শ্মশান থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি পরম স্নেহে বললেন---আহা চোখ মুখ বসে গেছে। খুব খিদে পেয়েছে তো? যাও বাবা স্নান করে আগে খেয়ে নাও। অমরের সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। হাতে মুখে জল দিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে সাজান রয়েছে দুধ, সাবু, ফল আর মিষ্টি। খাবারের দিকে তাকিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল। নামমাত্র একটু মুখে দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা দিনে না জুটল খাওয়া আর না হল বিশ্রাম। পাশের ঘরে তখন গল্পের মস্ত আসর বসেছে। মাঝে মাঝেই হাহা হিহি আওয়াজ ভেসে আসছে। সদ্য কাছা নেওয়া শ্বশুর মশাইও ঐ আসরে রয়েছেন। আর রমা তো মধ্যমণি। অমর শুয়ে শুয়ে ভাবে, অন্তরে যেখানে শোকের লেশমাত্র নেই সেখানে কেবলমাত্র লোকলজ্জার খাতিরে খাদ্যে আর বস্ত্রে এই কদিনের কৃচ্ছ সাধনের কি প্রয়োজন! ... ...
সেলিমকে কড়া ধমক লাগিয়ে ভেবেছিলাম, এতেই কাজ হবে। তাছাড়া, চাইলেই কি আর ম্যানেজ করতে পারবে! বিশেষত কোম্পানির হিসেবনিকেশ এসব ক্ষেত্রে যখন খুবই কড়া! কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বিশাল পলিপ্যাকে করে একটি সদ্যোজাত হাতি হাজির হল আমার টেবিলে। সারাদিন ছুঁয়ে না দেখলেও দিনশেষে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম জিনিসটা, সেলিমের কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না! ... ...
এবার আর ভুল হয়নি, গেল শীতেই তো ডেকে এনেছিলেন, আর হ্যান্ডশেক করতে করতে বলেছিলেন, “কঠিন রাজনৈতিক কলাম বাদ দিয়ে ভূতের গল্পও তো লিখতে পার!“ ... ...
রাতে বাড়ী ফিরে দেখে যোগমায়ার শরীর খারাপ। গায়ে জ্বর, চুপচাপ শুয়ে আছে। মুখঝামটা যতই দিক বৌকে নন্দ যথেষ্ট ভালবাসে। ডাক্তার ডাকা মানেই এখনি কয়েকশ টাকা খসবে, তা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল—হ্যাঁগো, বিপিন ডাক্তারকে একটা খবর দিই? যোগমায়া স্বামীকে মানা করল—অত ব্যস্ত হতে হবে না। সামান্য জ্বর, একটু শুয়ে বসে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভাল হওয়া দূরে থাক পরদিন বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু হল। নন্দ আর দেরী না করে বিপিন ডাক্তারকে নিয়ে এল। ডাক্তার যখন এসেছে তখন যোগমায়া প্রায় সংজ্ঞাহীন। ডাক্তার যত শীঘ্র সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল। একা কিভাবে কি ব্যবস্থা করবে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে সাহায্যের আশায় নন্দ পাগলের মত ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। প্রথমেই নজর গেল বাড়ির থেকে কয়েক পা দূরে চায়ের দোকানের আড্ডাটায়। অনেক গুলো ছেলে ছোকরা গুলতানি করছে। এই চায়ের দোকানের আড্ডাটাকে ও কোন কালেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এখন ওসব ভাবার সময় নেই। দোকানে গিয়ে কাতর ভাবে বলল—আমার বাড়িতে বড় বিপদ, একটু আসবে ভাই! ঘটনা শুনে নন্দকে আশ্বস্ত করে ছেলেগুলো বলল--কাকু আপনি শান্ত হোন। আমরা সকলে আছি, কোন চিন্তা করতে হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকজন নন্দর বাড়িতে পৌঁছে গেল। আর তাদের অধিকাংশই নন্দর অপছন্দের ওই জানোয়ারের দলের। সত্যিই নন্দকে কিছু করতে হয়নি। ওরাই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মুমূর্ষু যোগমায়াকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করল। ভর্তির সময় প্রয়োজনীয় টাকাটাও নিজেরাই যোগাড় করে জমা দিয়েছে। যোগমায়া যে কদিন হাসপাতালে ছিল সে কদিন রাতজাগা থেকে আরম্ভ করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ, সব ওরাই পালা করে করেছে। ডিসচার্জের দিন স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছে নন্দ দেখে যে ছেলেগুলো আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। নন্দর দুচোখ জলে ভরে গেল। মানুষকে বোঝা, তার ভালমন্দের বিচার করা খুবই কঠিন। এতবড় একটা বিপদের আঁচও ওরা গায়ে লাগতে দেয়নি। ... ...
সংসারের অন্যান্য দায়িত্বের সাথে সাথে শ্বশুরকে ভোরের চা থেকে আরম্ভ করে রাতের খাবার দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত কিছু বিমলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করে। এখন টুকটাক কিছু কাজ ছাড়া মলিনাকে প্রায় কিছু করতেই হয় না। সবই বৌমা করে। কাজের ভার কমলে খারাপ লাগার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা তো অন্য যায়গায়। সারা জীবন এই সংসার একা চালিয়েছেন। যা উচিৎ মনে করছেন তাই হয়েছে। সেই সংসারেই কাজ কমার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে কর্তৃত্ব। এখন তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাই শেষ কথা নয়, বৌমার মতটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর সব থেকে বিরক্তির ব্যাপার হল যে, এতে সত্যেনের প্রচ্ছন্ন আশকারা আছে। শাশুড়ি বউএর মনমালিন্য নতুন কিছু নয়। হয় না এমন বাড়ি খুব কমই আছে। কিন্তু এই তরজার কিছু নিয়ম আছে। শ্বশুরের জীবিতাবস্থায় শাশুড়ি যতদিন কর্মক্ষম থাকে ততদিন এই দ্বৈরথে বিজয় তিলক তাঁর কপালেই থাকে। তারপর ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু এ তো সময় দিল না। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মলিনাকে একেবারে নক্ - আউট করে দিল। বৌমা চিৎকার চেঁচামেচি করে না। যা করবে ঠিক করে তা করে ছাড়ে। যেটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। তাই চেঁচামেচি তাঁকেই করতে হয়। প্রথম দিকে অল্প ছিল কিন্তু বৌমার দখলদারি বাড়ার সাথে সাথে অশান্তিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। সেবা যত্ন করে শ্বশুরকেও হাত করে নিয়েছে। সেবা তাঁকেও যে করেনা তা নয়। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক নয় তা হল বৌমার মাতব্বরি। ... ...
ছোটবেলায় বিজয়ার সময় ঠাকুর চলে গেলে অফুরন্ত খেলাধূলোর আনন্দ ছেড়ে আবার নিয়মবদ্ধ পড়াশুনোর জীবনে ফিরতে হবে এই ভেবে মনখারাপ হত খুব। আর এখন অফুরন্ত সময়।হাজারো নিয়ম-রীতি পাশাপাশি সাজিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই মাথার পিছনে।তবুও ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য বড় কষ্ট হয়।( পড়ে নিন গল্পটি) ... ...
তাহলে ছেলের অনুরোধটা রাখছেন না কেন – এ কথা আর আমি জিজ্ঞাসা করতে গেলাম না তাকে। কারণ এখন মনে হচ্ছে, মরণের আগ পর্যন্ত এই ব্যবসা ছাড়বেন না তিনি। জমিগুলো যেমন সবসময় এক রকম না – কখনো তৃণের দখলে চলে, কখনো পুড়ে যায়, কখনো ঝুরঝুর করে পড়তে থাকে, আবার, কখনো দুফাঁক হয়ে যায় বুক চিরে, উঁচু পাহাড় হয়… তেমনি জমির ক্রেতা-বিক্রেতার জীবনেও আসে পরিবর্তন, তারাও জলে বা বাতাসে এক সময় প্রস্তর হয়। জমির সাথে যেন তার ক্রেতা-বিক্রেতার একটা সমান্তরল জীবন, যা অন্তহীন ও অনিঃশেষিত। আর জগতদা মনে করেন, পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র জমির ব্যবসাটা বোঝেন এবং তিনি না থাকলে ব্যবসাটা যখন আর থাকবেই না, ... ...
এলাকাটা ইতিমধ্যেই ভুতুড়ে আকার ধারণ করেছে! এই দাবদাহেই বিদ্যুতটা দরকার সব থেকে বেশী, অথচ প্রতি বছর এই সময়েই লোডশেডিংয়ের ভূতটা চেপে বসে! কর্তৃপক্ষ অবশ্য হরহামেশাই ‘সীমিত সম্পদ’ কার্ডটা ছেড়ে দেয় বাজারে! কিন্তু মাটির নীচে ও উপরে এত সম্পদ আছে আর কয়টা দেশে? ... ...
লুবনার মুখখানা তখন পুরো সেলাই হয়ে আছে সংকোচে! আর এই সংকোচটা ছোট থেকেই ছিল লুবনার। যখন প্রাইমারিতে পড়ত, তখন থেকেই ছেলেদের সহ্য করতে পারত না সে! আর এজন্যই কিনা স্কুলের প্রেমের অফারের মত ফিরিয়ে দিয়েছে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব! ... ...
মিডিয়া কিভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে । ... ...
রেখা ঢাকায় থাকে, স্বামী একটি বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রডাকশান ম্যানেজার। উন্নত বাসা, সিকিউরিটির চোখ সর্বত্র, বাসায় সাহায্যকারী লোকেরও নেই অভাব। তারপরো এক ফোঁটা চোখ বোঁজা আর দম নেয়ার অবকাশ নেই রেখার! ওর কেবলি মনে হয় এই বুঝি ছেলেটাকে কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল! অথবা, এই বুঝি সে কোন অ্যাকসিডেন্ট করল! ... ...
অনেক ভারি-ভারি জিনিস লেখা হল, এবার অন্য কথা শুনুন। এটা জীবনস্মৃতির গল্প। রবীন্দ্রনাথ তখন সদর স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন। কলকাতার রাস্তা সে সময় একদম ফাঁকা-ফাঁকা। ভোরবেলা বারান্দা থেকে এদিকে ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, ওদিকে ভিক্টোরিয়া আর ওপাশে ভবানীপুর অবধি দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের তখন রাইটার্স ব্লক চলছে, তাই ভোরে উঠে বারান্দায় বসে থাকতেন, যদি কোনো অনুপ্রেরণা আসে। ভিক্টোরিয়ায় দেখতেন বুট-পরা সায়েব মেম, প্রাতঃভ্রমণে। ফ্রিস্কুল স্ট্রিট শুনশান। অন্যদিকে কিছু বাঙালি লোকজন, চটি পরে চলেছে। এক মহিলাকে প্রায়ই দেখতেন উচ্চকিত স্বরে কথা বলতে বলতে চলেছেন। যেমন জোরালো কণ্ঠ, তেমনই দাপট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবার একটু বিষণ্ণ ধরণের লোক, এইসব দেখে কবিতা আসেনা। কিন্তু জেদ তো কম না, তাই বসেই থাকতেন। কাদম্বরী প্রায়ই এসে তাঁর পিছনে লাগতেন, তবু বসে থাকতেন। ... ...
হ্যাঁ, আমার এরকম একটা ঘটনা আছে, এবং এখন পর্যন্ত আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কারোরই তা জানা নেই। তবে এই অবিশ্বাসী ও অর্বাচীন ডাক্তারটিকে সে কথা জানানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। শৈশবের দিনগুলিতে বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই নানুবাড়ি যাওয়া ছিল আমাদের জন্য রুটিন ওয়ার্কের মত। নানুবাড়ির পেছনে একটা জংগলের মত ছিল - সেখানে আমরা কাজিনরা সবাই দল বেঁধে আউটিং করতাম, বিভিন্ন রকম এডভেঞ্চারে মেতে উঠতাম। এমনি এক আউটিংয়ে দলের লোকজন একটু বেশীই ছিল, আর জংগলটাও খুব ভরতি হয়ে ছিল গাছে-লতায়-পাতায় যাদের বাঁধন টুটে সামনে এগোনো কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল! কিছুটা এগুনোর পর হঠাৎ একটা অদ্ভুত দেখতে অচেনা বুনো ফুল আমার চোখে আটকে দেয়; এতটাই বিভোর হয়ে যাই যে খেয়ালই করিনি কখন দলছুট হয়ে গিয়েছি। ... ...
তদন্তে নতুন ক্লু এসেছে। বাইরে কয়েকটা ফচকে ছোঁড়াছুড়ি স্লোগান দিচ্ছে, এজেন্সির বড়বাবু ওসবে কান না দিয়ে ক্লাস সেভেনের ব্যাকরণ বই খুলে বাগধারা চ্যাপ্টারটা পড়ছিলেন, চুড়ি-পরা বিষয়ে তদন্তের জন্য, এমন সময় ধড়মড়িয়ে ছোটোবাবু এসে বললেন, স্যার ওদের মনে হয় ভিতরে চর আছে। শুনুন কী বলছে। বড়বাবু কান খাড়া করে শুনলেন, বাইরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্লোগান হচ্ছেঃ পরব চুড়ি মারব চড় / জাস্টিস ফর আরজিকর। ... ...
লেকি চলে যাওয়ার পর, আমি দরজি’র দিকে ফিরলাম, “এটা কি বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার না? লেকি’র পক্ষে এটা কি করে না জেনে থাকা সম্ভব? তার বন্ধুটি কোথায় আছে, কি করছে – সে কিছুই জানবে না? লেকির কথাটা , মানে, স্যানগে যে লেকির সাথে কোন সাথে যোগাযোগই করছে না – সত্যি হলে কিন্তু ভয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে … এই এত বড় শহরে যেকোন কিছু ঘটতে পারে স্যানগে’র সাথে, ” আমি বললাম টিভি সংবাদে আসা নিখোঁজ মহিলাদের দুর্ভাগ্যজনক কাহিনীগুলোকে মাথায় রেখে। দরজিকে খুব একটা বিচলিত মনে হল না, বরং সে মনে হয় আমার এই উদ্বেগে এক প্রকার আমোদই অনুভব করল। “তুমি খুব বেশী টিভি দেখছো ইদানিং” সে বলল। ... ...
বাবার বয়েস হয়েছে; কিন্তু তার চেয়ে বেশী বয়েসীরাও তো হেসে-খেলে, ঘুরে-ফিরে জীবন যাপন করছে, সমাজ-সেবা, ওরশ-মাহফিলে মশগুল থাকছে। কিন্তু বাবা আরো বছর পাঁচেক আগে থেকেই যেন কবর দেখতে পাচ্ছেন সামনে! তার কোথায় কি আছে, আর কিভাবে সেগুলো ভাগ হবে, তা নিয়ে আমাদের ভাইবোনদের সাথে বেশ কয়েকবার বসা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গেল বছর, যত দেনাপাওনা আছে, তাও চুকিয়ে ফেললেন। শুধু এক পাওনাদারকে নিয়েই ঘটে গিয়েছিল বিপত্তি। প্রায় তিরিশ বছর আগে বিপদে পড়ে সামান্য ক’টা টাকা হাওলাৎ করেছিলেন; কিন্তু দিনের পর দিন খুঁজেও পাওয়া গেল না লোকটিকে। পরে যখন জানা গেল, তিনি মারা গেছেন, আর তার কোন ওয়ারিশও নেই, তখন কিছু অভাবী মানুষ খুঁজে নিয়ে তাকে দান করে দিতে হল সেই টাকাটা! ... ...
মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ধর্মের অছিলায় বিনোদনের এই আসরের ঔচিত্য, কোন ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা দিয়ে প্রতিপাদন করা যায় না। তবুও এই মোচ্ছব আজ ঘরে ঘরে। ... ...