"ওরা আমাদের আত্মসম্মানকে জেলে পুরেছে !" কল্পনা সোরেন
লিখেছেন : উপল মুখোপাধ্যায়
মেরুনা মুর্মুর নামের বানানটা আমি বারবার ভুল লিখেছিলাম। তখন নিউজ এডিটর আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘এই নাও।’
আমি বললাম, ‘এটা কী দিচ্ছেন স্যার।’ মহিলা রেগে বললেন, ‘স্যার স্যার করছ কেন! বিরক্তকর!’ আমি বুঝেছিলাম অভ্যাস হয়ে গেছে স্যার স্যার করে তাই বলেছিলাম, ‘বুঝেছি।’ উনি রেগে গেলে কী রকম হয় সে লিখতে পারব না কারণ তা আগেই লেখা হয়ে গেছে। তবু এটুকু লেখা নিশ্চয়ই লিখব যে রাগের পর উনি বললেন, ‘এটা একটা সফট ওয়্যার যেখানে নামের বানান ঠিক করা যায়, এমনকি ট্রাইবালদেরও।’
— এমনকি?
— ট্রাইবালদেরও।
আমি বললাম, ‘ট্রাইবাল কেন বলছেন ম্যাডাম? উনি তো সাঁওতাল।’ তখন উনি বলেছিলেন, ‘ওই হল।’
অবশ্য সাঁওতালদের নামের বানান খুব একটা লিখতে হয় না। তাই আমার ভুলের সংখ্যাও কমে আসে। শুধু কি মেরুনা মুর্মুর নামের বানান আমি ভুল লিখেছি? এমন কি কখনও হয় নি যে অন্য নামের বানান লিখতেও আমার ভুল হয়েছে? নাকি সে সব বানান এমনি এমনি ঠিক হয়ে গেছে নিউজ এডিটরের নজরে পড়ার আগেই? শুধু সাঁওতাল ও অন্য আদিবাসীদের বানানেই যত গণ্ডগোল? ওই জন্যই এই সফট ওয়্যার দিলেন আমাদের ম্যাডাম, নিউজ এডিটর।
এই ভাবে নানান বানান লিখতে হয় বলে চাকরি থাকে, এমন কী লকডাউনের সময়ও তা থেকে যায়, সে হেতু অজস্র বানান আমাকে লিখতে হয়। লক্ষ লক্ষ বানান আমি লিখেই চলি। তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ নামের বানানও থাকে। তবে ওই সফটওয়্যারটা কোন দিন আর ব্যবহার করতে হয় নি কারণ সাঁওতাল বা অন্য আদিবাসীদের নাম লেখার মতো লোকজন খুবই কম। সাঁওতাল এলাকায় আমি প্রায়ই যাই সেখানে অন্য আদিবাসীরা থাকলেও তাদের তফাৎ করার দরকার আছে কি? ওসব জিনিষ নিয়ে বেশি ভাবতে যাবার জন্য তো আমি আদিবাসী অঞ্চলে যাচ্ছি না। এই ভাবে অনেক দিন কেটে যাবার পর গল্প যখন আগের মতোই আকার ও প্রকার ধারণ করতে চলেছে, আমি ওই সফটওয়্যারটা ব্যবহার করতে গেলাম- যতই হোক ম্যাডাম অত যত্ন করে দিয়েছিলেন। ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি সেখান দিয়ে অজস্র ফুল গাছ, ফল গাছ ও লতাপাতার ছবি বের হয়ে আসছে। আদিবাসী বলতে প্রথমে আমরা বুঝি জঙ্গলের কথা। সেখানে ফুল গাছ, ফল গাছ, নানা লতাপাতা, ঝোপঝাড়, নানান প্রজাতির বেত, বাঁশ, ফার্ন পাওয়া যায়। তাই দেখা দরকার ওই সফটওয়্যারটার মধ্যে শুধু ফুল গাছ, ফল গাছ ও লতাপাতা ছাড়াওঝোপঝাড় আর বাঁশ, বেত, ফার্ন বের হচ্ছে কিনা। ভালো করে দেখতে দেখা গেল - হ্যাঁ , জঙ্গলের সব কিছুই ওই সফট ওয়্যার থেকে বেরচ্ছে। মায় সব রকমের স্তন্যপায়ী, সাপ, পোকামাকড়, মাছ এই সব ধরণের প্রাণীরও। এমনকি বন দপ্তর কবে গাছ কাটার লাইসেন্স দেবে, শ মিলের লাইসেন্স কবে রিনিউ করবে, কত নতুন গাছ পোঁতা হয়েছে সব আছে— শুধু বানান ছাড়া। বানান কি জঙ্গলে পাওয়া যায় না? মেরুনা মুর্মু বা অন্য আদিবাসী সাঁওতালের সঙ্গে কি শুধু জঙ্গলের সম্পর্ক আছে বানানের কোন সম্পর্কই নেই?
এই সব ভাবতে ভাবতে সফটওয়্যার দিনকে রাতের দিকে টেনে নিতে থাকে, রাত আবার দিনের জন্য অপেক্ষা করে করে কম্পিউটার গেম খেলতে থাকে। সেই গেমের ভেতর লোক মারামারি হয়। কেউ কাউকে না চেনার জন্য মেরে ফেলতে থাকে অথবা চেনা লোক বলে আরো মারতে বাধ্য হয়। মাঝে মাঝে সফটওয়্যারে ফুটবল খেলাও আসে অন্য খেলার মতোই। তবে বানান ছাড়া আর সব কিছু দেখানোটা বেশি দিন সহ্য করতে পারিনি। আবার ম্যাডামের কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার।’ উনি আর না রেগে আমার দিকে আলতো করে দেখে সিগারেটে একটা টান দিলেন তারপর বললেন, ‘বসো। এসিটা চালিয়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘এসি না চালিয়ে বসেছিলেন কি করে।’ উনি বললেন, ‘সিগারেট খাচ্ছিলাম।’ ওনাকে বললাম, ‘ম্যাডাম একটা সমস্যা হয়ে গেছে।’
— কী?
— সফটওয়্যারটা ম্যাডাম।
— সফটওয়্যার?
— হ্যাঁ ম্যাডাম।
— কোন সফটওয়্যার?
— সেই যে আপনি দিয়েছিলেন না।
— দিয়েছিলাম ? কবে ?
— অনেক দিন আগে। বানান ঠিক করার কথা- মেরুনা মুর্মুর নামের বানানটা ভুল করেছিলাম। ঠিক করার জন্য দিলেন।
— ও হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাতো বেশ ভালো একটা প্রোডাক্ট এমনকি ট্রাইবালদের নামও ঠিকঠাক বানানে বেরচ্ছিল।
— এখন ওসব বেরচ্ছেনা।
— তবে কী বেরচ্ছে?
— ফুল, ফল, লতাপাতা ,বাঁশ, বেত,ফার্ন, বন দপ্তরের স্ট্যাটেসটিক্স, বন্য প্রাণীর নাম— ছবি।
— এসব কী?
— এসবই বেরচ্ছে ম্যাডাম। হয় ছবি বেরচ্ছ নয় লাইন ড্রয়িং। নানান স্ট্যাটেসটিক্স।
— এতো জঙ্গলের বর্ণনা দিলে। যাবে নাকি একটা স্টোরি করতে চিলাপাতা? “রাভাদের জঙ্গল সংরক্ষণের প্রবণতা”— ভালো স্টোরি হবে না?
আমি বললাম, ‘কিন্তু সফট ওয়্যারটার কী হবে?’ উনি সিগারেটটা এ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বললেন, ‘সেটা মেরুনা মুর্মুকেই জিঞ্জেস কর।’
আমি বেশ ঝামেলায় পড়লাম, বুঝতেই পারছি। একে সফটওয়্যারটা উল্টোপাল্টা দেখিয়ে চলেছে তার উপর মেরুনা মুর্মুর নামের বানানটা নিজে নিজে লিখতে গেলে আবার যদি ভুল করি? ভয়ে ভয়ে মেরুনা মুর্মুকে ফোন করলাম, ‘ম্যাডাম দয়া করে আপনার নামের বানানটা যদি একটু বলেন।’ মেরুনা মুর্মু কোন উত্তর করলেন না। ও পাশ থেকে কোন শব্দ আসছে না দেখে আমি আবার বললাম,“ ম্যাডাম ম্যাডাম মেরুনা মুর্মু। ম্যাডাম ম্যাডাম ম্যাডাম। মেরুনা মুর্মু মুর্মু মুর্মু মুর্মু মুর্মু। মেরুনা মেরুনা মুর্মু মুর্মু ম্যাডাম ম্যাডাম। মেরুনা।” এই ভাবে সময় কেটে গেল। ফোন কাটতে গিয়ে দেখি কাটছে না। সে না কাটুক নামের বানানটা কিন্তু এক রকম মুখস্থই হয়ে গেছে।
সহমন ওয়েবজিনে ইতিমধ্যে প্রকাশিত
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।