হিমালয়ঘেরা এই শহরটাতে পুজো আসার সাথে সাথে চারদিক থেকে হিমেল হাওয়ার দল উঁকিঝুঁকি মারে।সারাদিন নানা শোরগোলে আর লোকের ভিড়ে, পুজোমন্ডপের চারধার বেশ সরগরম থাকলেও সন্ধ্যে হতে না হতেই ঠিক শীত না, তবে হিম ভাব। আরতি শেষে ফাংশন শুরু হলে প্রথম দিকটায় ভিড়টা চারিদিকে মাঠের ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আস্তে আস্তে ঘন হয়ে আসে শামিয়ানার নীচে। একটু রাতে বাড়ি ফেরার সময় হাল্কা একটা পাতা পোড়ার গন্ধ মেশে হাস্নুহানার মাতাল গন্ধে। টুপটাপ হিম ঝরে গন্ধরাজের পাতায়, আর ঝিমলির মন কেমন করে, কারণ ভালো বোঝা যায়না, তবু করে। অন্তত ওই সরস্বতী মন্দির থেকে বাড়ির আধো অন্ধকার পথ চলার ক্ষণে তো করেই। পুজোয় তার তেমন কিছু করার ছিলনা। এমনিতেও সে কোনো বছরই পুজোর ফাংশনের দিকে ঘেঁসেনা খুব একটা, ওই অনন্ত রিহারসাল পর্ব তার মোটেই পছন্দ নয়। আসলে বাঁধাধরা সময়ে কোন কিছু করতেই ঝিমলির ভালো লাগেনা। সেই কারনে এতকাল কোথাও ঠিকমত টিউশনই পড়ে উঠতে পারল না। এবার বারো ক্লাস বলে জোর করে শরাফ স্যরের কাছে অংক করতে পাঠানো হচ্ছে, খুব নিমরাজী হয়েও যাচ্ছে, এন্ট্রান্সের গরজ বালাই! ... ...
ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন। একদিন বিকাল বেলা গোলাগুলির শব্দ শুনে আমরা অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। দেখি কয়েকটা গাড়ী এক সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এতদিন পরে স্পস্ট মনে পড়ছে না, তবে আবছা মনে হছে দেখেছিলাম একটা পতাকা, তাতে লেখা ছিল – আর সি পি আই (R C P I – Revolutionary Communist Party of India)। গাড়ী গুলো ভর্তি মানুষ। সকলের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, রাইফেল বা রিভলবার। সব বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, তাই একটা ছোটখাট ভীড়। আমাদের দেখে একটা গাড়ি থেকে এক যুবক নামল – হাতে রাইফেল। আমাদের সামনে এগিয়ে এসে উঁচু স্বরে বলল – আপনারা সকলে বাড়ির ভিতরে চলে যান। আপনাদের কোন ভয় নেই। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই যুবক আমাদের তারাপদদা। গাড়ি গুলো কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। পরে শুনেছিলাম এরা বসিরহটের কোর্ট কাছারি ট্রেজারী থানা দখল করে বন্দুক গোলা গুলি হস্তগত করে, বসিরহাটকে স্বাধীন ঘোষনা করে এগিয়ে গেছে। কলকাতা যাওয়ার পথে প্রায় পয়ত্রিশ মাইল দূরে ডানলপ ফ্যাক্টরি অধিকার করে ও সেখানকার এক স্বেতাংগ ফোরম্যানকে জ্বলন্ত ফারনেসের মধ্যে ফেলে দেয়। এ ঘটনা সেসময় দেশে খুব উত্তেজনার সৃস্টি করে। বলা বাহুল্য, অচিরেই এই উত্থানকে দমন করে তারাপদদা সহ সব বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করে সরকার। এদের নেতা পান্নালাল দাসগুপ্ত অবশ্য পলাতক হন এবং প্রায় দুবছর আত্মগোপন করে ছিলেন। সরকারের গোয়েন্দারা কিন্তু বসিরহাটের ক্লাব আর যুবকদের উপর সর্বদা নজর রেখেছিল। আমি যখন কলকাতায় স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র তখন কেন যেন আমার মনে হত কেউ যেন আমায় চোখে চোখে রেখেছে। ... ...
হোস্টেলের মন্টুদা বিডিও হয়েছিল। গণিতের। দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে ইংরেজির নামী শিক্ষক। সদ্য অবসর নিল। প্রজিত পড়ায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস। অনাথ ইংরেজিতে ভালো ছাত্র। আমার জীবনে বহু মানুষের অবদান। দেবাশিসদা আমার শক অ্যাবজরবার। অনাথ আমি খেতে না গেলে খাবার নিয়ে এসে থাকতো। আমি ওদের সঙ্গে খেতাম। টিউশন করে আমি পাঁচ লিটারের একটা হকিন্স প্রেসার কুকার কিনেছিলাম ১৯৮৪ তে। ২২০ টাকা দামে। কিস্তিতে। প্রথমে ৬০ টাকা তারপর প্রতি মাসে ২০ টাকা। ... ...
এরিক ফান রিবেকের ডাচ অনুগামীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই দ্বীপে জেলখানা বানিয়ে শাস্তি প্রাপ্ত অপরাধী, অবাঞ্ছিত, পূর্ব এশিয়া, মাদাগাস্কার ও কেপ কলোনির রাজনৈতিক বন্দিদের যদি সেখানে নির্বাসন দেওয়া হয় তাহলে ডাঙ্গায় ইট গেথে কাঁটা তার ঘিরে জেলখানা বানানো ও ডজন ডজন প্রহরী পোষার খরচাটা বাঁচে। রোবেন আইল্যান্ড কেপ টাউন থেকে দূরে নয়, বাইনোকুলার দিয়ে নজর রাখা যায়, কিন্তু পথ দুর্গম; তার আশে পাশে অজস্র মগ্ন মৈনাক, ঝোড়ো হাওয়ায় আকস্মিক উচ্ছলিত আটলান্টিকের জলরাশি, পালাবার পথ নাই। অন্তত দু ডজন জাহাজ ডুবেছে এখানে নোঙর বাঁধতে গিয়ে। কারাগারে পাহারাদার লাগবে কম। ওই দ্বীপ থেকে কেউ সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুতে তো পারবেই না বরং হাঙরের মেনুতে পরিণত হবে। চিন্তাটি সঠিক। তিনশো বছরে নৌকা যোগে মাত্র দুটি সফল পলায়নের কাহিনি জানা যায়, তবে কোন বন্দীর সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুনোর রেকর্ড নেই। ... ...
আমি ভূগোলের প্রেমে পড়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে, সেই যেবার নিবেদিতা ইস্কুলের ছোট বাড়ি মানে প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়ে বড় বাড়িতে অর্থাৎ মাধ্যমিক বিভাগে এলাম। কাকলিদি ভূগোল পড়াতেন। সেই সময় প্রথম জানলাম ক্লাসের ঘণ্টা পড়লেই দিদি আসার আগে ব্ল্যাকবোর্ডের হুকে মানচিত্র টাঙিয়ে রাখতে হয়। আর ভূগোল ক্লাসে খাতা আনতে ভুলে গেলে তাও কোনোদিন ক্ষমা পেতেও পারি, কিন্তু চণ্ডীচরণের ম্যাপ বই না আনলে ক্ষমা নেই। ... ...
নদীর নাম ইছামতী। খুব বড় নদী নয়, খুব ছোটোও নয়; এপার ওপার দুপারই পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এই শান্ত নদী মাতাল হয়ে উঠে। কালবৈশাখী ঝড়ে এর রূদ্র রূপ চমক লাগায়। বর্ষায় এ হয়ে উঠে ভয়ংকর – পাড়ের জমি ভেঙ্গে পড়ে নদীর বুকে, গাছপালা বাড়ী ঘর কারো রেহাই নেই। বসিরহাটে আমাদের বাড়ী ছিল এই নদীর ধারে। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ীর সামনে বেশ বড় একটা বাগান, গাছ পালা ভর্তি। সেই বাগানে আমরা খেলাধুলা করতাম। বাগানের শেষে নদীর পাড়। প্রতি বছরই ইছামতী এই বাগানের ভাগ নিত একটু একটু করে। প্রতি বর্ষায় নদীর পাড় ভাঙত; ইছামতী গ্রাস করত জমি। নদীর ধারে একটা বকুল গাছ ছিল। গ্রীষ্ম কালে প্রচণ্ড গরমে গুমোট ঘরে থাকা যেত না; পড়ায় মন বসত না। সন্ধ্যাবেলা এই বকুল গাছের নীচে মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে পড়শুনা করতাম। নদীর ধারে মৃদু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিত --- কি অভাবনীয় প্রশান্তি! একদিন সকালে উঠে দেখি সেই বকুল গাছটার শিকড় উপড়ে গেছে; পদচ্যুত বৃক্ষ মুখ থুবড়ে ইছামতীর জলে পড়ে আছে। মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। পরে সরকার নদীর পাড় বাঁধাবার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল। ইছামতী করুণা করে আমদের বাড়ী গ্রাস করে নি; কিন্তু মানুষ করেছিল। মানুষের হাত থেকে আমরা রেহাই পাই নি। ... ...
“মা বাইরে তাকিয়ে দ্যাখো না, বৃষ্টি হচ্ছে?” “হচ্ছে, কিন্ত জোরে নয়, উঠে পড়।“ “আর পনের মিনিট, মা। তুমি দশ মিনিট পরে আবার জানালায় যেও। যদি দেখ প্রাইমারির ছেলেমেয়েরা ফিরছে, তাহলে ডেকো না, তাহলে রেনি ডে। যদি না ফেরে তাহলে ডেকো। “রেনি ডে হলেই বা কী? সকাল সকাল উঠে পড়, বাড়িতেই পড়বি। আর এক মাস পরে তোর ফার্স্ট টার্ম না? এ কথার জবাব দিতে গেলে সকালের মিষ্টি আলতুসি ঘুমটা মাটি হয়। ঝিমলি মুখের ওপর চাদরটা টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। মা গজগজ করতে করতে মশারি খুলতে থাকে। ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভের পড়া, এত কম পড়ে কী করে হয় কে জানে। স্কুলটুকু বাদ দিলে সারাদিনই তো হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে নয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, অথবা গল্পের বইয়ে মুখ দিয়ে বসে আছে। এত বন্ধু যে কোত্থেকে আসে? আবার কারুর না কারুর জন্মদিনের পার্টি লেগেই আছে। আজকাল নাকি এরপরে সব আলাদা হয়ে যাবে বলে, জন্মদিন পালনের বেশী ঘটা। রাত্রি দশটা এগারোটায় সবাই ঘুমোতে গেলে, তিনি আলো জ্বালিয়ে বই খাতা নিয়ে নাকি পড়তে বসেন । অত রাতে কী ছাই পড়া হয় অমন করে কে জানে! ... ...
আমার দাদুকে বেশ ভাল মনে আছে । দাদু দীর্ঘায়ু ছিলেন , এক শত বছর এ ধরাধামে জীবন কাটিয়ে দেহ রেখেছিলেন । দাদু ছিলেন সুপুরুষ এবং সৌখীন । আমি যখন দেখেছি বার্ধক্য তখন দাদুকে ছুঁয়েছে । ধবধবে ফর্সা পক্ককেশ কালোপাড় শান্তিপুরী ধুতি পাঞ্জাবীতে ভূষিত সেই মানুষটিকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে । মায়ের কাছে দাদুর গল্প শুনেছি । দাদুর যখন বয়স পনেরো-ষোল তখন পিতা আনন্দ মোহন পরলোকগমন করেন । দাদু বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান ও উত্তরাধিকারী । ভায়েরা সব অল্পবয়সী নাবালক । একান্নবর্তী পরিবারের দায় দায়িত্ত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের গুরুভার দাদুর উপরেই । সেই সঙ্গে জমিদারি ও তার তত্বাবধান । বিত্তবান অল্পবয়সী জমিদারের তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী ও উপদেস্টার অভাব হয় নি । আমাদের সে সময় কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে একটি বড় বাগানবাড়ি ছিল । বাড়িটি প্রধানত: জমিদারের বিনোদনের জন্যই বব্যহৃত হত । মোসাহেবের অভাব ছিল না --- তাদের নিয়ে নাচ গান বাজনার আসর বসতো । সেই বাড়ি দেখাশুনাআর জন্য এক দম্পতি ছিল । বাবা তাদের বাগানের খুড়িমা বাগানের খুড়ো বলতেন । দাদুর সঙ্গে বেশী নগদ টাকা থাকত না । নাচ গানের আসরে বখশিস বা মুজরো দেওয়ার দরকার হলে বাগানের খুড়োর কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ টাকা নিতেন । টাকা দিয়ে খুড়ো এক টুকরো কাগজ দিত এগিয়ে দাদুর দিকে । দাদু তখন আসরে মশগুল , সরল মনিবের মত সেই কাগজে সই করতেন । কিছুকাল পরে সেই বাগানের খুড়ো খুড়িমা বাগান বাড়িটা দখল করে নিল । অজুহাত দিয়েছিল দাদু নাকি অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিলেন । প্রমান স্বরূপ তদের কাছে দাদুর সই করা কাগজগু্লো আছে । ... ...
কলকাতার রয়াল হোটেলে লোকে খুব শখ হলে বিরিয়ানি খেতে যায় বা নিউ মার্কেটে আমিনিয়ায়। রয়াল হোটেল তখন খুব নামী। সেখানে ত্রিশ টাকা প্লেট খাসির বিরিয়ানি। লোকে মাটন বিরিয়ানি বলতো না। চিকেন তখনও মুরগি ছিল। কথায় কথায় এত ইংরেজিয়ানা ছিল না। আমরা পরিকল্পনা করলাম, ত্রিশ টাকা দাম নিচ্ছে! হোস্টেলে তখন মিল চার্জ এক টাকা আশি পয়সা হলেই ধুন্ধুমার বেধে যায়। অডিট হয়। এত কী করে হলো? ... ...
টেনের রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকেই জয় এই শহরের হীরো হয়ে গেল, যে বাড়িতে যাও, সেখানেই শুধু তাকে নিয়ে আলোচনা। একদিন দাদার কাছে এসেছিল ইলেভেনের ফিজিক্সের কী ডিফিকাল্টি বুঝে নিতে। রাস্তায় জিজ্ঞেস করতে দাদাই বাড়িতে এসে ভালো করে বুঝে নিতে বলেছিল। সে কী বিপত্তি, মা দাদা বৌদি সব এসে জড়ো হল। তার মধ্যে দাদার চিৎকার, "দ্যাখ, এভাবেই ওরকম রেজাল্ট হয়, জয় এসেছে পড়া বুঝে নিতে আর তোকে ডেকে ডেকেও বই নিয়ে বসানো যায়না।" মাও মহা উৎসাহে যোগ দেয়, "শুধু কী তুই, কারুর কাছেই তো পড়তে চায়না, কী যে হবে ওর! এই তো জয় শরাফ স্যরের কাছে অংক করছে, শহরের সব ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা তার কাছে অংক করে ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল পায়। আর এই মেয়ে একদিন গিয়ে বলে, শরাফ স্যর নাক খোঁটে, ওর কাছে পড়বনা। বালাসুন্দরমের কাছে কেমিস্ট্রী পড়বেনা কেন না সে এম কে ইয়াম আর এন কে ইয়ান বলে, কে বি গুপ্তা নাকি বই মুখস্থ করায়। হাজারটা বায়নাক্কা এর, এমন মেয়ে দেখেছিস জয়?" চশমার সরু স্টাইলিশ ফ্রেমের আড়ালে ঝকঝকে উজ্জ্বল চোখের, আপাতগম্ভীর মুখে কি চাপা হাসির আভাস? কিন্তু সে ছাই ভালো করে দেখার উপায় আছে এদের জ্বালায়! কী যে ভাবছে ওর সম্বন্ধে, ধরণী দ্বিধা হও ব্যাপার স্যাপার, ঝিমলি মানে মানে সরে পড়ে সেখান থেকে। ভাবছে কি, হয়ত ভাবছেই না, বয়ে গেছে তার, ওর মত বিচ্ছিরি, লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ, কোনোকিছুতেই ভালো নয় মেয়ের কথা ভাবতে! ... ...
অমলেন্দু বিশ্বাস সেই প্রজন্মের লোক যাদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হতো যে তাঁদের জীবনের সংকল্প ছিল ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন ওই দেশেতেই মরি’। কিন্তু ঠাট্টায় যেটা ধরা পড়ে না তা হলো এই জন্ম আর মৃত্যুর ঠিকানা আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সহজ নয়। যাঁরা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন, এবং যাবার সময়ে ভেবেছেন যাওয়াটা কিরকম, কোথায় যাচ্ছি, যেতে যেতে আমার আমিটার কি হচ্ছে - তাঁদের নিজের জীবন সম্পর্কে লেখার, আমাদের জগতে, একটা বিশাল প্রয়োজন আছে। একশো বছর আগে যা লেখা হতো সেগুলো ইউরোপ যাত্রীর পত্র, বা স্বল্প প্রবাসের কথা, সে প্রবাস যে বাসিন্দা তার সত্তাকেই পরিবর্তিত করে দেয় না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এই প্রবাস অতি সাধারণ; অনেক সময় মনে হয় মধ্যবিত্ত ব্যক্তিদের জীবনের প্রথমটা এই প্রবাসেরই সুদূর ভূমিকা বা প্রস্তুতি। মনে রাখতে হয় অবশ্যই এই প্রবাসও পরিবর্তনশীল - ষাট-সত্তরের পাশ্চাত্য সমাজ এখনকার পাশ্চাত্য সমাজের মতো ছিল না; ষাট সত্তরের মধ্যবিত্ত বাঙালি সত্ত্বাও তার এখনকার অবতারের থেকে আলাদা ছিল। তার থেকেও বড়ো কথা, প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ এই প্রবাসের ইতিহাসকে নিজের মতো করে তৈরী করে নেয়। এই সততভিন্নতার জন্যেই একজন ব্যক্তির এক বিশাল ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যাত্রার কাহিনী আমাদের পড়তে ভালো লাগে। ... ...
এইখানে প্রকৃতি একটি ফাঁদ পেতে রেখেছেন। আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে আরেকটি অন্তরীপ আছে তার নাম হাং ক্লিপ। নাবিক জানে ফেরার সময়ে মহাদেশের শেষ বিন্দুতে এসে জাহাজ যাবে উত্তর মুখে,সাদার্ন ক্রসকে চোখে রেখে, আফ্রিকার উপকূল যথারীতি রইবে ডান দিকে। তিনশো বছর আগে কিছু নাবিক ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়ে এই হাংক্লিপ অন্তরীপকে কেপ অফ গুড হোপ ভেবে জাহাজের মুখ ঘুরিয়েছেন উত্তর দিকে, ফলে অনেকটা ঘুরে এসে আবার বুঝেছেন, উত্তর নয় এখন তাদের জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে দক্ষিণে, তবে পৌঁছুবেন আসল কেপ অফ গুড হোপে। এই ভ্রান্তির কারণে উপসাগরের নাম ফলস বে যার নাম হওয়া উচিত ছিল দি রং বে! হেলিকপটার থেকে দেখলে মনে হবে ফলস বে যেন একটি প্রকাণ্ড প্রাকৃতিক বাথটাব, প্রায় একটি বর্গক্ষেত্র, তিরিশ বাই তিরিশ কিলোমিটার! ... ...
গেরস্তের ঘরে ধান উঠচে, ঘরে ঘরে আমোদ আল্লাদ। বরের গলা জড়িয়ে নতুন পুরনো সব বউয়ের বায়না, এবার কিন্তু ওই গয়না/ শাড়িটা দিতে হবে। কতা দিয়েচো, ধান উটলে। ছেলে মেয়েরা খুশি। পরীক্ষা শেষ। যত খুশি খেলো। লুকোচুরি খেলার আদর্শ সময়। খামারে খামারে ধানের খড়ের, কুটির মেলা। লুকনো সোজা। তারপর সাঁঝবেলায় বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে নিজেরাই রেঁধে বেড়ে ফিস্টি। ... ...
আফ্রিকা মহাদেশ পরিক্রমা করে ইউরোপ থেকে ভারত তথা পূর্ব এশিয়ার পথ খুঁজে নিয়েছেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী নির্মম লুটেরা ভাস্কো দা গামা। সেই দীর্ঘ নৌ-সফরে নাবিকদের প্রয়োজন মাঝেমধ্যে স্থল-বিরতি, একটি সাময়িক আস্তানা, খাদ্য ও পানীয়ের সরবরাহ কেন্দ্র। লিসবন থেকে পালতোলা জাহাজের প্রায় তিন মাস লেগে যেত আফ্রিকার শেষপ্রান্তে পৌঁছতে, খানিক থেমে আবার যাত্রা। পূর্ব এশিয়া (ইস্ট ইন্ডিজ) যাওয়ার পথে একদিন ইয়ান ফান রিবেক হল্যান্ড থেকে আশি জন পুরুষ, আট জন মহিলা সহ তিনটি জাহাজ নিয়ে আটল্যান্টিকের অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে পাহাড়ের নিচে এই শান্ত বন্দরে নোঙর ফেললেন, সেদিন ৬ই এপ্রিল, ১৬৫২। রিবেক ও তার সঙ্গীদের জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গেল। দূরে গাঢ় নীল সমুদ্র সফেন অথচ বন্দর নিস্তরঙ্গ, সামনে খাড়া পাহাড় যার শিখর একেবারে সমতল; তার নাম দিলেন টাফেলবার্গ, টেবল মাউন্টেন। ভারত, জাভা, বোর্নিও , মশলা-দ্বীপ নাহয় পরে যাওয়া যাবে। আগন্তুক ডাচ মানুষেরা ভাবলেন এখানেই আড্ডা গাড়া যাক - স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদ করে সংসার পাতলেন। সেই আফ্রিকার দক্ষিণতম ভূখণ্ডে শ্বেত-পদসঞ্চারের প্রারম্ভ, যার মাশুল গুণতে হবে সেখানে স্থিত বা আগত সকল অশ্বেতকায় মানুষকে, মালে, চিনা,ভারতীয়কে। এই অন্তরীপ শহর আর হাল ভেঙে ক্লান্ত নাবিকের কোনো বুড়ি ছোঁয়ার বন্দর রইল না। ক’টা দিন থেমে চাল কলা আলু কুমড়ো পটল জাহাজে তুলে নিয়ে, ফ্লাস্কে জল ভরে ভারত যাত্রার ওয়েটিং রুমও নয়। নতুন বিজনেস মডেল - জমিদারি, চাষবাস আর ভারত অভিযাত্রীরা যখন এখানে থামবেন তাঁদের ‘চায় গরম’ অফার করা, মোটরওয়ের রেস্তোরাঁর মতন। লোভী ডাচ ক্রমশ দখল করবেন চাষের জমি, লাগাবেন আঙুরের চারা, দূরে ভাগাবেন খোই খোই জাতিকে তাঁদের হাজার বছরের বাসভূমি থেকে। ... ...
আশির দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলার বেশিরভাগ ক্লাব ব্যস্ত থাকতো ফুটবল নিয়ে। পরের দিকে ক্রিকেট ভলিবল এসব আসে। এছাড়া কবাডি প্রতিযোগিতা হতো। আর ছিল যাত্রা গ্রামীণ কোনও মেলা বা উৎসব ঘিরে যাত্রা করা। বাইরের দল নিয়ে যাত্রার আয়োজন করা হতো ফুটবল মাঠের উন্নয়ন বা ইত্যাদি বিষয়ে। কিন্তু অ্যামেচার যাত্রা এবং নাটক ছিল ক্লাবগুলোর প্রাণ। এছাড়াও ক্যারাম, দাবা, চাইনিজ চেকার, তাস, দাবার আয়োজন থাকতো। আড্ডা ছিল ক্লাবের প্রাণ। পানভোজন ক্লাব সংস্কৃতির অঙ্গ হয়নি। অন্তত আশির দশক পর্যন্ত। ... ...
সত্তরের দশকে ফুটবল ঘিরে গ্রাম বাংলায় যে উন্মাদনা ছিল তা আজ কল্পনাই করা যায় না। ফুটবল খেলা মানে কয়েক হাজার দর্শক। আমাদের গ্রামের খেলা থাকলে বাচ্চা বুড়ো সবাই গ্রাম ফাঁকা করে ফুটবল ম্যাচ দেখতে ছুটতো। কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ১০ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত হেঁটে যেত লোকে ফুটবল দেখতে। ... ...
সত্তর দশকের মাঝামাঝি শোনা গেল সবুজ বিপ্লবের কথা। আগে শুধু লোকে অ্যামোনিয়া আর ইউরিয়া দিতেন চাষের সময়। এবার এল পটাশ, গ্রোমোর, ইফকো কোম্পানির নানা সার। তাঁদের প্রতিনিধিরা চাষিদের নিয়ে বৈঠক করতে লাগলেন। বড় চাষির জমিতে বিনা পয়সায় সার দিয়ে দেখিয়ে দিল, ধান কত বেশি হচ্ছে। কেউ কেউ বললেন, সার দিয়ে দিয়ে জমির পোঙা মেরে দিচ্ছে। ছিবড়ে করে দিচ্ছে। কিন্তু সে কথা উন্নয়ন হাওয়ায় উড়ে গেল। একে একে এরপর নতুন ধান এল। বেশি ফলনের লক্ষ্যে। পাঞ্জাব খাস, আই আর এইট, মিনিকিট, বসুমতী, মশুরি এবং চীনা ধান তাই চুং। ... ...
আমার তা-ই মনে হয়েছে, বলে ফল্গু, কিন্তু এসপিণ্ডোলো ছাড়া আর কাউকেই বলিনি। তোদের বলছিলুম বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছি, সেই বিশেষজ্ঞ তিনিই। পেরুর পুলিশকে জানালে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা ছিল। কে দখল নেবে, ক্রেডিট কার – এইসব আন্তর্জাতিক কচকচি তৈরি হত। ব্যাপারটা তাই ছেড়ে দিয়েছি এসপিণ্ডোলোর হাতে। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফল্গু, কিন্তু এখনো কিছু জানালেন না এসপিণ্ডোলো। এদিকে পরশু দিনের ফ্লাইট কনফার্মেশন হয়ে গেছে আমাদের। ফেরবার আগে জানতে পারব কিনা কে জানে! ... ...
এলাকার বিধায়ক রামনারায়ণ গোস্বামীর খুব প্রিয় ছিলেন। সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির নেতা করে তাঁকে দিল্লি না পাঠালে হয়তো বাবার পক্ষে একটু বেশি ভালো হতো। যাক, বাবার গলা শুনে চিন্তিত হলাম। কিছুদিন আগেই একটা মিলে চারজন শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে। বাবা বারবার বলা সত্ত্বেও তেমন আন্দোলন করছে না পার্টি। কিছুদিন আগে বাড়িতে একটা ব্রাঞ্চ মিটিং হয়েছে। চাপা স্বরে কথা। কিছু শুনতে পাই নি। আর বাবা দাদা এঁরা তখনকার রীতি অনুযায়ী পার্টির ভেতরের কথা বাড়িতে বা বন্ধু দের কাউকে বলতেন না। খালি মিটিং শেষে এক পার্টি নেতার কথা শুনলাম, বাবাকে বলছেন, এনাম পার্টিতে আমার শিকড় অনেক ভিতরে। তুমি কিছু করতে পারবে না। ... ...
পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবেই বেঁচে থাকলেন। পার্টির গণসঙ্গীত স্কোয়াডে কিছু দিন ছিলেন। পরে সেসবে ভাটা পড়ে যায়। গণনাট্য সঙ্ঘের বর্ধমানের কর্তা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আন্দোলনের নেতা। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কলকাঠি তিনিই নাড়তেন। কে অধ্যাপক হবেন কে পদোন্নতি পাবেন বিশেষ করে কে চাকরি পাবেন কর্মচারী পদে অফিসার পদে-- সে সবের দণ্ড মুণ্ডের মালিক তিনিই। উপাচার্য যিনিই হোন, তিনিই শেষ কথা। ... ...