এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপার বাংলা

  • রসুইঘরের রোয়াক

    স্মৃতি ভদ্র লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩১৭২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • আমাদের বাড়ির বাইরের দিকটাকে আমরা বাইরবাড়ি বলতাম। বাইরবাড়ির বারান্দা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সেখানে ছিল একটি বড় নকশা করা কাঠের বেঞ্চ। সেই বারান্দা আর বেঞ্চ ছিল আশেপাশের সকল বাড়ির মানুষের অবসরে সময় কাটানোর জায়গা।

    কারণ এই বারান্দাই ছিল সেই পাড়ার সদর জায়গা।

    পাড়ার কোন বাড়িতে কী রান্না হলো বা কার জমিতে ধান কম হলো কিংবা কার তাঁতে এবার নতুন নকশায় শাড়ি বোনা হলো--- সব সে বারান্দায় বসলেই জানা যেতো। সাধারণত দুপুরের খাবারের পর ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে পাশের বাড়ির বড়মারা, জেঠি ঠাকুমা, মনি কাকিমা সব এসে জড়ো হতো সেই বারান্দায়।

    বারান্দায় সাথেই লাগোয়া দু'টি তেজপাতা গাছ। তেজপাতার কচি পাতা অমন সবুজ হয়, আমি সে গাছেই কেবল দেখেছি।

    গাছ দু'টো আমাদের ছিল না। গোলেনারা দাদীর ছিল সে গাছ। আমাদের বাইরবাড়ি ঘেঁষা সে বাড়ির সীমানায় তখনো প্রাচীর ওঠেনি।

    আর বাড়ি দু'টি এমনভাবে একে অন্যকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো যে, সীমানা বোঝা তো দূরে থাক, বাইরবাড়ির গাছগুলোকেও পৃথক করা যেত না; এবাড়ির আর ওবাড়ির বলে।

    আসলে তখন একপাড়ার আঙিনাও ছিল এক।

    এই বাইরবাড়ির আরেকটি আকর্ষণ ছিল কারখানা। সেসব কারখানায় ছিল অসংখ্য তাঁত। হাতে চালানো তাঁত।

    সকাল শুরু হতেই আমাদের পাড়ায় যুক্ত হতো 'খটাস খটাস' শব্দ। শব্দটি এতই মিশে থাকতো আমাদের জীবনযাপনে যে, কোনোকারণে কারখানা বন্ধ থাকলে এক অদ্ভুত শূন্যতাবোধ হতো।

    বাইরবাড়ির বারান্দায় বসেই দেখতাম তাঁতিরা গামছায় বাঁধা খাবার হাতে নিয়ে কারখানায় ঢুকছে, কখনো শাড়ি বুনতে বুনতেই গলা ছেড়ে গান গাইছে, আবার কখনো দলবেঁধে গোলেনারা দাদীর উঠোনে বসে ভাত খাচ্ছে।

    আর খেতে খেতেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠা বা কোন বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা কিংবা একটা পান ভাগাভাগি করে খাওয়া দেখতে দেখতে কীভাবে যেন মানুষগুলোর আনন্দ আমার খুব চেনা হয়ে যেতো।

    এই মানুষগুলোকে আমি যখন মন দিয়ে দেখছি ততক্ষণে ভেতরবাড়িতে দুপুরের রান্না প্রায় শেষের দিকে।

    মা স্নানের জন্য তাড়া দিতেই, আমার খেলনা বাটির তরকারী, মাছ, মাংস সব উপুর হতো গোলেনারা দাদীর উঠোনে। ছোট ছোট মাটির হাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়তো গোলেনারা দাদীর তেজপাতা গাছের কয়েকটি সবুজ পাতা ছেড়া, বেশকিছু দেবদারু গাছের ফল, দু’তিনটি ইটের কুচো টুকরো আর একমুঠো মাটি।

    সেদিনের মতো খেলা শেষ করে মায়ের কথায় স্নান করে গিয়ে বসতাম ঠাকুমার রান্নাঘরে।

    ঠাকুমা তখন কুচানো পালং শাকের থাল হাতে নিয়ে কড়াইয়ের ফোড়ন পাকা হবার অপেক্ষায় আছে। জিরা আর শুকনো মরিচ একটু কালচে হয়ে পুড়ে উঠতেই তাতে মুগডাল দিয়ে অল্প সময় নেড়ে নিলো।

    আমি উশখুশ করতেই ঠাকুমা বলে উঠতো, দিদি আজ তুমি কী রান্না করছিলা? আমাকে তো খেতে দিলা না।

    আমার রান্নাবাটি খেলার রান্নাগুলো একমাত্র ঠাকুমাই চেখে দিতো।

    ভুল হয়ে যাবার অনুশোচনায় আমি একটু আড়ষ্ট হয়ে যেতেই ঠাকুমা বলতো, আজ তুমি আমার এই শাক রান্না করে দাও।

    আমি ছোট ছোট পা ফেলে ঠিক ঠাকুমার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াতাম।

    আমি এখন শাক কড়াইয়ে দেবো দিদি? আমার কাছে অনুমতি নেবার ভান করে ঠাকুমা
    কুচানো শাক কড়াইয়ে ঢেলে লবণ আর হলুদ দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতো।

    কড়াইয়ে তখন সবুজ শাক জল ছেড়ে আরোও সবুজ হয়ে উঠেছে। ঠাকুমা বলতো, রান্না করবা? আমি ঘাড় নাড়তেই বলতো, তুমি বলে দাও, আমি রান্না করি।

    আমি বলতাম, আরেকটু হলুদ দাও। হলুদ কম হয়েছে।

    ঠাকুমা এক চিমটি হলুদ ফেলে দিয়ে বলতো, শাকে অল্প হলুদ দিলে রঙ ভাল হয়, দিদি।

    এরপর কয়েকটি কাঁচামরিচ ফেলে দিতো সেই কড়াইয়ে। সবুজ জলের ভেতর কাঁচামরিচ ডুবিয়ে ঠাকুমা খুন্তা দিতে একটু বাড়ি দিতো মরিচে।

    ও ঠাকুমা, ঝাল হয়ে যাবেনি। অত ঝাল আমি কি খেতে পারি?

    আমাকে অভয় দিয়ে ঠাকুমা বলতো, এভাবে কাঁচামরিচের মাথা ভেঙে দিলে ঘ্রাণ হয়, ঝাল হয় না।

    দিদি, এবার একটু ঢেকে দেই? আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই ঠাকুমা বলতো, শাক কম ঢাকতে হয়, না হলে শাকের রঙ নষ্ট হয়ে যায়।

    আমি ততক্ষণে ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করেছি। চিতল মাছ দিয়ে আমি ভাত খাবনা। ও মাছে খুব কাটা। ঠাকুমা আমার গাল একটু টিপে দিয়ে বলতো, তোমার জন্য তো আমি চিতল মাছের কোড়া রান্না করেছি, দিদি। তাতে কী আর কাটা থাকে।

    ঠাকুমা কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে চন্দনের মতো মিহি করা বাটা বেশ খানিকটা আদা দিয়ে বলতো, তুমি দাদুরে বলো পিঁড়ি পাততে।

    আমি ঠাকুমার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়েই গলা চড়াতাম-- ও দাদু, লাল বারান্দায় পিঁড়ি পাতো।

    ঠাকুমা একটু চিনি ছিটিয়ে নামিয়ে নিতো পালং শাকের সবুজ সুক্তো।

    লাল বারান্দায় দাদুর পাশে গরম পালং সুক্তোয় আঙুল পোড়াতে গেলেই দাদু থামিয়ে দিয়ে বলতো-- রসো গিন্নি, ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দেই, এরপর খাও।

    দাদু ফুঁ দিয়ে পালং শাকের সুক্তো জুড়াতেই ঠাকুমা চিতল মাছের কোড়া আমার পাতে দিতো। তবে শর্ত থাকতো আগে সুক্তো শেষ করতে হবে, এরপর কোড়া।

    আমি যখন পালং সুক্তোয় মেখে সবুজ ভাত মুখে দিতাম তখন বাইরবাড়ির কারখানায় বাঁশিতে সুর তুলতো কোনো তাঁতি,

    ' বাড়ির পাশে আরশিনগর,
    সেথা পড়শী বসত করে
    আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।'
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপার বাংলা | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩১৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১১:৩৬97169
  • “সকাল শুরু হতেই আমাদের পাড়ায় যুক্ত হতো 'খটাস খটাস' শব্দ। শব্দটি এতই মিশে থাকতো আমাদের জীবনযাপনে যে, কোনোকারণে কারখানা বন্ধ থাকলে এক অদ্ভুত শূন্যতাবোধ হতো।

    বাইরবাড়ির বারান্দায় বসেই দেখতাম তাঁতিরা গামছায় বাঁধা খাবার হাতে নিয়ে কারখানায় ঢুকছে, কখনো শাড়ি বুনতে বুনতেই গলা ছেড়ে গান গাইছে, আবার কখনো দলবেঁধে গোলেনারা দাদীর উঠোনে বসে ভাত খাচ্ছে।”

    এই কথায় এপারে আমার গ্রামের বাড়ি, সিরাজগঞ্জের কথা মনে পড়লো। সেখানেও ভোর থেকে ঘরে ঘরে তাঁত চালানোর ‌‘ঠাকাস-ঠক’ মধুর শব্দ ভেসে আসে। ছেলেমেয়ে, বৌ-মাসি, বুড়োবুড়ি সকলেই কাপড় বোনায় পটু। গ্রামের রাস্তার দুপাশে দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেতের বেড়ায় শুকোতে দেওয়া হয় রং-বেরঙের বাহারি সুতো।

    আর কে না জানে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের গর্ব রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি এবং জগৎ বিখ্যাত জামদানী!

    লেখাটি এক কথায়-- ভীষণ মায়াময়। ব্রেভো

  • i | 59.102.***.*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৩২97180
  • খুব ভালো লাগল।
    সিরিজ হোক একটা।
  • kk | 97.9.***.*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:১০97182
  • স্মৃতি, আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগছে। ভারী সহজ গড়ান, কম্ফোর্টিং, অথ্চ সুন্দর স্পষ্ট ডিটেল। মনের মধ্যে কোথাও তুলে রাখা ভালোলাগা স্পর্শ করে যায়। সত্যি খুব মায়াময়।
  • সুকি | 49.207.***.*** | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:২৮97194
  • এই ধরণের লেখা আমার খুব ভালো লাগে - চলতে থাকুক এই লেখা। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন