ভাঙন, ভাঙন সব খায়। ঘরবাড়ি, গাছপালা, স্কুল কলেজ, মন্দির মসজিদ, শ্মশানঘাট কবরস্থান, মানুষজন, গরুছাগল, রাস্তাঘাট, সংসার। নদী হল আগুনের মত, কিছুই রাখে না। ভুল হল, আগুন ছাই ফেলে রাখে, নদী আরও নির্মম -- সে রাখে শুধু স্মৃতি। কত স্মৃতি। তিন চার জন বন্ধুর সাথে আলপথে ছুটে যাচ্ছে যে বাচ্চাটা, সে দাদু নয়, কারো নাতি। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে গাছ থেকে ঢিল ছুঁড়ে কুল পাড়ছে... নদীর ধারে ডাঙ্গুলি খেলছে, ক্লাস টেনে ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দিল, বটতলায় পুঁটি (ভাল নাম পার্বতী)-কে দেখে শরীরে একটা কাঁপুনি তৈরি হল, বাবার কথায় একটু একটু করে চাষের কাজ শিখতে শুরু করল, জমিজমা ছিল কিছু, একদিন পুঁটি অন্য কারও বৌ হয়ে গেল, তারপর একদিন... ... ...
বললে হবেনা, ছোটোবেলায় আমিও দাবা খেলতাম। ঘোড়াই আড়াই চাল, সিসিলিয়ান ডিফেন্সের নাজডর্ফ ভ্যারিয়েশন, সব জানি। হ্যাঁ, তারপর অনেকদিন ওসব ফলো করা হয়না। কিন্তু কাল দেখলাম গুকেশকে। নামটা যেন একটু কেমন মতো, কিন্তু কী চাউনি, বাপরে। ব্যস পুরো দাবা ব্যাপারটাই মনে পড়ে গেল, সাঁতার আর সাইকেল কী কেউ ভোলে রে ভাই। আঠারো বছর ধরে রগড়ানো, বোরিং গলা সাধা, ওসব কী আর লাগে রে ভাই। দাবা হল অ্যাটিটিউড। আসল কথা হল, ক্রিকেট খেলতে হলে লর্ডসের বারান্দায় জামা ওড়ানো আর দাবার বোর্ডে প্রতিপক্ষকে চাউনি দেওয়াটা শিখতে হবে। দৃষ্টিই হল সৃষ্টি। ঘোড়ার আড়াই চাল, সেসব নেহাৎই বা*। ... ...
তিথি যে ঠিক কার সঙ্গে ছক করছে বুঝতে পারিনা। সেবার ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে চকলেট এনেছিলাম, বলল মাথাব্যথা, এখন কিছু হবেনা। কে জানে ভাই, এ কী ধরণের মাথা। আমার তো শরীরেই মাথাব্যথা সারে। অষ্টমীর দিন নিয়ে এসেছিলাম একটা বোতল, বলে পিরিয়ড চলছে। মাসে একদিন ওসব হয়, সব্বাই জানে, কিন্তু বেছে বেছে আমি থাকলেই হতে হবে? এবার এই চব্বিশে বৈশাখটাও শুকনো যাবে কারণ, তিথি আজকে নাকি খেলা দেখছে। ঠিক এক হাত দূরত্ব রেখে বসে, থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এই প্রথম উইকেটটা পড়ল। খুব উত্তেজনা, কিন্তু সেটা আমায় দেখে না। খেলায় এত আগ্রহ তো জানতাম না। ওদিকে আবার নাকি রবীন্দ্রভক্ত। সব ফালতু কথা। রবীন্দ্রসঙ্গীত চালালে মুড এলেও আসতে পারত। কিন্তু টিভি চললে ওসব অসম্ভব। উত্তেজনা সবই টিভি খেয়ে নেবে। ... ...
শুভর পুরো শরীরটা যেন বুলেটবিদ্ধ ডলফিনের মত ঝাঁকুনি খেল ক্ষণিকের তরে! দীপের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সে মাথাটা নীচু করে ফেলল, তারপর সেই অবস্থাতেই মৃগী রোগীর মত স্বর বেরুলো তার মধ্য থেকে, “তার মানে… তোর চোখেও পড়েছে …জানিস, ওকে আমি এখনো স্পর্শ করতে পারিনি! ও শুধু একা থাকতে চায়, কাউকে কাছে দেখলেই ওর গায়ে মনে হয় জ্বালা ধরে! ভাবলাম, বৈবাহিক সম্পর্কটা নিয়ে ওর ভীতি আছে, বেড়াতে এলে কেটে যাবে। দ্বীপটিতে ঢোকার পর ওর চোখেমুখে অন্য রকম খুশীর ভাব দেখে মনে হয়েছিল, বরফ গলতে শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, সে খুশী ওর নিজের কাছে! ও যেন আমায় আরও ঘেন্না করতে শুরু করেছে! তাছাড়া, আর …আর একটা… ব্যাপার …’ শেষ করতে পারে না শুভ, এদিক ওদিক তাকায় ভয়ে ভয়ে, মনে হয়, কেউ শুনে ফেললে নেমে আসতে পারে রোজ কেয়ামত! ... ...
আরো কিছু কর্মপরিকল্পণা প্রায় চুড়ান্ত করে এনেছে, এমন সময় তার মনে পড়ে গেল, তার হাতে সময় নেই একদমই। তার তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ পড়ে আছে সামনে! তাই সে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল আবার সামনের দিকে। তার পায়ের পাতাটায় অবশ্য একটা আজব স্পর্শ-অনুভূতি হচ্ছিল! সে কি কঠিন শিলা, নরম পলি মাটি, না কি জল, বরফ আর মেঘের তুলোর স্পর্শ, তা সে বুঝতে পারছিল না সে। তার মনে হচ্ছিল, এসবের বাইরে একটা কিছু হবে, আর যা বর্ণনার জন্য কোন শব্দ তার ভান্ডারে নেই! ... ...
খরগোশদের আনন্দ ধরে না। নাচতে নাচতে লাফাতে লাফাতে তারা চলে বনের ধারে। তারপর শুরু হয় মহাযজ্ঞ। খরগোশ কর্তা তুর তুর করে নখ দিয়ে মাটি ভাঙ্গেন আর অবরে সবরে গোঁফে তা দেন, তাই না দেখে গিন্নিটি লজ্জায় লাল হয়ে ওঠেন। চিকচিকে চোখে হাসি মেখে তিনি কলকে ফুলের কলস ভরে জল আনেন, পদ্ম পাতায় ধরে রাখা ভোরের শিশির নিয়ে আসেন, মাটির তেষ্টা মেটাতে। আদরে আদরে মাটি ভিজে ওঠে। কর্তাগিন্নি দুজনে মিলে ক্ষেতে কাজ করে, বীজ থেকে চারা তৈরি করে, চারাদের যত্ন করে, তাদের আনন্দে-হাসিতে পাতারাও যেন হেসে ওঠে, শক্ত করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, জড়াজড়ি করে ওম খোঁজে। বাচ্চারা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ক্ষেতের চারপাশে ছুটে বেড়ায়। হৈ হৈ করে ক্ষেত পাহারা দেয়। আর স্বপ্ন দেখে, আহা গোল গোল টাটকা বাঁধাকপির পাতা কতই না সুস্বাদু! আর কদিন পরেই তারা তাজা বাঁধাকপির পাতা দিয়ে লাঞ্চ ডিনার ব্রেকফাস্ট স-অ-ব করবে । স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। ... ...
বলটা কোমর হাইটে, খগার ডানপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ খগার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মত একটা ছবি মনে পড়ল। কাকার ফেভারিট একটা ছবি, বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা একটা ঝাঁকড়াচুলো লোক বাঁপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডানপায়ে ভলি মারছে। ডানপাটা বাঁ পায়ের সাথে সমকোণে রয়েছে। কাকা খবরের কাগজ থেকে কেটে ছবিটা নিজের বইয়ের আলমারীতে চিপকে রেখেছে। ছবিটা মনে পড়তেই খগা ডান পা তুলে সটান চালিয়ে দিল বলটা লক্ষ্য করে। ... ...
যে বিপুল বেগে ছিটকে পড়েছিল নীচে, বাঁচার আশা একদম ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পর জ্ঞান ফিরে এল তার, একটু একটু করে চোখ খুললো, তখনো ব্যথাটা পুরো বিদায় নেয়নি, নিজের গায়ে চিমটি কাটলো সে… যাদুমাখা সেই জগৎ যা তার মর্মে মর্মে জাগিয়ে তুলেছিল অজানা শিহরন, নিজেকে আবিষ্কার করল তার কুসুম-কোমল পিঠে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছিল প্রথমে, পরে সামলে নিয়ে চারধার ভাল করে দেখতে শুরু করে সে, খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে প্রতিটা বস্তু, শেষমেষ আশু বিপদের কোন সংকেত না পেয়ে ফের হাঁটা শুরু করে। ... ...
ধরা যাক, রাস্তার ধারে একটি কৃষ্ণচুড়া আপাদমস্তক সিঁদুর মেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও এতটুকু জায়গা ফাঁকা নেই আর। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকবে নাইম। ধ্যানমগ্ন মুনীর মত সে চোখ দুটো জড়ো করে জড় হয়ে পড়বে! আবার, কোন অপূর্ব নকশাকাটা দালান, তাও টানবে তাকে জন্মজন্মান্তরের বাঁধন ছাড়িয়ে! বলতে কী, পাতা বা পাথর দুই-ই সমান করে টানে তাকে। কিন্তু এখানেও সে এক দর্শক, তার কাজ যেন শুধু দেখে যাওয়া, আর ভাল লাগা! এভাবেই হয়ত তার ভাল লাগত ফুটফুটে কোন মেয়েকে। সে দেখত আর চলে যেত। কিন্তু একজন জীবন্ত মানবী পাথরের মত নয়; সেখানে জীবন্ত সাড়া থাকে, বিধি বিধান থাকে – আর এসব যেন অজানাই ছিল নাইমের। তাকে কখনো যেচে আলাপ করতে দেখা যায়নি কোন মেয়ের সাথে। অথচ সেও তো একজন জীবন্ত প্রাণী, সেও তো একটি মেয়েকে নিজের করে নেয়ার জন্য যত প্রকার বুজরুকি আছে, প্রয়োগ করতে পারত। কিন্তু নিজে থেকে মন্ত্র পড়া, তাকতুক তো দূরের কথা, কোন মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হলেও সেই সংকেত কখনোই পৌঁছুতো না তার বন্দরে। আসলে সে তো একজন দর্শক, সে তো চলচ্চিত্রটি উপভোগ করতে এসেছে, অ্যাক্টিং করতে নয়! ... ...