থ্রিলার লেখার থ্রিল
কলকাতায় কেলেঙ্কারি
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
১৬ এপ্রিল ২০১৬ ২৩:১৮
ছবি: সুমন চৌধুরী
দু র্গাষষ্ঠীর সকাল। দিনের আলো সবে ফুটেছে। পুজো বলেই রাস্তায় লোকজন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। ঠিক এমন সময়ে নরেন্দ্রপুরের কাছে একটা অর্ধেক তৈরি বাড়িতে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল একটা বোমা। আর তার থেকে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম। মারা গেলেন অনেকে। আহত আরও অনেক বেশি। নিমেষে সারা কলকাতায় ছড়িয়ে গেল আতঙ্ক! এমন এক উৎসবের মুখে কলকাতায় কে ফাটাল বোমা!
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের তো মাথায় হাত! এই নিয়ে পর পর তিন বার পুজোর মুখে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আক্রান্ত হল শহর। লালবাজারে এসে হাজির হলেন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, চিফ সেক্রেটারি সঞ্জয় মিত্র, সিভিল ডিফেন্স সেক্রেটারি পি রমেশ কুমার, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেক্রেটারি ইন্দিভার পান্ডে, জয়েন্ট কমিশনার অব পুলিশ পল্লবকান্তি ঘোষ, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উচ্চপদস্থ কর্তারা। সিএম-কে ঘিরে শুরু হল আলোচনা আর স্ট্র্যাটেজি। কে এমন একটা ডার্টি বম্ব ফাটাল শহরে? কী তার উদ্দেশ্য? কেন সে ঢুকেছে শহরে? আর বার বার কেনই বা আমাদের এই শহরটা আক্রান্ত হচ্ছে?
আর এই আলাপ-আলোচনার মধ্যেই জানা গেল, চেক প্রজাতন্ত্র থেকে আসা এক কূটনীতিককেও অপহরণ করা হয়েছে!
কেন্দ্র থেকে এসে পড়ল স্পেশাল ফোর্সের টিম। আর সিএম-এর বিশেষ অনুরোধে প্রতি বারের মতো এ বারও আনা হল মার্কোস-এর এজেন্ট আদিল-কে।
ক্রমশ আশঙ্কার মেঘ জমতে থাকল। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ঘটনার জন্য। আর ঠিক তখনই এল সেই ফোন! জানা গেল, ভ্লাদ নামে এক আতঙ্কবাদী ঢুকে পড়েছে শহরে। তার পর পাতাল রেল, কালীঘাট ট্রাম ডিপো, মল্লিকবাজার সেমেটারি হয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা শহরে।
নিরীহ শহরবাসীকে বাঁচাতে, ভ্লাদের শর্ত অনুযায়ী একে একে লালবাজারে এসে পশ্চিমবঙ্গের সি.এম-এর সঙ্গে যোগ দিতে লাগলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সহ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই। কেউ বুঝতেও পারল না, আসলে এটা একটা প্লট। দেশের মাথাদের একসঙ্গে খতম করার চক্রান্ত!
ঠিক তখনই ছায়ার মতো, অশরীরীর মতো, নেমে এল সেই মানুষটি। যার নাম: সেন, অদম্য সেন। আর রহস্যের পরত খুলতে শুরু করল এক এক করে।
এর পর ভ্লাদ কি তার মিশনে সফল হল? আদিলই বা কী করল? আর অদম্য? সে কী পারল আবার তার কলকাতাকে বাঁচাতে?
কলাকতা-কেন্দ্রিক থ্রিলারটির নাম ‘আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী’। ২০১৪ সালের দুর্গাপুজোয় ‘এবেলা’ কাগজের ‘ওবেলা’ বিভাগে পূজাবার্ষিকীতে ছাপা হয়েছিল।
আসলে এটা ছিল কলকাতা-কেন্দ্রিক ট্রিলজি থ্রিলার সিরিজের তৃতীয় গল্প। প্রথম দুটির নাম ছিল ‘বিস্ফোরণের উৎসবে’, আর ‘অন্ধকারের রাজপুত্র’। এই দুটোও ‘এবেলা’তেই ছাপা হয়েছিল ২০১২ ও ২০১৩ সালে। তৃতীয় গল্পটার মতো এই দুটোতেও গল্পের বিষয় ছিল কলকাতা শহরের ওপর আতঙ্কবাদীদের আক্রমণ। ছিল ক্রিমিনাল, পুলিশ আর অদম্যর ‘ইঁদুর-বেড়াল’ খেলা।
প্রথম যখন থ্রিলার লেখার সুযোগ পাই ২০০৫ সালে, তখনই ভেবে নিয়েছিলাম, আর যা-ই লিখি না কেন, অপরাধমূলক গোয়েন্দা-ধরনের গল্প লিখতে গিয়ে কখনওই ভ্রমণকাহিনী লিখব না। আর ভেবেছিলাম, এমন কাউকে নিয়ে লিখতে হবে, যে কখনওই ছোটবেলা থেকে পড়া নানান থ্রিলারের মুখ্য চরিত্রের মতো আক্ষরিক ভাবে হিরো নয়। মনে ছিল, সে যেন কিছুতেই জটায়ুর সেই প্রখর রুদ্র না হয়ে ওঠে! সেই ছ’ফুট হাইট, ইয়া বুকের ছাতি!— এ সব যেন না হয় সে। সাধারণের মধ্যে থেকেই যেন বেরিয়ে আসে সেই মানুষটা! সবাই তো হিরোর গল্প লেখে, গোয়েন্দার গল্প লেখে, কিন্তু আমি যদি উলটো মানুষটার গল্প লিখি! যার হাইট পাঁচ ফুট পাঁচ-ছয় হবে। দেখতে সাধারণ হবে। যার একটা কষ্টের অতীত থাকবে। অনেকগুলো মনখারাপের বারান্দা থাকবে। যে অনেকটা ইনডিফারেন্ট হবে। এমন একটা মানুষ, যে টাকা রোজগারের জন্য খারাপ কাজ করে। বোমা ফাটায়, গুলি করে মানুষ মারে, চুরি করে! তবে! মনে হয়েছিল এমনই একটা লোককে ঘিরে গল্প লিখব যাকে কখনও কখনও ‘দুষ্টু লোক’-ও মনে হবে!
মনে পড়েছিল ‘হ্যামলেট’-এর সেই লাইন:
‘for there is nothing either good or
bad, but thinking makes it so.’
‘উনিশ কুড়ি’-র একটি থ্রিলার সংখ্যায় লিখেছিলাম প্রথম গল্প ‘বিস্ফোরণের একটু আগে’। এড্সের একটা ড্রাগের পেটেন্ট নিয়ে ছিল সেই গল্প। আর তার প্রোটাগনিস্ট এক জন মার্সিনারি। কথাটার আক্ষরিক অর্থ, ‘ভাড়াটে সৈন্য’। মানে, যে লোকটা— যে টাকা দেয়, তার হয়েই যুদ্ধ করে। একে সবাই চেনে অদম্য সেন হিসেবে। ডাকনাম— অ্যাডাম।
অদম্য বাঙালি ছেলে। জন্মের সময়েই মা মারা গিয়েছিল ওর। আর বাবা মারা যায় ওর একটু বড় হওয়ার পর, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে। তার পর দশ-বারো বছরের অসহায় অদম্যকে অন্ধকার থেকে বার করে আনেন ফাদার ফ্রান্সিস। তার পর ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যান অস্ট্রিয়ার ফিস শহরে। সেখানে একটা চার্চের অনাথাশ্রমে বড় হয়ে ওঠে অদম্য। এর পর নানা উত্থান পতন আর ঘটনার মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ-চক্রে ওর হাতেখড়ি। টাকার জন্যে নানান কাজ করে ও। ওর রোজগারে দশটা অরফ্যানেজ চলে। সাদা বা কালো কোনও গণ্ডিতেই জীবনকে বাঁধে না অদম্য। ‘ধূসর’টাই ওর রং।
শুরুর দিকে মনে হয়েছিল, অদম্যকে কখনওই শুধু কলকাতায় বেঁধে রাখব না। তার ঘটনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। আর সেই সুযোগে ছোট ছোট করে লেখাও যাবে সারা পৃথিবী জুড়ে কী কী বিষয় নিয়ে ক্রাইম হয়, হচ্ছে।
এর পর আরও চারটে ছোটগল্প লিখেছিলাম অদম্যকে নিয়ে। কোনওটা ছিল রেমব্রান্ট-এর ছবি চুরি করা নিয়ে, আবার কোনওটা ছিল ড্রাগের ব্যবসার সঙ্গে আন্তর্জাতিক টেররিজ্মের যোগসাজশ নিয়ে। আবার কোনওটার মূল বিষয় ছিল ‘কনফ্লিক্ট’ বা ‘ব্লাড ডায়মন্ড’।
কিন্তু এ সবই ছোটগল্প। এগুলোর কোনওটাতেই কোনও অপরাধ কলকাতায় ঘটেনি। কারণ প্রথম প্রথম তেমন কিছু ইচ্ছেও তো ছিল না। কিন্তু এর পর হঠাৎ করে ইচ্ছেটা হল।
আসলে এগারো বছর বয়স থেকে কলকাতায় থাকি আমি। এত দিনে শহরটার বড়রাস্তা থেকে শুরু করে গলিঘুঁজি, তলপেট আর অন্ধকার মনখারাপের কিছু কিছু জায়গা নানা কারণে দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। তাই গড়িয়াহাট মোড়ে হাঁটতে হাঁটতে, বিদ্যাসাগর সেতু পেরোতে পেরোতে, বাবুঘাটের গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে, কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ে বই কিনতে গিয়ে কিংবা বইমেলার ভিড়ে দাঁড়িয়ে মনে হত, এখানে যদি ‘তেমন’ কিছু ঘটে?
তেমন মানে? টুইন টাওয়ার! লন্ডন টিউব! বেসলান ম্যাসাকার! নভেম্বরের মুম্বই!
শহরের হা-হা হি-হি ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে, মেট্রোতে হাই-তোলা সিকিয়োরিটি পেরোতে পেরোতে, শপিং মলের ভেতর ঢোকার মুখে নামমাত্র মেটাল ডিটেক্টরের ‘ব্রাশ’ দেখে, আর কলকাতার পুজো প্যান্ডেলের ওই পাগল-করা ভিড় দেখে মন কু-ডাকত: এখানে যদি... এখানে যদি...
আর ঠিক এমন সময়ই ‘এবেলা’ পত্রিকা থেকে বলা হল, কলকাতাকে ভিত্তি করে একটা থ্রিলার নভেলা লেখার চেষ্টা করতে।
তো, আবার অদম্য সেন। কলকাতার পুজোর মুখে এক জন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বোমা রেখে প্রশাসনকে ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে। না, শুধু অর্থকরী লাভের জন্য নয়। বরং এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের জন্য, যেটা ভুল হাতে পড়লে গোটা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। গল্পের ক্রাইসিস পয়েন্ট সপ্তমীর কলকাতা হলেও, আসলে তার ডালপালা গোটা দেশ পেরিয়ে চিন, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মুজাফ্ফরাবাদ থেকে শুরু করে অস্ট্রিয়ার ফিস অবধি পৌঁছে গেছে। প্রাথমিক ভাবে পাজ্লের মতো করে বিভিন্ন ঘটনা ছড়িয়ে থাকলেও, গল্প যত এগোয়, তত পরিষ্কার হতে থাকে পুরো ছবিটা। সাদা আর কালোয় ভাগ করা পৃথিবীর রং মিলেমিশে হয়ে ওঠে রহস্যময়! (গল্পের নাম ‘বিস্ফোরণের উৎসবে’।)
এই গল্পগুলোয় বাস্তবের নেতা, নেত্রী ও পুলিশের উচ্চপদস্থ মানুষের উল্লেখ আছে, আবার তার সঙ্গে কল্পনা (মানে মিথ্যে) মিশে আছে পরতে পরতে। তাই কখনও মার্তোসের সৈনিক আদিল সপ্তমীর সন্ধেবেলা হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে নামে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাদে! কখনও বিদ্যাসাগর সেতুর অন্ধকারে ঘনিয়ে আসে গল্পের ক্লাইম্যাক্স! আবার কখনও স্বয়ং লালবাজার হয়ে ওঠে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু!
এই থ্রিলারগুলো যেহেতু কলকাতার হয়েও আন্তর্জাতিক, তাই লিখতে গিয়ে সামান্য বইপত্তর আর নেট ঘাঁটতে হয়েছে আমায়। আর প্রতি বার প্রতিটা গল্প শেষ করে দেখেছি, একটা ঘটনার লেজ ধরে টানতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য ঘটনা ও তথ্য। দেখেছি আমি নিজেই অজানা কত কিছু জেনে গেলাম!
যেমন ফিস। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে চার হাজার ফিটের বেশি উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট্ট অস্ট্রিয়ান গ্রামটি বরফ আর পাহাড় দিয়ে সাজানো। এই গ্রামটিকে ইউরোপের মানুষজন ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবেই দেখে। স্কি করার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন আসে এখানে। এমন একটা ছবির মতো গ্রামেই ছোটবেলা কাটিয়েছে অদম্য। আর ওই ট্রিলজির প্রথম গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে এখানেই।
এর পর মার্কোস। গল্পটা লেখার সময় অদম্যর পাশাপাশি আদ্যন্ত জেমস বন্ড ধরনের একটা চরিত্র খুঁজছিলাম। ভাবছিলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন অংশ থেকে নেওয়া যায় এমন একটা ‘সব পারে’ ধরনের চরিত্র। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম ‘মার্কোস’কে। মার্কোস মানে মেরিন কমান্ডোস! আগে এর নাম ছিল মেরিন কমান্ডো ফোর্স। শুধু ভারতের নয়, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক হল এই মার্কোসের যোদ্ধারা। এরা অ্যাম্ফিবিয়ান কমব্যাট ফোর্স! জল, মাটি, আকাশ— সব জায়গাতেই যুদ্ধ করতে সমান দক্ষ। প্যারাট্রুপিং থেকে ফ্রি-ফল বা আন্ডারওয়াটার কমব্যাট! সবেতেই এরা অপ্রতিরোধ্য।
এদের ট্রেনিংও হয় তেমনই কঠোর। যারা এই সিলেকশনে যায়, তাদের মধ্যে মাত্র দশ শতাংশের মতো নির্বাচিত হয়। ট্রেনিং-এর শেষ পাঁচ সপ্তাহকে বলা হয়: হেল’স উইক! আর এই নরকের সপ্তাহ পার করে যারা শেষ অবধি পৌঁছয়, তারা এক এক জন হয়ে ওঠে ওয়ার-মেশিন!
আদিল এমনই এক জন মার্কোসের সৈনিক! কলকাতার বিপর্যয়ে সে প্রথম বার এসে সাহায্য করে। আর তার পরের দু’বারের ঘটনা সামলাতে সিএম নিজেই তাকে ডেকে পাঠান।
তার পর সার্বিয়ার ভিঙ্কা শহর।
পৃথিবীতে ভিঙ্কা শহরটির গুরুত্ব অন্য রকম। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বর্তমানে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আর তার জন্য ‘ওয়েপন গ্রেড অ্যাটমিক ফুয়েল’ প্রচুর জমা হয়ে গেছে ভিঙ্কা-য়। তা ছাড়াও আছে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম ফুয়েল থেকে তৈরি হওয়া প্লুটোনিয়াম। আর সত্যি বলতে কী, এ সব অ্যাটমিক ফুয়েলগুলো খুব একটা সুরক্ষিত অবস্থাতেও নেই।
তাই ভিঙ্কা হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থীদের কাছে এক ‘ক্যান্ডি স্টোর’! কারণ ওইখানে সহজেই মেলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ! যা ট্রিলজির শেষ গল্পে ব্যবহার করা হয়েছে।
এ ভাবেই কলকাতা বিষয়ক থ্রিলার ট্রিলজি লিখতে গিয়ে গোটা পৃথিবীর অনেকে নতুন নতুন জায়গা আর ঘটনা, উন্নত যন্ত্রপাতি বা ইতিহাসের ছোট ছোট অধ্যায় খুলে গেছে আমার সামনে। আসলে কোনও দিনই আমি জটায়ুর ওই ‘প্রখর রুদ্র’-মার্কা দুনিয়াটা তৈরি করতে চাইনি। চাইনি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কিছু তৈরি করতে। বরং প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল, আমার গল্প হবে ‘ট্রু টু লাইফ’! ‘ইকোয়াল টু লাইফ’! সারা পৃথিবী জুড়ে ঘটে যাওয়া অপরাধের থেকেই উঠে আসবে আমার গল্প! সত্যি ঘটনার ‘এক্সটেনশন’ থেকেই তৈরি হবে আমার গল্প। সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক ক্রাইসিসের থেকে উদ্ভুত অপরাধ প্রবণতার ও ঘটনার পরম্পরা থেকেই তৈরি হবে আমার গল্প!
না, নিছক কোনও হিরে চুরি বা ‘সম্পত্তির জন্য খুন’ নয়। সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ঘটনার ছাপ থাকবে আমার গল্পে। আমি সচেতন ভাবেই চেষ্টা করেছি নিছক কোনও অ্যাডভেঞ্চার যেন না হয় গল্পগুলো। সচেতন ভাবে চেষ্টা করেছি, থ্রিলার বলতেই যে ‘সাহারায় শিহরন’ ধরনের গল্প মাথায় আসে, আমার গল্প যেন তার চেয়ে আলাদা হয়! তাই যতটা সম্ভব সত্য ঘটনা ও জায়গার কথা উল্লেখ করেছি।
তবে থ্রিলার লেখার সময় আসল মজাটা হয় লজিস্টিক্স নিয়ে। গল্প সাজাতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনার গিঁট পাকিয়ে ওঠে, যেগুলোকে না খুললে আর গল্প এগোবে না। তখনই হাত বাড়াতে হয় টেকনোলজির দিকে। খুঁজতে হয়, কী গ্যাজেট্স আছে, যার সাহায্যে গল্পের গিঁট খুলে তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
সে ভাবেই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গিয়েছি অদ্ভুত সব জিনিসপত্তর! যেমন আরডিএক্স বা সি-ফোর ডিটেকশন যন্ত্র! সবাই জানে, সি-ফোর যেহেতু প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, তাই মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে না। তা হলে কী ভাবে ধরা যায় এমন শক্তিশালী বিস্ফোরককে?
খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারলাম, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ উইলিয়াম ডাইট্ল-এর কথা। উনি এবং ওঁর ছাত্রী দীপ্তি গোপালকৃষ্ণণ এমন একটা পলিমার বানিয়েছেন, যার সাহায্যে খুব দ্রুত আর নির্ভুল ভাবে বের করা যায় আরডিএক্স-এর উপস্থিতি। পলিমারটি ফ্লুরোসেন্ট। কিন্তু আরডিএক্স-এর উপস্থিতিতে সেটি নিজের ভাস্বরতা (ফ্লুরোসেন্স) হারিয়ে, নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। গল্পে এটাও সেই গিঁট খুলতে ব্যবহার করতে হয়েছে আমায়।
এর পর নানা ধরনের বন্দুক, ডিটোনেটর, কমিউনিকেটিং ডিভাইস, বডি-আর্মার কেভলার ইত্যাদির ব্যবহারও করেছি। যার মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটাই বাস্তবে পাওয়া যায়, বা যেগুলোকে নিয়ে গবেষণা চলছে।
সিএম এবং অন্যান্যদের হত্যার চক্রান্ত নিয়ে গল্পটি (‘আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী’) লিখতে গিয়ে জানার দরকার পড়েছিল কলকাতার মাটির তলার ড্রেনেজ বা স্যুয়ার সিস্টেম সম্পর্কে। খোঁজ করে পেয়েও গেলাম তার ম্যাপ। দেখলাম কলকাতার মাটির তলা দিয়ে কী ভাবে উইয়ের বাসার মতো ছড়িয়ে রয়েছে এই ইটের তৈরি স্যুয়ার’গুলো! কোথা দিয়েই বা তারা গঙ্গায় পড়ছে। জানলাম, ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশরা এটা তৈরি করেছিল। তখনকার দিনে লন্ডন আর হামবুর্গ ছাড়া পৃথিবীতে এর সমতুল্য নিকাশি ব্যবস্থা আর কোথাও ছিল না। আর এটা ভাবতেও অবাক লাগে যে, ওই সময় এই নিকাশি ব্যবস্থা এমন করে তৈরি হয়েছিল, যাতে এত বছর পরেও এত বেশি সংখ্যক নাগরিকের ভার সে বইতে পারে!
এখন এই স্যুয়ারগুলো মেরামতির কাজ চলছে। গ্লাস রি-ইনফোর্সড পলিমার দিয়ে লাইনিং দেওয়া হচ্ছে। তাই রাস্তার ওপর জায়গায় জায়গায় কিছু ওপেনিং রাখা হয়েছে। এই সব তথ্যও ওই গল্পটা লিখতে আমায় সাহায্য করেছে।
এ ভাবেই কলকাতা বিষয়ক থ্রিলার ট্রিলজি লিখতে গিয়ে গোটা পৃথিবীর অনেক নতুন নতুন জায়গা আর ঘটনা, উন্নত যন্ত্রপাতি বা ইতিহাসের ছোট ছোট অধ্যায় খুলে গেছে আমার সামনে।
এক দিকে ফিস গ্রাম সম্পর্কে যেমন জেনেছি, তেমনই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোর-এর অপেরা হাউস’টি সম্পর্কেও খোঁজখবর পেয়েছি। ব্রাসেল্সের সকাল কেমন হয়ে জানতে পেরেছি, তেমনই জেনেছি তাইল্যান্ডের তামাকি নদীর কথা।
গল্পের খলনায়ক বা ভিলেনদের তৈরি করার সময় আবার নতুন করে জেনেছি লুসিয়াস ডোমিটিয়াস আহেনোবারবাস-এর কথা। যাকে ইতিহাস চেনে কুখ্যাত নিরো হিসেবে। বা আবার করে খুঁজে পেয়েছি পূর্ব ইউরোপের সেই ছোট্ট রাজ্যের অধীশ্বরটিকে। প্রিন্স অব ওয়ালাশিয়া, মেম্বর অব দ্য হাউস অব ড্রাকুলেস্টি, ভ্লাদ দ্য ইমপেলার-কে! যাঁর ওপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছিল কাউন্ট ড্রাকুলার সেই বিখ্যাত গল্প!
অদম্য সেনকে নিয়ে লেখা তাই আমার কাছে খুব আনন্দদায়ক ও পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা। লেখক হিসেবে সব সময়ই মনে হয়, যা ভাবলাম তা তো ঠিক লিখতে পারলাম না! যা মনে মনে দেখলাম, সেটা তো পুরোপুরি ফুটে উঠল না গল্পে! যে কোনও লেখকের মতো এই আপশোস ও অপূর্ণতা আমারও সঙ্গী।
তবে এটাও সত্যি যে একটা ভাল লাগাও তৈরি হয়েছে এই গল্পগুলো লিখতে গিয়ে! ‘অদম্য’ ও ‘অদম্য ২’— এই দুটো বই মিলিয়ে যে ন’টা গল্প ও উপন্যাস লিখলাম তাতে কিছুটা হলেও ওই তথাকথিত লার্জার দ্যান লাইফ হিরো-র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি আমি। ‘প্রখর রুদ্র’ ধরনের ক্যারেক্টার-গ্রাফের উলটো দিকে গিয়ে, আলো-ছায়ায় তৈরি আর একটা চরিত্রও ক্রমশ সামনে আনতে পেরেছি! যে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ! যে আমাদের পাশের বাড়িতেও থাকতে পারে! সে যেমন ইয়েনস বলে একটি বাচ্চা ছেলেকে গিটার বাজিয়ে গান শোনাতে পারে, তেমনই ঠান্ডা মাথায় মুখোমুখি হতে পারে রিভলভারের! সে যেমন বিভিন্ন অরফ্যানেজকে টাকা দেয়, তেমন রেমব্রান্ট-এর ছবিও চুরি করতে পারে টাকার জন্য! তাই হিরো প্রোটোটাইপের বাইরে এসে দাঁড়ায় এই অদম্য!
‘ভাল’-র যে একঘেয়েমি আর একমুখিনতা আছে অন্য অনেক কিছুর মতো, সেটা ভাঙতে চেয়ে কিছুটা হলেও হয়তো পেরেছি। কিছুটা হলেও ‘লেয়ার’, মানে, অনেকগুলো স্তর দেওয়া গেছে অদম্যর মধ্যে! মনের ভেতরে রাম আর রাবণের সহাবস্থান বোঝানো গেছে। তাই আমি নিশ্চিত জটায়ু নিজেও অদম্যকে দেখলে বলতেন— ‘হাইলি সাসপিশাস!’ বলতেন, ‘আপনাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই!’
amarchithipotro@gmail.com