। 'যান' পহেছান ।
বন্দীদশার দ্বিতীয়-পর্ব শুরু হওয়া ইস্তক শুভর মুড খুব খারাপ। প্রথম কদিন লোকজন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাতে সেইসব মানুষকে মূর্খ ভারতবাসী-টাসী বলে রাগ মেটাচ্ছিল। তারপর আর না পেরে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে আনন্দবাজার পড়তে পড়তে এক অতল বিষাদ-মিশ্রিত গলায় বলল, "অবিমৃষ্যকারিতা!"
আমি জানলা দিয়ে যানবাহনহীন গতিস্তব্ধ ওল্ড মহাবলীপুরম রোডের ভিউ উপভোগ করতে করতে রবি ঠাকুরের ধোঁয়া ওঠা চা-এ চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম। জয়দা বাথরুমের দরজা খুলে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফোম-পূর্ণ গালে রেজারব্লেড ঘষবে বলে উদ্যত হয়েছিল। এমন সময়ে আমাদের শুভর মুখে একেবারে তৎসম গালি শুনে যে যেমন ছিলাম সেইভাবে কয়েক মুহুর্তের জন্য মৃণাল সেনের ছবির মত ফ্রিজ হয়ে গেলাম। জয়দা একটু ফোম উড়িয়ে ফিক করে হেসে বলল, "জুতোর নাম রাখলি?"
আমি চা-এর কাপটা মুখ অবধি না তুলে, ফের নামিয়ে রেখে বললাম, "কী হয়েছে ভাই? সকাল সকাল বাতঃপীড়া না অম্লশূল?"
"এসব আবার কী?" শুভ আমার দিকে ফিরে বলল।
"সেইটাই তো জিজ্ঞেস করছি। দস্যু রত্নাকরের মুখে দেবভাষা কী করে? শরঃক্ষেপ করল নাকি কেউ? ব্যাধ তো নেই - উপরের গার্লস পিজির কেউ… "
"ধুর! তোরা এত আল-ফাল বকিস না!" শুভ আবার বিরস মুখে মোবাইলে কাগজ প্রায় মন দিল। শুভর মুখে 'শুভোচিত' বাক্য শুনে আমরা আশ্বস্ত হলাম।
"এইভাবে থাকা যায়? লোকজন একটু মেনে চললে মিটে যায়। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে... আর এরা সব একেবারে..." শুভ 'অবিমৃষ্যকারী' জাতীয় কোনও শব্দ বোধহয় আবার বলতে যাচ্ছিল। আমাদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে গিলে নিল।
জয়দা বাথরুম থেকে বলল,"সে আর কী করা যাবে? এসব তো হয়েই থাকে!"
"হয়েই থাকে?" শুভ তেড়িয়া হয়ে বলল!
"হ্যাঁ। শান্তরক্ষিত থেকে শরৎচন্দ্র - সবাইকেই কোয়রেন্টাইন্ড হয়ে থাকতে হয়েছে! তুই তো জাস্ট ঘরবন্দী! তাতেই এত দুঃখ!"
"শান্ত রক্ষিত আবার কে? তোমার চেনা করোনা পেশেন্ট নাকি?" শুভ ভুরু কুঁচকে বলল।
"আহম্মক!" জয়দা তোয়ালে দিয়ে গাল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বলল,"নালন্দার অধ্যক্ষকে করোনা পেশেন্ট মনে হল তোর!"
"নালন্দা!" ইতিহাসের গল্পের গন্ধ পেয়ে নড়ে বসি আমি। সাথে অবিশ্যি রবিবার ব্রেকফাস্টের ম্যান্ডেটরি পুরির মনোলোভা গন্ধটাও ভেসে আসছিল রান্নাঘর থেকে! সাথে সাদা আলুর তরকারিটা বানাতে বলেছি। রবি ঠাকুর মাথা নেড়ে 'তবে তাই হোক' বলে গেছে! সুতরাং এই দুই গন্ধের ডুয়েট রবিবারের সকালটাকে ভাল করে দেবে বলেই আমার মনে হল।
জয়দা তোয়ালেটা খাটের পাশে মেলে দিয়ে বালিশটা পিঠের পিছনে দিয়ে যাকে বলে জাঁকিয়ে বসল। "ইয়েস! নালন্দা। নিজে নালন্দায় পড়াশোনাও করেছিলেন। সম্ভবতঃ বাঙালী। কোন রাজপরিবারের সন্তান। শ্রীলঙ্কাতে বৌদ্ধ-ধর্ম প্রসারের জন্য যেমন সম্রাট অশোককে ইতিহাস মনে রেখেছে, তেমনি তিব্বতে বৌদ্ধ-ধর্মকে মানুষের ধর্ম করে তোলার পিছনে আচার্য শান্তরক্ষিতের অবদানের জন্য ইতিহাস তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। যদিও সম্রাট অশোক সিংহলে হীনযান বা থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মকে নিয়ে যান - আচার্য শান্তরক্ষিত থেরবাদী ছিলেন না, মহাযানী বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত ছিলেন।"
"এসব কী জিনিস? মহাযান, হীনযান? মাথার মধ্যে যানজট হয়ে যাচ্ছে তো!" শুভ গম্ভীর ভাবে বলল।
"ওটাকে 'মাথা' বলে ডাকিস কেন? ঝুনো নারকেল বললেই হয়!" 'শান্তরক্ষিত'কে অমন তাচ্ছিল্য করাটা জয়দার হজম হয়নি বুঝলাম। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,"আরে ছাড়ো ওর কথা! তুমি হীনযান মহাযানের ডেফিনিশনগুলো দাও তো। সেই ইতিহাসে কবে পড়েছি - মনে নেই।"
জয়দা বলল,"ডেফিনিশন দেওয়া এক লাইনে কঠিন। তাহলে একেবারে বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।"
আমি বললাম, "বেশ তো! শুরু হোক!"
"শাক্যরাজ শুদ্ধোদনের পুত্র হলেন সিদ্ধার্থ। যদিও 'রাজ' বললাম - কিন্তু আসলে শুদ্ধোদন রাজা ছিলেন না। মানে আমরা রাজা বলতে ঠিক যা বুঝি - সেটা ছিলেন না।"
"তবে?" শুভ গল্পের লোভে বকা-টকা হজম করে নিয়েছে।
"আচ্ছা, বল তো, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বৈশালীর গুরুত্ব কী?"
"বৈশালী? সে তো লিচ্ছবিদের রাজধানী ছিল না?" মনের অতল থেকে বৈশালী শোনামাত্র 'লিচ্ছবি' শব্দটা ফস করে বুড়বুড়ি কেটে উঠল।
"গুড! আর কিছু?" জয়দা আমাদের ইশকুলের ইতিহাসের স্যার অশোক বাবুর মত মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন। আমি মাথা নেড়ে সারেন্ডার করলাম। শুভর কথা বলা বাহুল্য।
"লিচ্ছবিরা এদেশের সব রাজা-রাজড়াদের রাজ্যের মধ্যে থেকেও একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র পরিচালনা করত। প্রায় ছ'শ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। তাদের রাজধানী ছিল বৈশালী।"
"মানে ওরা ভোট দিত?"
"হ্যাঁ। তবে এখনকার মত আমজনতার ভোটাধিকার ছিল না। জাতকের গল্পে পাওয়া যায় যে লিচ্ছবিতে প্রায় সাত হাজার মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন - যাদের হাতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। এবং প্রতি বছর তারা নিজেদের থেকে একজনকে 'রাজা' হিসাবে নির্বাচন করতেন। প্রতি বছর নতুন রাজা। এবং তার শাসন চলত এই পার্লামেন্টের সদস্যদের সাহায্যে। শাক্যদেরও সেই একই সিস্টেম ছিল। ফলে মনে করা হয় শুদ্ধোদন ছিলেন এই পার্লামেন্ট বা সেনেটের সদস্যদের একজন। ইতিহাস তাকে রাজা হিসাবেই মনে রেখেছে যদিও। সে যাই হোক। যীশুর জন্মের শ'পাঁচেক বছর আগে এই শুদ্ধোদন আর মায়াদেবীর সন্তান হিসাবে সিদ্ধার্থের জন্ম। একথা তো 'নালক' পড়েছে যারা সব্বাই জানে। বড়লোকের বেটা লো - ফুটানি মেরে ঘুরে বেড়ান। একসময় বিয়েও করে ফেললেন। ছানাও হল এক - নাম রাখা হল রাহুল। তারপর একদিন হঠাৎ তার চোখের সামনে থেকে এই ঐশ্বর্যের পর্দা সরে গিয়ে পৃথিবীর কঠিন চেহারা ধরা পড়ল - এক জরাগ্রস্ত অশীতিপর বৃদ্ধকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। স্তম্ভিত হলেন এই ভেবে যে 'চিরকাল কাহারো সমান নাহি যায়!' বেটার লেট দ্যান নেভার। সিদ্ধার্থ ত্যাগ করলেন সংসার। তখন তিনি ঊনত্রিশ বছরের যুবক। তারপর বছর ছয়-সাত কঠিন তপস্যা করে যা জ্ঞান লাভ করলেন - সেই জ্ঞান তিনি প্রচার করেন পরবর্তী চুয়াল্লিশ বছর। আশি বছর বয়েসে তিনি মহানির্বাণ লাভ করেন।"
"বেশ। কিন্তু হীনযান, মহাযান কী?"
"বলেছি না, ধৈর্য না ধরলে কিছু জানা যায় না! বুদ্ধদেব ছয় বছর ধরে একভাবে তপস্যা করেছিলেন। আর তোরা দশ মিনিট ধৈর্য ধরতে পারিস না!" জয়দা কড়কে দিল আমাদের। জয়দা আবার বলতে শুরু করল।
"মুশকিল হল, বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস বৌদ্ধরা সযত্নে কেউ লিখে যান নি। বাকিদের কথা তো ছেড়েই দে! প্রায় সাতশ বছর মুসলমান শাসকরা দিল্লীর মসনদে বসে ভারত শাসন করেছে। এদিকে বখতিয়ার খিলজি নাকি ওদন্তপুরী মহাবিহারকে কেল্লা আর তার সন্ন্যাসীদের গেরুয়া পরা ন্যাড়া মাথা সৈন্য ভেবে বসল। আবুল ফজল এই প্রকাণ্ড আইন-ই-আকবরী লিখে গেছেন - তার কোথাও একবারের জন্যও বৌদ্ধ ধর্মের নাম নেন নি। হিন্দুরাও তথৈবচ। কেউ কোথাও বৌদ্ধদের জন্য কথা খরচ করেন নি। লিখল কারা? ইউরোপীয়রা। তাদের সমস্যা হল যে তারা বিদেশি। বাইরে থেকে এসে বৌদ্ধ ধর্মকে যে যেমন বুঝেছে সে সেরকম বর্ণনা করে গেছে। অন্ধের হস্তি-দর্শন যেমন হয়!”
“তাহলে আসলে বুদ্ধ কী বলেছিলেন সেটা জানা যায় না?”
“যায়। বিভিন্ন সময়ে বৌদ্ধদের লেখা নানারকম বইপত্র থেকে। নানারকম দার্শনিক মতবাদ প্রচার করেছেন গৌতম বুদ্ধ। সেটা সব ধর্ম-প্রচারকরাই করে থাকেন। গৃহত্যাগের পর বছর ছয়-সাত শরীর স্বাস্থ্য ভগ্ন করে কঠোর তপস্যার পর সিদ্ধার্থ অনেক দার্শনিক উপলব্ধির মাঝে এটাও উপলব্ধি করেন যে এইরকম চরম কৃচ্ছসাধন করে লাভ নেই। তিনি শিষ্যদের বললেন - শোন বাছা, একেবারে ভোগবাদে নিজেদেরকে উড়িয়ে দিও না। আবার একেবারে কৃচ্ছ সাধন করে নিজের শরীরের ক্ষতি কর না। মধ্যমা প্রতিপৎ মেনে চল। অর্থাৎ মাঝামাঝি চল, বাড়াবাড়ি কর না। অহিংসা পালন করতে বলেছি বলে এটা করতে বলছিনা যে মুখে কাপড় বেঁধে চল যাতে মুখে পোকা না ঢুকতে পারে কি সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালিও না যাতে তাতে পোকা এসে না পড়ে। আবার তাবলে গিয়ে হরিণ শিকার কর - সেটাও বলছিনা। মাঝ বরাবর চল। ইচ্ছে করে জীব হত্যা কর না, তাহলেই চলবে। ওটাই অহিংসা ধর্ম। সেরকম নিজের জীবনেও মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর - কেবল ভাল খাব, ভাল পরব তার চেষ্টা করে যাব - সেটাও যেমন ঠিক নয়, সেরকম কঠোর তপস্যা করব, চারিদিকে আগুন জ্বেলে তার মধ্যে বসে সূর্যের দিকে চেয়ে দিন কাটাব সেটাও ঠিক নয়। আহারঃ প্রাণযাত্রায়ৈ ন ভোগায় নদৃপ্তয়ে!”
“তার মানে বৌদ্ধরা কি সব ভেজ?” শুভ জিজ্ঞেস করল। প্রশ্নটা যে আমার মাথাতেও ঘুরছিল না তা নয়।
“উঁহু। অন্ততঃ সবাই ভেজ নয়। গৌতম বুদ্ধ নিজে নন-ভেজ ছিলেন বলেই শুনেছি।”
“তাহলে অহিংসা-টিংসা বললে যে!”
“বুদ্ধদেব বলেছেন যে নিজে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা কর না। তবে অন্য কারণে মৃত পশুর মাংস খেতে পার। আপত্তি নেই।”
“এটা কীরকম হল!” শুভ ঠিক খুশি হল বলে মনে হল না।
“এটাই মধ্যমা প্রতিপৎ। এটাই বৌদ্ধধর্মের সারকথা। এই ঔদার্যের জন্যই জন্যই বৌদ্ধ ধর্ম ওরকম পপুলারিটি পেয়েছিল। বুদ্ধদেব যতদিন জীবিত ছিলেন সব বিষয়ে এটা মেনে চলতেন। কখনো কোন বিষয়ে বিরোধ তৈরী হলে খুব ভাল মীমাংসা করতে পারতেন বলে শোনা যায়। রাজার ছেলে - রাজনীতিটা তো মজ্জায়! যতই সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হোন, একজন রাজপুরুষের বাকি সবাইকে লিড করার যে স্বাভাবিক গুণ - সেটা ত্যাগ করেন নি।” জয়দা হাসে।
“এই মাধ্যমা প্রতিপৎ ছাড়া আর কী আছে বৌদ্ধ দর্শনে?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“সে বিস্তর জিনিস আছে। অত আমি জানিও না - বুঝি তো নাই! তবে একটা বিশেষ জিনিসের কনসেপ্ট আছে - যাকে বলে নির্বাণ। এই নির্বাণ নিয়েই গণ্ডগোল।”
“নির্বাণ কী? মুক্তি?”
“হ্যাঁ এবং না। সাধারণতঃ নির্বাণ বলতে মুক্তিই বোঝায়। মুক্তি অর্থাৎ এই সংসার, সমস্ত চাওয়া, আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে অসীমের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। মানে, এই যে তুই আছিস বা আমি আছি বা ওই যে শুভ বসে রবি ঠাকুরের পুরি-সবজির জন্য উন্মুখ হয়ে আছে - এই থাকার মধ্যে সবটা জুড়ে যেটা প্রধান হয়ে থাকে, তা হল আমাদের প্রত্যেকের ‘আমিত্ব'। রবি ঠাকুর, নট দ্য কুক বাট দ্য পোয়েট, বলেছেন না, আমি বলে 'মিলাই আমি আর কিছু না চাই’ - সেই ‘আমি’"।
"এ কি! রবীন্দ্রনাথ এরকম ভুলভাল লিখেছেন নাকি?” শুভ হঠাৎ আঁতকে ওঠে।
“কেন? কী ভুল লিখলেন?” জয়দা কথার মাঝে বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
“আমি ‘বলে' লিখেছেন? আমি ‘বলি' হবে তো!” রবীন্দ্রনাথের লেখায় ভুল পেয়ে শুভর মুখ চোখ উদ্ভাসিত।
“তুই বলি হবি সন্দেহ নেই। আমার হাতেই হবি। যদি একটা খাঁড়া পেতাম…” বলে জয়দা একেবারে খড়গহস্ত হয়ে উঠল।
“কেন? ভুল কী বললাম? আমি বলি হবে না? ফার্স্ট পার্সন?” শুভ নাছোড়।
“না। এটা থার্ড পার্সন। সেটাই ব্যাখ্যা করছিলাম। মাঝখান থেকে কথা বললে তো তোর কোষ্ঠকাঠিন্য হয়! এই ‘আমি' হল আমাদের মধ্যেকার ‘আমিত্ব’। ইগো। সেই ‘আমি’কে ঝেড়ে ফেলে যখন সব ‘নাই' হয়ে যায়, তখন নির্বাণ লাভ হয়।”
“সে আবার কী?” দুজনেই কিছু বুঝলাম না।
“কিছু বুঝলি না তো! আমিও বুঝিনি। অশ্বঘোষ বলেছেন, নির্বাণ একটা আনডিফাইনড স্টেট। যেটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। মানুষের ধারণার অতীত। ইমানুয়েল কান্ট যাকে ট্রান্সেন্ডেন্টাল বলে গেছেন। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিতে' বুদ্ধদেবকে দিয়ে তিনি বলাচ্ছেন যে, তুমি যতক্ষণ আছ, অর্থাৎ তোমার মধ্যে তোমার আত্মা আছে, ততক্ষণ তোমার ‘আমি’ বা ‘অহং’ থাকবে। অহং থাকলেই অহংকার থাকবে। আর অহংকার থাকলেই মুশকিল! মুক্তি সম্ভব নয়। তাহলে নির্বাণ সম্ভব কী করে? এটা কেউ ঠিকঠাক বুঝল না। সবাই নিজের নিজের মত করে অর্থ করল। নিজের মত করে সংজ্ঞায়িত করল ব্যাপারটা। যাই হোক, নির্বাণ অর্থাৎ ‘নাই দশা’। থেরবাদীরা এই রহস্যময় ‘নাই’ নিয়ে খুশি ছিলেন।”
“থেরবাদী কী?” জয়দাকে বাধা দিই।
“থেরবাদী বা স্থবিরবাদী। বুদ্ধের মৃত্যুর শখানেক বছর পরে বৈশালীতে বৌদ্ধদের একটা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। একে বৌদ্ধ-সংগীতি বলে। এখানে আলাপ আলোচনা করে বিশুদ্ধবাদীরা দেখলেন যে বৃজি বংশীয় বৌদ্ধরা ঠিক ঠাক করে বুদ্ধের অনুশাসন মেনে চলছে না। তারা নিজেদের মত করে কিছু নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে। আট জন বৌদ্ধ স্থবির তাদের বিচার করে প্রমাণ করেন যে বৃজি বংশীয়রা নিয়ম সত্যিই মানছে না। তখন বৃজিরা অমন প্রমাণের ক্যাঁথায় আগুন বলে কনফারেন্স ছেড়ে নিজেরা আলাদা করে কনফারেন্স আয়োজন করেন। এই যে বিশুদ্ধবাদীরা পড়ে রইল - তাদের বলা হয় স্থবিরবাদী বা থেরাবাদী বা থেরবাদী হিসাবে। এই থেরবাদীরা দাবী করতেন যে তাঁরা বুদ্ধের আসল বানী বা মতাদর্শ মেনে চলেন। নির্বাণকে তাঁরা ওই আত্মার মুক্তি হিসাবে দেখেই খুশি ছিলেন। এদের মধ্যে আবার দুই দল ছিল - প্রত্যেকবুদ্ধযান এবং শ্রাবকযান। প্রত্যেকযান বা প্রত্যেকবুদ্ধযানের মূলকথা হল নির্বাণ পাওয়ার জন্য তোমায় কোন বুদ্ধর স্মরণাপন্ন হতে হবে না। সেলফ সাফিশিয়েন্ট হও। আর শ্রাবকদের প্রয়োজন একজন বুদ্ধের। তার মুখে ধর্মকথা শুনে, পরামর্শ নিয়ে সেই নির্দেশ মত জীবন ধারণ করে নির্বাণের দিকে অগ্রসর হবে। পরবর্তীকালে এক নতুন দল এলো। এরা সম্ভবতঃ বৈশালীতে যারা বিক্ষুব্ধ হয়ে চলে গেছিল তাদেরই একটি শাখা। সম্রাট কনিষ্কর সময়ে এদের প্রকাশ হয় বলেই জানা যায়। অশ্বঘোষ নিজেও এই দলের সমর্থক ছিলেন। পরে অবশ্য নাগার্জুন এবং আর্যদেব নামে দুই দার্শনিক এই নতুন শাখার ব্যাখ্যা করে বই-টই লেখেন। যাই হোক, নতুনরা এসে বলল, এ কি! এই প্রত্যেকবুদ্ধ আর শ্রাবকরা তো সব নিতান্ত স্বার্থপর! নিজেদের নির্বাণ নিয়েই মেতে আছে! জগতের এত কোটি প্রাণী যে নানারকম বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে, বলি, তাদের মুক্তি কে দেবে শুনি! আপনার নির্বাণের চেয়ে জগতের নির্বাণই আসল। এই নতুন যে দল এলো, তারা নিজেদের মহত্ত্বর ভাবনার জন্য নিজেদের থিওরির নাম দিল ‘মহাযান'। আর প্রত্যেকযান এবং শ্রাবকযান কে স্বার্থপর বলে গালি দিয়ে দেগে দিল ‘হীনযান' বলে।”
“আর ওরা ছেড়ে দিল?”
“নাহ, সে কি কেউ ছাড়ে! তারাও লড়ে গেল। বলল, স্বয়ং বুদ্ধদেব এসব কিছু বলে যান নি। তোমরা কে এসব নতুন থিওরি খাড়া করার? মহাযানীরা মুচকি হেসে উত্তর দিল, বলে গেছেন - তোমাদের খাজা কাঁঠালের মত মাথায় ঢোকেনি এই যা! ভগবান বুদ্ধের কথার একেবারে লিটেরাল মীনিং নিয়ে বসে আছ। অন্তর্নিহিত অর্থটা তোমাদের ট্যান হয়ে গেছে! - এসব নিয়ে দেদার বচসা চলতে থাকল। মোদ্দা কথা হল মহাযান বুদ্ধের থেকেও ধর্মকে বেশী গুরুত্ব দেয়। তাদের কাছে বুদ্ধ একজন রক্তমাংসের মানুষ নন, বরং একটা কসমিক ফিগার - কোন জাগতিক ফিজিক্সের সূত্রে তিনি আবদ্ধ নন।”
“উরি বাবা! কীসব কঠিন জিনিস! যান বুঝতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেলাম।” শুভর খিদে পেয়েছে বুঝতে পারছি। আর ঠিক তখনই রবি ঠাকুরের ডাক পড়ল। খিদে যে আমারও পায়নি তা নয়। তবে শুভ ডাক শুনেই যে লঙ জাম্পটা দিল সেটা অলিম্পিকে দিলে একটা মেডেল জুতেই যেত। লাফ দিয়ে দরজা থেকে অস্তমিত হওয়া শুভর দিকে তাকিয়ে জয়দা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই ছেলেটার আর নির্বাণ লাভ এ জন্মে হবে না!”
(ক্রমশঃ)
এটি বিস্ময়কর যে, "সংসার ধর্ম আর ভাল লাগছে না" একারণে নয়, বরং দ্বন্দ্বের মীমাংসার জন্য সিদ্ধার্ত প্রাসাদ ছেড়ে সন্যাস নেন। এখানেই অন্য সন্যাস ধর্ম প্রচারকদের সংগে তার পার্থক্য। আবার বুদ্ধ পুরোপুরি সংসার ধর্ম ত্যাগ করতে বলছেন না, শুধু কিছু নির্দেশনা পালন করতে বলছেন, মধ্যম পন্থা । এইখানে তিনি জিতে গেছেন।
যদি ভুল বলে না থাকি, আরও বিস্ময়কর যে তিনি ভগবান, শয়তান, স্বর্গ ও নরক সম্পর্কে আশ্চর্য নিরব ছিলেন। "নির্বান" এর গুরুত্ব তথাগতের কাছে এতটাই প্রধান, আর কর্মফল ও পুনর্জন্ম।
তার মৃত্যুর পর সম্ভবত হিন্দু ধর্মের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্তির আশংকা থেকেই বুদ্ধকেই ভগবান বানিয়ে তার মূর্তি পূজা শুরু হয়, বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ হতে থাকে, বিশাখাসহ তার প্রধান শিষ্য-শিষ্যার বাণীও যুক্ত হয় ধর্মে, সব মিলিয়ে ধর্মটি একটি আকার পায়।
সৈকত দা, শুভর মতো নারকেল মাথার প্রশ্ন, "বিশুদ্ধ বুদ্ধের বাণী নির্ভর বুদ্ধ ধর্ম" বলে কী কোনো প্রচার ছিল, বা এই মতের অনুসারী?
পরের পর্ব জলদি প্লিজ।
ভাই বিপ্লব, তোমাকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই এমন মন দিয়ে প্রতিটি পর্ব পড়ার জন্য।
তোমার কথাগুলি ঠিকই। আসলে বৌদ্ধ দর্শন এত খটোমটো যে সে সব এখানে লিখে লেখাটিকে ভারাক্রান্ত করতে চাই নি। তাই কিছু বেসিক জিনিস সহজ করে বলার চেষ্টা করেছি। মানে, অন্তত আমি বইপত্র পড়ে যেটুকু বুঝেছি আর কি!
'বিশুদ্ধ বুদ্ধের বাণী নির্ভর' ধর্ম হয়ত বুদ্ধের মৃত্যুর শদুয়েক বছরের মধ্যে লোপ পেয়েছে। কারণ বুদ্ধ যে সমস্ত নিয়ম পালন করতে বলেছিলেন সেসব সবাই নিজের মত করে পরিবর্তন করে নিয়েছে। তবে হ্যাঁ, 'প্রত্যেকবুদ্ধযান' কে বুদ্ধ নিজে স্বীকার করে গেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাই বলছেন।
এই তাহলে ঘটনা! উড়ুক
ভালো হয়েছে।
দারুন হচ্ছে লেখা। চালিয়ে যাও সৈকত। তোমার লেখনী অক্ষয় হোক।
আগে খেয়াল করিনি। অনিমেষ বলল তুমি আমাদের লুরুতে বদলি হয়েছ। এই লেখাটার কথাও বলল। চার পর্ব পড়ে ফেললাম।
বেশ ভাল লাগছে। পরবর্তীর অপেক্ষায়।
পড়ছি। ভালো লাগছে। পরেের পর্বের অপেক্ষায় আছি।
যান নিয়ে জট পাকিয়ে লেখা ভারাক্রান্ত করতে চাইনি। কথার ফাঁকে ফাঁকে এসব নিশ্চয়ই বলবে জয়দা। পড়তে থাকুন। :)