নাঃ, হাতি আর বিক্রির জন্য আসে না এখানে। শুধু স্নান আর মেলার শোভা বাড়াতেই এখন গজরাজের দরকার হয়। বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকোলেন সত্তর ছুঁইছুঁই রাজারাম যাদব। ২০১৮ সাল থেকে বন্যপ্রাণী আইনে জারি হয়েছে এই ফরমান। যার জেরে একদা এশিয়ার বৃহত্তম পশুমেলার মুকুট আজ মণিহারা—বলছি সোনপুর পশুমেলার কথা। মনে পড়ে, ২০০৮ সালে পয়লা দর্শনে আমবাগানের ফাঁকফোকরে হাতিবাজারের গরিমার কথা। সেবারও বিশ-বাইশটি হাতি দেখেছিলাম। শুনেছিলাম, গোটা পাঁচেক তার আগেই কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন বন দফতরের বাবুরা। জঙ্গলে ঝড়ে ওপড়ানো গাছ সরাতে, নদী-নালা পেরিয়ে দুর্গম বনাঞ্চলে ফরেস্ট অফিসারদের পৌঁছে দিতে এখনও হাতিই ভরসা। আর তাই তার চাহিদাতেও খামতি নেই। এ ছাড়া বিহার-উত্তরপ্রদেশের বহু গ্রামে হাতি রাখার শখ আজও সম্পন্ন ঘরে চালু রয়েছে বলে ক্রেতার অভাব হয় না।
সোনপুরের পশুমেলায় হাতি। এখন আর এ দৃশ্য চোখে পড়বে না।
সোনপুর থেকে নাকি দেদার হাতি কিনতেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে সে তথ্য জানা গিয়েছে। এখানকার হাতি সওদার বৃত্তান্ত সবিস্তারে লেখা হয়েছে একালের বহু ভারতীয় হস্তি বিশেষজ্ঞের কলমেও। ঊনবিংশ শতকে ১৮০ দিনে দুনিয়া প্রদক্ষিণ সাঙ্গ করার রোমহর্ষক সফরের ভারত পর্বে জুল ভের্নের সাহেব নায়ক ফিলিয়াস ফগ তাঁর দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চারের বাহন হাতিটি সোনপুর থেকে না কিনলেও, কালের নিরিখে এই সেদিন, ১৯৭০-এর দশকে ওড়িশা থেকে ৬০০ মাইল হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে গণ্ডকের তীরে হাজির হয়েছিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী মার্ক শ্যান্ড। স্বপ্নের সেই যাত্রা সাঙ্গ করে সফরসঙ্গী হস্তিনী তারাকে মেলায় বেচে দেওয়াই মনস্থ করেছিলেন সাহেব। তবে ভাগ্যের ফেরে শেষ পর্যন্ত কলিজা উপড়ে সে পাপ কাজ করতে হয়নি। ব্রাহ্ম মুহূর্তে তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন বন্ধুরা। সে সফরের কথা বিশদে জানতে গেলে ওলটাতে হবে Travels on My Elephant নামে শ্যান্ডের লেখা দুরন্ত বইটির পাতা।
তারাকে স্নান করাচ্ছেন মার্ক শ্যান্ড
আবার হরিহরক্ষেত্র তীর্থধামের উৎপত্তিতেও হাতির উপস্থিতি সুবিদিত। অগস্ত্য ও দেবল মুনির শাপে হাতি ও কুমির রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও গন্ধর্বরাজ হুহু। একদিন বেজায় গরমে অতিষ্ট হয়ে গণ্ডকে স্নান করতে গেলে হাতিরূপী ইন্দ্রদ্যুম্নকে আক্রমণ করেন কুমিররূপী হুহু। প্রবল পরাক্রমশালী গজরাজ বনাম অতিকায় কুমিরের সেই প্রাণঘাতী সংঘর্ষ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চললেও অমীমাংসিত থাকে। যুদ্ধের শেষে শক্তি হারাতে থাকলে বিষ্ণুকে স্মরণ করেন গজরাজ। ভক্তের আকুতিতে সাড়া দিয়ে সুদর্শন চক্রের সাহায্যে তিনি কুমিরবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করেন। দেবতার আশীর্বাদে ইন্দ্রদ্যুম্নের ঠাঁই হয় স্বর্গলোকে। অন্য দিকে, প্রতিযোগিতায় পরাজিত হুহুও সুদর্শন চক্রের স্পর্শ পেয়ে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গবাসী হন। বিষ্ণুর কৃপায় ভক্তজনের মোক্ষলাভ স্মরণীয় করে রাখতেই প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় সোনপুরের হরিহরক্ষেত্রে পুণ্যস্নানের আয়োজন হয়। পার্বণ উপলক্ষ করে বিশাল মেলা বসে আদিকাল থেকেই। হাতি আর কুমিরের সেই যুযুধান মূর্তি দেখা যায় হাজিপুর থেকে গণ্ডক সেতু পেরিয়ে সোনপুরে প্রবেশের মুখে গজগ্রহ চকে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, হাতি নিয়ে সোনপুরের যতেক আবেগ আর পরম্পরার ঝলকানি হালে সরকারি কলমের এক খোঁচায় বেমালুম ইতিহাসের কেতাবে মুখ গুঁজেছে।
সোনপুরের গজগ্রহ চকের সেই মূর্তি।
গত তিন দশক হল প্রতি বছর ছাপরার লাঠুয়া গ্রাম থেকে হেঁটে মেলায় পৌঁছানোর অভ্যাসে ভাটা পড়েনি রাজারামের। সেসব খতিয়ান ফুটে রয়েছে পাথুরে কাফ মাসল আর চকা নিকোবরি পায়ের চেটোর প্রতি খাঁজে। গণ্ডক-গঙ্গার সংগমে কার্তিক পূর্ণিমার স্নানের জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকেন তাঁর মতোই আরও বহু মানুষ। যে ক-দিন মেলায় থাকা, সকালে গণ্ডকে ডুব না দিলে সোয়াস্তি মেলে না। স্নানের পর হরিহরনাথ মন্দিরে বিগ্রহ দর্শন সেরে দহি চূড়ার নাস্তাও তেমনই অভ্যাস। খোপকাটা স্টিলের থালার মাঝে চাপ চাপ ধবধবে দইয়ের স্তরের ওপর মুঠো দুয়েক চিড়ে, আর তার ওপরে কালচে বাদামি আখি গুড়ের গুঁড়ো, বা স্থানীয় লব্জে স্রেফ ‘গুড়া’। সঙ্গে কপি মটরশুঁটির রগরগে ঝোল আর আমের আচার। জ্ঞানের নাড়ি টনটন হওয়া ইস্তক দই-চিড়েতে পাকা আম, কাঁঠালের কোয়া বা মর্তমান কলা পর্যন্ত চটকে গিলেছি। শীতে তাতে দানাদার খেজুর গুড়ও ঢেলেছি। কিন্তু ফুলকপির ডালনা আর টক আচারের এই কম্বো আগে দেখিনি। ধীরেসুস্থে চিড়ে মাখতে মাখতে রাজারামের ব্যাখ্যা, শরীর ঠান্ডা রাখতে টক-মিষ্টি-নোনতা-ঝালের মিশ্র ডোজ জরুরি। মকর সংক্রান্তিতে ঘরে-পাতা দই ও দিশি ধানের চিড়ের সঙ্গে খেতের টাটকা সবজি দিয়ে বেশ কয়েক রকম ব্যঞ্জনের ব্যবস্থা হয় বিহার-ইউপির গ্রামে।
তা বেশ কথা। কিন্তু আমার নাকে যে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়ছে সিঙাড়া ভাজার আনচান করা সুবাস। বেশি দূর যেতে হল না, চার নম্বর স্টলের সামনে ডাবু কড়াই থেকে ভেজে তোলা হচ্ছে হাতের তেলো উপছানো বাঘা সমোসা। পাশের উনুনে ফুটন্ত তেলে ফুলে উঠছে লালচে পুরি। তাদের ছেড়ে দহি চূড়ায় কখনও তেলেভাজা-অন্ত-প্রাণ বঙ্গ জঠর মজতে পারে! বিহারি সমোসায় আলুর আধিক্য যে থাকবে, তা বলে দিতে হয় না। কিন্তু এই সিঙাড়ার পুর ফালি নয়, আদাবাটা দিয়ে কষানো হয়ছে। সেদ্ধ মটর বেশ নরম, আর ধনে-জিরের সঙ্গে আমচুরের ছিটে টানটান স্বাদ এনেছে। মেঠো সমোসার সঙ্গে দাঁত শিরশির করা মিষ্টি চাটনি দেওয়ার চল নেই বলে খোলেও খাস্তা ভাব বহাল। মোটাসোটা আটার পুরিতে হিঙের গন্ধ কিন্তু নতুন চমক। সঙ্গী আলু-কপি-মটরশুটির তরকারি যে এত চিত্তজয়ী হতে পারে, কলকাত্তাইয়া স্বাদ কোরকের তা জানা ছিল না। উপরি পাওনা, কাঁচালঙ্কা ধনেপাতা বাটা নোনতা চাটনি। কালে কালে সোনপুর মেলায় শহুরে ছোঁয়াও লেগেছে বই কি! তাই দেখা দিয়েছে কেসরিয়া আর তন্দুরি চায়ের রমরমা। চমক ছেড়ে মোষের দুধে জ্বাল দেওয়া সাবেক চায়ে চুমুক দিলে বরং অপার তৃপ্তি মেলে।
চায়ের দোকান থেকে হদিশ পেয়ে চিড়িয়া বাজারে ঢুকে দেখি এলাহি কাণ্ড। ত্রিপলে চারদিক ঘেরা খোলা চৌখুপ্পির সারি। তার ভেতরে থরে থরে খাঁচায় রকমারি পাখি রাখা। টিয়া, চন্দনা, লালমোহন, ময়না, পায়রা, কাকাতুয়া, বদরি, লাভবার্ডসদের হরেক প্রজাতির পাশে বেশ কিছু বিদেশি পাখিও রয়েছে, যার মধ্যে ম্যাকাওদের চেনা গেল। আছে ঘুঘু, বুলবুলি, তিতির, বেনেবউ, শ্যামা, দোয়েল, পেঁচা আর ময়ূর। পাশাপাশি খাঁচাবন্দি কুকুরছানা, বেড়ালছানা, গিনিপিগ, খরগোশ, সাদা ইঁদুর, বেজি, বাচ্চাবাঁদর, এমনকি একজোড়া বনবেড়ালও। মোবাইল ক্যামেরা তাক করতেই রে রে করে তেড়ে এল ষণ্ডা গোছের কয়েক জন। পালের গোদা লালচোখো তর্জন-গর্জন করে জানতে চায়, কোন্ আস্পদ্দায় ছবি তোলা হচ্ছে? তার অতি উৎসাহী স্যাঙাতদের ছোঁ থেকে মোবাইল আড়াল করে যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, নতুন জিনিস দেখে ছবি তুলছি। তা ছাড়া, সরকারি নিয়মেই তো সওদা চলছে, তা হলে ভয় কী—সে বান্দা কোনো কথাই শুনতে চায় না। রেগেমেগে মুখ থেকে খৈনির দলা ছুড়ে আস্তিন গোটালে প্রমাদ গুনি। ঠিক সেই সময় ভলান্টিয়ার পুলিশ এসে না পৌঁছোলে কপালে দুঃখ ছিল।
ভলান্টিয়ারদের সর্দার দীপঙ্করের তিন পুরুষের বাস সোনপুরে। বলে, মেলায় ফি বছর কত হুজ্জত হয়, তা বাইরের লোকে টেরও পায় না। আগে রেলস্টেশন থেকে মেলা শুরু হত। আশপাশের গাঁ-গঞ্জের লোকই ভিড় করত বেশি। হাতি, উট, ঘোড়া, গাধা, গাই-বলদ, মোষ, ছাগল, ভেড়ার পাশাপাশি দেহাতি মিঠাই, গেরস্থালির জিনিসপত্র, চাষবাসের সরঞ্জাম আর জড়িবুটি দাওয়াইয়ের পসরা সাজিয়ে দোকান বসত। কুস্তির আখড়া, গোরুর গাড়ির দৌড়, সার্কাস আর নৌটঙ্কি নিয়ে ছিল জমজমাট বিনোদনের ব্যবস্থা। দোকান দিতেন রাজস্থান, হরিয়ানা, পঞ্জাব, ইউপি, বাংলা আর দিল্লির ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে মেলায় শহুরে ধান্দাবাজদের আনাগোনা শুরু হল। মেলাও আগের চেয়ে আড়ে-বহরে ছাঁটা হল। আস্তে আস্তে ঘুচে গেল তার সহজসরল রূপটি। দীপঙ্কর বলে, বেচাকেনা হইহল্লার আড়ালে এখন নানান কিসিমের জবরদস্ত অপরাধের ফলাও কারবার চলে এখানে। তাই হুঁশিয়ার থাকতে হয় হরবখত। এ সব বলে ডিএসপি অফিস থেকে বিশেষ পাস জোগাড় করে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলে, দরকারে একটা ফোন দেবেন, আর মিয়াঁ মিঠাই না চেখে যাবেন না।
আড়ং ধোলাইয়ের হাত এড়ানো গিয়েছে খুব জোর। পুলিশি আশ্বাসে টেনশন মুছে যেতেই নজরে পড়ল, মাদারির খেল দেখানোর মাঠে লোহার স্ট্যান্ডে রাখা পেতলের ছড়নো পরাতের আধখানা জুড়ে দো-ভাঁজ করা বিশাল পরোটা আর বাকি আদ্ধেক দখল করা বাদামকুচি ছড়ানো গাজরের হালওয়ার ওপর। মাছি আটকানোর সেলোফেন পরদা ফুঁড়ে ঘিয়ের সুগন্ধ এমন ডাকাডাকি শুরু করল যে, একপ্লেট নিতেই হল। পরোটা না খাস্তা না মিয়োনো, আর হালওয়াতে গাদাখানেক মিষ্টি দিয়ে গা গুলোনোর ফন্দি আঁটা হয়নি দেখে ভালো লাগল। দীপঙ্করের মুখে শোনা মিয়াঁ মিঠাই খুঁজতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। কড়া পাকে ময়দা ঘি চিনিতে তৈরি থালা, বাঁকা চাঁদ আর হরতন আকারের কঠিন মিষ্টি চাঙড়ে অসাবধানে কামড় দিলে দাঁতের পাটি খোয়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। তবে মুখের ভিতর তা গলতে শুরু করলে তৃপ্তির মাত্রা কোন্ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তার আন্দাজ পেলাম পাশে দাঁড়ানো মোমপালিশ করা ইয়া গোঁফজোড়ার ফাঁকে খোলতাই হওয়া অনাবিল হাসিতে। মিনিট বিশেক বাদে মওত কি কুয়াঁর খাড়া দেয়াল বেয়ে মোটরবাইক স্টান্টের পেছনে সেই মিঠাইয়ের কোনো অবদান ছিল কি না, তা অবশ্য জানার সুযোগ পাইনি।
মেলায় জাঁকালো প্যাভিলিয়ন খুলেছে রেল দফতর। সেখানে ভারতীয় রেল ইতিহাসের নানান ফিরিস্তি পড়ার লোক না পাওয়া গেলেও ইঞ্জিন কামরা সিগনালের খুদে মডেলের সামনে ভিড় কচিকাঁচাদের। লাগোয়া ফুড প্লাজায় প্যান ইন্ডিয়ান জগাখিচুড়িতে বিরিয়ানির দোসর ঘোর কমলারঙা চিলি চিকেন চাক্ষুস করে পালিয়ে বাইরে এসে দেখি, গোমড়ামুখো একজন মন দিয়ে লিট্টি সেঁকছে। মোট তিন রকম লিট্টি তার ডালায়। পরিচিত আমলকির মাপের লিট্টির পাশে রয়েছে তার চ্যাপটা সংস্করণ। তবে সেরা আকর্ষণ টেনিস বলের সাইজের লালু বোম। তার একটা চার্জ করলে পাকস্থলির দমফুঃ নিশ্চিত হলেও রসিকজনের সেকেন্ড হেল্পিং বিরল নয়। মোক্ষম সময়ে দীপঙ্করের ফোন: কী অবস্থা? লিট্টি-চোখার বাসনা জেনে বলে, ধুস, বেরিয়ে আসুন তো মেলার বাইরে। আজ আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবেন।
বাইকে বসিয়ে কিক মেরে বলে, কাল রাত থেকে ডিউটি দিচ্ছি, এবার ছুটি। মেলার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে স্টেশন পানে ছুটল বাইক। সাইডিং পেরিয়ে সটান এসে থামলাম মহাদেও লাইন হোটেলের দোরগোড়ায়। দীপঙ্করকে দেখে কাউন্টার থেকে চশমা কুড়িয়ে ছুটে এলেন মালিক মহাবীর প্রসাদ। তাঁর হাঁকডাকে স্পেশ্যাল কেবিনে টেবিল সাফসুতরো করা হল। না বলতেই হাজির রামের বোতল, মিনারেল ওয়াটার, সঙ্গে কড়া ভাজা রুইয়ের গাদা-পেটি। ব্যবস্থা ভালোই, কিন্তু লিট্টি? হবে, হবে! বরাভয় দিয়ে গ্লাসে চুমুক দেয় দীপঙ্কর। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না মোটেই, অ্যালুমিনিয়াম রেকাবিতে চেপে হেলেদুলে মঞ্চে প্রবেশ করল ডজনখানেক সদ্য সেঁকা ঘিয়ে জবজবে লিট্টি। আর পিছু পিছু স্টিলের জামবাটিতে উপুচুপু বটের পাখির কষা। লিট্টি ভেঙে গরগরে ঝোলে ভিজিয়ে মুখে ফেললাম। লালুজি কি কসম, দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এ স্বাদের অভিজ্ঞতা যার না হয়েছে, তার জীবনের ষোলো আনাই গোল্লায় গিয়েছে। মশলাদার লিট্টির অন্দরে কষানো বটেরের আপাত অকল্পনীয় অনুপ্রবেশ নিঃসন্দেহে স্বাদ মোহনায় অজানা ঠিকানার সন্ধান দেয়। সঙ্গে ধনিয়া-পুদিনার ঝাল চাটনি ছোঁয়ানো সরেস ঝাঁঝালো মুলো স্লাইসের টুসকি টেস্টবাডে তুফান তোলে। রামনামের মাহাত্ম্য প্রচারে এর চেয়ে সরেস আবহ আর কী-ই বা হতে পারে!
নৌটঙ্কি দেখবেন না কি? তিন পেগের শেষে জানতে চায় দীপঙ্কর। রেল সাইডিঙের সীমান্তে বাবলার আড়ালে কিছুক্ষণ আগে ডুব দিয়েছে হরিহরক্ষেত্রের ঘোলাটে সূর্য। পোড়ো জমির পুটুশ ঝোপে আঁধার ঘনাচ্ছে ঝুপ ঝুপ। মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে ভেসে আসা গুনগুন ক্রমে ঝালাপালায় রূপান্তরিত হল এক নম্বর গেটে পৌঁছে। এলইডি লাইটের ঝলকানি আর লেজার কিরণের দাপাদাপি রাতের আকাশ ফালাফালা করার নিষ্ফল প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। কমপক্ষে গোটা আষ্টেক নৌটঙ্কি কোম্পানির তাঁবু পড়েছে মেলায়। তালিকার শীর্ষে শোভা থিয়েটার। ২০০ টাকার টিকিট খরিদ করে জায়গা পেলাম মাঝের সারিতে। গপ্পো-টপ্পোর বালাই ঘুচেছে কোন্ আমলে জানা নেই, দেখি ডিস্কো লাইটমাখা স্টেজে গায়ে গা ঠেকিয়ে জনা পঞ্চাশ মেয়ে ভোজপুরি আর হিন্দি হিট গানের সুরে শরীর দোলাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ কে জানে কাকে তাক করে মোহিনী নজর হানায় বা চটুল ইশারায় ব্যস্ত, কিন্তু অনেকেই পড়া না-জানা ছাত্রের মতো অদৃশ্য ব্ল্যাকবোর্ডে ফ্যালফেলে দৃষ্টি ফেলে দম দেওয়া পুতুলের মতো কোমর দোলাচ্ছে। তাদের নিয়ে উন্মাদ পয়লা সারির দর্শক। মঞ্চে ওঠার এলেম না থাকায়, আসন ছেড়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে চিৎকার করে সে এক মহা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছে তারা। হঠাৎ দেখি, স্টেজ-কাঁপানো সুন্দরীদের ইমপ্রেস করতে কে কার থেকে বেশি উঁচুতে মাঙ্কিটুপি ছুড়তে পারে, সেই কম্পিটিশন শুরু হল। তাতে অন্য একজনের টুপি লুফে জাঁক করতে গেলে ঘোরতর ঝামেলার সূত্রপাত হল এবং অচিরেই ঘুষোঘুষি বাধল। এরই মধ্যে কালো হাফশার্ট পরা একদল কোত্থেকে এসে বেদম ডান্ডা চালাতে থাকলে দীপঙ্করের ফুসমন্তর মেনে তাঁবু ছাড়ার সময়ও ডেসিবেলের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে ছাড়ছে ‘আরা হিলে বালিয়া হিলে, ছাপড়া হিলে লা’, সেই কমরিয়া-লচকদার লোকগান, যার অনুকরণটি আমরা সবাই শুনেছি স্বয়ং মান্না দে-র কণ্ঠে —‘কাশী হিলে পটনা হিলে, কলকত্তা হিলে-লা... ।’
গণ্ডকের কোল ঘেঁষে রামনামের আস্তানা থেকে ভেসে আসে একঘেয়ে সংকীর্তন। গুটিগুটি সেখানে সেঁধিয়ে মন ঠান্ডা হয়। এরই মধ্যে সাদা পাগড়ি মাথায় কারা যেন শালপাতায় ক্ষীর দিয়ে বলে গেল, হরিহরনাথের মহাপ্রসাদ। হিম টুপটুপ তারার চাঁদোয়াতলে টানা শতরঞ্চির কোলে কখন যে ঘুমঘোরে ডুব দিয়েছি, বুঝিনি। যখন ঘোর কাটল, তখন পূব দিগন্ত ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। নৌটঙ্কির মেহফিল ছেড়ে এক্কা-দোক্কা দিনের আলোয় ভ্যাবাচ্যাকা মোহাচ্ছন্ন রসিককূল। ওয়েস্টউড অ্যান্ড বেইলির তৈরি ১৮৮৬ সালের বুড়ো ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি নদীর চরে। একপাশে পলিথিন শিটের নীচে টিমটিম টেমির আলোয় ঝকঝক করে ঢাউস অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি। তার কন্দরে একঝাঁক ভাপা পুলি পিঠে গ্যাঁট হয়ে বসে। শালপাতায় বেড়ে দিলে দেখি, নরম ময়দার খোলের পেটে জিরে-লঙ্কা-জোয়ানে মাখামাখি সেদ্ধ মুগডালবাটার পুর ঠাসা। ঝাল ঝাল ধনেপাতা-পুদিনা চাটনির ছোঁয়ায় জাস্ট অমৃত! নাম জিজ্ঞেস করতে দোকানদার বলে, ‘ফারা’। চেনা মুগপুলির এ হেন অপরিচিত অবতার রসনাপ্রেমীর অযাচিত সম্ভ্রম আদায় করে নেয় নিমেষে। অনাস্বাদিত সুখের আবেশ আবিল হয় ভোরের আজানের অপার্থিব মূর্ছনায়।
ব্যস ! কাহানি খতম ? কেন ?
একদম হিলিয়ে দিয়েছেন ! কী সুস্বাদু বিবরণ !
আরে রে দামুজি? কেইসন বা? লিঠঠি চোখা জানিতন, পর উয়ো মিঞা মিঠাই? ফটুক দেখত মনুয়া খুশ হোই গেলা।
দামু মুখোপাধ্যায় মশাইয়ের বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের বছরেই শোনপুরের পশুপাখীমেলা, সেখানে বটের পাখির মাংস খাওয়া নিয়ে আহ্লাদ ("আর পিছু পিছু স্টিলের জামবাটিতে উপুচুপু বটের পাখির কষা। লিট্টি ভেঙে গরগরে ঝোলে ভিজিয়ে মুখে ফেললাম। লালুজি কি কসম, দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এ স্বাদের অভিজ্ঞতা যার না হয়েছে, তার জীবনের ষোলো আনাই গোল্লায় গিয়েছে। মশলাদার লিট্টির অন্দরে কষানো বটেরের আপাত অকল্পনীয় অনুপ্রবেশ নিঃসন্দেহে স্বাদ মোহনায় অজানা ঠিকানার সন্ধান দেয়।"), হাতি কেন বেচাকেনার জন্য আসে না নিয়ে হাহুতাশ ("নাঃ, হাতি আর বিক্রির জন্য আসে না এখানে।") নিয়ে কয়েকটি কথা লেখার ছিল।
বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাস এবং এই গোত্রের আরো নানান ভাইরাল অসুখের (হচ্ছে / হবে) মহামারীর উৎসে মানুষের বন জঙ্গল ধ্বংস করে বন্যপ্রাণী, পশু পাখী কে "ধরে", খাঁচায় পুরে ব্যবসা করার প্রবণতার বিষয়টি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য | জঙ্গল ধ্বংস করছেন, বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসছেন, তাদের সঙ্গে তাদের বাহিত জীবাণুকেও জনসমাজে ছড়াচ্ছেন, এর ফলে মহামারীর শংকা ক্রমশ বাড়ছে। চিনের হুনান প্রদেশ, পূর্ব/দক্ষিণ পূ্র্ব এশিয়ার বিস্তৃত জঙ্গল, এমনকি ভারতের বিস্তীর্ণ জঙ্গল এই ধরণের আইনি বেআইনি পশু-পাখির বাজারের চাহিদা পূরণ করার কাজে ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে, লেখক মশাই খুব সম্ভবত খবর রাখেন না। তার থেকেও যেটা বড় কথা, এশিয়া জুড়ে এই ধরণের বাজারের আর মেলার কারণে ছড়ানো Zoonosis পৃথিবীতে বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ।
গত এপ্রিল ২০২০ তে ইউ এন বায়োডাইভারসিটি প্রোগ্রামের প্রধান এলিজাবেথ মারুমা বিশ্ব জুড়ে পশু-পাখীর খোলা বাজার বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছিলেন (দেখুন https://e360.yale.edu/digest/un-biodiversity-chief-argues-for-a-permanent-ban-on-wildlife-markets), Zoonoses এর সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে CDC থেকে WHO প্রশ্ন তুলছেন (দেখুন,
১) https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/zoonoses
২) https://www.cdc.gov/onehealth/basics/zoonotic-diseases.html
)
শোনপুরের মেলা নিয়ে আহ্লাদ করার সময় এগুলো তো একটু মনে রাখতে হবে দামুবাবু?
শুধু তাই নয়।
"তার ভেতরে থরে থরে খাঁচায় রকমারি পাখি রাখা। টিয়া, চন্দনা, লালমোহন, ময়না, পায়রা, কাকাতুয়া, বদরি, লাভবার্ডসদের হরেক প্রজাতির পাশে বেশ কিছু বিদেশি পাখিও রয়েছে, যার মধ্যে ম্যাকাওদের চেনা গেল। আছে ঘুঘু, বুলবুলি, তিতির, বেনেবউ, শ্যামা, দোয়েল, পেঁচা আর ময়ূর। পাশাপাশি খাঁচাবন্দি কুকুরছানা, বেড়ালছানা, গিনিপিগ, খরগোশ, সাদা ইঁদুর, বেজি, বাচ্চাবাঁদর, এমনকি একজোড়া বনবেড়ালও। মোবাইল ক্যামেরা তাক করতেই রে রে করে তেড়ে এল ষণ্ডা গোছের কয়েক জন। পালের গোদা লালচোখো তর্জন-গর্জন করে জানতে চায়, কোন্ আস্পদ্দায় ছবি তোলা হচ্ছে? তার অতি উৎসাহী স্যাঙাতদের ছোঁ থেকে মোবাইল আড়াল করে যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, নতুন জিনিস দেখে ছবি তুলছি।"
এগুলো দেখে খারাপ লাগে না? এই লেভেলের পশু-পাখির ওপর অ্যাবিউস দেখেও "নতুন জিনিস দেখে ছবি তুলছি" কথাটা কতটা অমানবিক এবং আন-এথিকাল কখনো ভেবে দেখেছেন? পালের গোদা কেন লাল চোখ দেখাচ্ছেন বুঝতে অসুবিধে হয়? এই বেআইনি ব্যবসা কোথাও রিপোর্ট করেছেন? না করে থাকলে আপনি কি দেখার পরেও চোখ উল্টে থাকার অপরাধের নৈতিক দায় এড়াতে পারবেন?
আপনার বিবেক বোধ নেই, খাঁচায় আটকানো পশু পাখী দেখে খারাপ লাগে না, বটের পাখির মাংস তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে তাই নিয়ে গুরুচণ্ডালীর পাতায় আহা উহু করতেও বাধে না। বটের পাখীর মাংসের নামে কি খেয়েছেন জানেন? কে জানে হয়ত Himalayan Quail এর সুস্বাদু মাংস গরগরে ঝোলে ডুবিয়ে খেয়ে এলেন, একবার চোখ বুলিয়ে নিন , যদি চৈতন্যোদয় হয়:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_endangered_animals_in_India
হাতি কেনাবেচা।
প্রথমত জুল ভের্ণের ১৮০ দিন নয়, ৮০ দিনে পৃথিবী ঘোরা নিয়ে গল্পটা ছিল, ভুলটি পারলে শুধরে নেবেন। তবে হাতি আর আসে না বলে যে হাহুতাশ করছেন ("নাঃ, হাতি আর বিক্রির জন্য আসে না এখানে।"), একটা কথা খেয়াল রাখবেন যে ভারতে হাতি কেনাবেচা বে-আইনি, কাজেই এ যে শোনপুরের মেলায় হাতি দেখতে পান নি, সে বেচারারা যে কটি অবশিষ্ট আছে, এযাত্রা বেঁচে গেছে। আরেকটু পড়ুন সময় থাকলে,
- No country for elephants, https://www.livemint.com/Politics/pRNXvtcOpirA7XjxbbKL4K/No-country-for-elephants.html
- Turning the clock back on elephant display and trade, https://www.worldanimalprotection.org.in/blogs/turning-clock-back-elephant-display-and-trade-sonepur
- আরেকটা, https://www.wti.org.in/news/sonepur-the-illegal-wildlife-trade-fair/
আপনি হয়ত মেলার বর্ণনা, সুস্বাদু খাবারের কথা জানানোর জন্যই লেখাটি লিখেছেন | তবে একটু ভেবে দেখতে পারেন যে শোনপুর মেলা জাতীয় খোলা বাজারে পশু-পাখী বিক্কিরির উৎসব আর সেখানে বিরল পাখীর মাংস খাবার গল্প কতটা মর্মান্তিক।
ভাল লাগল, এ কথাটা বলতে পারলাম না।
ফাটাফাটি লেখা
জিভে জল এসে গেলো
হিমালয়ান কোয়েল না হবার চান্সই বেশি। এখন মুরগী পালনের মতো কোয়েল পাখিরও ফার্ম হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন এটাকে উৎসাহ দেওয়া হয় বলে পড়েছিলাম মনে হচ্ছে। আমাদের এখানেই একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেণ্টে কোয়েল ভাজা দেয় নোক্কির সাথে। দুর্দান্ত খেতে, আর বেআইনি নয় তো বটেই :)
অরিন ঠিকই লিখেছেন, এই ধরণের মেলা বন্ধ হওয়া উচিত। খাঁচায় পাখি, পশু বন্দী করে রাখা নিষ্ঠুরতা। রোগ ছড়ানোর ঝুঁকিও আছে - দামু এই দিকগুলো খেয়াল করেন নি।
বটের-এর মাংস খাওয়া নিয়ে অবশ্য আদিখ্যেতা করতেই পারেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমার ভাল লাগে না এই বটের, কোয়েল ইঃ ছোট পাখী দের ধরে খেয়ে ফেলা , তবে পাঁঠার মাংস নিয়ে যখন আহা উহু জায়েজ, তখন অন্য যে কোন প্রাণীর মাংস খেতে কারও জিভে জল এলে কিছু বলার নেই, যদি না প্রায় বিলুপ্ত শ্রেণীর হয়
তাই যেন হয়। তবে এ ভদ্রলোকের লেখা পড়লে এবং শোনপুরের পশুমেলার পরিস্থিতি বিচার করলে ইনি ফার্মড quail এর মাংস খেয়েছেন কিনা সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। লেখক নিজেও সম্ভবত জানেন না। যেটা বিশেষ করে এই লেখাটায় বিরক্তিকর, আকরষণীয় লেখার স্টাইলের মোড়কে একটা অন্যায় এবং বাজে ব্যাপারকে ইনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, যেটা না করলেই মনে হয় ভাল হত।