২৮ বয়সী ফেলুদা তোপসেকে জানায় - "দেখেছিস, অরুণ কেমন আমার জীবনটা চরিত্রে বসিয়ে দিয়েছে।"
অর্থাৎ, পাড়ার থিয়েটারে অভিনয় শিখে পরবর্তী কালে চাকরী ছেড়ে ২৭ বছর বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করা চরিত্রটি Private Investigator ফেলুদার চরিত্র থেকে নেওয়া!
ফেলুদার এইরকম সাদৃশ্য ধরার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তার বিভিন্ন কাহিনীতে আমরা কিন্তু দেখিনি!
৪) নায়ক চলচ্চিত্র প্রকাশের ও চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্র বানানোর আগে অর্থাৎ ১৯৬৬-১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে সতজিৎ রায় তোপসেকে বলেন - "আমরা আবার নতুন করে সন্দেশ বার করছি, জান তো?"
যদিও বাস্তবে ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে সন্দেশের পুনঃপ্রকাশ শুরু হয়ে গেছিলো এবং ১৯৬৭ অবধি "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি" এবং "বাদশাহ আংটি" নামক দুটি কাহিনী সেখান থেকেই ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিলো।
কাজেই তোপসে যে কালপরিক্রমা (Time-Travel) করতে পারতো সেটা এই বইটি না পড়লে আপনি জানতে পারতেন কি?
এই নোটবুকটি যে সায়েন্স ফিকশন সেটা আমার লেখা এই আলোচনার আগে জানতেন? এই জ্ঞান দেওয়ার জন্য আমাকে একটি সাধারণ Sugar Cube দিলেই আমি খুশি হবো।
৫) কাহিনী থেকে, মিত্র পরিবার বৌদ্ধ থেকে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করার পরে এই পরিবারকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের দ্বারা দেওয়া যমন্তক মূর্তি অলৌকিক ভাবে হারানোর কথা জানা যায়।
অর্থাৎ "কোথা থেকে কী হইয়া গেলো সঠিকভাবে বোধগম্য হইলো না, দেখিতে পাওয়া গেলো যে মূর্তিটি উধাও হইয়া গিয়াছে।"।
এইভাবে আকস্মিকভাবে অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করার জন্য লেখকের লেখনীর প্রশংসা করতেই হয়। এইভাবে তিনি কাহিনীতে অদ্ভুতরসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন!
৬ ও ৭) এই নোটবই থেকে জানা যায় যে কমপক্ষে ঊনিশ বছরের নবকৃষ্ণ মিত্রের সাথে হেমাঙ্গিনী দেবের বিবাহ এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সাথে বিধুমুখী গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহ একই বছরে হয়।
বাস্তবে, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সাথে বিধুমুখী গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহ ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে হয়েছিলো।
নোটবুক থেকে আরো জানা যায় যে, নবকৃষ্ণের দ্বিতীয় ছেলে জয়কৃষ্ণ মিত্রের জন্ম ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে এবং তার দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় ছেলে বিনয়কৃষ্ণ মিত্রের জন্ম হয়।
কাজেই কাহিনী অনুসারে, কমপক্ষে (১৯১৯ - ১৮৮৫ + ১৯) = ৫৩ বছর বয়সে নবকৃষ্ণ দ্বিতীয় বার এবং (১৯২৯ - ১৮৮৫ + ১৯) = ৬৩ বছর বয়সে নবকৃষ্ণ তৃতীয় বার বাবা হন।
তৎকালীন সমাজের গৌরীদান প্রথার কথা বিবেচনা করলে বিয়ের সময় হেমাঙ্গিনী দেবের সর্বাধিক বয়স হতো বারো বছর।
কাজেই কাহিনী অনুযায়ী, ৪৬ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয়বার এবং ৫৬ বছর বয়সে তিনি তৃতীয়বার মা হন।
এই নোটবুকের লেখক এইভাবে কিশোরকুমারের গলায় যৌবনের জয়গান গেয়েছেন!
৮) এই নোটবুক অনুসারে রাজেন মজুমদার ঢাকায় থাকতেন এবং জয়কৃষ্ণ মিত্রের বন্ধু ছিলেন।
কিন্তু ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি" কাহিনী অনুযায়ী রাজেন মজুমদার বাঁকুড়ার মিশনারী স্কুলে পড়তেন। তার ৫০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে তার বয়স ১৩-১৪ ছিলো বলে তোপসের অনুমান করেছিলো। তাই জয়কৃষ্ণ মিত্রের থেকে তার মোটামুটি ১৭-১৮ বছরের বড় হওয়ার কথা।
এরপরেও যে তারা অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন সেটা জয়কৃষ্ণের নিজস্ব প্রৌঢ়ির জন্য! যেটা আমরা এর আগে অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রদোষ মিত্রের ক্ষেত্রেও দেখেছি।
৯) এই নোটবই থেকে জানা যায় যে ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে চিত্রশিল্পী ফাল্গুনী পালের সাথে জয়কৃষ্ণ মিত্রের আলাপ হয় এবং এর কিছু দিন পরেই ফাল্গুনী পাল খুন হলে সেই খুনের তদন্ত করে ব্যোমকেশ খুনীকে ধরে।
অন্যদিকে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "দুর্গরহস্য" থেকে আমরা জানতে পারি যে রামবিনোদ ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের শীতকালের পরপর প্লেগে মুঙ্গেরে মারা যান এবং তার মারা যাওয়ার পর প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে অর্থাৎ দুর্গরহস্যের ঘটনার সময়কাল ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দ হবে। এছাড়া এখানে জানা যায় যে এটি চিত্রচোরের ঘটনার প্রায় একবছর পরের ঘটনা। অর্থাৎ ফাল্গুনী পালের মৃত্যুর সময় তার একবছর আগে অর্থাৎ ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি।
অর্থাৎ, জয়কৃষ্ণ মিত্র নিজেও কালপরিক্রমা করতে পারতেন!
সন্দেহ হয় যে, তারা প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর আবিষ্কৃত কালপরিক্রমণ যন্ত্র (Time-machine) নিয়ে এই কাজটি করতেন! যদিও সেটির জন্য স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কুকেই অতীতে গিয়ে জীবিত জয়কৃষ্ণ মিত্রকে ধরতে হতো।
এইসব বুঝতে না পারলে আপনার "মধ্যমনারায়ণ তেল" মাখার দরকার!
১০) এই বইয়ের কাহিনী অনুযায়ী ১৯৩৮ এর ডিসেম্বরে জয়কৃষ্ণ মিত্রের বিবাহ হলো ডক্টর ঘটকের স্ত্রী রজনীর দূর সম্পর্কের বোন প্রমীলা বসুর সাথে।
কিন্তু শরদিন্দুর লেখা অনুযায়ী, "চিত্রচোর"-এর ঘটনাগুলি তো ১৯৩৯ ডিসেম্বরের এবং ডাক্তার ও রজনীর নিজেদের বিয়েই হয়েছে পয়লা জানুয়ারি ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে।
জয় বাবা কাল পরিক্রমণ যন্ত্র!
১০) এই বইয়ের কাহিনী থেকে আরো জানা যায় যে জয়কৃষ্ণ মিত্র ও প্রমীলা বসুর বিবাহের সময় কন্যা সম্প্রদায় করেন ব্যোমকেশ বক্সি স্বয়ং।
কিন্তু শরদিন্দুর লেখা অনুযায়ী, "চিত্রচোর"-এর ঘটনাগুলোর প্রথম দিকের সময়ের পরেই ডাক্তার ঘটক ও ব্যোমকেশের সম্পর্ক এমন খারাপ হয়ে গেছিলো, যে, ব্যোমকেশের মনে হতো, যে, ব্যোমকেশ কিছু বলতে গেলে ডাক্তার ঘটক কামড়ে (!) দিতে পারে।
কিন্তু এরপরেও রজনীর পিতা মহীধর চৌধুরী মত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি আবার প্রমীলা ও তার বোন পূর্ণিমা বোসের দেখাশোনা করতেন, তার জায়গায় সেই আমলেও বিয়েতে ব্যোমকেশ যে কন্যা সম্প্রদান করেন তার একমাত্র কারণ হলো জয়কৃষ্ণের প্রৌঢ়ি (বারবার এই শব্দটাই আমার মাথায় আসছে)!
মাথায় না ঢুকলে একটাই ঔষধ - "অনর্গল ঘৃতকুমারী"!
—————————————————————————————————————
নোটবুকের কাহিনী নিয়ে এইভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যায় কারণ সাতাশটি অধ্যায়ের মধ্যে মাত্র আটটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করেছি। এখনো অনেক বাকি। বিশেষত ফেলুদার কিছু কাহিনী, যেগুলোর নাম সত্যজিৎ উল্লেখ করলেও ঘটনার বিবরণ দেননি এবং "তোপসের নোটবুক"-এ তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
যাইহোক, আবার সময় - সুযোগ পেলে পরবর্তী পর্ব নিয়ে আসবো। আলোচনা চলুক।
খুব্বাজে বই এটা।
কিন্তু বেশ লেখা! পরের পর্ব আসুক। এই লেখাটা পড়তে গিয়ে স্মরণজিতের টইটার কথা মনে পড়ল।
জটায়ুর ভাষায়, "ভেএএএরি ইন্টারেসটিং!"