বিশালাক্ষীপুর পার হয়ে ট্রেনটা আচমকা ব্রেক মেরে থমকে গেল। তার লোহার হাতপায়ে এমন আওয়াজ উঠল, আমার পিলে চমকে যাওয়ার যোগাড়। তার কারণও আছে, একে তো আমি যে কামরায় বসে আছি, সেটায় একজন লোকও নেই। কামরার জানালা দিয়ে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার ওপর কী হল কে জানে, আচমকা ব্রেক মারতেই কামরার ভেতরের লাইটগুলোও, ঝপ করে নিভে গেল একসঙ্গে।
অথচ হাওড়া থেকে এই ট্রেনে যখন উঠেছিলাম, কামরায় পা রাখার জায়গা ছিল না, এত্তো ভিড়। নানা বয়সের লোকজনের কথাবার্তায় কামরা গমগম করছিল। তার ওপর ছিল ভেণ্ডারদের ডাকাডাকি। “অ্যাই, চা। চা গরম”। “সল্টেড বাদাম, ডালমুট, চিপ্স্স্স্”। “ঝালমুড়ি, মশলামুড়িইইই”। “পতিতের বিখ্যাত আলুরদম, ঘুগ্নি”। সে সব হইচই হট্টগোল একটু একটু করে কমতে লাগল। ব্যাণ্ডেলে এসে বসার সিট পেয়ে গেলাম, তাও জানালার ধারে! তারপর থেকে ট্রেন যতই ছুটছিল আর থামছিল, লোক কমছিল ততই। বিশালাক্ষীপুরে ট্রেন দাঁড়াতে, পুরো কামরা খালি। একলা আমিই বসে রইলাম জানালার কাঠে কনুইয়ের ভর দিয়ে, গালে হাত রেখে। আমার গন্তব্য হাবিবগঞ্জ, এই ট্রেন ওই অব্দিই যাবে। আজ রাত্রে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, কাল ভোরে আবার রওনা হবে হাওড়ার দিকে।
ট্রেনটা হাওড়া থেকেই ছেড়েছিল মিনিট কুড়ি লেটে। সত্যি বলতে, লেট না হলে আমি ট্রেনটা ধরতেই পারতাম না। তখন অনেকে বলেছিল, এটুকু লেট, ব্যাণ্ডেলের পর মেক আপ করে নেবে। কিন্তু সে আর হয়নি, উলটে লেট বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় দেড়ঘণ্টা। ঠিকঠাক চললে, এতক্ষণ আমার পিসিমণির বাড়ি পৌঁছে, জল-পেঁয়াজি-মুড়ি চা খেয়ে আইপিএল দেখার কথা। সে তো হলই না, বরং যা অবস্থা, তাতে কতক্ষণে পৌঁছোব সেটাই এখন দেখার। মোবাইলের পর্দায় দেখলাম, এখনই বাজছে সাড়ে আটটা। বিশালাক্ষীপুর থেকে হাবিবগঞ্জ আধঘন্টার পথ। পিসিমণি নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। ফোনে যে বলে দেব, তারও উপায় নেই। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ফোনে নেটওয়ার্ক আসছে না। ফোনে চার্জের অবস্থাও সুবিধের নয়। জ্বালিয়ে রাখতে ভরসা হচ্ছে না। কে জানে পরে যদি দরকার হয়।
আমি যাকে বলে ভিতু টাইপের ছেলে, তা কিন্তু মোটেই নয়। কিন্তু অন্ধকার কামরায় একলা! অন্ধকার যে এত ঘন থকথকে কাদার মতো হয়, আগে কোনদিন বুঝিনি। হাত নাড়ালেও চটচটে অন্ধকার লেগে যাচ্ছিল হাতে। আচ্ছা জামাকাপড়েও কী অন্ধকারের দাগ লাগে? কে জানে? আলোয় গেলে বোঝা যাবে! বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। একজন কথা বলার মতো লোক থাকলে এতটা খারাপ লাগত না। আর কী আশ্চর্য, চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্রই একজন ভদ্রলোক, লাইন থেকে ট্রেনের কামরায় উঠতে উঠতে বললেন,
“সেদিন তোমায় দেখেছিলেম ভোরবেলায়...”। বললেন না, গুনগুন করে গাইছিলেন। আমি মোবাইলের পর্দাটা অন করতে নীলচে আলোর আভায় দেখলাম, ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা, মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। আমার হাতে আলোর আভা দেখে আমার দিকেই এগিয়ে এলেন। আমার সামনের সিটে বসতে বসতে বললেন,
“কদ্দূর”?
“হাবিবগঞ্জ”।
“অ। আমারও তাই যাবার কথা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরো অনেকদূর...হাবিবগঞ্জে কাদের বাড়ি?” আমি আমার পিসেমশাইয়ের নাম বললাম। একবারেই চিনতে পারলেন। বললেন,
“অ ছক্কা? ছক্কা আপনার কে হয়?” আমার পিসেমশাইয়ের ডাকনাম ছকু। ওঁনার বন্ধুরা শুনেছি ছক্কা বলেও ডাকেন। তবে ভাল নাম শরদিন্দু শর।
“আমার ছোট পিসেমশাই”।
“তাই বুঝি? তাহলে তো তুমি অনেকটাই ছোট। খামোখা “আপনি”, “আজ্ঞে” করছি কেন? অন্ধকারে ভালো বুঝতেই পারা যাচ্ছে না, ছাই! তা কী করা হয়?”
“আজ্ঞে, এই হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি”।
“অ, তার মানে নতুন ডানা গজাচ্ছে?” কথাটার মানে বুঝলাম না, চুপ করে রইলাম।
“কথাটা বোঝা গেল না, না? মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। এখন হয়েছে হায়ার সেকেণ্ডারি, আমাদের সময় ছিল ম্যাট্রিক। ম্যাট্রিক দিয়েই আমাদের মনে হত, বেশ বড়সড় হয়ে গেছি। উড়তে শুরু করতাম। একাএকা কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এখান ওখান যাওয়া আসা শুরু করে দিতাম! বাবা-মার সঙ্গ আর ভাল লাগত না!” হাসতে হাসতে বললেন ভদ্রলোক। কথাটা খারাপ বলেননি, নতুন ডানা গজানোর কথাটা ভালই লাগল। কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের মধ্যে কথাটা চাউর করতে হবে।
“তোমার নামটা কী যেন বললে, হে, ছোকরা?”
“আজ্ঞে বলিনি তো!”
“বলোনি? কেন বলোনি, কেন? চট করে বলে ফেল দেখি”।
“আজ্ঞে ভূয়সী ভড়। আমার দাদু রেখেছিলেন নামটা।”
“বাঃ বাঃ, বেশ নাম। আমি তো জিগ্যেস করিনি, নামটা কে রেখেছিলেন সেটা বললে কেন?”
“আজ্ঞে আমার নাম বললেই, সবাই জিগ্যেস করে। তাই আজকাল নিজে থেকেই বলে দিই”। হা হা করে আবার হেসে উঠলেন ভদ্রলোক, তারপর বললেন,
“আমার নাম বিশাল, বিশাল চক্রবর্তী। এ নামটা আমি নিজেই রেখেছি।” আমি অবাক হয়ে তাঁর ঝাপসা চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজেই নিজের নাম রাখা যায় নাকি? ভদ্রলোক হয়তো আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরে বললেন,
“ঠাকুরদা আমার নাম রেখেছিলেন হরিপদ চক্রবর্তী। নামটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। আইএ পরীক্ষার আগে শেয়ালদা কোর্টে এফিডেবিট করে, হয়ে গেলাম বিশাল। বাবার পয়সায় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে, অদ্য হইতে আমি শ্রী হরিপদ চক্রবর্তী শেয়ালদার এফিডেবিট বলে শ্রী বিশাল চক্রবর্তী হইলাম”। বিশালবাবুর কথায় মনে পড়ল, এমন বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে দেখেছি বটে, “আমি শ্রীযুক্ত গণারাম, অদ্য হইতে শ্রীযুক্ত অর্কপ্রভ হইলাম”।
“ছক্কা, মানে তোমার ওই ছোট পিসেমশাই, খেলাধুলোয় খুব তুখোড় ছিল, জানো কী? ফুটবল হোক কিংবা ক্রিকেট। স্কুল টিম হোক, কলেজ টিম হোক, ছক্কা ছাড়া টিমই হতো না। আমরা যেবার ম্যাট্রিক দিলাম, ছক্কা তখন বোধহয় সিক্সে কিংবা ফাইভে পড়ে। সেবার আমাদের স্কুল, এই মহকুমায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কার জন্যে জানো? তোমার পিসেমশাই ছক্কার জন্যে। ওইটুকুনি ছোঁড়া নিজেদের বক্স থেকে বল নিয়ে, একাএকা গোল দিয়ে এল অপোনেন্টকে! এক আধবার নয়, তিন তিন বার! সে বছর ছক্কাই হায়েস্ট গোলগেটার হয়েছিল! সেই থেকে আলাপ। বুঝেছ? পরে আমি যখন কলেজে আটকে পড়লাম, ছক্কা আমাদের কলেজেই এল। একসঙ্গে তিনবছর খেলেছি! তারপর ও গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরি পেয়ে গেল, আর আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হয়ে গেলাম”। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“এঃ রাম, লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন কেন?” বিশালবাবু খুব রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন,
“আমার সামনে ওই সব আজেবাজে কথা একদম বলবে না! গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে?” আমি গুম হয়ে বসে রইলাম। যাচ্চলে, কী এমন কথা বললাম, কে জানে? আমি মোবাইল টিপে সময় দেখলাম, ৮.৫৮। ট্রেনটা যেভাবে থমকে আছে চলবে কী চলবে না, বোঝাই যাচ্ছে না। হঠাৎ বাইরে থেকে মুখের ওপর কেউ টর্চ মারল, জিগ্যেস করল,
“খোকা কী একলা? কোথায় যাওয়া হবে? হাবিবগঞ্জ নাকি?” খোকা বলাতে আমার একটু রাগ হল, কিন্তু ওঁনার থেকে কিছু যদি জানতে পারা যায়, তাই বললাম,
“হ্যাঁ কাকু। কিন্তু ট্রেনের কী হল? কখন ছাড়বে?” ভদ্রলোক হনহনিয়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বললেন,
“একটু দেরি হবে”। আমি হতাশ হয়ে আবার কামরার ভেতরে মুখ ঘোরালাম। দেখলাম ভদ্রলোক আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বললেন,
“ইয়ে, মানে তোমাকে তখন ওরকম বকাবকি করাটা আমার ঠিক হয়নি। তোমার আর দোষ কী? ছেলেমানুষ, তুমি অতশত কী করে জানবে? তবে একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না, হে। তোমার মাথাটি তেমন সরেস নয়, নিরেট। তোমাকে বললাম, তোমার পিসেমশাই যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন আমি ম্যাট্রিক দিয়েছি। তারপরে বললাম, কলেজে তোমার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে খেলেছি! তাতেও বুঝতে পারলে না? আইএ পড়ার সময় এবং কলেজে পড়তেও বেশ কয়েকবার গাড্ডু খেয়েছিলাম। তোমার পিসেমশাই এক চান্সে সব পরীক্ষায় পাশ করে গেল, আমি সেবারও পারলাম না। বলি, আমার কী লজ্জা ঘেন্না থাকতে নেই? “একবার না পারিলে, দেখ শতবার” কবি বলেছেন বলেই কী আমাকে একশ বার চেষ্টা করতে হবে?” আমি ঠিক কী উত্তর দেব না বুঝে বললাম,
“আজ্ঞে, তা তো বটেই!”
“একটা কথা জেনে রাখো, জীবনে সব কিছু হয় না। যাদের লেখাপড়া হয়, তাদের লেখাপড়াই হয়, আর কিছু হয় না। আমাকেই দেখো না। লেখাপড়া ব্যাপারটা তেমন সুবিধে করতে না পারলেও কী করিনি জীবনে? এই যে তুমি জানালায় কনুই রেখে বসে আছো। আগে হলে তোমার একটা লাইফ ইন্সিওরেন্স, আমি করিয়েই ছাড়তাম”।
“তার মানে?” আমি খুব অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
“ধরো, ওই জানালার লোহার শাটারটা ঝপাং করে পড়ল তোমার কনুইতে। কিংবা ধরো হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের মোটা একটা ডাল ভেঙে এসে পড়ল তোমার কনুই ঘেঁষে। অথবা চারমণি সাইজের একটা বিশাল পাথর এসে গড়িয়ে পড়ল...”। আমি ভয়ে ভয়ে হাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম, এতক্ষণ কী ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে আমি বসেছিলাম, ভাবতেই শিউরে উঠলাম। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করার সুরে বললেন,
“তবে এই বিশাল থাকতে তোমার বিশাল কোন ক্ষতি হত না। ইন্সিওর করলেই, তোমার হাত ভেঙেই যাক কিংবা কেটেই যাক, তুমি সিওর টাকা পেয়ে যেতে! তারপর বসো না যত ইচ্ছে কনুই বের করে। হাতটার ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু ইন্সিওরেন্সের টাকায় চপটা, কাটলেটটা, জিলিপি-সিঙ্গাড়াটা, সেও তো ওই হাতে না হোক অন্য হাতে মুখে তোলা যাবে!” আমি বেশ বিরক্ত হয়ে, আবার কনুই বের করে বসলাম। কোন কথা বললাম না। ভদ্রলোক আবার বকতে শুরু করলেন,
“এদিকে খুব পাট হয় জানো তো? পাট, পাট, ইংরিজিতে যাকে জুট বলে। ইন্সিওরেন্সের কাজটা ছেড়ে দিয়ে জুটের ব্যবসায় জুটে গেলাম। রূপোলী আর সোনালী পাটের গাঁট, গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষীদের থেকে কিনতাম, দিয়ে আসতাম হাওড়ার জুট মিলে। কয়েকজন বন্ধু মিলে খুব লাভ করতাম, বুঝেছো? যে দামে কিনতাম, তার চার-পাঁচগুণ দামে মিলে বেচে দিতাম। পাটের গাঁটওয়ালা না বলে, আমাদের গাঁটকাটাও বলতে পারো!” নিজের বোকা বোকা রসিকতায় নিজেই, হে হে করে হাসলেন খানিকটা। তারপর আবার বললেন,
“সে ব্যবসাটাও ভেস্তে গেল। কোথা থেকে কিছু লোক এসে জুটলো, তাদের গাঁটে গাঁটে পাটোয়ারি বুদ্ধি! তারা চাষীদের থেকে আমাদের চেয়ে বেশী দামে গাঁট কিনে, আমাদের থেকে কম দামে মিলকে বেচত। ওদের সঙ্গে সকলেরই বেশ মিলমিশ হয়ে গেল! অতএব আমাদের পাটব্যবসার পাট তুলে দিতে হল”। ভদ্রলোকের বাজে বকবক ভালো লাগছিল না। কিন্তু কিছু করারও নেই, ট্রেন একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গম্ভীরভাবে বললাম,
“তার মানে আপনার পাটের ব্যবসা ডুবল পাটে, ব্যবসাটাও বোধহয় সকলে পারে না”।
“কে বলেছে তোমায়? আরশোলার ব্যবসায় কম কামিয়েছি? তারপর ব্যাং?”
“আরশোলার ব্যবসা? সে আবার কেমন? ব্যাং শুনেছি বিদেশে কোথাও কোথাও খায়”।
“বিদেশের নিকুচি করেছে। আমাদের নিজের দেশ থাকতে, বিদেশ কেন? স্কুলে কী নিয়ে পড়েছো হে?”
“আজ্ঞে আরশোলা নিয়ে তো পড়িনি! ইলেভেন টুয়েলভে সাবজেক্ট ছিল সায়েন্স”।
“বায়োলজি ছিল না? সেখানে আরশোলা, ব্যাং কাটোনি? তাদের পৌষ্টিকতন্ত্র দেখনি?” আমার মনে পড়ল। বায়োলজি প্র্যাক্টিক্যালে কেটেছি বৈকি!
“সেই আরশোলা আপনি সাপ্লাই করতেন?”
“তোমাদের কলকাতার কোন স্কুল বলো?” আমি স্কুলের নাম বললাম। শুনে মুখ ব্যাঁকালেন, বললেন,
“নাঃ, আমরা নই। তোমাদের স্কুলে সাপ্লাই করত ন্যাপা বক্সি। হতভাগা যেমন টিকটিকির মতো দেখতে, তেমনি তার আরশোলাগুলোও! না খেতে পেয়ে শুঁটকে পাৎলা। আরে বাবা, আরশোলা ভরপেট খাবে, তবে না তার পৌষ্টিকতন্ত্র পুষ্ট হবে! তাই দেখে, তবে না আমাদের দেশের ছেলেরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে! হুঁ হুঁ ব্যবসা অত সস্তার ব্যাপার নয়। আমার আরশোলা আর ব্যাং কেটে কত্তো ছেলে বড়ো বড়ো ডাক্তার হয়ে গেল! সেদিন কলকাতায় এক ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। বুকে একটা ব্যথা ব্যথা হচ্ছিল, চেক আপ করাতে। খুব নামকরা ডাক্তার, চেস্ট স্পেশালিস্ট, বারোশো টাকা ফিস! শুনেছি বাড়িতেও অনেক চেস্ট বসিয়েছে, টাকা রাখার জন্যে! চেস্ট মানে সিন্দুকও হয়, জানো তো? আমি তো তাকে চিনতে পারিনি। কিন্তু আমাকে দেখেই বলে উঠলে, “স্যার, আপনি এখানে?” অবাক হয়ে আমি তাকিয়ে আছি দেখে বলল, “চিনতে পারলেন না, স্যার, আপনার আরশোলা না পেলে, আজ আমি এখানে আসতে পারতাম, স্যার?” আমি হে হে হেসে ম্যানেজ করলাম। আমাকে খুব যত্ন নিয়ে দেখল, কিন্তু ফিসের একটা পয়সাও নিল না! সেও তো ওই আরশোলার জন্যেই নাকি?”
এই সময় ট্রেনটা দুবার ভোঁ ভোঁ ডাক ছেড়ে, আড়মোড়া ভাঙলো, তারপর গড়াতে শুরু করল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু কামরার আলো জ্বলল না। মোবাইলে টাইম দেখলাম নটা বত্রিশ! ভদ্রলোক আবার কথা বলতে শুরু করলেন,
“আরশোলা নিয়ে যারা ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে তারা আমার দু চক্ষের বিষ! অনেকেই বলে “আরশোলা আবার পক্ষি, ভ্যারেণ্ডা আবার বিরিক্ষি”। তাদের কথায় কানও দেবে না। আরশোলা ছাড়া তোমাদের মতো ছেলেপুলেদের শিক্ষাটাই মাটি হয়ে যেত। আজ গাঁয়ে গঞ্জে এত যে ডাক্তার, তার জন্যে আরশোলাদের আত্মত্যাগের কথা ভুলে থাকা যায়!” ভদ্রলোকের গলাটা আবেগে কেমন বুজে এল, “আরশোলা আমাদের ভবিষ্যৎ, আরশোলা আমাদের জাতীয় শিক্ষার ভিত”। ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন কিনা অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না, তবে গলা শুনে তাই মনে হল। আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল,
“আপনার মাথা-ফাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?” ভদ্রলোক এতটা রেগে যাবেন বুঝতে পারিনি,
“দেখ হে ছোকরা, ছোট মুখে বড়ো কথা আমার একদম সহ্য হয় না! ছক্কাকে আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবো। পেট খারাপের কথা বলতে, চোখ খারাপের বলতে, কিচ্ছু মনে করতাম না। আমার মাথা খারাপের কী দেখলে হে? দেখাতে পারবে, আমার মাথাটা কোথায় খারাপ হয়েছে? দেখাও তো, দেখাও তো..”
ঠিক সেই সময়েই কামরার আলোগুলো জ্বলে উঠল, কিন্তু ভদ্রলোক “দেখাও তো, দেখাও তো” বলে যা দেখালেন, তাতে আমি সব অন্ধকার দেখতে লাগলাম...।
গল্পে বা সিনেমায় যেমন বলার নিয়ম, সেভাবেই, “আমি কোথায়, আমি এখানে এলাম কী করে” কথাগুলো আমিই বললাম, কিন্তু মনে হল অন্য কেউ অনেক দূর থেকে বলছে, আমি শুনছি।
“অ ভুয়ো, আমি তোর পিসিমণি বলছি রে, চোখ মেলে তাকা। এ পাশে তোর পিসেমশাই, ওপাশে দাঁড়িয়ে মাটি আর শুঁটি। তাকা বাবা, তাকা। দেকো দিকি কী বিপদেই পড়ল আমার সোনাছেলেটা!” আরেঃ এ তো পিসিমণির গলা! শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। আস্তে আস্তে চোখ মেলে, প্রথমে ঝাপসা তারপর স্পষ্ট দেখতে পেলাম মুখগুলো। সিনেমাতে প্রায়ই যেমন দেখায় আর কি! পিসিমণি, পিসেমশাই, পিসতুতো দাদা মাটি আর বোন শুঁটিকেও দেখলাম। তারমানে পিসিমণির বাড়িতেই শুয়ে আছি!
কিছুক্ষণ ধাতস্থ হয়ে, বিছানায় উঠে বসলাম। এক গেলাস গরম দুধ চুমুক দিয়ে খেতে খেতে বেশ আরাম পাচ্ছিলাম। পিসেমশাই সামনেই বসেছিলেন, জিগ্যেস করলেন,
“কেমন বুঝছিস রে? কী হয়েছিল বলতো, ভয় পেয়েছিলি?”
“আপনার বন্ধু বিশালবাবু...”।
“বিশালদা? পাগলা বিশু - তুই তাকে চিনলি কী করে?”
“আমার কামরায় উঠলেন তো, বিশালাক্ষীপুর ছেড়ে এসে, ট্রেনটা ঘচাং করে থেমে গেল যেখানে, সেখানে”। পিসিমণি আঁতকে উঠলেন আমার কথায়, পিসেমশাই কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। পিসিমণি বললেন,
“শুনছো, আমি কিন্তু ভালো বুঝছি না। তুমি এখনই পশুপতি ওঝাকে ডেকে আনো”।
“থামো তো! আগে ওকে বলতে দাও। কামরায় বিশালদা উঠল, তারপর?”
“খুব বক বক করতে লাগলেন। কামরাতে আর কেউ ছিল না। আলোও চলে গেছিল। একা একা ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বসে, প্রথমে বেশ ভালই লাগছিল ভদ্রলোকের কথা শুনতে। কিন্তু পরে বড্ডো বাজে বকতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ল, তারও কিছুক্ষণ পর কামরায় আলো এল। তখন ভদ্রলোক নিজের মাথাটা...”। দৃশ্যটা মনে করে আমার আবার হেঁচকি উঠতে লাগল, পিসিমণি দৌড়ে গিয়ে লোহার চাবি আনলেন একটা, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা ধরে থাক বাবা, কোন ভয় নেই। আর মনে মনে রাম-নাম জপ কর”। রাম-নামের কথায় মনে পড়ল, আমি একবার “এঃ রাম” বলেছিলাম বলে, ভদ্রলোক খুব রেগে উঠেছিলেন। তবে কী ভদ্রলোক...। পিসেমশাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছেন দেখে আবার বললাম,
“ভদ্রলোক নিজের মাথাটা খুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ধমকাচ্ছিলেন, “আমার মাথাটা কোথায় খারাপ হয়েছে? দেখাও তো, দেখাও তো”। আমার মাথাটা ঘুরে উঠল, সব কিছু অন্ধকার হয়ে এল।” পিসেমশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“বিশালদা, আজই সন্ধেতে বিশালাক্ষীপুর ছাড়িয়ে একটা লেভেল ক্রসিংয়ে তোর ট্রেনের তলাতেই কাটা পড়েছে। সেই জন্যেই আচমকা ব্রেক মেরে ট্রেনটা থেমে গেছিল। তারপর বিশালদার লাশ সরিয়ে ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি হয়েছিল। বিশালদার লাশ পাওয়া গেছে, কিন্তু পাশে মাথাটা ছিল না! তোর ট্রেন লেট হচ্ছে শুনে আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম, সেখানেই এই সব শুনলাম। তারপর ট্রেনটা আমাদের স্টেশনে পৌঁছালো দশটা কুড়িতে। খুঁজে খুঁজে তোকে বের করলাম, দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস ট্রেনের কামরায়”। আমি ভয়ে রীতিমতো তোৎলাতে লাগলাম,
“ত্-তার ম্-মানে যা দেখেছিলাম, সেটা সত্যি!! ত্-তার ম্-মানে, উনি আসলে বিশালবাবুর ...”। পিসিমণি হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলেন, বললেন,
“চুপ কর, এ সময় ওঁদের আর নাম নিতে হবে না, বাবা”।
-০০-
[একপর্ণিকা পত্রিকায় পূর্ব-প্রকাশিত]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।