ভোর পাঁচটার দিকে লুঙ লেই পাড়া জেগে উঠতে শুরু করেছে মাত্র। তখনো আলো ফোটেনি। মাত্র গোটা বিশেক ঘর নিয়ে এই বম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গ্রাম বা পাড়াটি গড়ে উঠেছে সেই ব্রিটিশ আমলে। উঁচু পাহাড়ের ওপর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছোট্ট গ্রাম। বান্দরবান-মায়ানমারের সীমান্তে গহিন জঙ্গল ঘেরা এক অন্য জনপদ।
আমার গাইড, বম নেতা জুমলিয়ান আমলাই। দুজনের হাতেই শক্তিশালী টর্চ। গাছপালা, পাহাড় আর কুয়াশার জন্য প্রায় কিছুই ভাল করে নজরে পড়ে না। অনেকটা অন্ধের মতো অনুসরণ করি জুমলিয়ান দা'কে।
ডিসেম্বরের হাঁড় কাঁপানো শীতে পা জমে আসতে চায়। জঙ্গলের ভেতর অজানা পাখি ডানা ঝাপটায়। কুয়াশা জমে শিশির হয়ে গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়ে। শীতকাল বলে রক্ষা। নইলে বর্ষায় নাকি গাছ থেকে বিষাক্ত সাপও গায়ের ওপর এসে পড়ে!
জুমলিয়ান একজন পরিশ্রমী মানুষ। বয়স ৬০ বছর ছাড়িয়েছে। পাহাড়িদের সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তখন ওনার গেরিলা পদ মর্যাদা ছিল করপোরাল। পাহাড়, জুম চাষ, শিকার, বন্য প্রাণী, অরণ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান তার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব সামান্যই।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে, পাহাড়ের পর পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ শুনতে পাই ছম ছম ছমমম্ অবিরাম শব্দ। থমকে জিজ্ঞেস করি ‘সিয়ান কি দা ?’ জুমলিয়ান দা মুচকি হাসেন।
এবার দুজনে ছোট একটা পাহাড় থেকে নীচে নামতে থাকি। ছম ছম শব্দ এখন আরো প্রকট হচ্ছে। হঠাৎ টর্চের আলোয় এক বিস্ময়ের খানিকটা দেখে জুমলিয়ান দা’র বাহু আকড়ে ধরি। ‘ও দা, ও দা, মুই মরি যেম।’
দেখি আমার সামনে ধারণার চেয়েও উচুঁ এক খাড়া পর্বত। সেটার প্রায় পুরো শরীর কুয়াশায় ঘেরা। পর্বতে চূড়া থেকে ফিনকি দিয়ে নেমে আসছে সাদা সিল্কের ফিতার মতো বিশাল এক ঝর্ণা। সেই ‘ছম ছম ছমমমম্’ শব্দ এখন ‘হুম হুম হুমমমমম্’ শব্দ কোলাহলে পরিনত হয়েছে।
বহুবছর ধরে প্রবল ধারায় ঝরতে থাকা প্রপাতের জলের আঘাতে নীচের পাথর ক্ষয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট্ট এক পাথুরে কূপের। সেখান থেকে আবার একেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ছড়া বা ঝিরি নদী।
জুমলিয়ানদা নিজস্ব তাঁতে বোনা ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করেন দুটি বড় বড় তাঁতের গামছা। দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ জামা কাপড় খুলে গামছা পড়ে নেমে পড়ি ঝর্ণার জলে। হিম শীতল একটা বৈদ্যুতিক শক কাঁপিয়ে দেয় পুরো শরীর, এমনকি অন্তর্আত্ম! সম্ভবতঃ একসেকেন্ডের জন্য বাহ্য চেতনা লুপ্ত হয়। …
পরে টের পাই, ভেতর থেকে নিমেষে উবে যাচ্ছে ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে লক্কড়-ঝক্কর জিপে চেপে রোয়াংছড়ি, রোয়াংছড়ি থেকে পাহাড়ি পথে খানিকটা হেঁটে ব্যাঙছড়ি, আবার ব্যাঙছড়ি থেকে ১০ মাইল নন স্টপ পাহাড়ের পর পাহাড় ভাঙার শরীরী বেদনা, আর না পাওয়ার সব বঞ্চনাসমূহ...
হঠাৎ সূর্যদেব উঁকি মারেন পাহাড়ের চূড়ায়। ঝর্ণার জল তখন ফেনিল দুধ সাদা রং থেকে সোনালী রূপ নিয়েছে। সেখানে যেন অপেক্ষা করছিল আরেক অপার বিস্ময়! মাথা একেবারে পেছনে হেলিয়ে দেখা যায় সেই নাম না জানা পাহাড়ের চূড়ায়, ঝর্ণার উৎসে দেখা দিয়েছে আধখানা এক রঙধনু!...
আমি আজলায় করে জল খাই। মনে মনে বলি, ও পাহাড়, তোমায় প্রনাম!
--
ছবি: (c) দুর্গম পাহাড়, জুয়েল চাকমা পরান
উড়ুক
হ
পাহাড়ি প্রকৃতি আর ঝিরি নদীর কথা চমৎকার লিখেছেন। ‘সিয়ান কি দা?’ অর্ত্থ কী?
আরও পড়ার প্রত্যশা বাড়ল।
আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ ইশরাত।
চাকমা ভাষায় ওই কথাটি অর্থ, "ওটা কী দাদা? " জুমলিয়ান দা বম জনগোষ্ঠীর মানুষ হলেও কয়েকটি আদিবাসী পাহাড়ি ভাষায় পারদর্শী। চাকমা ভাষা শিক্ষণ সচল রাখার জন্য সে সময় তার সাথে ওই ভাষাতে কথা বলছিলাম।
লেখাটার হাত ধরে খানিক পাহাড়- সবুজ দেখেটেকে আজলা ভরে জল খাওয়া হলো :) চনমনে লেখা।
বি:দ্র: বিপ্লবদা আপনার কথা মতো ডানপাশের খুঁটিনাটিতে খোঁচাখুঁচি করেও ফল হলো না.. নামের শরীর থেকে ইংরেজ হটানো গেল না।
নেট আসছে যাচ্ছে। ফেসবুক খোলা যাচ্ছে না। হঠাতই লেখাটা খুলতে পারলাম। মানসভ্রমণ হলো। অপূর্ব লাগল।
আর ছবিটি। যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের আঁকা।
পৃথিবীতে থেকেই অপার্থিব আনন্দ পাওয়া বোধ হয় একেই বলে। লেখা-ছবি দুইই মন ভরানো (সে ত আপনি জানেনই)।
নাহার, প্রতিভা দি, একলহমা,
অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
দিদি, তুমি পড়েছ বলেই এ লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
এ আর,
আপনার অনুসন্ধিৎসু পাঠ সত্যিই প্রশংসনীয়। রোয়াংছড়ি হচ্ছে বান্দরবানের থানা, তাই হয়তো ম্যাপে আছে। আর দুর্গম ব্যাংছড়ি, লুংলেই বম (Bwam) জনগোষ্ঠীর গ্রাম ম্যাপে হয়তো ফুলস্টপও নয়। ঘটনাস্থল মিয়ানমার থেকে আনুমানিক ছয় কিলোমিটার গহিন অরণ্যে।
আগামীতেও সাথে থাকার বিনীত অনুরোধ।
"অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী এই অঞ্চলগুলোতে প্রচুর ভেষজ ঔষধের/মেডিসিন্যাল প্ল্যান্ট পাওয়ার সম্ভাবনা, যা হয়ত ঐ অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে চলেছেন।"
এ আর,
এবারো যথার্থই বলেছেন। ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও কার্যকরি এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এতো বছরেও তেমন গবেষণা হয়নি, দু-একটি বই লেখা হয়েছে মাত্র। পাহাড়, বন ও প্রকৃতি উজাড়ের পাশাপাশি আধুনিকতার চাপে বৈদ্য চিকিৎসা পদ্ধতিও বিলুপ্ত হতে বসেছে।
আগামীতেও সাথে থাকুন শুভ
অবাক জলপান খুব ভালো লাগলো। কিভাবে যাওয়া যায় বান্দরবান?
আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। করোনাকালে ভ্রমণ চিন্তা না করাই ভাল। আসলে মহামারীর মনস্তাত্ত্বিক চাপ হ্রাসের চেষ্টায় এই লেখা।
পরিস্থিতি ভাল হলে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর কোম্পানির সংগে যোগাযোগ করতে পারেন, ফেসবুকে তাদের একাধিক পেজ আছে।
জানিয়ে রাখি, বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ইন্সার্জেন্সি এরিয়া, একা দুর্গম পাহাড়ে ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ম্যালেরিয়া, সাপ, জোঁক, বন্য প্রাণী ইত্যাদিও আছে।
শুভ