যে ভোরে মৃণাল ফোটে পায়ে
দিল্লির ভোর -
ক্রমে ঘুনসি থেকে হাফপ্যান্ট থেকে থ্রি কোয়ার্টার থেকে ফুল..
যত শীত বাড়ে - ভোর তত প্রলম্বিত
এই দীর্ঘ ঈ তে টান তোলা ভোরে প্রতিদিন অনেক সংকল্প তৈরি হয়, অনেক অধরা আধবোজা কাজ সমাপ্ত হয়, -মেরু ভাল্লুকের গোটানো লেজের মতো কৌম বলের ওমের তলায়.. নতুন গুড়কে কোন নতুন আঙ্গিক দেওয়া যায়, ফুলকপি কড়াইশুঁটির ঘ্রাণ, পরিত্যক্ত ভ্রূণের মতো বীট, দোয়াতে ডুবিয়ে লেখার মতো সরু গাজর দিয়ে যখন বাঁধাকপির পাতায় পশমিনা পদ্য লেখা শুরু হয়, তখন... সেই ভোরে... মৃণাল ফোটে পায়ে....
মৃণাল সেন। ঠিক দুবছর আগে আজকের তারিখে টর্চ হাতে আলোর পথে যাত্রা করেছিলেন মৃণাল সেন। মিশে গিয়েছিলেন তারই শুট করা মিটিং মিছিলের মহাপার্থিব ফ্রেমে।
আজকে যখন আমার বাড়ি থেকে ঘন্টা কয়েকের দূরত্বে বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সংকল্প যজ্ঞের আগুনের মতো দাউদাউ স্পষ্টভাষী হুতাশন! যারা প্রমাণ করেছে দিল্লির শৈত্যপ্রবাহ একটা নিরপেক্ষ কন্সেপ্ট, তাকে মান্যতা দিয়ে কেউ ফুলকপির সিঙ্গাড়া গড়তে পারে, কেউ অগ্রাহ্য করে গড়তে পারে শপথ, তখন মৃণাল - প্রবাহে কেঁপে উঠি অন্তরে... আমরা কি পেরেছি সময়কে ধরে রাখতে.. এই যে সব ঐতিহাসিক সময়গুলো চলে যাচ্ছে, আমরা 'হিজিজীবীরা' কি পারলাম তাকে কুঁদে কুঁদে এক চিরন্তন ভাস্কর্য তৈরি করতে?
মিটিং মিছিল বোমা বিক্ষোভের ব্যারিকেডের কলকাতাকে যেভাবে তিনি রক্তমাংসে লেলিহান করে তুলেছিলেন, সেইভাবে? আমরা কি দেখতে পাব সেই পাতাঝরা বৃদ্ধ পিতা বা বড় ভাইদের কালশিটে পড়া মুখ, যারা মৃণালের একই সিনেমা বারংবার দেখতে আসতেন, কারণ সেই সিনেমার মিছিলে তারা রুদ্ধবাক আবিষ্কার করেছিলেন, কোন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভোরে ঘাসের আকাশে বিলীনকন্ঠ পাখির মতো লুটিয়ে পড়া তাদের পুত্র বা ছোট ভাইয়ের মুখ...
নীতিগতভাবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থক হয়েও তার অন্ধ অনুকরণকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তাকে কাটাছেঁড়া করার নিরন্তর স্পর্ধা. …. এত বিদ্যুৎ কোন প্লাগপয়েন্ট থেকে সংগ্রহ করব আমরা!!
আজকে যখন আপনার বেডরুমের বেডসাইড টেবিলের শীর্ষে জলের গ্লাসের পাশে ছোট্ট স্মার্ট কাচস্বচ্ছ ফুলদানিতে রাখা তিনটি অর্কিডের মধ্যে যেটা পার্পল, তার অন্তরের অন্তরতম পাপড়ির বুকে যে কোন ধূসর পাহাড়ী গুহ্য ধর্মের হাজার হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত সাপের মাথার মণি নিহিত আছে, সেইটা প্রমাণ করতে তিনটে সিরিজ, তিনশো দশটা এপিসোড বা দু ঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিটের মুভি তৈরিতে আমরা আমাদের মাথা থেকে বিবেক ঘামিয়ে ফেলছি, তখন একদিন প্রতিদিনের বাড়ির বড় মেয়েটা কেন সারারাত বাড়ি ফিরল না, তার একরাত বাড়ি না ফেরাতেই ভাল ঘরের ভাল মেয়ে হাফগেরস্ত হয়ে গেল কিনা, জেনেসিসে'র গর্ভবতী শবানা ঐ পান্ডব বর্জিত ভোরে তার দুই অর্জিত পান্ডবদের বর্জন করে কেন বাতাসে মিলিয়ে গেলেন, কেন মহাপৃথিবী'র মা আত্মহত্যা করলেন, এবং শেষপর্যন্ত বিদেশ থেকে ফেরা হতভাগ্য ছেলে কেন মায়ের ডায়রি পড়ার সাহস করতে না পেরে পুড়িয়ে ফেলল-
এইসব প্রশ্ন তোলার চেয়ে মশারিতে নিঝুম তোলা ভালো,
যে নিঝুমতায় রোম পোড়ে আর নিরো বেহালা বাজায়, যে নিঝুম উপেক্ষায় আউসুইচ আর বিরখানাউয়ের ঝলসানো চুল্লীর ঢিল দূরত্বে থাকা সাধারণ জার্মান অধিবাসী মা ছেলের জন্মদিনে বার্থ ডে তে কেক বেক করে, কুশান কাভারে ফুল তোলে, সেই নিঝুম নিরাময়ে বুঁদ হয়ে থাকি,
ঠিক এরকম সময়ে জেনেসিসে' র নূপুর বাজে... রুনুঝুনু রুনুঝুনু.. পৃথিবীর এককোণে পড়ে থাকা দুই হতভাগ্য ভাবে, তবে কি আমাদের ইচ্ছেরাই নূপুর হয়ে বাজছে....!!
সংকল্প বাজে। এমন অনেক সংকল্প প্রতিদিন বাজে মেরু ভাল্লুকের কুণ্ডলীকৃত লেজের মতো কম্বলের তলায়, তারকোভস্কি বলেছেন, ফিল্ম হল সময়ের ভাস্কর্য। কম্বলের তলায় আদুরে ভাস্কর্য গড়ি, তাপ্পর, তার চূড়োয় পা দোলাতে দোলাতে ঘুমিয়ে পড়ি, যতক্ষণ না মৃণাল- চিল এক ছোঁয়ে কম্বল সরিয়ে
বেআব্রু ঝাপটা মেরে যায়।
তামিমৌ ত্রমি
বাঃ
ধন্যবাদ