প্রতিবেশী বাংলাদেশ উত্তপ্ত। কোটা বিরোধী আন্দোলন সে দেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এক বিশাল অংশের ছাত্র সমাজ সরাসরি রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের সঙ্গে এবং অন্যান্য সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্র রয়েছেন কিন্তু সিংহভাগই সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে পুলিশ কর্মীরও। এই বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়েছে আন্দোলন ও সংঘর্ষের ব্যাপকতা কতখানি ছিল যার ঢেউ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে রাজপথে আছড়ে পড়েছে। ... ...
মূল শিল্পীর অনুষ্ঠানে জাঁকজমক এবং শব্দের মাত্রা আরো কয়েককাঠি ওপরে। কেউ যে নিজের গাওয়া অত্যন্ত বিখ্যাত কিছু গানের পিণ্ডি এইভাবে চটকাতে পারেন—তা না শুনলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। শিল্পীর যত না গানে মনোযোগ, তার কয়েকগুণ বেশি মনোযোগ কেশসজ্জায় কিংবা লাফালাফিতে। তবে যে পুজোর যা মন্ত্র—যেরকম মাল দু-তিন কোটি টাকায় বিক্রি হবে, গায়ক তো তেমন জিনিসই উপহার দেবেন। সুরমণ্ডল সহযোগে সঠিক সুরে গাওয়া গানের দাম যদি দু্-তিন কোটির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র হয় (এবং তাও যদি সঠিক সময়ে না পাওয়া যায়), তবে কর্কশ চেঁচামেচির রাস্তা বেছে নেওয়াই ভালো। ... ...
আমার ছোটবেলা ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত অবস্থা, ৫০-এর দুর্ভিক্ষ(খ্রীষ্টাব্দ ধরলে ১৯৪৩), ভারতের স্বাধীনতা, নেতাজীর যুদ্ধ প্রচেষ্টা, বোম্বাই-এর রাজকীয় নৌসেনার বিদ্রোহ, দেশভাগ(বাংলা ও পাঞ্জাব), পাঞ্জাবের-তত-নয় কিন্তু বাংলার অকথ্য দুর্দশার শুরু – যা এখনো এই ৭০-৭১ বছর পরেও চলছে। এতে বাংলার সাধারণ মানুষের কিছু ভুল থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভুল, স্বার্থপরতা, চিন্তার দৈন্য, দলাদলিও কম দায়ী নয়। তাই ভাবলাম, ওই সময়ে আমাদের বাড়ির, পাড়ার, গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু লেখা সম্ভব, চেষ্টা করব। মনে রাখতে হবে যে এই লেখা ইতিহাস লেখা হয়। বরং কৈশোরে পা দেওয়া আট বছরের ছেলে যা দেখেছিল ও নিজের মত বুঝেছিল, তার বর্ণনা। তবে এটাও ঠিক বয়স বাড়লে বুদ্ধি সামান্য পেকেছে, আর তাই আগের দেখাগুলি কখনো কখনো অন্যরকম মনে হয়েছে। তাই একটু “ইধার উধার” হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ... ...
আমার জন্ম অবিভক্ত ভারতে। বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়। গ্রামের নামটি নাগর পাড়া। বাবা শিক্ষকতা করতেন প্রথমে নাগর পাড়া, তারপর টাঙ্গাইলে। নাগর পাড়ায় ছিল পূর্বপুরুষদের স্থায়ী বাড়ি, তাই আয়তনেও বেশ বড়। জমি-জায়গা, গাছগাছালি প্রচুর ছিল। পাঁচটা বড় ঘর ছিল আমাদের। দক্ষিণমুখী বড় শয়ন ঘর – মেঝে ও দেওয়াল ইটের তৈরি, উপরে ত্রিভুজাকৃতি টিনের ছাদ। পূর্বদিক, পশ্চিমদিক আর দক্ষিণদিকে আরো তিনটি ঘর আর মাঝখানে বড় উঠান। পুবদিকের ঘরের পাশে বড় রান্নাঘর ছিল। আর ছিল কুয়ো পায়খানা। ... ...
স্বাধীনতার ৭৫ বছর মানে দেশভাগেরও সুবর্ণজয়ন্তী। তিন-চতুর্থাংশ শতাব্দী আগে যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষগুলি দেশ ছেড়েছিলেন, যাঁরা আমৃত্যু স্বাধীনতাকে 'পার্টিশান' বলে এলেন, তাঁদের বেশিরভাগই আর নেই। বেঁচে আছেন তাঁদের সন্ততিরা, তাঁরাও এখন প্রবীণ, যাঁদের স্মৃতিপটে নানা ভাবে সেই বিভাজন এখনও কাঁটাতার তুলে আছে। কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন দেশভাগ, কেউ বাবার ড্রয়ারের দস্তাবেজে। আমাদের এই বিশেষ 'দেশভাগ' সংখ্যায়, বহুলাংশে কলম ধরেছেন সেই সন্ততিরা। এক এক করে প্রকাশিত হবে গোটা সপ্তাহ ধরে। সঙ্গে আছে, টুকরোটাকরা অন্যান্য লেখা। গল্প ও কবিতারা। পড়তে থাকুন গোটা সপ্তাহ ধরে। কারণ, এই বিভাজনের ইতিহাস মনে করা, মনে রাখা, এবং মনে করিয়ে দেওয়া ভীষণ দরকার। কারণ, ওই অযৌক্তিক কাঁটাতার এখনও আছে, আর ঘাতকেরা এখনও আছে দরজায়। ... ...
সে যাক, এ তো আমার দাদুর গল্প নয়, দেশভাগের কাহিনী, যার গায়ে লেগে আছে, আগুন, হত্যা, অসম্মান আর সব হারাবার টক টক গন্ধ। কিন্তু একথা তো ঠিক, দেশভাগ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান পুঁথিগত হয়েও হতে পারেনি ঐ ড্রয়ার দুটির জন্য। আসলে আজকাল স্মৃতি নির্ভর অভিজ্ঞতা, গল্পকাহিনী, এগুলোও ইতিহাসের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তাই মনে পড়ল ঐ অবিনাশী ড্রয়ার দুটির কথা, যে দুটোতে এখনও রয়ে গেছে মা, ঠাম্মা, দিদা এমনকি প্রতিবেশীদেরও নিজস্ব অভিজ্ঞতা অথবা নিছকই শোনা কথা। টুকরো টুকরো আলাপ এবং প্রলাপ, যাদের জোড়া দিলে উঠে আসে এই উপমহাদেশের একটি বালিকার অকিঞ্চিৎকর শৈশব এবং সেই শৈশবের গায়ে লেগে থাকা এক ভয়ংকর অবিমৃষ্যকারিতার তীব্র গন্ধ। দেশভাগের অনেক পরে জন্ম বলে যে বালিকার পাওনা ছিল একটি নিরুপদ্রব মেয়েবেলা, যে ছিল এইসব ঘটনা থেকে অনেক দূরে, দেশভাগের গল্পকথার অভিঘাত তাকেও ছাড়েনি। চারপাশে মন পালটে দেওয়া, মনুবাদী করে তোলার সমস্ত মাল মশলাই তৈরি ছিল, কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ঐ গল্প ভর্তি গোপন দুটি ড্রয়ার আর সাহিত্যপাঠ। ভাগ্যিস! ... ...
গল্প শুনতে যে মানুষ ভালোবাসে, তার বোধহয় গল্প বলার লোকও ঠিক জুটে যায়। পরের দিন সুমনকাকু আসতেই তাকে বললাম, তোমার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বল। স্বভাবসিদ্ধ হাসিমুখ নিয়ে শুরু করল সুমন কাকু, “বাবাকে ওরা গুলি করে মেরেছিল। আমি আর দাদা পালিয়েছিলাম, আমাদেরও ধরেছিল, কিন্তু পরে ছেড়ে দেয়। তখনই পালিয়ে আসি এখানে।” যে লোকটা এমনি সময় বড্ড বেশি কথা বলে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলার সময় দেখলাম অল্প কথায় কাজ সারল – আমি আর ঘাঁটালাম না। সত্যি বলতে, জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। সুমন কাকু কিন্তু তখনও হাসছেন, বাবার মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বলছেন – কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ-ক্ষোভ কিছুই নেই – কেমন যেন নির্লিপ্ত। এটাই দেশভাগের দান, এই মানুষগুলোর চোখের জল কেড়ে নিয়েছে ৪৭, ৭১ –এই বছরগুলো। এরা আর কিছুতেই আশ্চর্য হয় না। ... ...
পঞ্চক্রোশী। নদী নয়, গ্রামের নাম। আমার নিজের গ্রাম। নামের হয়ত ইতিহাস আছে। সবটা আজ মনেও নেই, থাকবার কথাও নয়। তবু পাবনা জেলার উপান্তে সিরাজগঞ্জ থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরের এই গ্রামে আমার জন্ম। নামের ইতিহাস যাই হোক, গ্রামটি যে এককালে নেহাত ছোট ছিল না তার প্রমাণের অভাব নেই। তার পুরনো আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় নানা কাহিনী বিজড়িত কতকগুলো পরিত্যক্ত ভিটে থেকে, আর পাওয়া যায় হৃত-গৌরব জমিদারবাড়ির চুনকাম খসা, নোনাধরা ইঁটের তিন তলা দালানের চোরা কুঠরির গহবর থেকে -- যেখানে এখন চামচিকে আর লক্ষ্মীপেঁচার তত্ত্বাবধানে পড়ে রয়েছে রৌপ্য-নির্মিত আসা-সোঁটা, বল্লম, বিরাট আকারের ছাতি, চিত্র-বিচিত্র করা ভাঙা একটি রাজকীয় পালকি আর বস্তাপচা অজস্র শামিয়ানা, তাঁবু আর শতরঞ্চি। জীবনের যে সময়টা রূপকথা শোনবার বয়স সে সময়ে এমন কোন সন্ধ্যা বাদ যায় নি যেদিন ঠাকুমার মুখ থেকে শুনতে পেতাম না আমাদের গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধির নানা অপরূপ কাহিনী। ... ...
আশঙ্কা ও বিষাদের হাত ধরে ১৪ ই অগাস্ট '৪৭ এসেছিল- আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। তবে স্কুলে বা বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা ওঠে নি। মাঝে, অখণ্ড বাংলা গঠনের কথা নিয়ে শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাবর্দি প্রভৃতি নেতারা বহু আলোচনা করলেও, হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সকলেই এ প্রস্তাব অন্তত তৎকালীন পরিবেশে অবাস্তব মনে করলেন। বর্ণহিন্দুরা পাকিস্তানের মুসলমান গরিষ্ঠতার শাসন মেনে নিতে অপ্রস্তুত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মহাত্মা গান্ধীর আন্তরিক প্রয়াস তাঁদের মনে বিন্দুমাত্র সাহস যোগাতে পারল না। আমাদের বাড়ির আট- নয় গৃহস্থ পরিবারের মধ্যে পড়ে রইলাম আমরা তিন - চার ঘর। মা বাবার ওপর চাপ দিতে লাগলেন কলকাতায় সপরিবার চলে যেতে। বাবা তখনও গররাজি। এভাবে এক বছর কেটে গেল। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে টেনের ক্লাস আরম্ভ হল। ততদিনে স্কুলের মাঠ চোর-কাঁটায় ভরে গেছে, খেলাধুলা হয় না। গ্রামের ক্লাবের অবস্থাও সঙ্গীন। টিমটিমে আলো-ও জ্বলে না সন্ধ্যের পরে। ম্লান সন্ধ্যা। নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ঘিরে ধরতে লাগল। ঐ বছরই, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দূর্মূল্যতা সম্পর্কে বাবা এক পত্রে লিখছেন , " চালের দাম মণ প্রতি ২১-২২ টাকা; দুধঃ টাকায় তিন - সাড়ে তিন সের; নারকেল ১ জোড়া ৮-১০ আনা। পত্রের তারিখ ২৪শে এপ্রিল, ১৯৪৮। ... ...
নড়াইলে লোহাগড়া সাহাপাড়ায় গত শুক্রবার( ১৫ জুলাই, ২০২২) পরিকল্পিত ভাবে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাড়িঘর, দোকানপাট এবং মন্দিরে হামলা করেছে ধর্মান্ধরা। কারণ? কোন কারণ যদিও লাগে না, এবারও তেমন কোন কারণ নাই। শুক্রবার জুম্মার নামাজ এখন ভিন্ন ধর্মালম্বীদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে যাচ্ছে। জুম্মার নামাজের পরে হুট করেই তাদের নজরে আসে যে ধর্মের তো প্রচণ্ড অপমান হয়ে গেছে, মান উদ্ধার না করলেই না! তারা মান উদ্ধারে নেমে গেছিল বিকালের মধ্যে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কেউ অনুভূতিতে আঘাত করেছে আর সেই আঘাতে কাতর হয়ে এরা গিয়ে নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘরে হামলা করেছে! এবং, তাদের ধারণা এতে ধর্মের যে ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণ হয়ে গেছে! ... ...
স্বপ্ন দেখি, একদিন সত্যি ভেঙে যাবে বার্লিন দেওয়ালের মতোই আমাদের পদ্মার বুক ভেদ করে চলে যাওয়া ব্যবধান। দুই বাংলা এক হয়ে যাবে আবার। কোনও উগ্রপন্থার হাত ধরে না। স্বাভাবিক ভাবেই। বরিশালের মাটিতে দাদুর সুরে আমার গলা দিয়ে বেরবে আবার মুকুন্দ দাসের গান..সেদিন...আমার অজানা পূর্বপুরুষের বহু কিছু জানিয়ে দেবে বরিশালের আকাশ-বাতাস আমায়....আমি মানুষ হিসেবে পূর্ণ হয়ে উঠব.. প্রণত হব আরেকবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে.. ... ...
অন্তর্জালে ঢুকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখতে পাব স্বাধীনতার পর ১৯৬১-র মধ্যেই হারিয়ে গেছে ২২০টি। আগের তো কোনো হিসাবই নেই। পরেরও না। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তো জনগণনা বন্ধ। মানুষের খবরই কেউ রাখছে না, তার আবার ভাষা! ... ...
দুর্গাপূজার আগে আগে মিস্ত্রী আনা হতো ধান রাখার কড়োই তৈরি করার জন্য। তাদের পাণ্ডা ছিল শীতল কাকা। তারা এসে অনেকদিন থাকতো, খেতো, আর কড়োই বুনতো। এই কাজটা সবাই পারে না। একটা কড়োই বুনতে অনেকদিন সময় লাগতো। মড়াই বোনা বরং অনেক সহজ। মড়াইটা খড় পাকিয়ে বিচালি তৈরি করে বুনতে হতো, আর কড়োই বাঁশের বাতা দিয়ে। মড়াই নিয়মমতো ছোট-বড় করা যেতো। কড়োই একবার তৈরি হয়ে গেলে আর কিচ্ছুটি করা যেত না । -- " বুঝলা দাদুভাই, ষাট মণ, আশি মণ, নানা মাপের কড়োই হইতো। যতো বড় পরিবার, যতো সম্পন্ন গিরস্থি -- তত বড় কড়োই। " প্রথমে মাটিতে বাতা পুঁতে পুঁতে গোল করে পানের ডাবরের মতো একটা ফ্রেম বানানো হতো। তারপর তারমধ্যে আরো সরু সরু বাতা দিয়ে দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করে কড়োই বোনা হতো। ঝুরি, চুপড়ি, ধামা বানানোর মতোই একটা পদ্ধতি। কড়োইয়ের ফ্রেম এতো বড় তাই দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া যেতো না। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি হলে, দড়ি দিয়ে বেঁধে পাঁচিল টপকে অনেক কষ্ট করে ভিতরে নিয়ে যেতে হতো। অনেক লোকও লাগতো তার জন্যে। এইসব কঠিন কঠিন কাজ করার সময় তারা মুখে নানা আওয়াজ করতো। গান করতো। শীতলকাকা যখন কাঠের কাজ করতে আসতো, ঠাকুমারা চুপ করে তার কাজ দেখতেন। জল থেকে কাঠ বা তালগাছের কাঁড়ি তুলে এনে সেগুলো ‘বাইশ’ দিয়ে কি সুন্দর মসৃণ করে ছুলে ছুলে দরজা জানলার ফ্রেম বানিয়ে ফেলতো। যন্ত্রগুলোর নামও শেখাতো শীতলকাকা। বাটালি, বাইশ, করাত, ছেনি, হাতুরি আরো অনেককিছু থাকতো তার ব্যাগে। -- "একটাই প্রশ্ন শীতলকাকা প্রত্যেকবার আমাগো জিগাইতো। “আচ্ছা কওতো, একটা ব্যাগে একশোটা যন্ত্র আছে, তা থেকে ‘বাইশ’টা তুইলা নিলে কটা থাকব ?” বাইশ বিয়োগ কইরাই উত্তর দিতাম। কাকা ঘাড় নাড়াইয়া কইতো, “উহুঁ হয় নাই , হয় নাই। ভালো করে ভাবো।” আমরাও চিৎকার কইরা কইতাম, “নিশ্চয়ই হইসে, তুমি ভুল কইতাসো।” সে বলতো, “না রে বোকা নিরানব্বইটা হইব। একটা যন্ত্রের নামই তো ‘বাইশ’।” প্রত্যেকবার এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতেই হতো। অন্যেরা ঠিক বললেও, লানছু ঠাকুমা প্রতিবার গল্পটা শোনার জন্য, ভুল উত্তর দিতেন। কাকা ছিলেন তার নামের মতোই শান্ত শীতল। ... ...
বাস্তবে, হিন্দু ধর্মের মন্দির, পূজামণ্ডপ, বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলার জন্য জুমার নামাজের যে মিছিলগুলো বের হয়েছিল, মসজিদে-মাদ্রাসায় মাইকিং করে ধর্মানুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত, জেহাদি জোশে যারা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর!’ ধ্বনিতে বিধর্মী-কাফেরদের ওপর হামলা করেছিলেন, ভাঙচুর, লুঠপাঠ ও অগ্নিসংযোগ করে বদলা নিতে মরিয়া ছিলেন, তাদের কোনো দল ছিল না, ওই জেহাদি মিছিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, কমিউনিস্ট পার্টি – সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, মিছিলকারীদের একটিই পরিচয় তখন যেন প্রধান, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান!’ ... ...
প্রাথমিকভাবে এই ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর বিবাদের আবর্তে ঘুরপাক খেলেও, ঘটনা পরম্পরার প্রবাহ কিন্তু ইতিমধ্যেই অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে। বর্তমান ঘটনার পরম্পরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, কিংবা হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দের সীমারেখাকে ছাপিয়ে রাষ্ট্রের ধার্মিক চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে ভীষণভাবে উস্কে দিয়েছে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বর্বরোচিত হিংস্রতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজ বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে পুনরায় ‘রাজধর্মহীন’ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। শাহবাগ স্কোয়ারের সমবেত সুধী নাগরিকেরা এমন এক রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়েছেন, যে রাষ্ট্র কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় আভরণে নিজেকে মুড়ে রাখবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হোক সবার। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম থাকবে না। ... ...
ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রায়ই একটা কথা বলেন। তিনি বলেন, একটা দেশ কেমন তা জানতে হলে, সেই দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে তা জানতে হবে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে? এখানেই লজ্জায় মুখ লুকাতে হয় সংখ্যাগুরুর। আমারা ভাল রাখতে পারিনি আমার প্রতিবেশীকে। নানা প্রতিবেদন, গবেষণা প্রমাণ করছে যে আমরা কত যত্ন করে দেশের বিশাল একটা অংশের মানুষকে স্রেফ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। গবেষণা বলছে, প্রায় একটা দেশের মত জমি আমরা দখল করেছি শুধু মাত্র দেশছাড়া করেই! কত চমৎকার না ব্যাপারটা? এই যে পরিস্থিতি – তা হুট করেই তৈরি হয়েছে? আকাশ থেকে নাজিল হয়েছে গজব? সংখ্যাগুরুর পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত নানা অনুভূতি। পোশাকে অনুভূতি, জুতাতে অনুভূতি, চোখের দৃষ্টিতে অনুভূতি। পান থেকে চুন খসলে এই সব অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে সংখ্যালঘুর কোন অনুভূতি নাই। পেটে নাই, রক্তে নাই, ঘরবাড়ি কোথাও কোন অনুভূতি নাই। ... ...
পুজোর দিনগুলিতে সন্ধ্যে নামার আগেই শিউলি চলে আসে শিঙ্গিমারি নদীর কাছে। সাবেক বাত্রিগাছ ছিটমহলের কোল ঘেঁসে শিঙ্গিমারি বয়ে চলেছে ভূগোলের মানচিত্র ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া আর এক বঙ্গদেশের হাতছানির অমোঘ ইশারায়। শিঙ্গিমারির কাছে এলেই শিউলি যেন তাঁর মাকে ফিরে পায়। পূজো আসলেই শিউলির গোলাপি মনটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। দুর্গার মুখ দেখলেই কেবলই মায়ের মুখ মনে পড়ে। ফ্যালফ্যাল করে সে মণ্ডপের দুগগা মার মুখপানে চেয়ে থাকে। শিউলির বিলক্ষণ মনে আছে, এমনই এক শারদ সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে আসার সন্ধিক্ষণে শিঙ্গিমারির কূল ধরে মা চলেছিল বিসর্জনের পথে। ... ...
এক নারীকে পুরোপুরি উলঙ্গ করে তার ওপর নির্যাতন করছে প্রভাবশালী মাস্তানরা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বড়খাল এর পাশে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার,বাদল ও কালামের নৃশংস নির্যাতনের শিকার এই নারী,বহু বার পায়ে ধরে বাবা ডাকলেও শেষ রক্ষা হয়নি এই নারীর।তারা খুব নারকীয়ভাবে এই নারীর যৌনাঙ্গ ও সমস্ত শরীরে নির্যাতন করে। যেখানে এই নারীর যৌনাঙ্গে টর্চ লাইট ও হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খুব খারাপভাবে নির্যাতন করা হয়েছে,যা ৭১এর বর্বরতাকেও হার মানায়। সম্পূর্ণ ভিডিওটি প্রশাসনের কাছে প্রেরণ করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন পোস্টদাতা। এই একটি ঘটনার বহুমাত্রিকতা আসুন একটু তলিয়ে দেখি, এই সদম্ভ উল্লাসকারী ধর্ষকগুলির বয়স কত? আঠারো থেকে ত্রিশ। পরপর দুটি প্রজন্ম। তারা কেন করেছে এই ঘৃণ্য অপরাধ? আমাদের বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাসকে ভেঙেচুরে, ভাবতে পারেন এই জেনারেশন কাজটি করেছে তাদের ‘পবিত্র দায়িত্ব’ ভেবে! ভাবতে পারেন, নারীটির প্রাক্তন স্বামী তার ঘরে এসেছিল বলে তাকে শায়েস্তা করার ‘পবিত্র দায়িত্ব’ তারা স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছে কাঁধে। ভাবুন, পড়শির বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রজন্মের বৌদ্ধিক পতন। ... ...
এমনই এক নির্মম বাস্তবতায় সবশেষ, ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের বলপাইয়া আদাম এলাকায় পাহাড়ি গ্রামের ভেতরে ঢুকে নয়জন সেটেলার বাঙালি হামলা ও লুঠপাঠ চালায়। এ সময় তারা বাড়ির প্রতিবন্ধী চাকমা মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে। লক্ষ্যণীয়, সেপ্টেম্বরেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও মহালছড়িতে দুজন পাহাড়ি স্কুলছাত্রী এবং বান্দরবানে এক ত্রিপুরা নারী ধর্ষিত হয়েছেন, আদিবাসী বলে এ পর্যন্ত কোনো ঘটনারই সুরাহা হয়নি। ওই ঘটনার পর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একজন প্রতিনিধি নির্যাতিতা প্রতিবন্ধী মেয়েটির বাড়িতে যান। তিনি দেখেন, মেয়েটির মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। আর আহাজারি করে বলছেন, “আমরা কি এদেশের নাগরিক নই? তাহলে কেন আমাদের ওপর এমন অত্যাচার?” সাংবাদিক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কয়েক বছর আগে বাবা ও ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পাহাড়ের আরো আট-দশটা নির্যাতনের ডামাডোলে প্রতিবন্ধী নারী গণধর্ষনের ঘটনাটিও হয়তো হারিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু এক্ষেত্রে সোচ্চার হয় দেশ। করোনাক্রান্তির ভেতরেই পাহাড়ে তো বটেই, খোদ ঢাকার শাহবাগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একের পর এক প্রতিবাদী মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। ... ...
করোনার ক্রান্তিতে গত ২৬ মার্চ, স্বাধিনতা দিবস থেকে সারাদেশে গণছুটি ও গণপরিবহণ বন্ধ রেখে দফায় দফায় বাড়ানো হয় লকডাউন। সবশেষ ঈদের কেনাকাটার জন্য ১০ মে থেকে আংশিক লকডাউন শিথিল হলো। দোকান-পাট, মার্কেট ও শপিং মল সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা রাখার ঘোষণা এলো। সরকারের পক্ষ থেকে সবখানে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায়, করোনাকে মোটেই কেয়ার করছে না বাঙালি। দোকান-মার্কেট-শপিং মলে ঘেঁসাঘেষি আর ঠেসাঠেসি করেই চলছে কেনাকাটা। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বেরিয়ে এলো প্রচুর ব্যক্তিগত যান, সিএনজি চালিত অটো-রিকশা, অবৈধ ইঞ্জিন রিকশা, রিকশা, ভ্রাম্যমান হকার ও সাধারণ মানুষ। আইন-শৃংখলা বাহিনীও সরিয়ে নিলো তাদের টহল ও নজরদারি। ... ...