দুঃসংবাদের মিছিল যেন এবছরে। এমন একটা দিনও যায় না যেদিন খারাপ খবর আসে না। যেমন পরশুদিন পণ্ডিত যশরাজের মৃত্যুর খবর আর তারপর দিনই এল বিসমিল্লা খানের বেনারসের বাডি ভেঙে বহুতল হওয়ার খবর। অদ্ভুত সমাপতন সব। আজ, তাঁর মৃত্যুদিন। বাড়ি, আর তার সংগে বহু স্মৃতির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়ার খবর উজিয়ে নিয়ে গেল বেনারসের সেই গলির সফরে।
আমার বেশ কয়েকবার বেনারস যাওয়ার মধ্যে একটি ২০১১ সালে। সেইবার মনস্থির করেছিলাম বিসমিল্লা খানের বাডি খুঁজে বের করব, ম্যাপে অনেকক্ষন ধরে বাডিটা খুঁজছিলামও, না পেয়ে শেষ অবধি মালাই সরবত খেয়ে গোধুলিয়া মোড় থেকে অটো তে চড়ে বসলাম। ট্রাফিক জ্যাম, ষাঁড় এসবের গুঁতো না খেলে বেনারসে আসাই বৃথা। যাব ডালমন্ডি। সেখানে পৌঁছে রাস্তার একদিকে “বনফুল হোটেল” অন্যদিকে মসজিদ , ওখানে গিয়ে জানতে চাইলে যে কেউ দেখিয়ে দেবেন বিসমিল্লা খানের বাড়ি। বেনারসে মন্দির যত মসজিদ ও কিন্তু কম কিছু নেই।সেই মন্দির মসজিদ পেরিয়ে অটাওয়ালার গায়ে পড়া গল্প ,পানের পিক ফেলা থেকে শুরু করে বাবা বিশ্বনাথ দর্শন, বেনারসি শাড়ি কেনা বিজেপি, কংগ্রেস সব উপাখ্যান শেষে তিনি জানতে চাইলেন ডালমন্ডিতে ঠিক কোথায় যেতে চাই। বললাম বিসমিল্লা খানের বাডি । সে বলল ওনার বাড়ি তো পৌঁছে দেব তার আগে চলুন আরও একটা জায়গায় নিয়ে যাই আপনাদের। এগলি ওগলি পেরিয়ে পৌঁছলাম তাঁর সমাধির কাছে। হাওয়া দোল দেওয়া নিম গাছের ডাল , তার নিচে শুয়ে আছেন একা বিসমিল্লা খান।২০০৬ সালে ২১ আগস্ট, আজকের দিনে হার্ট আ্যটাকে মারা যান । জন্ম ২১ মার্চ ১৯১৬। নব্বই বছরের দীর্ঘ জীবন তাঁর সানাইয়ের সাথে। যে সানাইকে তিনি বিয়ে বাড়ির বাদ্যযন্ত্রের তকমা থেকে বের করে বিশ্বের দরবারে তার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার অটোতে চড়ে বসলাম, অবশেষে পৌঁছলাম ডালমন্ডি, উল্টোদিক রাস্তা পেরিয়ে সেই মসজিদ, পেছনের রাস্তা গেছে ওঁর বাড়ির সামনে। সরু গলির আরও সরু হয়ে যাওয়া ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সর্পিল চলনের মত। হারিয়ে যেতে যেতে মনে হয় সেই গলি আর সানাইয়ের সুরের ঘোরের এক ভুলভুলাইয়া যা থেকে কোনোদিনও বেরতে পারব না। খুব ঘিঞ্জি আর অন্ধকার গলি। কী নেই সেখানে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব চলেছে। তারই মধ্যে এ পাশ ওপাশ কাটিয়ে গলির একদম শেষে পৌঁছিয়ে অকস্মাৎ চোখে পড়ল একটি কাঠের ম্রিয়মাণ লেটারবক্স। যেখানে লেখা ছেলের নাম তলায় সন অফ ভারতরত্ন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। সি.কে/৪৬/৬২ সরাইহদহ বারানসী। রঙের আস্তরন ওঠা কাঠের সেই লেটারবক্সের থেকেও মলিন এক বাড়ি।সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না প্রথম ধাক্কায় ভারতরত্ন বিসমিল্লা খানে বাড়ি এটি। মনের মধ্যে সানাইয়ের সুর যেন বাড়ির বিষাদময়তায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সারা জীবন উনি গাড়িও কেনেন নি, রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন বেনারসের আটঘাট। সহজ সরল জীবন যাপন কাকে বলে। প্রকৃত শিল্পী। দরজা খুলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরের ভেতর। রঙটটা আর এবড়ো খেবড়ো দেওয়াল। দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর সানাই জগতে আলো আনলেও তাঁর বাড়ি অবধি সেই আলো হয়তো পৌঁছতে পারেন নি। দেওয়াল জুড়ে বিসমল্লাহ খানের স্মৃতিতে অজস্র ছবি আর প্রাপ্ত পুরস্কার সাজানো।ওনার সাথে সাথে বাড়ির ছিরিছাঁদও যে চলে গেছে তা বলাই বাহুল্য। লোডশেডিংর জন্য এত অন্ধকার, তাই নাতি পাশের জানলা খুলে দিলেও সে জানলা দিয়ে কোনো জ্ঞানের আলোর প্রবেশ ঘটে নি সেদিন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারে শেখর গুপ্ত জানতে চেয়েছিলেন প্রাসঙ্গিকভাবে,
- যখন দেশভাগ হয় তখন আপনি আপনার পরিবার নিয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা ভাবেন নি।
- আল্লার দোয়া, বেনারস ছাড়ব আমি? কখনো না।
- খান সাহেব, আপনার যত সমসাময়িক বন্ধুরা সবাই টাকা করেছে, গাড়ি কিনেছে, বিদেশে থাকে, আপনি এখনও সেই পুরোনো বাড়িতেই থাকেন। অনুশোচনায় হয় না?
- একদম না। যখন যার ইচ্ছে আমার বেনারসের বাড়িতে এসে দেখা করতে পারে। আমি কোথাও যাই না। রাজা মহারাজা থেকে যে কেউ চলে আসতে পারে। যদি আমার ইচ্ছে থাকে যাব নাহলে যত টাকাই দাও না কেন, আমি সেখানে বাজাতে যাব না। সানাই ছুঁয়ে বলছি। (১৭ ডিসেম্বর ২০০৩)
গৌতম ঘোষ যে তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন ওঁকে নিয়ে, “মিটিং আ মাইলস্টোন: উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান”(১৯৮৯) সেখানে বেনারসে থাকার কারণ হিসেবে খান সাহেব বলেছিলেন গোটা শহরটাই তাঁর এত মিউজিকাল লাগে যে অন্য কোথাও গিয়ে তা পাবেন না। যেমন গান গাইতে গাইতে নাপিত চুল কাটে, ধোপা কেমন তালে তাল মিলিয়ে কাপড় কাচে। উনি এক আশ্চর্য মিউজিকাল পারসন। যিনি সবকিছুতেই মিউজিকের অনুষঙ্গ খুঁজে বেড়াতেন। কোনো হাতছানি তাঁকে তাই তাঁর কাশীবাসী হওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি। আজীবন পাঁচ ওয়াক্ত নমাজধারী তার সানাইয়ের যাদুকে কত হিন্দু মেয়ের সুখের সংসার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যখন তিনি তাঁর সানাইয়ে সুরের যাদু খেলান সেই সুর বেনারসের গঙ্গা পারের মন কেমনের হাওয়ায় আজও যেন ভেসে বেড়ায় ।
পাঁচ বাই পাঁচ সামনের ঘরটা । সেই ঘরে বসেই কথা হয়েছিল তাঁর দুই ছেলের সাথে। সামনের এই ঘরেই পেতে রাখা খাটে তিনি শুতেন। বাড়ির পেছনে যে অন্য ঘর সেখানেই পাঁচ ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। কত গুণী মানুষের যাতায়াত ছিল এবাড়িতে। ওপরের ঘরে রেওয়াজ করতেন। সেই ঘর থেকে দেখা যেত গঙ্গা। ছেলেরা সেই গল্প বলছিলেন। আরও কত কাহানী আব্বার, কলকাতার গল্প।এগোতে থাকে। জানতে চাইলাম আপনাদের চলে কেমন করে? দুজন বলে উঠলেন আব্বা ছিলেন সম্রাট। তাঁর চলে যাওয়ার পর আর তেমন বাজনার ডাক আসে না। সংসার বড়, তাই চালানো মুশকিল। বুকের ভিতরটা সেদিনও কেন জানি না একটা আশঙ্কা জেগে উঠেছিল, তা যে ভুল ছিল না সেটাই প্রমাণিত হল তাঁর বাডি ভেঙে বহুতল বিল্ডিং হওয়ার খবরে। বেরিয়ে আসার সময় আমরা পরস্পরের মুখ চেয়ে সেই আলোচনাই করছিলাম।
আজকাল আর বিচলিত হই না এসব খবরে। কারণ সত্যি কতটুকু সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করি আমরা? কত বিখ্যাত বাড়ি ভেঙ্গে গেল, তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেল, কী করতে পারলাম। সংরক্ষণ কী, সেটা নিয়ে কি সত্যি আমরা বিশেষভাবে ভাবতে চাই? মনে হয় না।
ঠিক খান সাহেবের বাড়ির মতনই কলকাতার বুকে কত বিখ্যাত মানুষের বাডি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট করে দিয়েছেন পরিবারের লোকজন । কোনো আন্দোলন করেছি আমরা? সরকার থেকেও কি বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? না হয় নি।হিন্দুস্তান রোডে পাহাড়ী সান্যালের বাড়ি ভেঙ্গে যেদিন ফ্ল্যাট উঠেছিল বা টালিগঞ্জে ছবি বিশ্বাসের বাড়ি বা আরও অন্যান্য বিখ্যাত মানুষের বাড়ি, সেদিন পাড়ার একজন মানুষও কি প্রশ্ন করেছিলেন? মনে হয় না। সংরক্ষণ হয় না বলেই উনিশ শতকের বাংলা বই নিয়ে কাজ করতে যেতে হয়েছিল লন্ডনে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। একফোঁটা বাংলা, উর্দু, ফার্সি বা হিন্দী না জানা ব্রিটিশ লাইব্রেরি স্টাফরা সযত্নে আপনার হাতে বইগুলো তুলে দেবে। প্রত্যেকটা পাতা ট্রেসিং পেপারে মোড়া। আমাদের কাছেও ছিল এসবের কপি। রাখতে পারি নি। সংরক্ষণের কোনো ধারাবাহিকতা আমাদের নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু হলেও সামগ্রিকতা নেই তার। দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে দৃষ্টিপাত করতে চাই।
প্রথমত পরিবারের লোকদের এই বিখ্যাত মানুষজনের প্রতি কোনো আবেগ কাজ করে বলে মনে হয় না। তাই নিজেদের অভাব অনটন মেটাতে গুণী মানুষজনকে বেচে খাওয়াই সহজ পথ। মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু অভাবই নয়, এটা সংরক্ষন না করতে পারা একটা আ্যটিচুড। দ্বিতীয়ত সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকাতেও সংরক্ষিত করা যায় না তাঁদের বাড়ি, ব্যবহৃত জিনিস, ডকুমেন্টস।শুধু বাড়ি কেন কত বিখ্যাত মানুষের বই গডিয়াহাটের ফুটপাতে খুঁজে পেয়েছি আমরা।
খান সাহেবের বাড়ির ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনা ঘটল। পারিবারিকভাবে যেমন কোনো দায়িত্ব নেওয়া হল না। অভাব মেটাতে সেই তাঁকেই ব্যবহার করলেন পরিবার। কিন্তু প্রশ্ন হল সরকার কি এখানে কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। নাকি যোগি সরকারের কোনো ইচ্ছেই নেই একজন মুসলমান সানাই বাদকের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার। প্রশ্ন থেকেই যায়।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় সানাই বাজিয়েছিলেন একত্রিশ বছর বয়সী বিসমিল্লা খান, স্বয়ং নেহেরুর অনুরোধে। আবার ১৯৫০ এ ২৬ জানুয়ারী দেশের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে। সেদিনের সেই কাফি রাগের মূর্ছনা কি তাঁর পরিবার বা যোগি সরকার কারোর কানেই গিয়ে পৌঁছল না।
আর...ভারতবর্ষ!
ওস্তাদের হাতে পরেই সানাইয়ের মতো বাদ্যযন্ত্র শিল্পের মর্যাদা পেল। 'ভারতরত্নের' বাড়িটিকে অনেক আগেই জাদুঘরে পরিনত করা উচিৎ ছিল।
ধিক্কার মোদি সরকার!
লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।
ব্যক্তির বাড়ি সংরক্ষণের যৌক্তিকতা আমি বুঝিনা। কাজের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝি। অল ইন্ডিয়া রেডিও টেপের পর টেপ পুঁছে ফেলেছে। সেগুলোই, আমার মতে, আসল ক্ষতি।