(২০২০-র জানুয়ারি সংখ্যার "শুকতারা" পত্রিকায় প্রকাশিত।)
শক্ত মুঠিতে তপুর হাত ধরে সুধাকরদা হেডস্যারের ঘরে সটান হাজির হল, বলল, “এই যে স্যার, ক্লাস সিক্সের তপস্বী হাজরাচৌধুরী”।
হেডস্যার টেবিলে রাখা অনেক কাগজপত্র নিয়ে কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন, প্রথমে বুঝতে পারলেন না। মুখ তুলে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন, “বাঃ খুব ভালো, কিন্তু তাতে আমি কী করবো? আমার কাছে এনেছিস কেন?”
সুধাকরদা বলল, “আপনি স্যার বললেন না, ওকে ক্লাস থেকে ধরে আনতে?”
“আমি বলেছিলাম? কেন বল তো?”
“ওই যে স্যার, ইস্কুলের পেছনে বারবার আমগাছে চড়ছিল, আর গাছের ডাল ভাঙছিল। পিটির অমলস্যারের মুখে শুনে, আপনি বললেন, বাঁদরটাকে ধরে আন তো, সুধাকর”!
“ও এই সেই বাঁদরটা! এ তো একেবারে নিরীহ বাঁদর রে!”
“না স্যার! এক নম্বরের ভিজে বেড়াল। আপনার সামনে ভালোছেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে! এ ঘর থেকে বেরোলেই...”।
হেডস্যার গম্ভীর মুখে বললেন, “আচ্ছা, তুই এখন যা। আমি দেখছি”।
স্যারের কথাটা সুধাকরদার খুব একটা মনঃপূত হল না। ওর ধারণা ছিল, তপুর আঙুলের ফাঁকে পেনসিল, অথবা বাইরের বারান্দায় হাতে থান ইঁট নিয়ে নিল ডাউন, কিংবা নিদেনপক্ষে কান মলার ব্যবস্থা হবেই! সেটা দেখে, তবে ও যাবে। তপুর দিকে কটমট করে তাকিয়ে, সুধাকরদা হেডস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুধাকরদা বেরিয়ে যাওয়ার পর স্যার তপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর বাড়ি কোথায় রে?”
“চৌধুরী পাড়ায়, স্যার”।
তপুদের এই গ্রামের নাম শিমূলতলা। এই গ্রামেই অনেকগুলি হিন্দুপাড়া আছে, আর আছে দুটো মুসলিম পাড়া। তাদের গ্রামে এই একটাই স্কুল, শিমূলতলা বুনিয়াদি উচ্চ বিদ্যালয়।
“চৌধুরী পাড়া? তার মানে তুই কেষ্টদার ছেলে, নাকি নবুর ছেলে?”
তপু মাথা নিচু করে উত্তর দিল, “আজ্ঞে, কেষ্টদা আমার জ্যাঠামশাই হন”।
হেড স্যার রেগে উঠে বললেন, “ডেঁপো ছেলে, জ্যাঠামশাইকে কেষ্টদা বলা হচ্ছে?”
“না স্যার, জ্যাঠামশাইকে আমরা জ্যেঠু বলি, আপনি কেষ্টদা বললেন, তাই...”
“হুম্ম্ম্, তাহলে তোর বাবার নাম...?”
“আজ্ঞে, শ্রীযুক্ত নবনারায়ণ হাজরাচৌধুরী”।
মুচকি হেসে হেডস্যার বললেন, “ঠিকই ধরেছি, তুই নবুর ছেলে? নবু আর আমি এই স্কুলেই এক ক্লাসে পড়েছি, জানিস? খুব বন্ধু ছিলাম আমরা। তা তুই ক্লাস ছেড়ে, বারবার আমগাছে চড়ছিলি কেন? তোর জ্যেঠুকেও আমি খুব ভালো করে চিনি। তাছাড়া নবুকে বললে, তোর কী হাল হবে বল তো?”
তপু নির্বিকার মুখে বলল, “আপনি জ্যেঠুকে বলুন কিংবা বাবাকেই বলুন, আমি ঠাম্মাকে গিয়ে বলবো”!
খুব অবাক হয়ে হেডস্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন? ঠাম্মাকে বললে কী হবে?”
“ঠাম্মা জ্যেঠুকে খুব বকা দেবেন। তখন বাবা আর কিছু বলতেই পারবেন না। বরং সুজনদাদুর থেকে মাখা সন্দেশ কিনে এনে আমাদের খাওয়াবেন!”
তপুদের গ্রামে “অমুক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার” কিংবা “তমুক সুইট্স্” নামের কোন মিষ্টির দোকান নেই। মিষ্টির দোকান চলে, দোকানদারের নামে, ওদের গ্রামে সুজনদাদুর মণ্ডা, মিঠাই, সন্দেশের খুব নাম।
তপুর কথায় হেডস্যার বেজায় অবাক হয়ে বললেন, “কেন, কেন? সন্দেশ খাওয়াবে কেন?”
“বাবা আমাদের বেশি বকাবকি করলে, বাবা ছোটবেলায় যা যা দুষ্টুমি করতেন, দুরন্তপনা করতেন, সে সব ঠাম্মা আমাদের বলে দেবেন যে, সেই ভয়ে!”
“কী সাংঘাতিক। কাকিমা, ইয়ে মানে তোর ঠাকুমা এমন করেন নাকি?”
“করেন বৈকি! প্রায়ই করেন! জ্যেঠুকেও বকাবকি করেন”।
“জ্যেঠু, মানে কেষ্টদাকেও”!
“হ্যাঁ স্যার। ঠাম্মা কাউকেই ছেড়ে দেন না। উনি রেগে গেলে, আপনাকেও ছেড়ে দেন না, স্যার। বাবাকে বলেন, তুই আর দীপু কম দস্যি ছিলি? সেই দীপু এখন হেডস্যার হয়ে ছোট ছোট ছেলেগুলোকে, শুনি, খুব শাসন করছে”?
শিমূলতলা বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের হেডস্যারের নাম দীপক কুমার সান্যাল। তপুর কথা শুনে হেডস্যার রীতিমতো চমকে উঠলেন, প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে জিগ্যেস করলেন, “টিফিন করেছিস? মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে! এঃহে, অনেকক্ষণ খাওয়া হয়নি মনে হয়, না”?
তারপর টেবিলের ওপর রাখা ঘন্টায় ঠং ঠং আওয়াজ তুললেন। ঘন্টার আওয়াজ শুনে সুধাকরদা হেডস্যারের চেম্বারের দরজা ঠেলে মুখ বাড়াল, বলল, “জল দিয়ে ধুয়ে, দুটো থান ইঁট এনে রাখা আছে, স্যার!”
বিরক্ত হয়ে হেডস্যার বললেন, “থান ইঁট? থান ইঁট কী হবে? তুই দ্যাখ তো, সামনের নলিন ময়রার দোকান থেকে মাখা সন্দেশ পাওয়া যায় কিনা। চার আনার নিয়ে আয়। এই পয়সা নিয়ে যা, দেখিস বাসি না হয় যেন!” পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পয়সা বের করে সুধাকরদাকে দিতে দিতে বললেন।
অবাক হয়ে সুধাকরদা তপুর মুখের দিকে আড়চোখে তাকাল, তপু নির্বিকার মুখে হেডস্যারের টেবিলে রাখা গ্লোবটা নিরীক্ষণ করতে লাগল। সুধাকরদা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই হেডস্যার খুব নরম সুরে জিগ্যেস করলেন, “তোর নাম তপস্বী, মানে তপু – আমাদের সেই নবুর ছেলে তপু, তাই তো? তা হ্যাঁরে, তোর ঠাম্মা আমার সম্বন্ধে কী বলেন রে?”
তপু ম্লান হেসে বলল, “সে স্যার, অনেক কথা। তাছাড়া আপনি গুরুজন সে সব কথা আমার বলা ঠিক হবে কী?”
“অনেক কথা? আচ্ছা সে আমি বুঝবো...তা, দু একটা বল না”।
তপু খুব ভারিক্কি চালে বলল, “আপনার সেই পোষা ব্যাংয়ের গল্পটা, ঠাম্মা প্রায়ই বলেন”।
হেডস্যার হেসে ফেলে বললেন, “য্যাঃ, বোকা ছেলে। লোকে কুকুর, বেড়াল, টিয়াপাখি পোষে, ব্যাং আবার কেউ পোষে নাকি?”
“কী জানি, স্যার! ঠাকুমা তো তাই বলেন। আপনি নাকি ওই ব্যাংয়ের পায়ে সুতো বেঁধে স্কুলে নিয়ে আসতেন! তারপর সংস্কৃত স্যারের ক্লাসে চেয়ারের পায়ে তাকে বেঁধে রাখতেন!”
হেডস্যার রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে নিজের মাথা চুলকোতে লাগলেন। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে জিগ্যেস করলেন, “এ সব কথা তোর বন্ধুদের কাউকে বলিসনি তো?”
“না, স্যার! এখনো অব্দি বলিনি! সেই ব্যাংটা নাকি ক্লাসে শব্দরূপ পড়ানোর সময় কটকট শব্দ করে ডাকত! আর আপনাদের সংস্কৃত স্যার, রেগে গিয়ে বলতেন, ‘যত্তো সব অর্বাচীন কূপমণ্ডুকের দল!’ মণ্ডুক মানে তো ব্যাং, তাই না, স্যার? আচ্ছা স্যার, সংস্কৃত মানেই আমরা শুনেছি, অং বং চং মন্ত্র – ওটা কী অং ব্যাং চ্যাং মন্ত্র হবে?”
হেডস্যার খুব বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দিলেন না, সামলে নিয়ে বললেন, “আর কী বলেছেন, তোর ঠাকুমা?”
“আর যা বলেছেন, সে তেমন কিছু নয়, স্যার। মানে বলার মতো নয় আর কী! সে সব শুনলে আপনি রেগে যাবেন, স্যার”!
“কেন? রেগে যাবো কেন?”
“ঠাম্মা বলেন, দীপু কেমন হেডমাস্টারি করছে, দেখতে তোদের স্কুলে যাবো একদিন। দরকার হলে বেশ করে কানটি মুলে দিয়ে আসবো!”
হেডস্যার চমকে উঠে নিজের দুকানে হাত দিলেন, বললেন, “কাকিমা এমন বলেন?”
এমন সময় সুধাকরদা শালপাতার ঠোঙায় মাখা সন্দেশ নিয়ে ভেতরে এল, হেডস্যারের সামনে ওটা রেখে বলল, “এখনই খাবেন, স্যার? প্লেট এনে দিই?”
হেডস্যার কান থেকে হাত সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ প্লেটে করে দে, তবে আমাকে নয়, তপুকে। কাচের গ্লাসে খাবার জলও দিস”।
সুধাকরদা অবাক হয়ে তপুর মুখের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখতে লাগল। তপু খুব লজ্জা পেয়ে বলল, “আমার জন্যে আবার সন্দেশ আনালেন, স্যার?”
“কেন? তুই খুব ভালোবাসিস তো? তোর বাবাও তোকে মাখা সন্দেশ খাওয়ায় না? কই তখন তো এমন লজ্জা পাস না, পাস নাকি?”
সুধাকরদা যে ভাবে কটমট করে তাকিয়ে তপুর সামনে প্লেটে সন্দেশ আর খাবার জলের গ্লাস রাখল, তপু বেশ মজা পেল। কিন্তু খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “না তা পাই না। তবে আমি একা একা খাবো স্যার? সুধাকরদা একটু খাবে না?”
হেডস্যার ভারি অবাক হয়ে বললেন, “কেন সুধাকর খাবে কেন? ও পরে খাবে, তুই এখন খা! সেই কখন বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস, খিদে পায়নি?”
সুধাকরদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, “স্যার, ও তিনজনের থেকে...”।
হেডস্যার বলতে দিলেন না, বললেন, “আঃ সুধাকর। ওকে এখন খেতে দে, পরে এসে প্লেট আর গ্লাস তুলে নিয়ে যাস”।
সুধাকরদা খুব রাগ রাগ মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তপু কিছুটা সন্দেশ মুখে নিয়ে, মুখটা একটু বেঁকিয়ে বলল, “নলিনকাকুর সন্দেশ তেমন ভালো নয়। ঠাম্মা বলেন নলিনকাকু সন্দেশে ময়দা মেশায়।“
“তোর ঠাম্মা আর কী বলে রে?”
তপু মন দিয়ে সন্দেশ খেতে খেতে বলল, “ঠাম্মা বলেন, নলিনকাকু নাকি, রসের কড়াইতে ডুবে মরা সব মাছি আর ডেঁওপিঁপড়ের পেট টিপে রসগোল্লার রস বানায়”।
হেডস্যার মাথা নেড়ে বললেন, “ধ্যাত্তেরি, নলিনের কথা কে জানতে চেয়েছে? বলছি, তোর ঠাম্মা আমার সম্বন্ধে আর কী বলেন?”
“আপনার সম্বন্ধে? কই তেমন কিছু তো বলেন না?”
“বাঃ রে, এই যে একটু আগেই বললি, আমার সম্পর্কে, তোর ঠাম্মা অনেক কিছু বলেন?”
“ও সেই সব কথা? না স্যার, সে সব কথা ছোট মুখে বড়ো কথা হয়ে যাবে!”
“আঃ, বলছি না, সে আমি বুঝবো। কাকিমা আমার সম্বন্ধে আর কী বলেছেন, বল!”
নিরীহ মুখ করে তপু বলল, “ঠাকুমার মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় আপনি আর বাবা বেজায় দুষ্টু ছিলেন, স্যার। একবার একটা জুতোর বাক্স সুন্দর রঙিন কাগজে মুড়ে স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন!”
হেডস্যার এই অব্দি শুনেই টেবিল চাপড়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। হেডস্যারের যে অমন সুন্দর ঝকঝকে দাঁত আছে, তিনি যে এমন প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, এ ব্যাপারে তপুর কোন ধারণাই ছিল না। তার ধারণা ছিল গোমড়ামুখো মানুষ ছাড়া কেউ হেডস্যার হতেই পারেন না! কিছুক্ষণ সন্দেশ খাওয়া ভুলে হেডস্যারের দিকে তপু তাকিয়ে রইল।
হাসির দমক কমলে হেডস্যার বলতে লাগলেন, “ওফ্, সে যা মজা হয়েছিল না! নবু আর আমি আগে থেকেই মতলবটা এঁটেছিলাম। জুতোর বাক্সে পাঁচটা বোলতা ভরে, ফুলছাপ সুন্দর কাগজে মুড়ে, লাল ফিঁতে দিয়ে বেঁধে গিফ্ট্ বক্সটা বানিয়েছিলাম। পরদিন স্কুলে এসে আমি নবুর হাতে গিফ্ট্ বক্স দিয়ে বললাম, “হ্যাপি বার্থ ডে, নবু”।
নবুও খুব খুশি খুশি মুখে বাক্সটা নিয়ে নিল। তারপর যা হয়, ক্লাসের অন্য সবাই আমাদের ঘিরে ধরল, বাক্সে কী আছে, রে? এই দীপু, নবুকে কী গিফ্ট্ দিলি রে? নবু বলল, আমার গিফ্ট্ আমি দেখাবো কেন? আমিও বললাম, নবুর গিফ্ট্ নবু বলবে, আমি কেন বলতে যাবো? ক্লাসের সব্বাই হামলে পড়ল, কিন্তু আমরা কেউই কিচ্ছু বললাম না। নবুও বাক্সটা আগলে রেখে দিল কোলে নিয়ে।
চারটে ক্লাস পরে টিফিনের সময়, নবু বাক্সটা আমার হাতে দিয়ে বলল, বাক্সটা একটু ধর তো, আমি একটু আসছি! নবু চলে যাওয়ার একটু পরে আমি ডেস্কের মধ্যে বাক্সটা রেখে, সবাইকে বললাম, অ্যাই তোরা কেউ এটায় হাত দিবি না। আমি এক্খুনি যাবো আর আসব! তারপর আমি ক্লাশ থেকে বেরিয়ে সবে বারান্দায় পা দিয়েছি, ক্লাসের ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাক্সটার ওপর। মোড়ক-টোড়ক ছাড়িয়ে, যেমনি বাক্সটা খুলেছে...বাস্রে...পাঁচটা বোলতা ছাড়া পেয়ে ভোঁ ভোঁ করে উড়তে লেগেছে ক্লাসময়। আমি আর নবু, ক্লাসের জানালা দিয়ে তখন দেখছি, ছেলেদের লাফালাফি আর চেঁচামেচি! ডেস্ক বেঞ্চি উল্টে এ ওর ঘাড়ে পড়ছে, মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে...বোলতার ভয়ে! হাসতে হাসতে আমাদের পেট ফেটে যাবার যোগাড়!”
গল্পটা বলে হেডস্যার আবার হাসতে লাগলেন, হো হো করে!
তপুর সন্দেশ খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, গ্লাসের জলটা খেয়ে, ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, “কাজটা মোটেই ভাল করেননি স্যার! বোলতাগুলো হুল ফুটিয়ে দিতে পারতো! ডেস্ক কিংবা বেঞ্চ উল্টে ছেলেদের হাতে পায়ে চোট লাগতে পারতো”!
হেডস্যারের হাসি হাসি মুখটা আবার গম্ভীর হয়ে গেল, বললেন, “অ্যাই, বাঁদর তুই আমার স্যার, না আমি তোর স্যার? তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস? ক্লাস কামাই করে, তুই কী করছিলি, আম গাছে উঠে?”
তপু হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, “অর্জুনের পাখি বসাচ্ছিলাম, স্যার”।
অবাক হয়ে স্যার জিগ্যেস করলেন, “তার মানে? অর্জুন আবার কে? কোন ক্লাসে পড়ে?”
“অর্জুন আমাদের স্কুলে নয় স্যার, অন্য স্কুলে পড়তেন। আপনাদের থেকেও অনেক সিনিয়র, স্যার! তাঁর হেডস্যার ছিলেন দ্রোণাচার্য। তিনি পাখির চোখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাননি বলেই না, সবার সেরা বীর হয়েছিলেন! তাই আমিও ভাবছিলাম, গাছের ডালে মাটির পাখি রেখে শুধু চোখ দেখবো”!
ভুরু কুঁচকে হেডস্যার জিগ্যেস করলেন, “এ বুদ্ধিটা আবার কে দিল?”
“অমলস্যার, স্যার। পরশুদিন পিটি করানোর সময়, বলছিলেন, মনটাকে একাগ্র করতে হবে। সেই সময় তিনি অর্জুনের গল্পটা বলেছিলেন। এইবারের রথের মেলা থেকে ছোড়দি একটা মাটির পায়রা কিনেছিল, সেটা লুকিয়ে এনে আমগাছের ডালে বসাচ্ছিলাম। কিন্তু আমগাছে বড্ডো পাতা, স্যার। পাখিটাই চোখে পড়ছে না, তো তার চোখ চোখে পড়বে কী করে? তাই বার বার উঠে নিচের ডালগুলো ভেঙে হাল্কা করছিলাম, যাতে পাখিটা দেখা যায়। দেখতে পেয়ে অমলস্যার খুব রেগে গেলেন, বললেন, হতভাগা ছোঁড়া গাছের ডাল ভাঙছিস? দাঁড়া দীপকস্যারকে কমপ্লেন করছি!”
হেডস্যার তপুর মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, এখন তুই ক্লাসে যা। অমলস্যারের সঙ্গে আমি কথা বলবো। আর শোন, খামোখা আমগাছে চড়তে যাস না। হাত-পা ভেঙে শেষে একটা কাণ্ড বাধাবি?”
তপু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “না, স্যার গাছে আমি খুব চড়তে পারি। ঠাম্মা আমায় “গেছো ছোঁড়া” বলেন”।
“খুব একটা মন্দ বলেন না, কাকিমা। আচ্ছা, তুই এখন যা”।
“আসছি, স্যার”।
তপু হেডস্যারের চেম্বারের দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, স্যার পিছু ডাকলেন, “আর শোন, কাকিমাকে আবার এসব কথা সাত কাহন করে বলতে যাসনি, যেন!”
“আপনার সন্দেশ খাওয়ানোর কথাও বলবো না, স্যার”?
“না। বলবি না। আর বাইরে সুধাকরকে দেখলে বলিস তো, আমি ডাকছি”।
হেডস্যারের চেম্বারের বাইরে, একটা টুলে সুধাকরদা বসেছিল, তার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলল তপু, তারপর বলল, “সুধাকরদা, হেডস্যার তোমায় ডাকছেন, ভেতরে যাও”।
তারপর তপু বীরদর্পে তার ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা দিল, আর সুধাকরদা তপুর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে, হেডস্যারের চেম্বারে ঢুকল।
সুধাকরদা ঘরে ঢুকতেই দীপকস্যার বললেন, “টেবিল থেকে এঁটো প্লেট আর গ্লাসগুলো সরিয়ে নে। ছেলেটার বেজায় খিদে পেয়েছিল রে!”
সুধাকরদা টেবিল থেকে প্লেট আর গ্লাস তুলতে তুলতে বলল, “খিদে পেয়েছিল না, ছাই, স্যার। অলরেডি ক্লাসের তিনজনের থেকে চুরি করে তাদের টিফিন সাবাড় করে এসেছে! পরোটা আলুভাজা, ডিমসেদ্ধ, কলা, এই সব...”।
“বলিস কী?”
সুধাকরদা গোমড়া মুখে বলল, “তবে আর বলছি কী, স্যার। ওর মতো বিচ্ছু ছেলে এ স্কুলে আর দুটি নেই!”
সুধাকর এঁটো প্লেট-গ্লাস নিয়ে ঘরের বাইরে যেতে, হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর আপন মনে হাসতে হাসতে ভাবলেন, “এমন ছেলে দু একজন না থাকলে স্কুলটাকে কেমন পানসে লাগে! আর ছেলেবেলাটাও কেমন নিরিমিষ হয়ে যায়!”
..০..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।