দারুন লিখলেন। খুব ভালোলাগল পড়তে...
"এক টেবলে ভাগাভাগি করে পাশাপাশি বসে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, মৃণাল সেন, সমর সেন, ও পাশের টেবলে গর্জন করছে সদ্য-ছাপা কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর প্রথাচ্যুত জোয়ান কবিদের দঙ্গল!"
- তাই?
মধ্যবিত্তর সত্যজিৎ বলতে গেলে প্রফেসর শঙ্কুর বিজ্ঞানচেতনার কথা আসবে। এটাসেটামিক্স করে কিছু একটা ভেলকির নাম বিজ্ঞান, এই বোধটা মধ্যবিত্তর খুব আরামের জায়গা।
ফেলুদার ঘ্যাম নেওয়া, লালমোহনকে হ্যাটা করাও আরেকটা আরাম। তেমনি কী হইতে কী হইয়া গেল টাইপের ডিটেকশনও।
বাই দা ওয়ে, প্রদীপে তো পানু দেখতে যেত লোকে, সেগুলো বিদেশি সিনেমার কাটিং ছিল বটে, লাতিন আমেরিকান ্কি?
ইসে আবাপয় পড়েছিলাম মনে হচ্ছে রায়বাবু ক-কু-ম এঁয়ারা সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউএর কফি হাউসে আড্ডা মারতেন আর সুনীল শক্তিরা।,
তা এদের পাশাপাশি টেবিলে বসালেন কী করে?
ইসে আবাপয় পড়েছিলাম মনে হচ্ছে রায়বাবু ক-কু-ম এঁয়ারা সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউএর কফি হাউসে আড্ডা মারতেন আর সুনীল শক্তিরা কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসে।
তা এদের পাশাপাশি টেবিলে বসালেন কী করে?
অবভিয়াসলি মানিকবাবু, শাঁটুলবাবু, কমলবাবু, ফর্সামতন ভদ্রলোক প্রমুখরা বসতেন সেন্ট্রাল আ্যভিনিউয়ের লর্ডসে। তাও লাঞ্চে, কারণ কমলবাবু ছাড়া সবাই প্রায় সদাগরি আপিসের চাকুরে। তবে পাশের কখনও কখনও সেখানে অন্য টেবিলে উৎপল দত্তকে দেখা যেত, হয়ত সঙ্গে রবি ঘোষ প্রমুখ নাটুকেরা। মৃণাল সেন, ঋত্বিক, সলিল চৌধুরী, হৃষিকেশ মুখার্জিদের ঠেক ছিল কোন একটা চায়ের দোকান, ভুলে গেছ।
সুনীল, শক্তিরা কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজ, ও সন্ধ্যেয় অনেক সময়েই খালাসিটোলা বা বারদুয়ারি। কমন বলতে কমল মজুমদা।
... ভুলে গেছি।
ঋত্বিকগণ প্যারাডাইস কাফেতে।
দশ মিনিটের জন্য হুড়মুড় করে ঢোকা প্রসঙ্গে শুনেছি সিনেমার পোস্টারে হাতে লেখা আরো ছোট ছোট সময় লেখা থাকত। বারোটার সিনেমা হলে ১২:৩৫, ১:১৭ এইসব লেখা থাকত। লোকজন বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেতে খেতে ঘনঘন ঘড়ি দেখতেন। সময় হলেই সবাই মিলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তেন।
হঠাৎ পর্দায় ফুটে উঠতো " গঙ্গায় বান আসিয়াছে, পা তুলিয়া বসুন " । সবাই পা তুলে বসলো , সিট এর তলায় কুলকুল জল ।
শিমূল বন্ধু মানুষ, বয়সে অনেক ছোট, চমৎকার ঝরঝরে গদ্য লেখেন। কিন্তু এই লেখাটায় যাকে বলে আদিখ্যেতার হদ্দমুদ্দ করেছেন। একে তো সত্যজিৎকে মৃণালের সঙ্গে এক টেবিলে বসিয়েছেন, তায় উল্টোদিকে আবার কৃত্তিবাসীরা। মানে সব মিলিয়ে প্রথমেই ঘেঁটে ঘ!
দ্বিতীয় ঘেঁটে যাওয়া জিনিসটা হচ্ছে বাঙালির রেনেসাঁস প্রেম। শিমূল এখানে শিবাজী বন্দ্যো-র প্রসঙ্গ এনেছেন বলে তাঁকেই অনুসরণ করে বলি, উনিশ ও বিশ শতকে বাঙালির শব্দভাণ্ডারে যে গুচ্ছ রি-প্রিফিক্সওয়ালা (যেমন রিফর্মেশন, রিকন্সট্রাকশন, রিসার্চ) শব্দ ঢুকে যায়; সেই শব্দগুলো অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সুশোভন সরকারের বাংলার রেনেসাঁস-এ এসে। এই বস্তুটি নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির যুগপৎ উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, তার সীমানা নির্ধারণে বাঙালির বারে বারেই ভুল হয়ে যায়।
কেউ শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে (ডেভিড কফ); কেউ বা রামমোহনের কলকাতা আগমন থেকে আর বাকিরা হিন্দু কলেজ স্থাপন করা থেকে। এঁর প্রতিভূরা পাইকিরি হারে রামমোহন-বিদ্যাসাগর হয়ে বঙ্কিম-বিবেকানন্দতে এসে পড়েন; অনেকে শেষ করেন রবি ঠাকুরে এসে। এখন সে ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ সময়কালীন নাকি তাঁর মৃত্যু অবধি - সে নিয়ে ধোঁয়াশা মোটে যখন যেতে চাইছে না, তখন বাঙালি মধ্যবিত্তের রুচি ও সংস্কৃতি নির্মাণের স্বঘোষিত ঠিকাদার আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী এই আচাভুয়া বস্তুটিকে সম্প্রসারিত করে দেয় সত্যজিৎ অবধি। বলা বাহুল্য, শিমূল এই আনন্দবাজারি ব্যবসার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং প্রত্যাশামাফিক ফেঁসেছেন!
আমি শুধু ফেলুদাকে সোনার কেল্লাতে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি কারণ নমুনা হিসবে এটি এতই উৎকৃষ্ট যে এই এক ছবি দিয়েই গোটা জঁর-টাকে নির্ধারণ করা যায়। ফেলুদা আসলে ঠিক সেই নিক্তি মাপা সাহেব বাঙালি, যা বাঙালি মধ্যবিত্তের বিশেষত রেনেসাঁস নিয়ে ল্যালাপনা দেখানো বাঙালির পরম আদরের ধন। বাঙালিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় এই ফেলুদাই তোমার আদর্শ, মুকুলের বাবার মতো ছাপোষা বাঙালির যাপন তোমার কাঙ্ক্ষিত বা বাঞ্ছিত হতে পারে না।
ফেলুদা সময়নিষ্ঠ। অ্যাালার্ম বাজলে তার ব্যায়াম শেষ হয় (মানে শরীর সচেতন); তারপরে ডালমুট দিয়ে মকাইবাড়ির চা পেঁদিয়ে আয়েস করে একটি চারমিনার ধরায়। পেছনে শোভিত হন যামিনী রায়, বৈঠকখানাটিও বিলিতি কায়দায় সজ্জিত। গোটা গল্পে (এবং সিনেমায়) প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে রেনেসাঁসের অন্যতম চরিত্র লক্ষণ 'অজেয় পৌরুষ' (ঋণ: রবীন্দ্রনাথ)। ছবিতে মহিলা চরিত্র থাকে না, থাকলেও তাঁদের জন্য কোনও সংলাপ বরাদ্দ হয় না।
ছাপোষা বাঙালির ছেলে মুকুল নতুন কোট-প্যান্টালুনে আদৌ অস্বস্তি বোধ করে না এবং এই কোট-প্যান্টালুন ছবিটির প্রায় প্রতিটি বাঙালি চরিত্রের আবশ্যিক পোশাক হয়ে ওঠে। মন্দার বোসকে জ্যাকেট গায়ে চাপাতে হয় কেবলমাত্র ফেলুদাকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। এমনকি যে লালমোহনবাবু কানপুর স্টেশনে মাফলার-মাঙ্কিক্যাপে সজ্জিত থাকেন (এ জিনিস আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘাতেও দেখব), তিনিও ফেলু-তোপসের সঙ্গগুণে (নাকি দোষে?) পুরোদস্তুর সাহেব বনে যান!
ফেলুদা হোটেলে নয়, সার্কিট হাউসে ওঠে (মানে ওপরমহলে যোগাযোগ যথেষ্ট)। তৈরি হতে মিনিট তিনেক সময় নেয়। তোপসে ট্রেনে ব্রেকফাস্ট খায় বিলকুল বিলিতি কায়দায়। মাঝে ভাঁড়ে করে চা যতটা বাঙালিত্ব না বোঝাতে, তার চেয়ে অনেক বেশি লালমোহনবাবুকে জ্ঞান দিতে যে চা-টা আসলে উটের দুধে তৈরি! এবং ফেলু-তোপসের লাগেজও হয় সাহেবদের মতোই, লালমোহনবাবুর মতো কুলি-ফুলি তাঁদের লাগে না।
লালমোহনবাবু ক্রমেই একটি ক্যারিকেচারে পরিণত হন। বাঙালি কিশোরকিশোরীরা যে আদতে গোয়েন্দা গপ্পের আড়ালে পিটুলিগোলা খাচ্ছে, সেটা বোঝাতে প্রথমে উল্লিখিত হন উইলিয়াম হার্শেল (রেনেসাঁ-পুরুষ বিদ্যাসাগরের প্রিয় চরিত্র কি না!) এবং ট্রেনে বসে ইংরেজি বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে উটের পাকস্থলী নিয়ে আরেক প্রস্থ জ্ঞান বিতরণ হয়! আমাদের ছোটবেলায় আনন্দমেলায় মার্কামারা ভালো ছেলেদের (মেয়েদের নয়!) প্রিয় লেখক ছিলেন শংকর ও সত্যজিৎ (কে হায় হৃদয় খুঁড়ে...) কারণ তাতে নাকি 'অনেক কিছু জানা যায়'। তো সত্যজিৎ লালমোহনবাবুর মাধ্যমে এন্তার জিকে সাপ্লাই দিতে থাকেন (মনে করুন বোর, ক্যালিবার)।
কিন্তু গোটা গল্পই আবর্তিত হয় এক অবিশ্বাস্য গাঁজাখুরি (জাতিস্মর) নিয়ে। রাজস্থানের নয়নলোভন পটভূমিতে সত্যজিৎ এই গল্পকে ফেলেন বোধহয় এই দুর্বলতাটাকে ঢাকতেই। যেমন রেনেসাঁর প্রাথমিক ঢক্কানিনাদ অবশেষে হিন্দু পুনরুত্থানবাদে শেষ হয়; অবিকল একই ভাবে দেবীর সত্যজিৎ সোনার কেল্লায় থিতু হন! পারিশ্রমিকের ধার এক্ষেত্রে ধারে না ফেলু মিত্তির যদিও তাঁর মক্কেলরা বেশিরভাগই শাঁসালো এবং বসে খাওয়া পার্টি হয়। তাঁরাই তাঁর মূল খদ্দের, রেনেসাঁ সমর্থকদের মতোই।
তো এহেন রেনেসাঁ পুরুষের (ক্যামেরার সামনে ফেলু পেছনে সত্যজিৎ) কেবল শাঁসটাই বাঙালির থাকে কিন্তু সেটা অন্তঃসারশূন্য। কারণ ফেলু মিত্তির চলনে-বলনে-মননে পাক্কা সাহেব। তাতে চাড্ডি ভাত খেলে কিংবা বাংলায় কথা বললে এমন কিছু ফারাক হয় না। এবং অতি অবশ্যই কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো এ ছবি রঙীন। বোঝা আয় সাদা-কালোর যুগ বাতিল হয়ে গেছে, এখন রঙিন যুগের জমানা।
এবং এবং এবং। কী আশ্চর্য শরদিন্দুর গোয়েন্দার মতোই ফেলু কায়েতের ব্যাটা হন!
জয় ফেলুদা। জয় সত্যজিৎ। জয় বাবা রেনেসাঁস।
* 'কেবল শাঁসটাই বাঙালির থাকে'-র বদলে 'কেবল খোলটাই বাঙালির থাকে' পড়বেন দয়া করে।
তিনটে ডট, আপনি 'সম্ভবত' এ বিষয়ে খোদ শরদিন্দুর বক্তব্যটা জানেন না।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নিজেই বলেছেন কায়েত দের বুদ্ধি বেশি হয়।এদিকে ব্যোমকেশ বক্সি হলো তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। সেই অর্থে বামুন হতেই পারতো। কিন্তু এলেবেলে বাবুর আপত্তি টা কোথায়?ব্যোমকেশ কায়েত বলে না ধুতি পাঞ্জাবী পরে বলে?
ফেলুদার টাইটেল মিত্তির। তো,কি করা যাবে?কি হলে ভালো হতো?
মন্দার বোস,জ্যাকেট পরে কি দোষ করলো?ওঁকে বিদ্যাসাগর এর মতো ধুতি চাদর পরালে,বেটার হতো,বলছেন?
তর্কচূড়ামণি শ্রী এলেবেলে আবার ছড়ালেন। মশাই সোনার কেল্লায় জাতিস্মর ব্যাপারটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওটা একধরনের ঠকানো। কায়দাটার কি একটা খটমট নাম আচে। ফিলিমের নোকেরা এসে আপনাকে বুজিয়ে দেবে।
রাজস্থানও কিছু ঢাকতে বা চাপতে বাছা হয়নি। কাহিনীতেই বলা ছিল কেল্লা, উট আর বালি বলতে রাজস্থানের কথাই সবচেয়ে আগে মনে পড়ে।
নেন, ফোর্ট উইলিয়াম তাক করে গুদুম গুদুম কামান দাগতে থাকুন।
এসেম, এর আগে অনেকবার বলেছি আপনাদের মতো দিগগজ পণ্ডিতদের আমার মতো একটা ফালতু লোককে 'বাবু' বলার মানে হয় না। তবুও যে কেন বলেন! এমনিতেই শিমূলের হাজার শব্দের পোবোন্দের প্রেক্ষিতে ৬৫০ শব্দের মন্তব্য করে মরমে মরে আছি। তো এতকিছু লেখার পরেও যদি আপনি ফেলুর 'টাইটেল' (ছিঃ আপনি না সায়েব!) আর মন্দার বোসের জ্যাকেটে আটকে থাকেন, তবে তা আমার বাংলা লেখারই অক্ষমতা। এমনিতেও আমি আপনাকে ঠিক কোনও জিনিসই এ জীবনে বুঝিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে করি না, এদান্তি আপনার কথার উত্তর দিতে গেলে দেখছি আমার কী-বোর্ড আটকে যায় অজানা আতঙ্কে। এমনিতেই মরমে মরে আছি, তার পরে খাঁড়ার ঘা কি না দিলেই নয়?
তবু ভালো আপনি অন্তত নিজের নিকে লিখেছেন। কিন্তু কোনও এক দাঁতক্যালানে বাঞ্ছারাম তক্কে তক্কে থাকেন বোধায় কোন মওকায় এলেবেলেকে হ্যাটা করা যায়! এর আগে একজন 'সৌরিন' লিখে ব্যাপক আবাজ খাওয়ার পরে চেপে গিয়েছিলেন। তো তিনিই আবার ঘোতনা নামে হাজির হলেন, নাকি ইনি কোনও নয়া অবতার - কে জানে!
তবে ছড়িয়ে ছত্তিরিশ করার আগে যোধপুর সার্কিট হাউসে মন্দার বোসের জাতিস্মর নিয়ে সংলাপটার কেন প্রয়োজন হয়েছিল তা যদি ঘোতনা-গনশা জানাতেন তবে বড্ড উবগার হত আর কি!
সোনার কেল্লার কাহিনীর সঙ্গে চলচ্চিত্রটির আকাশপাতাল ফারাক। অবিশ্যি গুরুর পাড়ার ঘোতনা-গনশারা এখনও ছবি বলতে 'বই' বোঝেন সেটা জানা ছিল না মাইরি! গপ্পোটা পড়েছেন নাকি ফের 'সৌরিন' মার্কা চালাকি করে কেস খাওয়ার ইচ্ছে? কোন পক্ষে লড়ছেন? সত্যজিৎ না সৌরিন!!
না, সোনার কেল্লায় সোনার কেল্লা থুড়ি জাতিস্মর কে আদর্শ ম্যাকগাফিন বলা যায় কী না সে নিয়ে সন্দেহ আচে। তথাকথিত রেনেসাঁ পর্বে প্লাঁশে এবং থিওসফি চর্চা নিয়ে শিক্ষিত এলিট দের মধ্যে সচেতন আদিখ্যেতা ছিলো। সত্যজিৎ সেই ট্রাডিশন কে সোকা তে বজায় রেকেচেন।
এ বাদে, এই লেখাটি গ্যাদগেদে বাংলা রচনা হয়েচে, তাই কথা বাড়ানোর প্রয়াস পাচ্চি না।