গত নভেম্বর থেকে কোভিড-১৯ অসুখ মানবদেহে প্রকট হতে শুরু করে, বিগত পাঁচমাসে বস্তুত কোনও সর্বশরীর গ্রাহ্য চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরি হয় নি এই রোগের জন্য। প্রতিষেধকও যে সহজলভ্য হবে না তা বিলকুল বোঝা যাচ্ছে। ফলে, এই মুহূর্তে বিজ্ঞানের হাতে এই রোগের সুরাহা আছে, এরকম নয়। আর তাই, একমাত্র রাস্তা হিসেবে মানবগোষ্ঠীগুলির হাতে থাকছে রোগকে এড়িয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করা। চিকিৎসা-চেতনার চলতি ধারণার নিরিখে এ এক ব্যতিক্রম বৈ-কী! আমাদের মধ্যে স্বচ্ছল শ্রেণির রোগভোগের মূল কারণ তার জীবনশৈলীজনিত; আমরা এই ধারণা নিয়েই বাঁচি যে শরীরের উপর অত্যাচার অনাচার যাই করি না কেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান আমাদের বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। পরিমিত আহার, নিয়ন্ত্রিত যাপন বা কায়িক শ্রমের মধ্যে এক ভোগবিবর্জিত কৃচ্ছ আছে, তার চেয়ে ডাক্তার-পথ্যের আশ্রয় নেওয়া সহজতর আমাদের কাছে। তার উপর, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি বলতে ইদানীং আমরা পেয়ে এসেছি ম্যাজিকপ্রতিম এক বিস্ময়। আমরা নিজেরা সামান্যতম আয়াস স্বীকার করিনি, কিন্তু আমাদের মুঠো ভরিয়ে দিয়েছে নতুনতর প্রযুক্তি, সেলফোন, গাড়ি, এম্বেডেড সিস্টেমে। জীবন ও দুনিয়ার সকল সমস্যায় আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞান স্বর্গলোকের সমাধান নিয়ে আসবে। সেখানে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় বিজ্ঞান আর পাঁচটা সামাজিক ক্রিয়ার মতন একটা পদ্ধতি হয়েই দেখা দিচ্ছে, যার মধ্যে বিজ্ঞানী-কৌমের সমষ্টিগত অর্জন আছে, সেখান থেকে ভাইরাসটিকে বোঝার চেষ্টা আছে আর সেই বোঝার উপর দাঁড়িয়ে তার চিকিৎসা বা ভ্যাক্সিন প্রস্তাব করা এবং ডাক্তারি-গবেষণার পর্যায়গুলি মেনে সেই প্রতিষেধকের গ্রাহ্য হয়ে ওঠার পর্যায়টি আছে, যা ম্যাজিক নয়, সময় ও শ্রমসাধ্য পদ্ধতি। এর পাশাপাশি দেখছি এই রোগের সংক্রমণ হার এত বেশি যে উন্নততম দেশগুলোর পরিকাঠামো অবধি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে।
ফলে, এই মহামারীটি আমাদের চলতি পৃথিবীকে তার চিন্তনের জগতেও এক বিপর্যয়ের সামনে এনে ফেলেছে, যেখানে বিজ্ঞানের স্বাভাবিক চলনে রোগটিকে কাবু করা যাচ্ছে না। বরং একমাত্র উপায় হয়ে উঠছে রোগের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো আর সেইটা করতে গিয়ে অর্থনীতির পা হড়কাচ্ছে। অথচ, আমরা একাধিক মহামারীর মধ্যে বাস করেছি। কেবলমাত্র যক্ষ্মারোগে ভারতে দিনপ্রতি গড়ে ৬৫০ জন মারা যান। কিন্তু, এই রোগগুলির মোটের উপর চিকিৎসা আছে, আর প্রান্তিক লোকজন এর শিকার হন, যাঁরা আমাদের চোখেই পড়েন না, তার তুলনায় কোভিড-১৯-এর ধ্বংসলীলা অনেকগুণ স্পেক্ট্যাকুলার। বিত্তনির্বিশেষে মানুষ এর সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। কোভিড-১৯ সামলানোর পদ্ধতিটিও অনুরূপ দর্শনীয় হয়ে উঠছে। আমরা লকডাউনের এক বিপুল আয়োজন দেখছি, যার মধ্যে দিয়ে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির প্রায় ধুধধুরি বেজে যাচ্ছে। অর্থনীতি-রাজনীতির আঙ্গিনায় প্রায় নিষিদ্ধতম উচ্চারণ এখন সরকারগুলির মুখে শোনা যাচ্ছে, মানুষকে নাকি ঘরে বসিয়ে খাইয়ে যেতে হবে, এই রোগের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে। এইবছরের অর্থনীতির নোবেল যিনি পেয়েছেন, তিনি বলছেন সরকারকে টাপা ছাপিয়ে লোকের হাতে তুলে দিতে হবে, সেই প্রভূত ইনফ্লেশনই নাকি টিকে থাকার একমাত্র উপায় হবে। অগুণতি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, আরও অগুণতি মানুষ হারাবেন- দরিদ্র মানুষের দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
ভারতের আধুনিক ইতিহাসে মারী বা মড়ক খুব কম আসে নি। মধ্যযুগের ভারতে বহু উপদেবতার আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা মারী হতে মানুষকে বাঁচানোর জন্য পুজো পেয়েছেন। যদিও প্রাক-বৃটিশ যুগে মড়কের মহামারী হয়ে ওঠা ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়, তবু আচার বিচারের গণ-অভ্যাসে সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে সংঘাতের স্মৃতি উঁকি মারে। ব্রিটিশ যুগের একদম গোড়ার থেকে এদেশে মহামারীর ঘনঘটা দেখা যায়। প্রাক-বৃটিশ ভারতে সমাজ খুবই শক্তিশালী ছিল, গণস্বাস্থ্য, গণশিক্ষার দায়িত্ব সমাজের হাতেই থাকত। ব্রিটিশ লুন্ঠনের মুখে সামাজিক সংগঠনগুলি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব প্রভূত বাড়তে শুরু করে। কখনো দেখি গুটিবসন্তের মহামারী ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেমে আসছে, কখনও দেখি কলকাতা শহর গঠনের শুরুর পর্যায়ে এই অঞ্চল থেকে কলেরা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র সাম্রাজ্যে। বাইরে থেকে এদেশে আসা মহামারীর ক্ষেত্রে দুটি আলাদা করে উল্লেখযোগ্য, ১৮৯৬-৯৯ এর প্লেগ এবং ১৯১৮-এর স্প্যানিশ ফ্লু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ঐ প্লেগের গুরুত্ব আলাদা করে উল্লেখ করার মতোন। প্লেগ দমনের নামে ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক আইন প্রণয়ন এবং শাসননীতি মহারাষ্ট্রের গুপ্তসমিতিগুলিকে সক্রিয় করে তোলে (প্লেগ কমিশনার র্যান্ড হত্যা), তেমনি প্লেগের ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙলার যুবকদের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরবর্তী যুগের নেতৃত্ব, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সামাজিক আন্দোলনে বিস্তৃত করার প্রাথমিক বনিয়াদও সমভবতঃ প্লেগের ত্রাণ থেকে গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য গান্ধিজিও সম্ভবতঃ ভারতে তাঁর প্রথম অ্যাক্টিভিজম শুরু করেন প্লেগের সময়েই। হংকং থেকে জাহাজে প্লেগের ইঁদুররা ভারতের বিভিন্ন বন্দরে এসেছিল। ক্রমে তারা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগ কীভাবে ছড়ালো, তার সূত্র গান্ধিজি হিন্দস্বরাজে দিয়েছেন- "যদি রেল না থাকত, হিন্দুস্তানে আজ প্লেগের যে বিস্তার তা থাকত না। রেলে প্লেগের বিস্তার হয়। রেল না থাকলে লোকের এদিক সেদিক যাতায়াত কমে যেত, আর ছোঁয়াচে রোগ দেশময় বিস্তৃত হতে পারত না। আগে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাধির সংক্রমণ থেকে পৃথক হয়ে থাকতাম। রেলে দুর্ভিক্ষও বেড়েছে"। হিন্দস্বরাজের এই অধ্যায়ে তিনি দেশের দুরবস্থার এক অন্যতম কারণ হিসেবে রেলকে চিহ্নিত করেছেন। এর পূর্বপ্রেক্ষিত দেখতে গেলে আমাদের রমেশ চন্দ্র দত্ত-র ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া বইটিতে একটু তাকাতে হবে। রমেশচন্দ্র ১৮২৮-৩২ সালের ব্রিটিশ দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখছেন কীভাবে ভারতের মানুষের দেয়া ট্যাক্সের টাকার ব্যায় সেচ এবং অন্যান্য জনমুখী খাতে বন্ধ হয়ে যায়, আর সেই টাকায় শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক স্বার্থে ভারতের রেলব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তিনি দেখাচ্ছেন ১৯০০ সাল অবধি রেলে যত বিনিয়োগ হয়েছে, তত বিনিয়োগ কমেছে সেচব্যবস্থায়। এবং ব্রিটিশ আমলাদের কেউ কেউও এই বিষয় লক্ষ্য করে নোট দিয়েছেন, রেল-এর পশুশক্তির বদলে জলপথ পরিবহনে জোর দিতে বলেছেন।
একথা নিশ্চিত যে, দ্রুতগামী যান, যেমন রেল, প্লেনই মারীর মহামারী বা অতিমারী হয়ে ওঠার মূল বাহন। এবং এই পরিকাঠামো জনগণের টাকায় গড়ে ওঠে, তাদের সরাসরি কল্যাণকর কাজগুলির বরাদ্দ বঞ্চিত করেই। আমরা দেশজুড়ে যে বিশাল এয়ারপোর্ট আধুনিকীকরণের উদ্যোগ দেখছি গত দশক থেকে, তার কতটুকু আসলে গরিষ্ঠ জনতার কল্যাণ করছে সে প্রশ্ন উহ্য থেকেই যায়। বাণিজ্যের এই সংগঠন, বৃহিৎ বাণিজ্যের সুবিধার্থে বিশাল পরিকাঠামো গড়ে তোলা এই ধনতান্ত্রিক যুগের লক্ষণ এবং এই সংগঠনের পিছনে জনগণের শ্রমের মূল ভাগ নিয়োজিত হয়। এর ফলে নিশ্চিতভাবে বরাদ্দ কমে আসে গণমুখী কল্যাণপ্রকল্পগুলির। প্রাক ব্রিটিশ বাংলা যখন পৃথিবীর এক বিশাল অংশে বস্ত্র সরবরাহ করত, সে বিকেন্দ্রিভূত, অসংগঠিত উৎপাদন এবং বাণিজ্যের এক মডেল চালাত। কোনও বৃহৎ শিল্পবাণিজ্য লাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ সেখানে ছিল না। ঐতিহাসিক দলিলগুলিতে দেখি, সেইসময়ে বাংলায় মানুষ মোটের উপর স্বচ্ছল। উত্তর-পলাশি যুগে বাংলার বয়নশিল্প ধ্বংস হল, বিশ্বের বস্ত্রবাজাররের উৎপাদন শুরু হল ইংল্যান্ডের মিউল গুলিতে। সেখানে স্থানীয় লোক বড় সংগঠিত মিলগুলিতে কাজ করতে শুরু করল, আর আশ্চর্যের বিষয় তাদের জীবনধারণ আগের থেকেও খারাপ হয়ে পড়ল (ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা, এংগেলস, ১৮৪৫)। অর্থাৎ, একই উৎপাদনে যখন বিকেন্দ্রিভূত সামাজিক শিল্পব্যবস্থা মানুষকে স্বচ্ছলতা দিত, বৃহৎ শিল্প সংগঠনে সে সংখ্যাগরিষ্ঠের দুরবস্থার কারণ হল। হয়ত কিছুটা একই ভাবে সংগঠিত শিল্পভিত্তিক ধনতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র শহরগুলি গড়ে ওঠার সময়ে সেখানে মানুষের ভালো থাকার মূল অক্ষগুলি অবহেলিত হল, কারণ এই শহরের বিকাশ হল কেবলমাত্র ঐ কেন্দ্রিভূত উদ্যোগ ও বাণিজ্যকে পুষ্ট করার স্বার্থে। তাই কি আমরা দেখতে পারি উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা হয়ে ওঠে এশিয়াটিক কলেরার বিশ্ব-আঁতুরঘর?
এবার, স্প্যানিশ ফ্লু-র প্রসঙ্গে আসি। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারী ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধফেরত সৈন্যরা বোম্বাই বন্দরে এই রোগ নিয়ে আসে, সেইখান থেকে ভারতের বাকি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়ার প্যাটার্ন যদি দেখি, বোম্বাই থেকে যত দূরে গেছে এর প্রকোপ তত কমেছে, বাংলায় স্প্যানিশ ফ্লু সেরকম সাড়া ফেলে নি, পরিসংখ্যান সেরকমই। এও খেয়াল করা যায় ওই সময়ের বাংলা সাহিত্যে কলেরা ম্যালেরিয়া যক্ষ্মা বসন্ত ছড়িয়ে রয়েছে, স্প্যানিশ ফ্লু বলতে গেলে নেই-ই। স্প্যানিশ ফ্লু ভারতে এক কোটির বেশি প্রাণহানি ঘটায়। কিন্তু, যুদ্ধফেরত সৈনিকদের মূল (সম্ভবতঃ একমাত্র) পোর্ট অফ এন্ট্রি বোম্বে হওয়ায়, এই রোগের ধাঁচ হয় বোম্বে থেকে বিকীর্ণ হয়ে তার প্রকোপ যত দূরে গেছে তত কমে এসেছে এরকম। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না, শিক্ষা নিয়ে ভারতে যদি একটি বা দুটি মাত্র পোর্ট অফ এন্ট্রি চালু রাখতাম, যদি বাইরে থেকে আসা যাত্রী ও বিমান সংখ্যা কমাতাম, কোভিড-১৯কেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়ত সম্ভব হত। কতিপয় মানুষের আন্তর্দেশীয় চলাচল বন্ধ রাখলে বাকি বিশাল সংখ্যক মানুষকে সংক্রমণের আশঙ্কা বা বেরোজগারির দুরবস্থার মধ্যে একটা বেছে নিতে হচ্ছে এই আতান্তরে পড়তে হত না। আশ্চর্যের বিষয়, এইসব হিং টিং ছট প্রশ্ন আর আমাদের মাথার মধ্যে কামড়ায়ও না। কারণ আমরা ধনতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায়ে আছি, যার নাম বিশ্বায়ন। আমাদের অঙ্কবইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার গ্রোথ আর ফরেন ইনভেস্টমেন্ট!
আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না, কারণ ঐতিহাসিকভাবেই আমরা একটা ভুল অর্থনৈতিক মডেলে গত আড়াইশ বছর হাঁটছি। শিক্ষা নিতে গেলে সেই মডেলটাকেই নাকচ করা হয়ে যায়, যা আমাদের আত্ম-অস্বীকৃতির সমতুল্য হবে! লকডাউনের দেশে আমাকে নিজের ঘরের কাজের একাংশ নিজেকে করতে হচ্ছে। দেখছি তাতে যা সময় যাচ্ছে তাতে আমি আমার মূল যে কাজটা ওয়ার্ক ফ্রম হোম হিসেবে দেওয়া আছে সেটাই করে উঠতে পারছি না। অথচ এই কাজটার জন্য আমি যে মাইনে পাই, তার ১/১০০ ভাগ পান সেই মহিলা যিনি আমার গৃহসহায়িকা। তার মানে আমার পেশাগত জীবন বস্তুত এক পরজীবিতার উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ১/১০০ ভাগ মাইনে নিয়ে আমাকে নিজের জীবনধারণের কাজগুলো করার থেকে অব্যাহতি না দিলে আমি বাকি ৯৯ ভাগ উপার্জনের কাজ করেই উঠতে পারব না! তবে এই হিসেব ভারতবর্ষের নিরিখে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মানুষ অধিক পরিশ্রমী, নিজের গৃহস্থালীর কাজ নিজেই করে নেন। তাস্বত্ত্বেও পরজীবিতার সেখানে মডেল অচল তা নয়, সামগ্রিক ভাবে অগ্রণীসমাজগুলি দাঁড়িয়েই আছে পিছিয়ে পড়া সমাজসমূজকে ১/১০০ বা আরও কম প্রদেয় দিয়ে। আমরা এও দেখছি অর্থনীতি যত উন্নত হচ্ছে প্রকৃতি তত বিপর্যস্ত। গত কুড়ি বছরের কার্বন এমিশনের গ্রাফ দেখলে একমাত্র বিশ্ব-মন্দায়নের ২০০৯ ছাড়া সব বছরেই এমিশন আগের বছরের থেকে বর্ধিত হারে বেড়েছে। অর্থাৎ, এই অর্থনীতির মডেলে মন্দা না এলে প্রকৃতি বিপন্ন হবে। আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি, এই মডেল হাজার বছর চলার নয়, একশ বছর তো নয়ই। কিন্তু, আমাদের ভরসা ওই বিজ্ঞানের ওপর, সে নাকি ম্যাজিকের মতন এর সুরাহা এনে দেবে। এমন শক্তি এনে দেবে যা কার্বন এমিট করে না, এমন প্লাস্টিক বানিয়ে দেবে যা দূষণ ছড়ায় না, ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যদি তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলিকে ভেঙে ফেলতে পারত সেটা হত বটে। দুঃখের বিষয় বিজ্ঞান সেখানে নেহাৎ-ই নিয়মের নিগড়ে বাঁধা এক প্রক্রিয়া, ঐশী চমৎকার নয়।
কোভিড-১৯ সেই দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে, যারা এই অর্থনৈতিক মডেলে অগ্রণীতম। আমদানি-রফতানিতে এগিয়ে থাকা প্রথম কুড়িটি দেশে থাকাই যেন এই মহামারীর তালিকায় এগিয়ে থাকার পাসপোর্ট (ইরান বাদে)। তাদের মধ্যেও সেই দেশগুলি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে যাদের আমদানি-রফতানি জিডিপির ৩০%-এর কিছু বেশি। অর্থাৎ, যেসব দেশের টিকে থাকা বাইরের দেশের উপর নির্ভরশীল, তারা এই মহামারীর কাছে তত ভালনারেবল। যেখানে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের আবশ্যকতা কম, সেখানে অবস্থা তুলনায় সহনীয়। ভারতেও যদি দেখি, মেট্রো শহরগুলির মধ্যে বিদেশ-যোগাযোগ সবচেয়ে দুর্বল কলকাতায়, আর নিশ্চিতভাবে সেইজন্যই, কোভিড-১৯-এর ছড়িয়ে পড়া কলকাতায় কম। ভেবে দেখলে লক ডাউনের যুগেও সেইসব এলাকার মানুষ সহজে বাঁচতে পারবে, যেখানে বৈশ্বিক যোগাযোগের প্রয়োজন কম, নিজের চাল-ডাল-সবজি-মাছ-দুধের কিছু নিজে বানিয়ে নেয়। সেইসব মানুষও কাজ চালাতে পারবেন, যাঁরা মূলতঃ স্থানীয় মানুষের জন্য কাজ চালান। ধরা যাক, যদি এরকম একটা মডেল থাকত যে ন্যূনতম খাওয়া পরার নিরিখে প্রতিটি অঞ্চল স্বয়ংসম্পূর্ণ, ব্যাপক হারে লক ডাউন করার কোথাও কোনও প্রয়োজন হত না। সে শুধুমাত্র বাইরের থেকে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে চালিয়ে নিতে পারত। ভারতের কয়েকটি গ্রাম লকডাউনের নিজস্ব অর্থ বানিয়ে নিয়েছে গ্রামের বাইরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে। সমস্যাটা হল আমাদের ব্যবস্থায়, কোনও গ্রাম বা জেলা কে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দিকে লক্ষ্য দেওয়া হয় না, বরং লক্ষ্য রাখা হয় সে যাতে পরজীবিতার অর্থনীতিকে পুষ্ট করে যেতে পারে, শহরকে রসদ জুগিয়ে যেতে পারে।
আসল অসুখ তাই, এই অর্থনীতির মডেলটির। সেই মডেলের বিকাশের পর্যায়ে ধনতন্ত্রের সবচেয়ে দুর্বিষহ রূপটি আমরা দেখছি বিশ্বায়ন নামে। চিনেরা কয়েক হাজার বছর ধরে হয়ত প্যাঙ্গোলিন খেয়ে এসেছে, তা থেকে রোগ-বিসুখও হয়েছে নিশ্চয়ই। এই কোটি কোটি এয়ারলাইন্স আর হাইস্পিড রেল না থাকলে এই অসুখ চিনের কিছু প্রদেশে থাকত, ক্রমে লোকে সুস্থ হয়ে উঠত। কিন্তু, বিশ্বায়নের ম্যাজিকে সেই রোগ আমার আপনারর ঘরের চাল ডাল দুধের বোতলে লেগে থাকছে। রোগ থেকে বাঁচতে কোটি কোটি মানুষকে নিশ্চিত অর্ধাহার-অনাহারের পথে হাঁটতে হচ্ছে, সেখানে হয়ত কয়েক হাজার লোককে যাতায়াত কম করতে দিলেই এই রোগ আসত না। বস্তুত এই রোগ বড়লোকেরা এনে গরিবদের দিচ্ছেন! বিশ্ববাণিজ্যের এক সামান্য উপসর্গ কোভিড-১৯ অতিমারী। উপসর্গকে এড়াতে গিয়ে যেই না বিশ্ববাণিজ্যকে একটু থমকে যেতে হচ্ছে আর কলকাতার আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে আর ব্রহ্মপুত্রের জলের স্বচ্ছতা বাড়ছে। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এবছর দক্ষিণবঙ্গে বজ্রপাতে কম লোক মারা যাবেন। অর্থনীতি থমকে গেলে প্রকৃতি সুস্থ হচ্ছে। তবে, এই অর্থনীতির থমকে থাকার ফল ভুগতে হচ্ছে কোটি জনতাকে, কারণ তাদের উৎপাদনশীলতার বিকাশ হয়েছে সিস্টেমের দাসত্ব করবার জন্য, নিজের খাওয়া পরাটুকু নিজেরা জোটানোর সামর্থ্য তাদের আসেনি, আমাদের চাষ অবধি পেট্রোপণ্য নির্ভর!
এবার বসন্ত গত হলে, আবার আমরা ওই বিশ্বায়িত পুঁজির মডেলেই ফিরে যাব। এ কথাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় সভ্যতার এই মূল অসুখের বিবিধ উপসর্গ, সে প্রকৃতির বিপর্যয় হোক, সংস্কৃতির বিপর্যয় হোক বা কৃষকের আত্মহত্যার মহামারী হোক, বারে বারে ফিরে আসবে। আর, যতক্ষণ না আমরা ব্যবসাটাকে কামড়ে ধরতে পারব, ঐ উপসর্গের চিকিৎসাই হাতড়ে যেতে হবে!
এই লেখাটার মূল সুরের সাথে আমি একমত। সুকি বা এস যে সব সরলীকরণের কথা লিখেছেন তা ভুল নয়, তবে এক্ষেত্রে আমার মনে হয় পুরো বিষয়টাই এতটাই জটিল (৭০০ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন) যে এবিষয়ে যাই লেখা হোক তাতে কিছুটা সরলীকরণ থাকবেই। ডাস ক্যাপিটালেও ছিল। পুরোটা কভার করে লিখতে গেলে কোন লেখাই আর হবে না।
আমাদের পরমুখাপেক্ষী পরজীবি জীবনযাত্রা নিয়ে যেটা লিখেছো সেটা ভীষণভাবে আমারও মনে হয়। ওঁরা ওঁদের প্রাপ্য অর্থের অনেক কমে, আমাদের সাধ্যের মধ্যে এসে কাজগুলো করে দিচ্ছেন বলেই আমাদের এই জীবনযাত্রা অ্যাফোর্ড করা সম্ভব হচ্ছে
ভারতে রেলপথ পাতা প্রাশাসনিক ও বাণিজ্যিক সুবিধের জন্য পরিকল্পিত না?
আমেরিকাতে গোল্ডরাশের সঙ্গে জড়িয়ে। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারও কি যেন সব খুব প্র্যাকটিকেল কারনে যদ্দূর মনে পড়ে।
হাল্কা শক্ত নৌকো সব, নতুন দেশ দেখা ও লুটপাট করার জন্যে (নেটফ্লিক্স্ ভাইকিংস দেখছি কিনা :))
কার্যকারন সম্পর্ক জটিল কিন্তু বহুমুখিও।
গুহায় ফিরতে হবে কিনা সেই প্রশ্ন অবশ্য এই আলোচনায় বোধয় আসবেই। লোকজনও কি দেশ দেখবে না, এক মহাদেশ থেকে অন্যত্র যাবে না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তো স্পষ্ট আমাদের কাছে। কিন্তু মূল প্রস্তাবের সঙ্গে এগুলো কী করে অ্যাকোমোডেট করা হবে তা আমার জানা নেই।
আবার, মূল প্রস্তাব বোধয় ঠিক সেরকম নয়। আবিষ্কার গুলির ইকনমিক ভায়াবিলিটি সরিয়ে, ডিসপ্লেসমেন্টকে বাধ্যতার বদলে বাছাইয়ের আওতায় আনলে কি হবে সেসব।
এক পুলিসকর্মীর জবানী- সাতজন শ্রমিক খড়গপুর থেকে হেঁটে ওড়িষার কোন গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, রাতে পুলিশ ধরে উত্তাল ক্যালায়, প্রথমেই। এবার পবঙ্গ তাদের রাখতে চাইছে না, ওড়িষা তাদের নিতে চাইছে না। তো, এই হৃদয়হীন ব্যাবস্থাটা সিরিয়াসলি ফ্লড।