পাউরুটি আমি ভালবাসি। না বেসে থাকা যায়? যার অমন নরম তুলতুলে গা! কিন্তু মুশকিল হল পাউরুটি আমায় মোটে পছন্দ করে না।
টিভিতে দেখায় না, বড় ডাইনিং টেবিলে বসে পাউরুটি, মাখন, ডিম আর ফলের রস (থুড়ি, ব্রেড, বাটার, এগ, ফ্রুট জুস) সহযোগে জলখাবার (থুড়ি ব্রেকফাস্ট) খাচ্ছে, আর তারপরই অফিস যাচ্ছে পেল্লাই গাড়ি করে, অমনটা আমারও খুব শখ। তাহলেই মনে হয় যেন স্পোকেন ইংলিশটা শিখে যাব। আটার রুটি আর আলু-কুমড়োর ছেঁচকি খেয়ে বেরোলে মুখ দিয়ে 'নরঃ নরৌ নরাঃ' ছাড়া আর কিছু বেরোবে কেন? ওই জন্যই ক্লাশ নাইনে ইংরেজিতে পঁয়ত্রিশ পেয়েছিলুম - আমি নিশ্চিত জানি।
তা, সে আমি পাউরুটি খেতেই পারি, কিন্তু ওই যে, প্রেম বেশিরভাগ সময়েই একতরফা হয়। আর সে প্রেমের দুঃসহ জ্বালা "বুকে যার বাজে সেই বোঝে"। আবার এরকম প্রেমের একটা অমোঘ আকর্ষণও থাকে বুঝলেন। বারে বারে তার কাছেই ফিরে যেতে হয়, তারপর যথানিয়মে যৎপরনাস্তি হেনস্থা হতে হয়। আমিও প্রাতঃকালে শুদ্ধ দেহে-চিত্তে যতবার পাউরুটিকে আপন করতে গিয়েছি, ততবারই সে আমাকে গ্যাসবেলুন করে সিলিং-এ ঠেলে তোলার চেষ্টা করেছে। তারপর রই রই কাণ্ড। ঠান্ডা জল, ফেনাওয়ালা-ঝাঁজওয়ালা ওষুধ-টষুধ খেয়ে নিজের সঙ্গে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানটা কোনমতে বজায় রাখতে পেরেছি আর কি।
এইরকমই চলছিল। হয়ত এমনই একতরফা প্রেমের টানাপোড়েনে কেটে যেত দাম্পত্য, কিন্তু বাদ সাধল দিল্লি। অপমানেরও তো একটা সীমা আছে!!!
তখনও ছাত্রাবস্থা পুরোপুরি ঘোচে নি। পাছে কেউ পদমর্যাদায় অবহেলা করে, তাই নাম জিগ্যেস করলে নামের সঙ্গে গম্ভীর মুখে যোগ করি 'রিসার্চ স্কলার'। দিল্লিতে সেবার একখান ভারিক্কি চালের কনফারেন্স হয়েছিল। তাও আন্তর্জাতিক। কত লোক, কত সাহেবসুবো। আর কত ইংরেজি। আমি কোনমতে এককোণে সিঁটিয়ে জায়গা পেয়েছি। আমার সাথে সতীর্থ, সমব্যথী ও সম-সিঁটিয়ে আরো চারজন আছে। আমি বয়সে জ্যেষ্ঠ, আমিই তাদের পালের গোদা। আমি যা করি, তারা দেখে দেখে টুকে দেয়।
উঠেছি এলাহি এক হোটেলে। গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে। সে দুঃখ সুদে আসলে উসুল করে নেব এই শপথ নিয়ে ডাইনিং হলে ঢুকলাম৷ ব্রেকফাস্ট কম্পলিমেন্টারি। তাই যেখানে যা আছে সব খাব। ছাড়ানছোড়ন নেই। ঢুকে দেখি আদ্দেক খাবারের নামই শুনি নি। সাতহাত লম্বা একটা নাম পছন্দ হলে প্লেটে নিয়ে দেখলাম স্রেফ বেগুন সেদ্ধ। আরে রামোঃ! কোথায় স্বর্গীয় লুচি-তরকারি, বা নিদেনপক্ষে তদ্দেশীয় রেওয়াজ মেনে গরগরে ঘি-ওয়ালা আলুর পরোটা, কিংবা রগরগে পেঁয়াজ রসুন দেওয়া ছোলে ভটুরে? তাও নয়? এদিক সেদিক নজর ঘোরাতেই দেখি ওই কোণে পুরাতন প্রেমিকার মতো আড়চোখে চাইছে একজন। হৃদযন্ত্রটা গলার কাছে উঠে এল। দুর্বার আকর্ষণে সেদিকে ধাবিত হলুম। আহা, কী রূপ কী রঙ। আয়তনে রকমারি। চৌকনা, গোল, লম্বা, সাদা, খয়েরি - সাজানো থরে থরে। আমার আবার গোল বান পাউরুটি দারুণ পছন্দ। কিন্তু সেঁকবো কী করে? ভাববেন না, আমি ততটাও অর্বাচীন। টোস্টার আমি বিলক্ষণ চিনি। ওই তো সেঁকা হয়ে গেলে পাউরুটি 'পপ' শব্দ করে লাফিয়ে ওঠে - ওটার নাম তাই 'পপ আপ'।
কিন্তু তেমনধারা তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না আশেপাশে। কাউণ্টারও ফাঁকা। তবে অবশ্য বেশ বড় কম্পিউটারের প্রিন্টারের মতো দেখতে যন্ত্র একখান বসানো আছে বটে। তার ওপরে চৌকো মতন কালো একটা প্লেটের মতন কিছু। তার ওপরে একটা স্লাইস পাউরুটি রাখা। আচ্ছা, বেশ তবে৷ এটাই তাহলে চাটু, রাজধানীর ভাষায় বলতে গেলে 'তাওয়া'। তা বাপু, এত কায়দা মারার কী আছে? এদিকে আমার অনুসরণকারীরা জুলজুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায়। প্রেস্টিজের পুরো ফালুদা হয়ে যাচ্ছে দেখে দিলুম দুখান স্লাইস পাউরুটি তাওয়ার ওপর চাপিয়ে।
দাঁড়িয়েই আছি। দুই, তিন, পাঁচ....সময় চলেছে। পাউরুটি যে কে সেই। যন্তরটা নির্ঘাত খারাপ হয়ে গেছে, নাকি ইলেক্ট্রিসিটি নেই -- এইসব সাতপাঁচ ভাবছি, এমন সময় এক সাহেব ছোকরা গ্যাটম্যাট করে এসে তার নির্বাচিত স্লাইসটা সেই যন্ত্রের মধ্যে অবলীলায় ঢুকিয়ে দিলে। কয়েক সেকেন্ড বাদে সেটি অবিকল প্রিন্টারের কায়দাতেই লালচে আভা সমেত কড়কড়ে হয়ে বেরিয়ে এল। আচ্ছা, ফাণ্ডাটা তাহলে এই।
আমি নিজের মূর্খতা প্রাণপণে ঢেকে যেন কিছুই হয় নি এমন ভাব করে ওই 'তাওয়া' বলে ভুল বোঝা জিনিষটার ওপর থেকে সেই অপরিবর্তিত পাউরুটির স্লাইসটা নিয়ে নিলাম স্মার্টলি, ততোধিক স্মার্টলি ঢুকিয়ে দিলুম যন্তরটার মধ্যে সাহেবকে নকল করে। এবং বলাই বাহুল্য সফল হলুম পুরোদস্তুর।
কিন্তু কপালে দুর্ভোগ থাকলে আটকাবে কে? সাফল্য থেকে আমার আত্মতেজ বেড়ে গিয়েছিল। আমি আরো একখান পাউরুটির স্লাইসের সাথে আস্ত একটা গোল বান বা গোল পাউরুটি ঢুকিয়ে দিলুম। যেই না দেওয়া, অমনি যন্তরটা খ্যাঁক ম্যাঁক ঘ্যাঁক প্রভৃতি বিচিত্র শব্দ সহযোগে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি চম্পট দিলুম।
একেবারে কোণের টেবিলের উল্টো দিকে বসে ভালোমানুষের মত মুখ করে আগের সেঁকা দুখান চিবুতে লাগলুম। আমার অনুসরণকারীরা আমার চারধারে গোল হয়ে বসে লাইভ ধারাভাষ্য দিতে থাকল।
- তোমার গোল বান আটকে গেছে। (ওটা মোটেই আমার বান না। আমি চিনিই না। গোল বান কাকে বলে জানিই না।)
- আর কোন পাউরুটি বেরোচ্ছে না। (তো আমি কী করব? যন্তরটাই খারাপ। প্রিন্টার দিয়ে কখনো পাউরুটি সেঁকা যায়?)
- পাউরুটির কাউন্টারে লাইন পড়ে গেছে। (ডিসিপ্লিন মেন্টেন করা ভালো)
- এক সাহেব সেটা ঠুকছে। (আর কীই বা করবে?)
- তোমার গোল বানে আগুন ধরে গেল- যাহ। (ইসসসসস....অত সাধের...)
- হোটেলের লোকজন এসে পড়েছে। (সব্বোনাশ করেছে।)
- তারাও ঠোকাঠুকি করেছে। (কী কাণ্ড!!!আমার দিকে তাকাচ্ছে না তো?)
-ওই বোধহয় ম্যানেজার এল। ( নির্ঘাত টাকা চাইবে। ওটার দাম কত? ওরে বাবা, ভাঁড়ে তো মা ভবানী।)
পেটে প্রচণ্ড ব্যথা করতে লাগল। আর সহ্য করতে পারলাম না। পাউরুটির কাউন্টারের দিকে পেছন করে উল্টো পায়ে বেরিয়ে এলুম। সোজা গিয়ে সেমিনার হলে ঢুকে হাঁফাতে লাগলাম। সেখানে শাস্ত্রীয় খাদ্যাখাদ্যের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণে ব্যস্ত সবাই।
বিবাগী হয়ে যাবো, নাকি ছদ্মবেশ নেব - ভাবতে ভাবতে পরদিন আবার সেই জায়গাতেই পুনরাগমন। সেই ডাইনিং হল, সেই কোণের টেবিল, সেই বেগুন সেদ্ধ। আরে সেই টোস্টার কাম প্রিন্টারটাও তো দেখছি রয়েছে। দিব্যি তাগড়া। নতুন নাকি? খালি তার পাশে একটা নোটিশ ঝুলছে। ইংরেজিতে লেখা - "দয়া করে গোল বান টোস্ট করবেন না"।
অনুসরণকারীরা সেই থেকে আমায় আর অনুসরণ করে না। ফিকফিকিয়ে হাসে। আমিও প্রিয়া কে ছেড়েছি। এখন দোকানে সাজানো দেখলে তার নরম তুলতুলে গায়ের কথা মনে পড়ে না, বরং তার মুখের অসংখ্য ছিদ্রের কথা মনে পড়ে।
একটি প্রেমের নিদারুণ মৃত্যু হল।
দারুন
হা হা হা :)) অনেকদিন এমন সরল রম্য পড়িনি। ব্রেভো
বেশ মজার। ভালো লেখা