প্রথমে ভেবেছিলাম শিরোনামে লিখবো চাকরিক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও অস্থায়ীকরণ। কিন্তু কাজের জায়গায় অস্থায়ী কারোরই হওয়ার কথা নয়। আংশিক সময়ের কাজেও ন্যূনতম সুরক্ষা এবং বেতনবিধি কাম্য। সুতরাং কাউকে অস্থায়ী বলে দিয়ে অবস্থানগত বৈষম্য তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে বিরত থাকলাম। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের মান নির্ধারিত হয় তার রোজগার করা টাকার অঙ্কে। পুঁজিবাদী কর্পোরেট কালচারের অন্যতম লক্ষ্য তাই কর্মীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য তৈরি করা এবং চাকরির অনিশ্চয়তা টিকিয়ে রাখা। এর মাধ্যমে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম সংখ্যক মানুষকে চাকরির দীর্ঘস্থায়িতা এবং বেশি বেতন দিয়ে ক্ষমতাশালী করে দিলে, বাকিদের কম পয়সায় অধিকতর শ্রম দিতে বাধ্য করা যেতে পারে। এই কম সংখ্যক মানুষই তখন সিস্টেমের হয়ে বাকিদের শোষণকে স্বাভাবিক মনে করবে। অনেক বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থায় তাই একই কাজের জন্য বিভিন্ন বেতনের কর্মী দেখা যায়। এঁরা ভয়ে থাকেন চাকরি হারাবার বা বেতন কমে যাওয়ার। তাঁরা সব সময় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় থাকেন যেখানে পাশের সহকর্মীর প্রতি সহানুভূতি বা ঐক্যের জায়গা করে নেয় অবজ্ঞা ও আত্মম্ভরিতা। এই সংস্কৃতি সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থাতেও দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা হয়েছে নিয়মিত (নিয়মিত কথাটার ওপর জোর দিলাম) অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে যাদের ক্লাস পিছু সামান্য টাকা দিয়ে দিনের পর দিন কাজ করানো যায় আর পূর্ণ সময়ের শিক্ষকদের বিরাগভাজন হলে বা তাদের তুষ্ট করতে না পারলে হারাতে হয় চাকরি। এই শিক্ষকেরা, যাঁরা বিভিন্ন নামে পশ্চিমবঙ্গের নানা কলেজে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন তাঁরা দীর্ঘ আন্দোলনের পর একটি ন্যূনতম বেতন ও চাকরির সুরক্ষা লাভ করেছেন স্টেট এপ্রুভড কলেজ টিচার্স (SACT) নামে। এর ফলে দীর্ঘদিন কলেজের স্টাফরুমে অলিখিত বৈষম্য ও অবজ্ঞা একটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। যে কোনো সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে এক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। কিছু মানুষের অন্যের ওপর ক্ষমতা কায়েমের স্বাভাবিক অধিকার বোধ আঘাতপ্রাপ্ত হলে যাঁরা এযাবৎ সেই অধিকার ভোগ করে এসেছেন তাঁরা ক্রুদ্ধ ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। তাই একদিকে যেমন তথাকথিত সাময়িক সময়ের শিক্ষকেরা (যাঁরা আসলে দীর্ঘদিন, কেউ কেউ প্রায় গোটা জীবন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে চলেছেন) বঞ্চনা ও অপমান থেকে স্বস্তি পেয়েছেন, অপরদিকে তাঁদের নতুন করে আক্রোশ ও অপমানের শিকার হতে হচ্ছে নিয়ত। বারবার মনে করানো হচ্ছে এই সদ্যপ্রাপ্ত অধিকারের তাঁরা যোগ্য নন।
প্রথমেই এখানে যে প্রশ্ন ওঠে সেটি হল কর্মীর যোগ্যতার আগে সেই কর্মীকে দিয়ে কাজ করানো সিস্টেমের যোগ্যতা নিয়ে। কোনো কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁর প্রাপ্ত নম্বর অথবা একটি কাজ করার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার পরিমাপ (সেরকম পরিমাপযন্ত্র একমাত্র ছাত্রের মূল্যায়ন বাদে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই) যাচাই করার আগে যাচাই করার দরকার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই। যে ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবত পূর্ণ সময়ের নিয়োগ না করে, ক্লাস পিছু পূর্ণ সময়ের শিক্ষকদের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ বেতন দিয়ে টিকে আছে (যখন এই কম বেতন পাওয়া কর্মীদের চাকরি নিশ্চিত হয়নি তখন থেকে) সেই সিস্টেমের যোগ্যতা থাকে কি নিযুক্ত কর্মীর যোগ্যতা বিচার করার? বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ামক ইউজিসির নির্ধারিত ক্লাস পিছু অর্থের অনেক কম টাকায় কাজ করিয়ে নেওয়া এই ব্যবস্থা বা অব্যবস্থা যেটুকু ভদ্রস্থ অবস্থায় আছে সেটুকু অবশ্যই এই বৈষম্যের শিকার হওয়া শিক্ষকদের কাঁধে ভর করে। তাই গালভরা ডিগ্রি বা একাডেমিক যোগ্যতার ধুয়ো তুলে (যা অবশ্য এঁদের অনেকেরই আছে) স্যাক্ট শিক্ষকদের খারিজ করার অধিকার কারোরই নেই। এমনকি যে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক ইউজিসির নিয়োগ যোগ্যতার ধুয়ো তুলে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করতে চায় তার পক্ষেও এযাবৎ তাঁর বঞ্চিত সহকর্মীটির সাহায্য ছাড়া চলা সম্ভব হয়নি। এখন উচ্চশিক্ষায় নিত্যনতুন নিয়মের যে চাপ বেড়েছে সেগুলো যাতে স্যাক্ট শিক্ষকেরা বেশি কাজ করে শিথিল করে সেই চেষ্টাতেই বরং প্রতিষ্ঠান ব্যস্ত। যদিও বারংবার একই সাথে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ যোগ্যতার যুক্তিতে যাকে খারিজ করেন কিছু মানুষ, তাঁরাই আবার এঁদের দিয়ে কাজও করাতে চান বেশি – কি বিচিত্র অসঙ্গতি তাই না?
এর পড়ে আসে মেধার যুক্তি। এই যুক্তিতে অবশ্যই স্যাক্ট শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের মূল্যায়ন দেখা হয় না। বারবার দেখানো হয় নিয়োগ পদ্ধতি ও একাডেমিক যোগ্যতার যুক্তি। বেশিরভাগ শিক্ষক মূল্যায়নকে ভয় পান। বরং অন্য কাউকে ছোট করে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করা একটি আদিম সহজ পদ্ধতি। সমস্ত অধ্যাপকের জ্ঞানের সমসাময়িকতা, নিয়মিত লেখাপড়া করার অভ্যাস এবং পড়ানোর দক্ষতা বিচারের কোনো স্থায়ী পদ্ধতি যেহেতু আমাদের দেশে নেই, তাই কতিপয় বেশি বেতন পাওয়া মানুষের মতামত এই সিস্টেমে মান্যতা পায়। যদি নিয়োগ পদ্ধতির কথা বলা হয় তাহলে সহজ যুক্তি হল আংশিক বা অতিথি অধ্যাপকের পদে যে ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে এবং যেভাবে নিয়োগ হয় সেটি পূর্ণ সময়ের নিয়োগের একটি সমান্তরাল বৈধ ব্যবস্থা যাকে প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে পরিচালিত করেছে। তাই এই ব্যবস্থায় নিযুক্ত অবশ্যই যোগ্য। মেধাকে যদি ডিগ্রি বা পরীক্ষা দিয়ে বিচার করা হয় তবে বলা যায় মেধা যাচাইয়ের বিকল্প পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে তাঁরা নিযুক্ত। আসলে আজকের স্যাক্ট শিক্ষকদের নিয়োগ অথবা কলেজে তাদের কাজ করা নিয়ে কারোর খুব একটা আপত্তি ছিল না যতদিন না তাঁরা চাকরির সুরক্ষা পাচ্ছেন বা তাঁদের বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে (যদিও সমকাজে অন্যান্য পূর্ণ সময়ের অধ্যাপকদের তুলনায় সেটা অবশ্যই যথেষ্ট নয়)। শোষণ যেখানে স্বাভাবিক সেখানে শোষিত সহকর্মীকে কাছ থেকে শোষিত হতে দেখার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিকৃত আরাম আছে।
আগেই বলেছি আমার মতে এই কর্মীরা কখনোই অস্থায়ী হতে পারেন না। অস্থায়ী তাঁরাই হন যাঁদের সিস্টেম সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুদিনের জন্য নিযুক্ত করেন। কিন্তু যে শিক্ষকদের একই কাজে কয়েক দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের অস্থায়ী বলা যায় কি? তাঁদের মাধ্যমেই সিস্টেম টিকে আছে আসলে। অনেক কলেজে খোঁজ নিলে দেখা যায় কোনো কোনো বিভাগের পুরোটাই অনেকদিন ধরে স্যাক্ট শিক্ষকেরা চালাচ্ছেন। তাঁরা সেই অর্থে বহুদিন ধরেই কলেজের পার্মানেন্ট স্টাফ, পূর্ণ সময়ের না হলেও। তাদের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে কাজের সময় বাড়ানোর জন্য নয়, চলতি কাজটুকুর স্বীকৃতির জন্য এবং এই বৃদ্ধির পরেও কাজের মাপ অনুসারে তাঁরা গড়পড়তা পূর্ণ সময়ের সহকারী বা সহযোগী অধ্যাপকের চেয়ে কম বেতনই পান। অতিথি অধ্যাপক, আংশিক সময়ের অধ্যাপক ইত্যাদি নামে কাউকে পূর্ণ সময়ের কাজ সারা জীবন ধরে করিয়ে নেওয়া শাসকের একটা পন্থা বিশেষ। সারা পৃথিবীতেই কাজের সুরক্ষা এবং বেতনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। অধিকার বোধের ধারণাটাই এভাবে বদলে যেতে পারে। প্রথমত চাকরির সুরক্ষা না থাকলে বিপন্ন শিক্ষকের কোনো অধিকার বোধ থাকে না, কাজেই তাকে দিয়ে যত ইচ্ছে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। পিছনে থাকে তার চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। দ্বিতীয়ত, কাজের জায়গায় সহমর্মীতা এবং বন্ধুত্বের জায়গা করে নেয় বৈরিতা ও অবজ্ঞার পরিবেশ যেখানে প্রশাসক শক্তিশালী হন আর কর্মীরা শত বিভক্ত থাকেন নিজেদের মধ্যে। এক ধরণের স্তরভিত্তিক বিভাজন থাকে এখানে। প্রিন্সিপাল নজরদারী করেন সব অধ্যাপকদের আর পূর্ণ সময়ের অধ্যাপকেরা ক্ষমতা ফলায় স্যাক্টদের ওপর – বারংবার বোঝানো হয় তাদের চাকরিটা যোগ্যতার নিরিখে হয়নি তাই সকলকে তুষ্ট করে চলাই তাদের কর্তব্য। তৃতীয়ত এবং সব থেকে উল্লেখজনকভাবে, দিনের পর দিন পূর্ণ সময়ের নিয়োগ না করে অনেক কম খরচে এভাবে সিস্টেম চালাতে পারে সরকার। যদি সমকাজে সম বেতন এবং কর্মীর একটা সময় অবধি কাজ করলে চাকরির সুরক্ষা আজ সাধারণ নিয়ম হিসেবে স্বীকৃত হয় তাহলে আর কোনো কর্মীকে অস্থায়ী রেখে শোষণ করা চলে না। মনে রাখতে হবে স্যাক্ট বা অতীতে গেস্ট কিংবা পার্ট টাইম শিক্ষকদের নিয়োগের কারণে পূর্ণ সময়ের নিয়োগ হয়নি এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। বরং সরকার পূর্ণ সময়ের নিয়োগ করবে না বলে কম বেতনে নিয়োগ করে কিছু মানুষকে দিনের পর দিন শোষণ করেছে।
আজ পশ্চিমবঙ্গে স্যাক্ট শিক্ষকদের আন্দোলন ও সাফল্য সারা দেশের উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন নামে নিযুক্ত অস্থায়ী শিক্ষকদের পথ দেখাতে সক্ষম বলে আমি মনে করি। এই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে যে দীর্ঘদিন পোস্ট ফাঁকা রেখে কম বেতনে কাজ করালে আখেরে চাকরির সুরক্ষা দিতে ও বেতনবৃদ্ধি করতেই হবে। এই ঘটনাকে সাধারণ নিয়মে পরিণত করলে ভবিষ্যতে পূর্ণ নিয়োগের পথও সুগম হবে। তবে পথ চলা এখনো অনেক বাকি। স্যাক্ট শিক্ষকদের আগামী দিনে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপকদের ক্রম অনুসারে বেতন, মূল্যবৃদ্ধি এবং চাকরির বয়স অনুসারে নিয়মিত বেতনবৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুবিধা যেন একইভাবে মেলে সেই দাবী করে যেতে হবে। দেশে নানা জায়গায় এড-হক ইত্যাদি নানা নামে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ একটি নিয়মিত বন্দোবস্ত। স্থায়িত্বের সাধারণ দাবী ও সম কাজে সম বেতনের জন্য লড়াই এই অসুস্থ ব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারে। স্যাক্টদের আন্দোলনকে তার একটা প্রাথমিক ধাপ বলা চলে। আমাদের দেশ ব্রাহ্মণ্যবাদের দেশ। কিছু মানুষ সুরক্ষিতভাবে সমাজের সব সুযোগ ও সম্মান লাভ করবে এবং বাকি আরো অনেকে তাদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হবে, অপমানিত হবে এ আমাদের মজ্জাগত। এর সাথে কর্পোরেট সংস্কৃতির বিভ্রান্তিকর মেধার ধারণা মিশে তৈরি হয়েছে ভয়ানক এক বিষাক্ত বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা। দেশের প্রথিতযশা কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথা আইআইটি এনআইটির মতো জায়গায় নিয়মিত অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন বেরিয়ে চলেছে – কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে সব পোস্ট কন্ট্র্যাকচুয়াল। এদের কারো বেতন বেশি, কারো কম। কিন্তু বৃদ্ধির নিশ্চয়তা নেই, অনেকক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ক্রম বা বিবিধ চাকরিগত সুবিধা স্পষ্ট করে লেখা নেই। এরা আধুনিক সমাজতত্ত্বের ভাষায় precariat অথবা অনিশ্চিত মানুষ। গাই স্ট্যান্ডিংয়ের মতো সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন অনিশ্চয়তা তৈরি করা শোষণের নয়া হাতিয়ার। আজ যে কর্মী এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের বেতন পাচ্ছে তার চাকরিও মেধার যুক্তি দেখিয়ে, চাপে রেখে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার অজুহাতে যদি অনিশ্চিত রাখা যায়, সেও সিস্টেমের দাসে পরিণত হয় - অপমানিত হয়ে, নিষ্পেষিত হয়ে চুপ থাকে। এই বেনিয়ম উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের বাইরেও আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। স্যাক্টদের আন্দোলনের মতো করে যদি এই অনিশ্চিতকরণ ও অস্থায়ীকরণকে চ্যালেঞ্জ করা যায় তাহলে হয়তো এই অসুস্থ অসাম্যের ব্যবস্থা বদলাতে পারে।