গল্পের আগে, পরে এবং কেন্দ্রবিন্দুতে : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব | ২৭ অক্টোবর ২০২০ | ৩৩৭২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
সরমা ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। এক পা বাড়িয়ে আবার ফিরে গিয়ে আঁট করল দরজার ছিটকিনি। অনাবশ্যক, কারণ গোটা বাড়িতে আর কেউ তো নেই। টাবুদির বিয়েতে গেছে সবাই। সামনে সরমার পরীক্ষা তাই ওর না যাওয়াই সাব্যস্ত হয়েছিল। সরমা অবশ্য এতসব কিছু ভাবছিল না, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। তার মধ্যেই দক্ষিণের জানালায় এসে জংলাসবুজ পর্দার স্প্রিং টেনে নাবিয়ে দেখল একবার বাইরেটা। আকাশে বেশ রং ধরেছে এখন, এই সময়টাকেই কি গোধূলি বলে? দূরে দূরে অনেক আলো জ্বলতে শুরু করেছে যদিও। সরমার চোখ গেল হাঁদুলের চায়ের দোকানে। ওরা কি এদিকেই তাকিয়ে আছে? এর পর কি প্যাঁচ কষবে তার হিসাব নিকাশ করছে? সরমা কি ভুল করল এইভাবে রিয়াক্ট করে?
ভয় : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : নববর্ষ | ১৫ এপ্রিল ২০২১ | ২৪৫১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আরে ধুর, ছেলেটা হাত দিয়ে যেন হাওয়া তাড়ায়। এক জায়গায় দুবার কখনও হবে না, টেররিস্টরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আবার কোথাও করবে, পুলিশ টিকিও ছুঁতে পারবে না।
পুলিশও কোন ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। দুই টেররিস্ট তো পরশুদিনই এনকাউন্টারে মারা গেছে। একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পরে সুবিমলের মুখে। কিন্তু কি অডাসিটি , তারপরেও আবার ব্লাস্ট হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ? গমগম করে ওঠে সুবিমলের গলা। পাকিস্তানের মদত আর ট্রেনিং। সবকটা মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলে তবে যদি কিছু হয়।
কিন্তু এনকাউন্টার করল কেন? খবরের কাগজ থেকে মুখ সরাল উপরের বার্থের লোকটা এবার। ওদের ধরতে পারলে তো বরং কিছু খবর জানা যেতো। হয়তো পরের ব্লাস্টটা হত না।
সবাইকে চমকে দিয়ে সালমা বলে ওঠে, আল্লা জানেন, পিছন থেকে গুলি করে মেরেছে ছেলেটাকে, ওদের হাতে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। তার জলভরা চোখ বোরখার সীমানা ছাড়ায়।
হঠাত কামরাটা এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে সুবিমল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বেশ করেছে, এতগুলো নিরীহ লোকের জান নিতে ওদের তো হাত কাঁপেনি। দেশের দুষমন সব। ধরে ধরে সবাইকে গুলি করে মারা উচিত।
সালমার কান্না আর নিঃশব্দ রইল না। বাধ্য হয়ে রমাকে বলতে হল , তুমি থামো তো একটু। সব জায়গায় গিয়ে তোমাকে পুলিশগিরি করতে হবে না।
সংক্রমণ : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : ইদের কড়চা | ২৮ মে ২০২১ | ২৫৬৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এই অ্যাপার্টমেন্টটায় এসেছে মাস গড়ায়নি। আটতলা বাড়ির পঞ্চম তলায় ওরা। পাশাপাশি এরকমই লম্বা ফ্ল্যাটের দুটো সারি, আটটা ব্লক মুখোমুখি। সেরকমই কোন পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে শৈলী। ছি:, শৈ কী করছো বলো তো? অন্যের বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারছ! বিরক্তির সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বরটা উঁচুতে উঠছিল সুকোমলের। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল শৈলী। ডান হাত দিয়ে সুকোমলের কবজি ধরে টান দিল। কী ব্যাপার, চোর টোর নাকি? দেওয়াল বেয়ে উঠছে? সুকোমল এসে জানালার বাইরে চোখ রাখল। পাশের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকটার জানালাটা একদম মুখোমুখি, মাঝখানে ফুট তিরিশেকের ব্যাবধান। সেই জানালার পর্দা পুরো সরানো। সেখানে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সুকোমল। এ কী দেখছে?
নকশিকাঁথা (১) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৭ জুলাই ২০২১ | ২৮৪৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
তার দৌড় ছিল খিদিরপুরের জাহাজঘাটা অবধি। একটা বড় বাক্স ভরে গেলেই একদিন নৌকায় করে হুগলি নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাও কলিঙ্গা বাজার। খিদিরপুর। কলিন লেন, টার লেনে জাহাজে মাল চড়ানোর জন্য বসে আছে চিকনদারি কাজের ব্যবসাদার। মাল পাঠাবে নিউ অরলিন, চার্লেস্তান, সাভানা আর কীসব খটমটো নামের সব জায়গায়। আলেফ সেসব হদিশ জানত না তখন। কে বিক্রি করে কাকে তাও না। আলেফের চাচা মোকসাদ আলি আগে এই কাজ করত, তারপরে চলে গেল ওই দেশে। তার কাছেই শুনেছে সে নাকি বসেছে এখন নিউ ইয়র্কের ডকে। মাল পৌঁছালে চলে যায় তার কাছে কি তার মত আরও সব লোকজন যে যেখানে আছে। চাচা যে এরপর তাকেও সঙ্গে নিতে চাইবে তখনো খবর ছিল না আলেফের।
নকশিকাঁথা (২) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২৫৬২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
ভোগান্তি হয়েছিল অবিদুল্লাহেরও। ওর চোখ টেনে কী যে দেখেছে, জামার উপর চক দিয়ে দাগ টেনে দিল। ওকে টেনে একদিকে নিয়ে গেল আরও কীসব পরীক্ষা করতে।
এইসব প্রশ্ন, তত্ত্বতালাশ পেরিয়ে জার্মান কসাই, ইহুদি দর্জি, জাপানি সুসি কারিগর, নরওয়ের চাষি, পোলান্ডের সিগার কারখানার কর্মী সবাই নেমে গেল। তারা কেউ যাবে পেনসেলভেনিয়া, কেউ মিশিগান, কারো রাস্তা ভার্জিনিয়ার দিকে। রয়ে গেল শুধু বারো জন চিকনের ব্যাপারি। আর দুজন চিনা। চিনাদের ব্যাপারটা আরও গোলমেলে, চাইনিজ এক্সক্লুসান অ্যাক্টে ওদের এই দেশে ঢোকাই এখন মুশকিল। তার উপর ওদের কথাও কেউ সহজে বুঝতে পারে না।
নকশিকাঁথা (৩) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩১ জুলাই ২০২১ | ২৫৮৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এই কথায় ঝর্নার জলের মত স্রোতস্বিনী আমিনা থমকে দাঁড়াল যেন কোন জিন পরী ওকে হঠাৎ পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে, তার আর নড়াচড়ার তাকত নেই, যেন শুধু আমিনা না তার চারপাশের পৃথিবীটাই ওমনি চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বলল আমিনা যার অর্ধেক কথা নোনা বাতাস চুরি করে নিয়ে গেল, আর বাকি আধখানা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেল। তারপর আমিনা ধীর গতিতে নিজের দুই হাতের পাঞ্জা এক করে নিজের মুখের উপর পান পাতার মত ছড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই এক দমকা হাওয়ার মত কোথায় চলে গেল আমিনা, আলেফ আর দেখতে পেলো না।
নকশিকাঁথা (৪) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৭ আগস্ট ২০২১ | ২৩৮৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
উচ্চৈঃস্বরে হাসলেন বিবেকানন্দ। তাঁর স্বচ্ছ ধারালো চোখে কোন ছায়া ঘনাল না, কণ্ঠস্বর তেমনি ভাবগম্ভীর এবং দৃঢ়। আপনার শরীর নিয়ে আমার কোন কৌতূহল ছিল না, জানতে চেয়েছিলাম এই পোশাক আপনি কোথায় পেলেন।
সারার চোখ এবার আনন্দে চকচক করে উঠল। আমি অনেক খুঁজে এই পোশাকের প্রতিটা উপকরণ সংগ্রহ করেছি। প্যারিস আর লন্ডনের বিভিন্ন মিউজিয়ামে গিয়ে হিন্দু নারীর পোশাক দেখেছি, রাজদরবারের নর্তকীর সাজ সজ্জার ছবি দেখেছি। তারপর এই পোশাকের কথা ভেবেছি। তবে এর প্রতিটা উপকরণ সংগ্রহ করতে আমাকে অনেক কসরত করতে হয়েছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন বুঝি?
নকশিকাঁথা (৫) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৪ আগস্ট ২০২১ | ২২৮৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
নকশিকাঁথা (৬) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২১ আগস্ট ২০২১ | ২৫৮৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
আমার কাছে আসে তো টাকা বদলে ডলার নিতে। কার কাছে কী টাকা দেখলেই সব বুঝি। কান এঁটো করে একচোট হাসল ডক্টর। রেখেও যায় ওদের টাকা, আমি ওদের হয়ে সুদে খাটাই।
এবার লোকটার আসল ব্যবসাটা বোঝা গেল। গোবিন্দর আরো শোনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আক্রাম আলি পেছন থেকে খালি গুঁতাচ্ছিল। অবশ্য কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক।
ওরা বেরোচ্ছিল, লোকটা পিছন থেকে ডাকল। শোন, শোন। যে পথে যাচ্ছো সেখানে পাউন্ডে দিলে ঘাঁটা পড়ে যাবে তোমাদের। তার চাইতে আমার এখানে ডলার বানিয়ে নিয়ে যাও।
কথাটা সত্যি। লোকটার কাছ থেকে পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে দশ দশ ডলার হাতে নিয়ে বেরোল দুজনে। বোঝা গেল এটা লোকটার সাইড ব্যবসা। কিংবা এটাই আসল, দোকান খুলে রেখেছে শুধু লোক টানার জন্য। ডক্টর লোকটা বেরোবার আগে আর একবার মনে করিয়ে দিল জাহাজ থেকে পালালে তাদের জীবনটা কেমন বেবাক ভাল হয়ে যেতে পারে।
আক্রাম দাঁড়িয়ে থেকে দোকানির কথা শুনতে না চাইলেও, রাস্তায় বেরিয়ে সেই কথা তুলল আবার। জুইতোর কথা কইছে গোবিনদা, জায়াজো আর না গেলে কিতা ওয়?
কথা কইবার বেলা খুব সওজ রে, অতো সুজা বিষয় নায় মনো রাখিস; যুদি একবার পুলিশোর আ'তো পড়স, তে কিতা অইবো?
কেনে, তুমরার ক্লাবার সাব কিতার লাগি? তান আ'তো রেজগি ধরাই দিলেই অইবো।
ওয়, তুমরার ওউ ক্লাবার সাব অখনও টিকিয়া আছে নি দেখ, মরিয়া মাটির মিশি গেছে!
বাপ নাই তে কিতা অইছে, পুয়া ভাতিজা তো বেটার আছে; তারার চলাফিরাত কুনু উঁচনিচ দেখছো নি কুনু দিন?
নকশিকাঁথা (৭) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৮ আগস্ট ২০২১ | ২১৪৬ বার পঠিত
বোঝা গেল টোনিয়ার গলা যতই বাচ্চা মেয়ের মত রিনরিনে হোক, সে নিজেও অনেক ঘাটের জল খাওয়া মানুষ। ম্যানহাটনে বোর্ডিং হাউজ খুলে বসেছে, নিগ্রো হলেও সে হেলাফেলার লোক নয়। তার আশ্রয়ে আরও পাঁচজনা থাকে, তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব টোনিয়ার মাথায়। যেসব মেয়ে থাকে তার বোর্ডিং হাউজে তারাও যে সব ধোয়া তুলসী পাতা সেরকম তো নয়। কিন্তু তারা বাইরে যা করে করুক, নিজের চত্বরে সে কোন ঝামেলা ঢুকাবে না।
টোনিয়ার পিছু পিছু গোবিন্দ সারেং চলল। বেশি দূরে নয়, সেভেন্থ অ্যাভেনিউতে একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। বাইরের দরজার মুখে বোর্ড লাগান – টোনিয়াজ বোর্ডিং হাউজ। তাই বলে এমন কিছু জাঁদরেল বাড়ি নয়, তবে শক্ত পোক্ত। কাঠের দেওয়ালে হলুদ আর বাদামি রঙের পোঁচ খুব পুরনো নয়। বাড়ির একপাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানে সারি সারি ঘর, একেক তলায় পাঁচ ছটা করে হবে। বেশ কটা ঘরে আলো জ্বলছে, আবার দুই একখানা অন্ধকার। দোতলায় ঘরগুলোর সামনে দিয়ে টানা বারান্দা চলে গেছে, বারান্দার রেলিংয়ের মাঝখানের একটা পাট ভাঙা, ঝুলছে। সেদিকে দেখিয়ে টোনিয়া হাসল, দেকেচো ওখেনটা কেমন আড় হয়ে ঝুলচে? অর্থপূর্ণ হাসি হেসে তাকাল গোবিন্দর দিকে।
নকশিকাঁথা (৮) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১১২৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
ক্যাটোরবাসী বিছানায় একটা হাল্কা সুবাস ছিল। কোন মন কাড়া আতরের গন্ধ, নারী শরীরের সুগন্ধি আবেশ। গোবিনের মনে পড়ছিল দামুর মায়ের কথা, রমনাবি। গত বিশ বছরে বিবির সঙ্গে মোলাকাত হয় দুই বছরে একবার। গোবিন বাড়ি ফিরলে তার তাম্বুল খাওয়া ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়ে, পায়ে আলতার পোঁচ পড়ে, হাটে চুপড়ি ভরা নোলা আর খলিসা মাছ বেচে জালালের বিলে ধুন্দুলের খোসা দিয়ে ঘসে ঘসে সিনান করে চালা ঘরের বিছানায় গোবিনের কাছে ঘন হয়ে আসত। রমনাবির পাক দেওয়া পাটালি গুড়ের মত চামড়ায় নাক ডুবিয়ে আঁশটে গন্ধে সিনা জুড়াত গোবিনের। মৎস্যগন্ধা নারী তার লেজের ঝপটায় ভাতারকে পাকে পাকে জড়িয়ে নিত একদম। স্বপ্নে দামুর মায়ের জন্য ছটফট করে উঠল দশ ঘাটের পানি-ছ্যাঁচা, ব্রিটিশ জাহাজের পোড় খাওয়া লস্কর গোবিন্দ সারেং। দামুর মা, জীর্ণ বেড়ায় ঘেরা তার একচালা ঘর, ভিটের এক ছটাক জমিতে মাথা দোলানো নিমের শীতল বাতাস, স্বপ্নে তাকে ঘিরে ধরেছিল। ক্যাটোর বিছানায় যখন ঘুম ভাঙল গোবিন্দের, তখনও মনে জেগে রইল পায়ের তলায় শক্ত জমির কথা, পায়ের পাতায় ধুলা মাখার সুখানুভূতি। গোবিন্দ সাব্যস্ত করল যা হয়েছে সে বাচ্চা পীরের দোয়া। এই যে আক্রাম হঠাৎ করে চোখের সামনে কোন ভোজবাজিতে হাফিস হয়ে গেল সেটা আখেরে ভালই হল। তাকে জাহাজে ফিরতে দিল না। যে ইঞ্জিন রুমের জন্য বছরের পর বছর বাঙ্কার থেকে চাঁই চাঁই কয়লা বয়ে নিয়ে এসেছে, হাতুড়ি মেরে মেরে সেই কয়লা ভেঙেছে, কিংবা ফার্নেসের হ্যাচ খুলে আগুনে কয়লা ঠেলেছে, সে জাহাজি জীবন আর তাকে টানছিল না। সেই কোন জোয়ান বয়সে মাছ ধরার জাল গুটিয়ে রেখে জাহাজের খোলে প্রবেশ করেছিল গোবিন্দ। তার দেশ বিদেশ দেখার হাউশ মিটেছে। অনেক দেশের লোক দেখেছে সে-ও সত্যি, কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেছে তিরিশ-হাত পানির নিচে, সে যেন এক অন্য পৃথিবী। যেখানে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া জড়ো হয় হাতের ফুলে ওঠা পেশিতে।
নকশিকাঁথা (৯) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮০১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
হাতের বাতি দোলাতে দোলাতে পুব-মাথা থেকে শুরু করে বিল্ডিঙের পশ্চিম-মুখো চলেছিল বিল। বারোটার ঘণ্টা শুরু হতে হতেই ও সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে হপস্কচ খেলার ভঙ্গিতে প্রতিটা ঢং শব্দের সঙ্গে কল্পিত ছক লাফাতে লাফাতে পার করল। কেউ দেখলে ভাবত এই মোটা মুচওয়ালা মুশকো জোয়ানটা করছে কী? আর ওর আট বছরের মিয়নো বউ সিমোন দেখলে কী বলত? কে কী বলল বা ভাবল তাতে বিলের ঠ্যাঙা। রাতের অন্ধকার যেমন কিছু ভয় জুটিয়ে আনে, তেমনি অনেক ভান-ভণিতাও ছেড়ে চলে যায়। এই যেমন, রাত একটার ঘণ্টা বাজার সময়, সে যদি পুব দিকে থাকে তাহলে ক্যাপ্টেন বার্কের গ্রে হাউন্ড জ্যাকের মত গলা উপরে তুলে একটা গম্ভীর ডাক ছাড়ে। দিনে দিনে গলাটা জ্যাকের মত সুরে খেলছে। ভাবলেই গর্বে বিলের বুক ভুঁড়ি ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এমনি-ধারা নানান খেলা দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে রাখে বিল গেন্স।
নকশিকাঁথা (১০) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮২৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
চারজনে চলল সার দিয়ে। মাথায় দুটো পেটি, পিঠে একখান বোঁচকা, দুই হাতেও দু’টো করে পোঁটলা। একেকজনকে দেখে মনে হচ্ছে চলমান গন্ধমাদন পর্বত। জোয়ান ছেলে, তাকতদার, গাঁ-গঞ্জে এমন বয়েছে ঢের। ওরা মোকসাদকে বেশি কিছু নিতেই দেয়নি। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে তো সেই, তার উপর বুজুর্গ মানুষ।
বুঝলে মিয়া, এই শহরের পথের নিশান বেশ সিধা সিধা, ক্ষেতের আলের মত। সার দিয়ে এইসব ইস্ট্রিট গেছে, ওদিক থেকে আবার তাঁতের মাকুর মত আভেনু এয়েচে সব। নাক বরাবর চলতে থাকো।
নকশিকাঁথা (১১) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৯৯৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
লম্বা লম্বা শিক লাগানো পেল্লায় তার কপাট। সেই শিক ধরে ভিতরে চোখ রাখল ফায়জল। সঙ্গে সঙ্গে যেন আলিবাবার গুহার মত এক আজব দুনিয়া চিচিং ফাঁক হয়ে চোখের সামনে হাজির। কি বনবন করে ঘুরছে সবাই। সঙ্গে গান করছে কেউ মিঠে সুরে। ছোট-বড়, রোগা-মোটা, বাচ্চা-বুড়ো সবাই চরকি-ঘোরান ঘুরতে ঘুরতে খলখল করে হাসছে। জীবনটা এত মজার, এসব না দেখলে বোঝাই যায় না। পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে গেছিল ফায়জল, নিজেকে গুটিয়ে কারো সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি না করে। ভিতরে কত রকমের বাতি ঝুলছে। চলতে চলতে এক আয়নার সামনে গিয়ে তার চোখ কপালে। হুবহু তার মত একটা লোক, শুধু কেউ যেন হামান দিস্তা দিয়ে এমন পিষে দিয়েছে লম্বায় এক হাত আর চওড়ায় তিন হাত। পোশাক দেখে শুধু বুঝতে পারল, যে এটা তার নিজের সুরত। এমন সেই সিসার কেরামতি। এমনি অনেক সিসা দিয়ে একটা দেওয়াল মুড়ে রেখেছে। কোনখানে ফায়জল বেঁটে, তো কোথাও হিলহিলে লম্বা, আর এক জায়গায় সে হয়ে গেল বেলুনের মত গোল। যেন এখুনি হাওয়া বেলুন হয়ে উড়ে যাবে। আলেফ ডেকে না নিয়ে এলে সেখানেই বুঝি পুরো দিনমান কাটিয়ে দিত ফায়জল।
নকশিকাঁথা (১২) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০২ অক্টোবর ২০২১ | ২০১৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
তাদেরকে সাদাদের কামরা থেকে নাবিয়ে দিল না কেউ। টিকেট দেখতে এসে লালমুখো গুঁফো লোকটা অনেকক্ষণ চোখ সরু করে সবার চেহারা জরিপ করল। এরা নিজেদের জান পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে বসে ছিল। ভাবটা যেন কিছুই হয়নি, কিন্তু বুক গুড়গুড় করছে। শেষ অবধি লোকটা জিগেস করল, হিন্দু? চেকার আসার আগেই পাঁচকড়ি চোখ বুজে হরিনামে ডুবে গেছিল। মোকসাদ মাথা নেড়ে সায় দিল। ফ্রম ক্যালকাট্টা। আর তুমি? লালমুখোর নজর ইরুবার দিকে। ইরুবা দাড়িতে হাত বুলিয়ে দাঁত বের করে বলল, হিন্দু ফ্রম কালকাত্তা। সে লোক ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। কি নাম তোমার? ইরুবা এত কিছু ভেবে রাখেনি। বলল, ইরুবা। কোথায় যাচ্ছো? নিউ অরলিন। সে লোক এবার ইরুবার কাঁধে এক থাবা মেরেছে। কথা বলছো যেন মিসিসিপির নিগার, আর ভেক ধরেছো হিন্দুর? মুহূর্তে ইরুবা দিল এক লাফ, যেন জলজ্যান্ত হনুমান ....
নকশিকাঁথা (১৩) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৯ অক্টোবর ২০২১ | ১৫৬৮ বার পঠিত
হাঁ করে গিলছিল আলেফ আর বসির। রেলের ইস্টিশানে নেবে অবধি দেখেছে এই শহরের রঙ-ঢঙ। যেন রোজকার উৎসব লেগে আছে। পথে পথে রঙ্গ রসিকতা, নাচ গানের আওয়াজ, গ্রাহকের প্রতীক্ষায় পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা, কিছুই চোখ এড়ায়নি তাদের। নিউ ইয়র্কের দশ-বিশ তলা ইমারত ওদের কাছে নতুন ছিল। কি তার চমক আর চেকনাই। আশবারি পার্কে দরিয়াপারের মেলা দেখে চুঁচড়োর দরগার বচ্ছরকার পরব ফিকে পড়ে গেছিল এ জন্মের মত। কিন্তু এই শহরের সাজ সহরত নকশা এমন, যেন চারদিকে আমোদের ভিয়েন বসেছে। এমন কোন রঙ তারা জানে না, যার কয়েক পোঁচ পড়েনি কোথাও না কোথাও। থেকে থেকে নিশেন উড়ছে। তাতে কত রকমের মুখ, জন্তু জানোয়ারের চেহারা দিয়ে চিত্র বিচিত্র করে রেখেছে। এই শহর তার উচ্ছল প্রাণ আর বেঁচে থাকার জীবন্ত ছবি নিয়ে শুরুতেই তাদের খুব টেনেছে।
নকশিকাঁথা (১৪) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ১০৪৩ বার পঠিত
গোবিন্দর শরীরে যে এত ঘুম জমে ছিল, সে নিজেও জানত না। দিনভর ঘুমাতে কসুর করেনি শুরুর ক’টা দিন। জাহাজের স্টকহোল্ডে কাজ করে শরীরখানা এমন দুমড়ে মুচড়ে যায়, সবসময় ঘুমের জন্য মুখিয়ে থাকে। দু’দিন এমনি গেল। তারপর বদনখান এমন ঝরঝরে হয়ে গেল, মোটে ঘুমই আসে না চোখে। শুয়ে থাকলে বরং গায়ে বেদনা। ওইটুকু তো ঘর, হাত-পা খেলানোর ঠাঁই নেই। পায়চারি করার পরিসর দূরস্থান। সে বেচারা কি করে? বিছানার উপরেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইল রাতভোর। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ফুটল, ঘরের হলুদ আলোর সঙ্গে ছায়া ভুবন তৈরি করল। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। জাহাজের জন্য মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল গোবিন্দের। অথবা ঠিক জাহাজের জন্য নয়, শুধু একটু বাইরে যাওয়ার জন্য। একটু বাইরের আলো বাতাস, মানুষের মুখ, কারো সঙ্গে দু’টি কথা কইবার তরে পাগলপারা ছটফটানি। ঠিক যেমন একেকবার ফার্নেসে কয়লা ঢেলে গোটা শরীরখান শুকিয়ে যেত, আর ইচ্ছা হত দেয় এক ঝাঁপ মাঝদরিয়ায়, নিশ্চিত মরণ জেনেও, এখন তেমনি ধরা পড়ুক চাই যা খুশি হোক – বাইরে একদম যাওয়া চাই – এমন একটা বেপরোয়া ভাব তাকে গ্রাস করছিল।
নকশিকাঁথা (১৫) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩০ অক্টোবর ২০২১ | ১৩০৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
সে হল এক ভীষণ বচসা। ভোরের খোঁজে পাখিরা ঘুমের থেকে উঠে উড়বার তোড়জোড় করছিল, আবার নিজের নিজের বাসায় গিয়ে ডানা গুটিয়ে ঘাপটি দিল। রাতের শেষে যে ক’জন মাতাল পথের ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিল, অসময়ে খোঁয়ারি ভেঙে গালিগালাজ করতে করতে বাড়ির পথ ধরল। টেন্ডারলয়েনের মাথার উপর দিয়ে যাওয়া সেই সকালের রেল কেন যে মাঝপথে আটকে গেল, নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের তাবড় সাংবাদিক কিছুতেই সেটার হদিশ করতে পারল না। আমান্ডা গোল থামাতে মাঝখানে এসে পড়েছিল, আন্তোনিওর দাবড়ানিতে ছাদের থেকে মাকড়সার মত ঝুলে রইল। সেই দুই ষণ্ডা জোয়ান রুথের দুহাত ধরে চ্যাংদোলা করে আন্তোনিওর ঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, রুথের চোখের আগুনের গোলায় ওখানেই কাটা সৈনিক হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।
অমল রোদ্দুর হয়ে গেছে : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৪ অক্টোবর ২০২১ | ২৮২২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৯
আমি বিমলের দিকে চেয়েছিলাম। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। প্রায় কদমছাঁট। একটু ভিতরে বসা চোখ। গোঁফজোড়া এতদিনে বেশ জম্পেশ, মিলিটারি কায়দায় পাকানো। ভুঁড়িটা না থাকলে বেশ মিলিটারি মিলিটারি লাগত। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল বিমল। স্কুলের রেসে ভাল দৌড়াত। ব্যায়ামমন্দিরে গিয়ে হাত-পা বেশ তাগড়া করেছিল। কে জানে, বাবার দোকান না থাকলে হয়তো আর্মিতেই নাম লেখাত ছেলেটা। বাবার দোকান না থাকলে, এরকম অনেক কিছুই হয়তো করতে চাইত, মাঝে মাঝে প্রেসার কুকারের সিটি মারার মত মুখ ফুটে সেকথা বেরিয়ে আসত। কিন্তু জোরের সঙ্গে অন্যকিছু করতেও দেখিনি বিমলকে।
নকশিকাঁথা (১৬) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৬ নভেম্বর ২০২১ | ১০৮৭ বার পঠিত
এই লোকটাকে আগেও দেখেছে পিয়েরে, প্রায় রোজই তো দেখে আজকাল। দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যায় তার। ইস্ট ইন্ডিয়ার থেকে আসে এরা। মুখটা দেখ? বাইরে থেকে নতুন কেউ এসে গেঁড়ে বসার চেষ্টা করছে ভাবলেই রাগ হয় পিয়েরের। এমন নয়, যে তার কোনো কাজ মার যাবে, কিন্তু সব দেশ থেকে হাড়-হাভাতেগুলো এখানে এসে জমাবে, সেটাও তার ভাল লাগে না। এমনিতেই আজকাল নিগ্রোগুলোর বাড় বাড়ছে খুব। ট্রেমের দিকটা তো পুরোটাই ওদের দখলে। এই লোকটার চেহারা যদিও আলাদা। এদের মতন আরও দুই তিনজনকে দেখেছে মার্দি গ্রাঁর সময়। খুব ব্যবসা জমেছে এদের। হিন্দু জিনিস কিনতে লোকের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। এই হিন্দুগুলো নিগ্রোদের থেকে আলাদা, শহরের সব জায়গায় পৌঁছে যায়। ওদের আসা-যাওয়ায় কোন বাধা-নিষেধ লাগেনি। হয়তো চেহারার জন্য। কাটা কাটা চেহারার মাজা রঙের এই লোকগুলো, হয়তো চোখের ওইরকম দৃষ্টি বা মাথার ওই গোল টুপির কারণে কেমন দার্শনিক বা শিল্পী স্বভাবের মনে হয়, কিন্তু আসলে খুব বজ্জাত। সেটা ঠিক বুঝতে পারে পিয়েরে, লোক চেনে তো। ফুটপাথে থুথু ফেলল পিয়েরে।
নকশিকাঁথা (১৭) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১০৩৮ বার পঠিত
মাউন্ট বাউতে ভাল আছিস তাহলে? অ্যাবসিন্থ হাতে নিয়ে গুছিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল ডিওয়েন।
সেসব কতা বাদে হবে। আগে তোর কথা ক’ তো দেকি। শিকাগোর কতা। শুনেচি ওধারে নাকি সাদা আর কালোর মদ্দে কোন ফারাক নেই কো।
বলতে গিয়ে একবার থমকাল ডিওয়েন। নেই আবার আছেও। সেরকম না হলে আমি আবার ফিরে এলাম কেন। তবে হ্যাঁ, সেগ্রিগেশন নেই সেটা ঠিক। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মুচকি হাসল সে। আমি যখন ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম, ট্রেন যেই ইলিনয় ঢুকেছিল, আমি কি করেছিলাম বল তো একবার?
কি?
সিধা ঢুকে গেলাম সাদাদের কামরায়। একটা অদ্ভুত কথা কি জানিস, আমাদের এই দক্ষিণের শহরে থেকে থেকে আমরা ভাবি – যা কিছু সাদাদের, সব বুঝি ভাল। ওদের বাগানওলা বাড়ি, জামা কাপড় ধোপদুরস্ত, মেয়েরা হাঁটছে মাটির দু’ ইঞ্চি উপর দিয়ে – ওদের দিকে তাকালে পর্যন্ত গায়ের চামড়া খুলে নেবে। আর আমাদের নিগ্রোদের সব নোংরা, ভাঙাচোরা। অথচ ওই কামরায় ঢুকে কি দেখেছিলাম বল তো? কামরার মেঝেতে যত কাগজ, খেয়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট, কি নেই! ঠিক আমাদের নিগ্রোদের কামরার মতই গন্ধ। সাদা মেয়েরাও বসেছিল সেই কামরায়, ওই নোংরার মধ্যেই। পা পুরোদস্তুর মাটিতে। They also piss and shit like us.
নকশিকাঁথা (১৮) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২০ নভেম্বর ২০২১ | ১২৪৯ বার পঠিত
তোর হিন্দু ফকিরের কতা ক বরন’, ওদের চার্চে গেচিলি বুজি? সে কি আমাদের ফাদার ইমানুয়েলের মত?
চার্চ না রে, ওই উৎসবে দেশ বিদেশের কত লোক এসেছিল ধর্মের কথা বলতে। চিন, জাপান, ইউরোপ। তেমনি এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে, ওরা হিন্দু। ইমারত গড়া হয়ে গেছে। আমার তখন কাজ জুটেছিল সাফসুতরো রাখার দলে। কাতারে কাতারে লোক আসছে তো। খাচ্ছে-দাচ্ছে মজা লুটছে। সবদিক তকতকে রাখতে হবে। আমি সারাদিন ঝাড়ুপোঁছা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমার সেদিন কাজ জুটেছিল যেখানে, সেখানেই হচ্ছিল সমস্ত দেশের এক ধর্মসভা। ওই সারাদিন কচকচি আর কি। আমার ওতে কি কাজ। তবু ভাল লাগছিল শুধু সাদারা নয়, কালো, বাদামী, হলুদ সব রঙের লোকেরা কথা বলছে আর সাদারা সেসব কথা শুনছে। কিন্তু কি যে ছাতার মাথা বলছে আমি কি ছাই বুঝতাম কিছু, নিজের মনে সভাঘরের পাশ ঘেঁষে ঝাড়ু দিচ্ছি। এমন সময় এলো সেই হিন্দু ফকির।
নকশিকাঁথা (১৯) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৭ নভেম্বর ২০২১ | ১২০৩ বার পঠিত
সন্ন্যাসী এক পা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। যেন কি অপরিসীম শক্তি তার শরীরে প্রবেশ করল। নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। তোমার গায়ের যে কালো রঙের চামড়াটা, সেটা ঠিক আমার পরনের কমলা রঙের পোশাকের মত। আবরণ মাত্র। আসল লোকটা ভিতরে আছে – সেখানে আমাদের সবার যিনি ঈশ্বর, তিনি কোন ফারাক রাখেননি ব্রাদার। সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল আমি মানুষ। পড়ে থাকা ঝাড়ুটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিলেন। তুমি যে কাজই কর না কেন, সব কাজের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। অন্য সব কোট-প্যান্ট পরা লোকের মতই, তোমারও আমার সামনে এসে কথা বলার সমান অধিকার।
ডিওয়েনের সেদিন মনে হয়েছিল, যেন শুধু তার জন্যে একটা মন্ত্র উচ্চারণ করলেন সন্ন্যাসী। উনি চলে যাচ্ছিলেন, কি মনে করে আবার ফেরত এলেন। স্মিত হেসে নিজের মাথার কমলা রঙের কাপড়টা খুলে তার হাতে দিলেন, এটা তোমার কাছে রাখো ভাই।
নকশিকাঁথা (২০) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৮৩৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
চকচক করে উঠেছিল আমিনার চোখ, আশা আর আনন্দে চোখের কোলে টলটল করছিল দুটো মুক্তোদানা। ডান হাতে খামচে ধরেছিল মনিরুদ্দির পেটি। একটা খপর এনে দাও আমায়। আজ থে তুমি আমার ভাইজান হলে, আলেফের খপর তোমাকে আনতেই হবে ফের।
কি কুক্ষণে মনিরুদ্দি সেদিন ব্যাপারি বুদ্ধি খেলিয়ে ভাইজান হবার সুবাদে কম পয়সায় মাল খরিদ করেছিল। তখন কি জানত ওয়াহিদ বক্স কোনো খবর আনতে পারবে না। মোদ্দা কথা হল, ওয়াহিদ নিজে তো যায়নি, এরকম বছর বছর লোক যায়। তার মধ্যে থাকবে কোনো এক আলেফ। কিন্তু যদি দশজনা যায়, ফেরে মুরুব্বি গোছের দু’জন। ক’মাস বাদে তারা আবার সঙ্গীসাথী জুটিয়ে পেটি নিয়ে সফরে রওয়ানা হয়ে যায়। আর সবার যাওয়ার জায়গা – সে-ও কি এক? বুঝিয়েছিল ওয়াহিদ বক্স। কেউ যায় লন্ডন, জোহানেসবার্গ, আবার এক দল যাবে নিউ ইয়র্ক, নিউ অরলিন, ভ্যাঙ্কুভার – এমনই হরেক বন্দর। কে আলেফ আলি, সে কোন দিকে গেছে, কে জানবে তার ঠিকানা?
নকশিকাঁথা (২১) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১১ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৩০৯ বার পঠিত
লুলু হোয়াইট সাদা হয়েও সাদা নয়, অক্টারুন। সাত ভাগ দুধে, এক চামচ কফি মেশানো সৌন্দর্য নিয়ে লুলুর দাম আকাশছোঁয়া। তার মেহগনি হল বিখ্যাত অক্টারুন আর ক্রেওল সুন্দরীদের জন্য। তাই না এমন চকমিলান জায়গার পত্তন করতে পেরেছে! খিলানওয়ালা চারতলা প্রাসাদ। সেখানে পনেরো-বিশখানা ঘর আছে অতিথি আপ্যায়নের। কোনো ঘর পারস্যের কার্পেটে মোড়া, কোথাও জাপানের ছবিতে চিত্রবিচিত্র, আবার কোনো ঘর খোদ প্যারিস থেকে আনা আসবাবে ঠাট বাড়িয়েছে। প্রতিটা ঘরের সঙ্গে একেকটা গা ধোওয়ার জায়গা – যেখানে জলকেলি করতে করতে নারীসঙ্গের সুখ পেতেও কোনো অসুবিধা নেই। শ্বেত মার্বেলের প্রশস্ত সিঁড়ির দু’ ধারে পুষ্পকুঞ্জ – যেখানে অতিথির অপেক্ষায় লুলু হোয়াইটের অক্টারুনদের নিজস্ব পরিচারিকারা বসে থাকে। যাদের অক্টারুন বা ক্রেওল সুন্দরী-অবধি পৌঁছানোর হিম্মত নেই, তারা পরিচারিকাদের সঙ্গেই বিশ্রম্ভালাপ করে যায় খানিক।
নকশিকাঁথা (২২) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ | ৮৯৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
ঘটনার এমন উল্টো টানে আব্দুল আর দামোদর সমান হতবাক। আব্দুলের জন্য ব্যাপারটা আরও মর্মান্তিক। পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে শুনে এলা ছুটতে ছুটতে হাজির। বাড়ি ভাড়া মার যাওয়ার ভয়ে নয়, আব্দুলের এই বিপদ যে তারও। ক’দিনেই এমন জমে গেছিল দু’জনের। এমন তুখোড় মেয়েটা এই ঘটনায় একদম বোবা হয়ে গেছে, চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে আছে। জালে ঘেরা গাড়ির বাইরে দাঁড়ানো এলাকে আবদুল সান্ত্বনা দিতে ছাড়েনি, কিন্তু তাতে কি হয়? একবার যদি আব্দুলকে আবার ব্রিটিশ শিপে চড়িয়ে দেয়, এই দেশের কোনো বন্দরে এসে লাগতে লাগতে বছর ঘুরে যাবে। অন্য কোনো দেশেও তো পাঠাতে পারে। সেটা এলাও বোঝে, আব্দুলও জানে। জানলেও মন কি মানে? সেই থেকে এক কথা আব্দুলের মুখে, গোবিন্দদা একটা পথ তো বাতলাও। আমাকে যে বেথেলহেমে ফিরতেই হবে।
নকশিকাঁথা (২৩) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৪২৪ বার পঠিত
স্টিলের কালো তোরঙ্গ একটা। এমন নয়, যে তাঁর খোয়া যাওয়া বাক্সের সঙ্গে একেবারেই একরকম দেখতে। আসলে এতদিন জাহাজে যাত্রা করে তিনি এত ক্লান্ত ছিলেন আর এঁরা সকলে উপস্থিত হয়ে তার জিনিসপত্রের জিম্মা নিয়ে নিয়েছিলেন, তাই কালীপ্রসাদ অত খেয়াল করে দেখেননি। নাহলে চেহারায় অনেক অমিল আছে। এটি যেন কতকাল আগের তৈরি, এর শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন আছে।
কালীপ্রসাদের বাক্সটি ছিল নতুন। যখনই বাড়ি থেকে বাইরে পা দিয়েছেন, একটি বস্ত্র সম্বল করে, পদব্রজে ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীর আর কি লাগে? এইবার নেহাত এতদূরে যাত্রা, আবার কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তাই নিজের সমস্ত অমূল্য গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে আসবার জন্যে তোরঙ্গ কেনা হয়েছিল।
নকশিকাঁথা (২৫) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৮ জানুয়ারি ২০২২ | ১৭৪১ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
বারলেস্ক থিয়েটার উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল প্রেক্ষাগৃহ, ছাদের থেকে ঝাড়লন্ঠন এই খুলে পড়ে বুঝি। বাতাসে উড়ছিল মাথার থেকে ছেড়ে দেওয়া টুপি, কারুর গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া ডলারের নোট, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়া উল্লাস। আক্রাম রুথকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতেই, সে ডান পায়ের তর্জনীতে ভর করে মঞ্চে অবতরণ করে, তার প্রথাগত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনের ভাগে এসে পা তুলে দিল আকাশপানে, আর একই ঘূর্ণিটানে সবার চোখের দৃষ্টি টেনে নিয়ে ভেসে গেল মঞ্চের পিছনে। নাচের এই শেষ অংশে এসে দর্শককে সেই দুই মুশকো পাহারাদার আর আটকে রাখতে পারে না মোটে।
নকশিকাঁথা (২৪) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ জানুয়ারি ২০২২ | ৯১৫ বার পঠিত
আপুনি তো সবই পেত্যক্ষ করেন মহারাজ। এবারটা আমাদের ক্ষেতির সন। এবার চুরি হল, তুফানে কত পসরা যে ভেইসে গেল – বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল আবার পাঁচকড়ি। আমাদের একজনা ওই তুফানে কোতায় যে গেল – এই অবধি বলে পাঁচকড়ি গলা তুলে – ওরে ফয়জল রে! বলে কান্না শুরু করল।
ফয়জল? কি হয়েছে ফয়জলের?
সদ্য এসেচিল গো, সে জোয়ান মদ্দ এক ব্যাটাছেলে। ফয়জল আলি নাম। যে দিনকা এল, ব্যস ফিরে দিন এইয়া তুফান। আমরা সবাই বোর্ডওয়াকে দ্রব্য ফিরি করচি। ফয়জল আর ফেরল নাকো।
নকশিকাঁথা (২৬) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৫ জানুয়ারি ২০২২ | ১৫১৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
রুথ উডবার্নকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরি ছিল। তাই বলে গিরগিটিটা যে তার সাজঘরে অপেক্ষায় বসে আছে সেটা ভাবতে পারেনি।
নাচ শেষ করে পোশাক ঝলমলিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই পেলো উডবার্নকে। তাকে দেখেই উডবার্ন নড়েচড়ে বসল, লাল বের করা জিভ বেরিয়ে এল এক হাত। আহা, এমন একটা নধর প্রজাপতি জিভের নাগালে আজ, সড়াত করে গিলে নেওয়াই শুধু বাকি। কথাতে কোনো রাখঢাক রাখেনি উডবার্ন। টাকা তো অনেক আছে, না চাইতেও পকেটে এসে জড়ো হচ্ছে। রুথের টাকায় কোনো লোভ নেই, চাই না মোটে। তাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছাই নেই। তার শুধু চাই রুথকে। ওই শরীরটি একবারটি না চাখলে তার অঙ্গ জুড়াবে না।
নকশিকাঁথা (২৭) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২২ জানুয়ারি ২০২২ | ১৬৭৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
আমরা কোনো প্রশ্ন করি না কেন? কেন সব ঘাড় গুঁজে মেনে নিই?
ততদিনে আমরা আর ক্রীতদাস নই, কিন্তু সে কেবল নামেই। মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করে যাওয়ার বাইরে কিছুই শিখিনি। রেভারেন্ড ওয়ালেস তার বক্তিমে থামিয়ে আমার দিকে সোজা চোখে তাকাল। কী বলতে চাইছ হে ছোকরা? আমার হাতে একটা বই ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, দু’পাতা পড়েই নিজেকে পন্ডিত ভাবছ বুঝি? শুনি তোমার বিদ্যের বহর। কী বলতে চাও?
বললাম তো। যা দেখছি চারদিকে সব কিছুকে প্রশ্ন করতে হবে।
আমরা এখানে ভগবানের কথা বলছি – জেসাস। সেটা কি মাথায় ঢুকেছে খোকা?
তাকেও প্রশ্ন করো।
চু-উ-প! ফেটে পড়েছিল রেভারেন্ড ওয়ালেস। আর একটা কথা না।
আমার তখন রক্ত নবীন, হেঁকে উঠলাম, কেন চুপ করব? সাদাদের ভগবান নিয়ে আমাদের এত আহ্লাদ কিসের?
দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে জমায়েতের দিকে তাকিয়ে রেভারেন্ড ওয়ালেস বলে উঠল, দ্যাখো, এই জন্যেই কি আমরা নিগ্রো বাচ্চাদের পড়তে-লিখতে শেখাচ্ছি?
আমার মাথায় তখন আগুন দপদপ করছে। আমিও সমানে চেঁচিয়ে বললাম, তুমি কিছুই শেখাচ্ছ না, সাদাদের বলে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছ।
নকশিকাঁথা (২৮) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১৩২৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
রথে শুধু বাদশা নেই, আছে বেগমও। যদিও সবার মুখে মুখোশ, মেয়ে হলে তাদের আবার বুকের কাপড় আলগা। তোবা! তোবা! বেলুজ্জেরা তার মধ্যেই দু’হাত আসমানে তুলে নাচগান জুড়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে মুঠো-মুঠো পুঁতি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আলেফরা নিচু হয়ে পুঁতি কুড়াবে, না ঘাড় উঁচু করে ফর্সাপানা মেয়েছেলের কেচ্ছাকাণ্ড দেখবে?
এত উৎসব, উত্তেজনা আর খাওয়া দাওয়ার ধূম কোনো বাপের জন্মে দেকিনিকো। রাতে বাড়ির পথ ধরে ওদের মুখে শুধু এই বুলি। মারদি গ্রাঁ দিনরাত মানে না, তেমনি চলছে যেন কারো কোনো ক্লান্তি নেই।
নকশিকাঁথা (২৯) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৭৭০ বার পঠিত
নিজেদের জমি, নিজেদের শহর – যেখানে মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য কোনো সাদা লোক মজুত নেই, আসতে চাও না এমন একটা জায়গায়? যেখানে বাঁচার জন্য সারাক্ষণ বুকে পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় না, সাদা মেয়েদের দিকে চোখ তুলে চাইলে বেঘোরে মারা যাওয়ার কোন ভয় নেই। চাও না এমন একটা পিঠসোজা করা শান্তির জীবন? এভাবেই বলত ইশাইয়া। তার কথায় আগুনের ফুলকি থাকত, মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত রঙমশাল।
নকশিকাঁথা (৩০) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৬০০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
দেকো, সিবিল ওয়ার হইচিল এখেনে, তারপর যতেক নিগ্রো ছিল সবাইকে বেবাক আজাদ করে দিল। দিল তো? কিন্তু সাদাদের সেটা কদ্দিন সইবে বল দিকিন? সব তো ফিরিঙ্গিদেরই জাতভাই। যা দেছেল, সব কুটুকুটু করে ফেরত নিতে চায়।
সেটা কীরকম? ফের জুতে দেবে ওদের?
না, তা নয়, কিন্তু নতুন আইন করেছে সরকার, অনেক নিগ্রোদের ভোট থাকবে নাকো।
ভোট? সেইটা কি এস্রাক ভাই? প্রশ্নটা জয়নাল করল, কিন্তু শব্দটা অজানা তাদের সবার।
এই দেশের লোক তা আমাদের মতুন নয়কো, এরা নিজেদের পছন্দমত সরকার বানায়, তাকেই বলে ভোট। মাথা চুলকিয়ে এটুকুই বলতে পারে এস্রাক। যা বলেছিল তার বউ-বেরাদর। নিগ্রোদের আর পছন্দ করতে দেবে না, যা করবে সাদারা।
নকশিকাঁথা (৩১) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫৯০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
পথেঘাটে মেয়ে মোটে নেই। গঙ্গার ঘাটে দেখেছিল হিন্দুঘরের মেয়েরা জলে ডুব দিয়ে নাইতে নেমেছে। এদিকটায় এসে দুই একটা মেয়ে দেখেছে, তাদের চলনবলন একেবারেই আলাদা। কী টকটকে গায়ের রং, তেমনি অদ্ভুত চুলের রং। চুল কার এমন লাল হয়! আমিনা তাজ্জব বনে যাচ্ছিল! এদের সবারই সাজগোজের ভারি বাহার, ছোট ছোট ফ্রক, বুকের আঁচলটুকু অবধি নেই। পায়ে চামড়ার জুতো, তাতেই বা কত কায়দা। আমিনা জুতো পরা কোনো মেয়ে কোনোদিন দেখেনি। এমন দুই-একজনকে কোনো ফিরিঙ্গির হাতে হাত গলিয়ে হিহি হাহা করতে করতে যেতে দেখল আজ। ওরা মেয়ে, কিন্তু যেন মেয়ে নয় – অন্য জগতের। এদেরই কি ওয়াহিদ বেবুশ্যে বলেছিল? তাদের গ্রামেও বদনাম হওয়া মেয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাজ পোশাকে না আছে রং, চলা ফেরায় না এই ঢং।
নকশিকাঁথা (৩২) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪৫৩ বার পঠিত
এই মত্ত জনতা মেয়েদের মধ্যেও চার্লসকে খুঁজে পেল। কিংবা মেয়ে সেজে চার্লস লুকিয়েছে কিনা, সেটা বুঝতেই যেন তাদের পোশাক খুলে চামড়া মাংস ঘেঁটে তারপর নিকেশ করল। নিউ অরলিন্সের রাস্তায় রক্ত জমাট বাঁধছিল।
আগের কাল আর নেই, যে নিগ্রো মানেই নিরস্ত্র, পড়ে পড়ে মার খাবে। তাদের কাছেও আছে বন্দুক, ছোরা, লাঠি। জায়গায় জায়গায় খণ্ডযুদ্ধ। নিউ অরলিন্স জ্বলছিল।
হই হই করে সাদাদের দল ছুটল ট্রেমে, ওখানে গেলেই পাবে চার্লসকে, কিংবা তাদের জাতভাইদের। একজন পুলিশকে শুইয়ে দিয়েছে কিনা একটা নিগ্রোর বাচ্চা!
নকশিকাঁথা (৩৩) : বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৯ মার্চ ২০২২ | ১৮৬২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে নিবিড় হতে সময় নেয়। রাস্তা বহুক্ষণ থরথর করে দোলে, কাঠের বাড়িরা ঠকঠক করে কেঁপে আতঙ্ক বজায় রাখে অনেক সময় ধরে। রাস্তার ধুলোর ঝড় ধীরে ধীরে থিতু হয়। এমনকি পথের পশুপাখিও গা ঝাড়া দেয় না ততক্ষণ। ওরা এই অবস্থায় পড়ে রইল, সেও কত মুহূর্ত, কত পল। হামলার শেষ প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতেই আলেফ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। যেকোনো মুহূর্তে এমনই আরেকটা দল এসে যাবে, এরপর পালাবার উপায় না-ও হতে পারে।