অগ্রগামীর পক্ষে জয়ন্ত ভট্টাচার্যর পরিচালনায় চার চারটি বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস থেকে ছবি করার কথা ভাবেন প্রযোজক অজয় বসু। 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'কোয়েলের কাছে', 'নগ্ন নির্জন' ও 'চবুতরা'। উত্তম নিজে 'নগ্ন নির্জন' ও 'চবুতরা' পড়েন। ছবিগুলির সহপ্রযোজক হতে চান চন্ডীমাতা ফিল্মসের সত্যনারায়ণ খাঁ।
যৌথ প্রযোজনায় উত্তম অভিনীত ছবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এই চারটি কাহিনীর। আর 'চবুতরা' ছবিতে প্রথমবারের মত বাংলা ছবিতে অভিনয় করতেন রেখা।
প্রযোজক অসীম সরকার, পরিচালক আলো সরকার এই বিষয়ে কথা বলেন শক্তি সামন্তের সাথে। রেখা রাজি হন। আর থাকতেন আমজাদ খান।
কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে এই ছবিগুলি আর হয় নি।
এমনকি 'কোয়েলের কাছের' মুহরত হয়ে যাবার পরও হয় নি। সে মুহরতে অমিতাভ বচ্চন ও এসেছিলেন ।
একবার ভেবে দেখুন যশোবন্ত এর অথবা সুকুমার বোসের ভূমিকায় মহানায়ককে ।
বুদ্ধদেববাবুর এই ঘটনাগুলি মনে আছে। তবে কোন আক্ষেপ নেই।
লেখক এতগুলি বছর পেরিয়ে এসে আজ হয়ত আর দু:খ পান না। তবে মহানায়ক এবং কথাশিল্পীর অগনিতভক্তদের কাছে এ আক্ষেপ যাবার নয় ।
বুদ্ধদেব গুহর লেখাগুলি নিয়ে এই ব্যাপারটা বারবারই হয়েছে। সত্তরের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় আকাশবাণীতে অভিনীত 'কোয়েলের কাছে'। যশোবন্ত হতেন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়। জানি না আকাশবাণীর আর্কাইভে আছে কিনা সেই অবিস্মরনীয় নাটকটি ।
আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের এই অসামান্য মাইলস্টোনটিকে নিয়ে কোনো ছবি কেন যে হয় নি সেটা সত্যি রহস্য ।
একই ব্যাপার 'একটু উষ্ণতার জন্য' নিয়ে । 'একটু উষ্ণতার জন্য' উপন্যাসটি আটের দশকে শ্রুতিনাটক হিসেবে অসামান্য সফল হয় অপর্ণা সেন ও দীপঙ্কর দের অভিনয়ে ।
রবীন্দ্রসদনে হল তো ভরে যেতই, বহু মানুষ সদনের সিঁড়িতে বসে শুনতেন সেই শ্রুতি নাটক।
মহানায়কের সময়ের অনেক পরও আবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ছবিটি হবার এবং আবার হয় নি ।
পরবর্তী কালে 'কোজাগর'ও হিন্দী তে ছবি হবার কথা ছিল, নানা পাটেকার কে নিয়ে। হয় নি ।
'মাধুকরী' র ব্যাপ্তিও ধরা পড়ল না কোনো ছবিতে ।
কেবল মাত্র আটের দশকে দূরদর্শনে বুদ্ধদেব গুহর বারোটি গল্প থেকে তৈরী হয়েছিল 'অয়ন'। এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। আর হয় নি।
তবে 'বাতিঘর' ওড়িয়া ভাষায় অত্যন্ত সফল চলচ্চিত্র হয়েছিল। খুব জনপ্রিয় হয় এই ছবির গানগুলি। সাধু মেহের অভিনীত দ্বিভাষিক এই ছবিটি বাংলাতেও মুক্তি পেয়েছিলো !
তবে বাংলায় আজ পর্যন্ত কোনো সত্যিকারের বড়মাপের পরিচালক কালজয়ী এই সাহিত্যিকের কোনো লেখা থেকে কোনো সার্থক চলচ্চিত্র আমাদের উপহার দিতে পারেন নি ।
আজ থেকে প্রায় আঠেরো উনিশ বছর আগে 'সাসানডিরি' খুব সফল ভাবে মঞ্চস্থ হয়। পরিচালক ছিলেন অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। সৌমিত্র, সাহেব চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এছাড়া 'ভোরের আগে' ছবি হয়েছে নব্বইয়ের দশকে।
মাধুকরী মঞ্চস্থ করার দুঃসাহসী কাজে ব্রতী হন কৃষ্টি নাট্য দল ! পরিচালনা এবং পৃথুর ভূমিকায় অভিনয়ের যুগপৎঅসমসাহসী দায়িত্ব পালন করেন সীতাংশু খাটুয়া ।
'সন্ধ্যের পরে' নিয়ে মরমী টেলিফিল্ম করেছিলেন পরিচালক রাজা সেন। অভিনয়ে ছিলেন শুভেন্দু।
ফেলুদা, কাকাবাবু কে নিয়ে বাৎসরিক চলচ্ছবি তো বটেই এখন তো কমিক স্ট্রিপ ও লেখা হচ্ছেরঙ, অস্পৃশ্য থেকে গেছেন শুধু ঋজুদা। অথচ বেস্টসেলার লিস্টে এখনো ঋজুদার জনপ্রিয়তা অব্যহত। কালানুক্রমিকতা অনুসারে ঘনাদা ফেলুদার পরই কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঋজুদার। আর আবির্ভাবেই তুমুল জনপ্রিয়তা।
বাংলার ঘরে ঘরে আজ ‘ঋজু' নামটির ছড়াছড়ি । অথচ কোনো এক রহস্যজনক কারণে আজও পর্দায় এলো না 'ঋজুদার র একটি গল্পও! 'গুগুনোগুম্বারের দেশে' বা 'রুআহা' র পটভূমি না হয় কৃষ্ণ মহাদেশ। কিন্তু অ্যালবিনো, বনবিবির বনে নিয়ে কি সৃষ্টি করা যেত না শিল্প এবং বানিজ্যসাফল কোনো সার্থক ছবি? একটা কারণ হয়ত, লেখকের একটি শর্ত ! শুটিং করতে হবে আউটডোরে, যথাসম্ভব আসল পটভূমিকায় ! এখানেই হয়ত আটকে গেছেন অনেক পরিচালক !
ঋভুর শ্রাবণ নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন গৌতম ঘোষ, বাংলাদেশের হওয়ার কথা ছিল আউটডোর লোকেশনের শুটিং! ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘একটু উষ্ণতার জন্য’র স্ক্রিপ্ট তৈরী করে নিয়ে এসেছিলেন লেখকের কাছে! ছবি হয়নি, জানি না সেই অপ্রকাশিত স্ক্রিপ্ট এখন কোথায়! কমলেশ্বরের ইচ্ছে ছিল কোজাগর কে রুপোলি পর্দায় তুলে আনার। ঋজুদা নিয়ে ছবি করার ঘোষণা করেছিলেন অরিন্দম শীল। অ্যালবিনো আর গুগুনগুম্বারের দেশে! ঋত্বিক চক্রবর্তী ঋজুদার ভূমিকায়! আজও হয় নি !
এবার এক সঙ্গে দু দুটি খবর !
এক বাবলি করতে চলেছেন রাজ চক্রবর্তী আর দুই প্রাপ্তি ছোট গল্প থেকে ছবি করতে চলেছেন তরুণ পরিচালক অনুরাগ পতি। সার্থক, কালজয়ী সাহিত্য থেকে সবসময়েই যে রসোত্তীর্ণ চলচ্ছবি সৃষ্টি হবে তার কোনো মানে নেই! বরং উল্টোটাই হয়ে এসেছে !
গানের মত সাহিত্যও লেখকের একার নয়! শ্রোতা যেমন মনে মনে গাইতে থাকেন, প্রকৃত পাঠকও চরিত্র গুলিকে গড়ে নিতে থাকেন মনের বনে, একাত্ম হতেথাকেন তাদের সকাল-সন্ধ্যেয়, সুখ-দুঃখে-আনন্দে-বিষাদে। বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে ঋজু, রুদ্র, সুকুমার বোস, প্যাট গ্লসকিন, ছুটি, কুর্চি, পৃথু, লালসাহেব, যশোবন্ত, অভি, বাবলি, তিতলি, সায়ন মুখার্জি, মুঞ্জরি, মানি, দিগা পাঁড়ে, ঠুঠা বাইগা, রাম, সরিৎ মেসো, নাজিম সাহেব, রুষা চরিত্র গুলি জীবন্ত হয়ে যান লক্ষ পাঠক পাঠিকার মনের ঘাসে দিগন্তে !
প্রতিটি পাঠকের কল্পনায় যেন পুনর্জন্ম হয়ে চলে একেকটি চরিত্রের তাদের চলন, বলন, আচার, আচরণ সহ! এক এক জন প্রকৃত পাঠকের মনোভূমি যেন চরিত্রগুলির নতুনতর একেকটি জন্মভূমি, সেখানে জীবন্ত হয়ে থাকে চরিত্রগুলির অজস্র মনোপ্রক্ষেপ, অগণিত সংস্করণ !
চলচ্চিত্রের মুশকিলটা এখানেই ! দর্শকের মনের কোণায় গড়ে ওঠা ছবির সঙ্গে রুপালি পর্দার ছবি মিলে গেলে ভালো, আর না মিললে সামান্যতমআঘাতে চুরমার হয়ে যায় বিপুল পরিশ্রমে গড়ে তোলা ফিল্মের ছদ্ম যাদু বাস্তবতা !
আসলে সাহিত্য আর চলচ্চিত্র দুটি আলাদা শিল্প মাধ্যম !
বুদ্ধদেব গুহর মত বিপুল জনপ্রিয় একজন কথাশিল্পীর লেখা থেকে ছবি করা প্রধানতঃ দুটি কারণে বিপজ্জনক !
প্রথম কারণটা আগেই বলেছি।
সেটা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠিত, সার্থক লেখকের লেখার ক্ষেত্রেও সত্যি ।
অন্য কারণটা হলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহ ! রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ সহ যে সর্বব্যাপী অডিওভিস্যুয়াল এফেক্ট তৈরী হয় তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে, যেভাবে সন্ধ্যে নামে, বর্ষা আসে, ফুলের গর্ভাধান হয়, মাটির গন্ধ, ঘামের গন্ধ মিশে যায় মুলারি বাইয়ের রূপ বর্ণনায়, পৃথিবীর কোন ক্যামেরার ক্ষমতা আছে তাকে তুলে ধরে?
বুদ্ধদেব গুহ একটি বাল
এই লেখার সঙ্গে আমিও একমত। বুদ্ধদেব গুহ আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। ওনার লেখার বিষয়বস্তু এতটাই অন্যরকম, পটভূমিকা এতটাই বিস্ততৃ, চরিত্রগুলো এতটাই জীবন্ত, পড়তে পড়তে কখন যেন চলচ্চিত্রের মতো দৃৃৃশ্যপটের ভিতরে নিজের অজান্তে ঢুকে পরতে বাধ্য হই। সমস্ত চরিত্র, সে ঋজুদা রুদ্র পৃথু লালসাহেব সুুকুমার তিতলি যেই হোক, এতবার পড়ে পড়ে নিজের মতো একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে, একটু ভয় তো হয়ই, যদি চলচ্চিত্রে তার অন্যরকম দেখি, যদি আমার ধারণার সঙ্গে না মেলে, তাহলে দ্বিতীয় বার সেটা দেখতে চাইব কিনা সন্দেহ।
তবে তিনি তাঁর রচনায় চলচ্চিত্রের সমস্ত উপাদানগুলো নিজেই এমনভাবে তৈরী করে রেখেছেন, যে কোন পরিচালকের পক্ষে তার চিত্ররূপ দেওয়া খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
তাঁর লেখা যখনই পড়ি মনে হয় কবে চলচ্চিত্রে জীবন্ত হয়ে আমাদের কাছে আসবে। সেই আশায় যৌবন থেকে এই বয়স পর্যন্ত বসে আছি।