আসাম ভারতের মধ্যে একটি বন্যা প্রবণ রাজ্য। রাষ্ট্রীয় বান আয়োগের হিসেবে রাজ্যের ৭৮৪৩৮ স্কোয়ার কিমি এলাকার মধ্যে ৩১৫০০ স্কোয়ার কি.মি. হল বন্যা প্রবণ, শতাংশের হিসেবে প্রায় চল্লিশ শতাংশ। বরাক উপত্যকার ২২২৪৪ স্কোয়ার কি মি র মধ্যে মোটামুটি ৯০০০ হল বন্যা প্রবণ এলাকা। জাতীয় গড় যেখানে ১০ শতাংশ, আসামে সেখানে যদি ৪০ শতাংশ হয়, তা হলে আসামে বন্যা কোনো আকস্মিক ঘটে যাওয়া দুর্যোগ নয়, এটা স্বাভাবিক এবং এর প্রতিরোধে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
আলোচনার সুবিধের জন্য আমরা আসাম কে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকা এই দুই ভাগে ভাগ করে নেব এবং শুধু এ আলোচনায় বরাক উপত্যকা নিয়ে কথা বলবো।
বরাক উপত্যকার প্রধান নদী হল বরাক। বড়া ইল পাহাড় শ্রেণীর দক্ষিণে উৎপত্তি হওয়া বরাক নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৯০০ কিমি যার মধ্যে আসামের দক্ষিণ অংশের চারটি জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এবং উত্তর কাছাড় মিলে ২২৫ কিমি বরাক নদী এখানে প্রবাহ মান। বরাক হল আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী, প্রথম হল ব্রহ্মপুত্র।
করিমগঞ্জের কাছে বরাক নদী বিভক্ত হয়েছে উত্তরের অংশ সুরমা আর দক্ষিণের অংশ কুশিয়ারা নামে। এই দুটো শাখা নদী ছাড়াও উত্তরে বরাকের উপনদী গুলো হল জিরি, সিরি, মথুরা, জাটিঙ্গা আর লারং। দক্ষিণের উপনদী গুলো হল সোনাই, ঘাগরা, কাটা খাল, ধলেশ্বরী, সিংলা আর লঙাই।
আঁকা বাঁকা পথে বয়ে চলা এই বরাক নদী এবং তার শাখা ও উপনদী গুলোর জল স্ফীতি বরাক উপত্যকার বন্যার জন্য দায়ী এবং স্মরণাতীত কাল ধরে কোনো সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় বন্যা বরাক উপত্যকার মানুষের নিত্য সঙ্গী এক ভয়াবহ বীভৎসতা।
এই পশ্চাৎ পট কে মনে রেখে এবার আমরা আলোচনা করবো আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলচরের বন্যা নিয়ে। ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ফিসার শিলচর শহরের পত্তন করেন। শিলচর ভৌগলিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহর। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মনিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে সমতলের প্রধান যোগাযোগ সূত্র হল শিলচর শহর। উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা, শিক্ষা দীক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থাকার জন্য পুরো অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ শিলচরের উপর পুরোই নির্ভরশীল।
শিলচর শহরে ১৮ জুন মধ্যরাত থেকে জল ঢুকতে শুরু করে। কাছাড় জেলা প্রশাসন তার আগে একটা বিবৃতি দেন, সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সেটা ছিল এরকম,
"এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রশাসনের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী বেতুকান্দি বাঁধটি কিছু দুষ্কৃতী নষ্ট করে দিয়েছে, বাঁধের ওই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু মেরামত করার চেষ্টা চালান সত্ত্বেও নদীর জল শিলচর শহরের নিচু এলাকা ও বেতুকান্দির আশপাশের এলাকাগুলোতে ঢুকে পড়তে পারে।"
আস্তে আস্তে বরাক নদীর জল পুরো শিলচর শহরকে ভাসিয়ে দেয়। গরীবের কুঁড়ে ঘর থেকে বড় অট্টালিকা কিছুই আর বাদ যায় না। অনেক বাড়ীর জানালার উপর পর্যন্ত বান ভাসি হয়ে যায়। বিপন্ন মানুষ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
শুরু হয় আত্মীয় বন্ধু যাদের বাড়ী দোতলা আছে সেখানে ছুটে যাওয়া। কেউ কেউ চলে যান হোটেলে, যাদের সে সামর্থ্য আছে। জলের নীচে পড়ে থাকে মধ্যবিত্তের বাইক, স্কুটার, সাইকেল, গাড়ী।
পড়ে থাকে সারা জীবনের কষ্টে কেনা আসবাব। বন্যা আগেও হয়েছে এ বছর মে মাসেও। কিন্তু বরাক নদীর এমন ভয়াল রূপ কেউ কখন ও দেখেননি। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা যাদের ছেলে মেয়ে কর্ম সূত্রে দেশের অন্যান্য শহরে রয়েছেন তাদের অসহায়তা বর্ণনার অতীত। ঔষধ, কাজের লোক, খাওয়া দাওয়া সব কিছু অপ্রতুল হয়ে যায়।
জলের দাপটে ২১ এ জুন থেকে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়, চলে যায় মোবাইল নেটওয়ার্ক। এক অনন্ত অন্ধকারে যোগাযোগ বিহীন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হোন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সমস্ত দোকান পাঠ বন্ধ হয়ে যায়। বাজার গুলো চলে যায় জলের নীচে।
এখন জিনিস পত্র যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম ও আকাশ ছোঁয়া। সমাজ মাধ্যমে দেখছি একপাতা ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০০ -৬০০ টাকায়, সব সব্জির দাম ন্যূনতম ১০০ টাকা কেজি, এক লিটার মিনারেল ওয়াটার ৬০ টাকা। ইনভার্টার এর চার্জ নেই, ১০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না মোমবাতি। ফলে ঘরে ঘরে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। খাওয়ার জলের ব্যাপক অভাব। স্নান রান্না এগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
শিলচরের কেন্দ্র স্থলে অবস্থিত সরকারি হাসপাতাল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। মেডিক্যাল কলেজ অনেক টাই দূরে। ফলে চিকিৎসা সেবা অনেক টাই ভেঙে পড়েছে।
এ যন্ত্রণার বর্ণনা দেওয়ার মত ভাষা আমার নেই। সেটা অনুভবের ব্যাপার।
খোদ শিলচর শহরের এ অবস্থা হলে পাশের গ্রামগুলোর অবস্থা কি হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সমস্যাটা মধ্যবিত্তের বলে আলোচনা হচ্ছে, এমন মনে করার কারণ নেই।
কাছাড় জেলা প্রশাসন বন্যা পীড়িতদের সাহায্যে উদ্যোগী হয়। পরিস্থিতি এতোটা খারাপ যে হবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা যায়নি। ২৩ শে জুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শিলচর সফর করেন এবং বিমানে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিদ্যুৎ পরিষেবা ফিরিয়ে আনার জন্য গৌহাটি থেকে এপিডিসিল এর ইঞ্জিনিয়ারদের শিলচরে পাঠানো হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। জলের নীচে যে ট্রান্সফরমারগুলো গেছে সে গুলো জল কমলেই ঠিক করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। এই বন্যা কে মানুষের তৈরি (মেন মেড) আখ্যা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দুষ্কৃতী দের কঠোর থেকে কঠোরতর (“stricter than strict”) শাস্তি দেওয়ার কথা ও ঘোষণা করেন।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইন্ডিয়ান Air Force এর বিশেষ বিমান খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট আকাশ থেকে বড় বড় বাড়ীর ছাদে ফেলতে শুরু করে। গৌহাটি থেকে আনা শুরু হয় দৈনিক ১ লক্ষ মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পি টি আই সূত্রে জানতে পারছি গৌহাটি এবং যোর হাট থেকে আনা হয়েছে ৮৫ মেট্রিক টন ত্রাণ সামগ্রী। আসাম সরকার কাছাড় জেলায় সাহায্যের জন্য দিয়েছেন হেল্প লাইন নাম্বার: 0361-2237219, 9401044617 and 1079 (toll free) খবর থেকে দেখছি “The National Disaster Response Force (NDRF) personnel along with SDRF, Fire and Emergency personnel, Police Force and AAPDA MITRA Volunteers are helping the district administrations in the rescue operation and relief distributions.”
বিভিন্ন এনজিও রা করিমগঞ্জ, হাইলকান্দি, ত্রিপুরা থেকে গিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে শিলচরের এনজিওদের সঙ্গে উদ্ধার কাজে সামিল হয়েছেন, ইতিমধ্যে।
বাস্তবে কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। খাদ্য সামগ্রী, জল যা উপর থেকে ফেলা হচ্ছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল এবং বেশির ভাগের হাতেই গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না।নৌকার ভাড়া হয়েছে ব্যাপক। ATM বন্ধ থাকায় মানুষ টাকা তুলতে পারছেন না, এ দিকে জিনিসের দাম ও আকাশ ছোঁয়া।
এটা একটা জাতীয় বিপর্যয়। এর জন্য urgency এবং intensity আরো বেশি হওয়া দরকার ছিল। সেটা হচ্ছে না। সেনা বাহিনী কে উদ্ধার কাজে নামালে লাভ অনেক বেশি হতো।
প্রশাসন কোন জায়গায় কিভাবে ত্রাণ বা উদ্ধার কাজ চালাবেন, কোথায় কি ভাবে খাদ্য এবং জল আকাশ থেকে ফেলা হবে সে গুলো সমাজ মাধ্যমে জানালে যদি নেটওয়ার্ক আর সামান্য মোবাইল চার্জ পাওয়া যায়, তা হলে বিপন্ন মানুষ জানতে পারতেন, এতে উপকার হতো।
আরো একটা বিষয় হল এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কিন্তু জাতীয় স্তরে একেবারেই আলোচিত হচ্ছে না। এনডিটিভি একটা হাল্কা রিপোর্ট করেছেন, বাকীরা ব্যস্ত মহারাষ্ট্র নিয়ে। কলকাতার নামী সংবাদ পত্রগুলো যাদের অনেক পাঠক শিলচরে রয়েছেন, এ সব নিয়ে কোনো খবরই করছেন না। এক বরাকের বীর সন্তান দিল্লীর যন্তর মন্তরে একক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। মহানগর কলকাতা সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একেবারেই চুপ। রাজধানী গৌহাটিতেও নেই তেমন আলোচনা।
এটা খুবই দুঃখ জনক। আসলে এতো বড় ট্র্যাজেডির তেমন কোনো TRP নেই বলেই বোধ হয় এ রকম অবস্থা!!
আসামের মুখ্যমন্ত্রী আজ নৌকা করে শিলচর শহরে লোকের অভাব অভিযোগ শুনছেন। নিশ্চয়ই এতে লাভ হবে সবার।
বেতু কান্দি বিষয়ে (যে খানে বাঁধ কাটা হয়েছে বলে অনুমান)সংবাদ মাধ্যমে যা পেয়েছি সেটা আপনাদের জানাচ্ছি,
“শিলচর মধুরবন্দ পিএইচই রোড ধরে সোজা এগিয়ে গেলেই হাতের ডান দিকে পড়বে মহিষাবিল। বাঁদিকে বরাক নদী।
এই বিশাল বিলটি শিলচর শহরতলির মধুরবন্দ, বেরেঙ্গা, বেতুকান্দি, ভাগাডহর, বরজুরাই, বাদ্রিঘাটের বাঁধ লাগোয়া হাজার হাজার মানুষকে বছরের ন'মাসই জলে ডুবিয়ে রাখে। বিশাল আকারের এই বিলটি প্রচুর পরিমাণ জল ধারণ করে রাখে বলেই শহরের মানুষ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। বিলের জল রাঙ্গিরখাল, সিঙ্গিরখাল হয়ে স্বাভাবিক গতিতে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু শহরের মানুষ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর বানানোয় খালগুলো ক্রমশ বেদখল হয়ে যায়। এবং এর চাপ পড়ে মহিষাবিলের ওপর।”
মহিষাবিলের জল বরাকে এনে ফেলার জন্য একটি স্লুইস গেটের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। অনেকটা কাজ হয়েও ছিল কিন্তু সে কাজ এক অজানা কারণে মধ্যপথে বন্ধ হয়ে যায়।
সব শেষে বলবো, বন্যার পরে আসবে আরো কঠিন সময়। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে হাতে হাত ধরে এগোতে হবে। যে সমস্ত এনজিও রা সত্যি সত্যি ভাল কাজ করছেন তাদের কথা সমাজ মাধ্যমে আমাদের নির্ভর যোগ্য বন্ধুরা বলছেন। তাদের সাহায্য আমরা নিশ্চয়ই করব। বন্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিতে হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
আপাতত: চেষ্টা করতে হবে জনমত গঠনের যাতে জাতীয় স্তরে বিষয় টা পৌঁছায়। পাশাপাশি চলবে জলমগ্ন মানুষের উদ্ধার কাজ।
সরকার তার কাজ হয়তো করবে, কিন্তু মানুষ ই সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজনৈতিক খেয়াখেয়ি যেন এর বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় এটাই এই প্রতিবেদকের একান্ত অনুরোধ।
(প্রতিবেদনের বিষয় ও তথ্য সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের ভিত্তিতে নেওয়া, ক্ষেত্র সমীক্ষা করা যায় নি।)
সব ছবি তুলেছেন- শাশ্বতী