আমার মনে হয়, আপনারা অনেকেই যখন পদার্থবিদদের মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাব আর তার গুরুত্ব নিয়ে ভাবেন, আপনাদেরও ঠিক সেই অনুভূতিই হয় – যেমনটা আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ে হয়েছে। আমরা বোধহয় নিজেদের এই রকম কিছু একটা বলি, “আমি মোটেই খারাপ লোক নই, আর পদার্থবিদদের মধ্যে বৈচিত্র্যও আমি বাড়াতেই চাই; কিন্তু, সমাজের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই যে নানারকম বাধার দেওয়াল, তা তো আর আমি বানাইনি – এসব দেওয়াল ভাঙতে আমি কী-ই বা আর করতে পারি?”
এই বক্তৃতাটি খুব জাজমেন্টাল শোনাক - এমন আমি মোটেই চাই না; নিজেকে বিশাল হনু হিসেবে দেখানোরও ইচ্ছে নেই। সত্যি বলতে, “আমার কিছু করার নেই” – ধারণাটা যে আসলে একদিকে নীতির ঘরে চুরি, অন্যদিকে পদার্থবিদ্যা বিষয়টির পক্ষেও অত্যন্ত ক্ষতিকর – এই সহজ সত্যটা বুঝতেই আমার ৪৫ বছরের ওপর সময় লেগেছে। লিঙ্গ-বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমার চোখ প্রথম খোলে ১৯৯২ সালে; তখন আমি হার্ভার্ডের পদার্থবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান। ততদিনে আমার হার্ভার্ডে ১৫ বছরের ওপর পড়ানো হয়ে গেছে, আর (হার্ভার্ডের যত্নে) আমার অভ্যেসও বেশ খারাপ হয়ে গেছে।
আমার তখন ধারণা ছিল, পদার্থবিদ হিসেবে আমার একমাত্র দায়িত্ব ভাল ফিজিক্স করা। আমি যখন হার্ভার্ডে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো (পোস্টডক) হিসেবে যোগ দিই, তখন সেখানে ছিলেন হেলেন ক্যুইন (Helen Quinn)। পদার্থবিদ্যায় মেয়েদের শোচনীয়রকম কম যোগদান নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি জানতাম যে এটা একটা সমস্যা, কিন্তু বুঝে উঠতে পারতাম না – কীভাবে আমার পক্ষে সাহায্য করা সম্ভব।
আমার এও ধারণা ছিল, যে শিক্ষক হিসেবে আমার কাজ হল – কোনো একটি বিষয়কে যতটা সম্ভব গভীর আর আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশ করা (আমার বেশ লাগত), তুখোড় সমস্ত সমস্যা খুঁজে বের করা (এইটিও ভালই লাগত) আর ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়া (মোটেই ভাল পারতাম না)। আমার নেহাত কপাল ভাল ছিল, তাই কর্মক্ষেত্রে এইক’টি কাজ করেই আমি পার পেয়ে গিয়েছিলাম। সবসময়েই একদল ডাকাবুকো পড়ুয়া ঠিক জুটে যেত, যারা অন্তহীন উৎসাহে আমার দৈববাণীসম বক্তব্যগুলি আত্মস্থ করত আর উদ্ভট সমস্যাগুলোর সমাধান করত। আমার নিজস্ব কোনো কেরামতি ছাড়াই, এমন বেশ কিছু চোখধাঁধানো গবেষক-শিক্ষার্থী (গ্র্যাজুয়েট পড়ুয়া) আমার জুটেছিল, যাদের আমি নিজের কমবয়সী সহকর্মীর মতই দেখতাম। আটের দশকের তাত্ত্বিক হাই এনার্জি-র [1] আমাদের সেই গোষ্ঠীতে তখন জ্বলজ্বল করছিলেন শেলি গ্ল্যাশো (Shelly Glashow) আর স্টিভ ভাইনবার্গ (Steve Weinberg) – অতএব, পার্টিকল ফেনোমেনোলজিতে [2] উৎসাহী পড়ুয়ার কমতি ছিল না – যাদের মধ্যে থেকেও আমরা আবার বাছাই করে নিতে পারতাম। এদের মধ্যে যারা শেষ অবধি আমার সঙ্গে কাজ করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল চারজন অসাধারণ মেয়ে: স্যালি ডসন (Sally Dawson), অ্যান নেলসন (Ann Nelson), লিজা র্যান্ডাল (Lisa Randall) এবং লিজ সিমন্স (Liz Simmons)। অ্যানের গ্র্যাজুয়েট ক্লাসটি ছিল আয়তনে ছোট আর তাতে বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল মেয়ে এবং আরো কিছু বিচিত্র আকর্ষণীয় চরিত্রও ছিল। পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্বভাব-চরিত্র আর সংস্কৃতিতে এই দলটির একটা ভাল প্রভাব ছিল। যেমন ধরুন, এদের শুরু করা ‘পুতুল নাচ’-এর অনুষ্ঠান গ্র্যাজুয়েট পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই মঙ্গলজনক হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা – নিজেদের নাম গোপন করে – অধ্যাপকদের নিয়ে মশকরা করত (আমাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে পুতুল ছিল) আর বিভাগের আসল রসালো খবরগুলো প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের জানাত। ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে’।
এই সময় থেকেই আমি চেষ্টা করতাম যাতে যতটা সম্ভব বেশি সময় ‘গ্র্যাজুয়েট অ্যাডমিশন কমিটি’-তে কাটানো যায়। উদ্দেশ্য – নারী আবেদনকারীদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করা। আবেদনকারীদের মধ্যে সংখ্যালঘু জাতির অংশগ্রহণ, তখনো, মোটের ওপর শূন্য। এত কিছুর পরেও যখন মেয়ে-গ্র্যাজুয়েটরা আমায় বোঝানোর চেষ্টা করতেন – পদার্থবিদ্যা-চর্চার পথটি মেয়েদের পক্ষে কতটা সমস্যা-সঙ্কুল – আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকত না ব্যাপারটা।
ইতোমধ্যে, স্নাতক (আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট) আর স্নাতকোত্তর (গ্র্যাজুয়েট) – দু’রকম পাঠ্যক্রমই পড়িয়ে আমি সুখে কালাতিপাত করে চলেছি। স্নাতক স্তরের বেশ কিছু পড়ুয়া আমার অফিসে আড্ডা দিত; তাদের অনেককেই – ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে – ভাল করে চেনার সুযোগ হয়েছিল আমার। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিল অসাধারণ। আবারও, কিছু মেয়ে আমায় বোঝানোর চেষ্টা করল, যে পদার্থবিদ্যার উচ্চশিক্ষামহলের আবহাওয়া তাদের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক – তাও ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মোটা মাথায় ঢুকছিল না।
সংক্ষেপে বললে, ১৯৯২ সালে, হার্ভার্ড পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে পাওয়া কিছু তথ্যের লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, ছাত্ররা যখন বিভাগে অতি সুমধুর সময় কাটিয়েছে, সেই একই সময়ে এই বিভাগে মেয়েদের অভিজ্ঞতা বিষময়! অথচ, এরা কিন্তু সেই মুষ্টিমেয় কিছু মেয়ে – যারা নেহাত বিষয়টাকে অপরিসীম ভালবেসে ফেলায়, নিজেদের বারংবার ‘বহিরাগত’ মনে হওয়া সত্ত্বেও – ক্রমাগত লেগে থেকে পাশ করেছে। মেয়েরা আমায় এতদিন ধরে যা বলার চেষ্টা করছিল, এই এদ্দিনে তা আমার মাথায় ঢুকল। হার্ভার্ড পদার্থবিদ্যা বিভাগের সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্কটা আসলে নিতান্ত অসম্মানের, বিষাক্ত। এ তো মেনে নেওয়া যায় না!
এইরকম সময় থেকেই আমি ‘বৈচিত্র্যের’ পক্ষে সওয়াল করা শুরু করি, যে চেষ্টা আজও চালিয়ে যাচ্ছি। এই চেষ্টাটা খুবই আনন্দদায়ক এবং ফলপ্রসূ হয়েছে – আর একটু পরেই আরো বিশদে বলব।
“আমার কিছুই করার নেই!” – এ কথা বলায় গলদটা তাহলে কোথায়?
সমাজে আমাদের নির্ঘাত নানারকমের বাধার মুখোমুখি হতে হয় – যা অতিক্রম করতে আমাদের সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করতে হবে। অসংখ্য শিশু – যাদের অসামান্য বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার কথা ছিল – তারা পদার্থবিদ্যাকে ঘিরে কর্মজীবন তৈরির কথা কল্পনাও করতে পারে না আর বহু সংখ্যালঘু ক্ষুদের – সেই স্বপ্ন দেখা সত্ত্বেও – পদার্থবিদ্যাকে পেশা বানানোর সামর্থ্যটুকুও নেই। যদি বলি, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি এই অবস্থার পরিবর্তনের কোনো চেষ্টাই করছে না – তবে তা কমিয়েই বলা হবে। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই, নিজেদের বৃত্তে, শিক্ষণ আর জনসংযোগের মাধ্যমে এই সমস্যার তিল তিল করে সমাধানের চেষ্টা করছেন।
কিন্তু এ-ও সত্যি, যে আমরা নিজেরাই এক অনতিক্রম্য দেওয়াল বানিয়ে তুলেছি। হয়তো নিজেদের অজ্ঞাতেই, আমরা পদার্থবিদ্যা-র পেশাকে, রূপকার্থে, ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’-এর একটি উদাহরণ হিসেবে দেখি – যে রূপকে সর্বদাই, অনেক লড়াইয়ের পর, সবচেয়ে কেঁদো বাঘটিই জঙ্গলের রাজা হয়ে ওঠে। সেই কারণে, পড়ানোর বা আলাপচারিতার সময়, নিয়োগের সময় এবং সর্বোপরি নিজেদের মাথার মধ্যেই, আমরা পদার্থবিদদের একটি তালিকায় ক্রমানুসারে সাজাই, আর “সর্বোত্তম”-এর সন্ধান করতে থাকি।
এমন আচরণ যে খুব অস্বাভাবিক, তা নয়। আমরা পদার্থবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হই, কারণ আমাদের মনে ‘সত্যিকারের’ প্রশ্নগুলোর ‘সত্যিকারের’ উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে থাকে। আমরা প্রশ্ন ‘তৈরি’ করি না। দুনিয়া-রহস্যের তল পাওয়ার চেষ্টা আমাদের নিরন্তর – আর সেই রহস্যের সমাধান আমরা ‘গোঁজামিল’ দিয়েও করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বোধ, রাশিবদ্ধ (quantified) এবং অঙ্কের ভাষায় প্রকাশিত না হচ্ছে, আমাদের শান্তি নেই – তা সে যতই চটকদার মুখের ভাষায় তার ব্যাখ্যা থাকুক না কেন। শুধু তা-ই নয়, আমাদের সমাধানগুলো, এরপরেও, সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয় – যখন পরীক্ষালব্ধ তথ্যের সঙ্গে তাদের মিলিয়ে দেখা হয়। স্বভাবতই, পদার্থবিদদের নিয়ে চিন্তা করতে বসেও, আমরা অভ্যাসবশত সেই চিন্তাকে ‘গাণিতিক’ মাপজোকে ফেলি। ঠিক তখনই আমাদের বক্তব্য হয়, “যদি আমাদের সাজানো লিস্টে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ প্রার্থী ‘ক’, সংখ্যালঘু প্রার্থী ‘খ’-এর উপরে থাকে, তবে আমরা ‘ক’-কে নিতে বাধ্য, আর সেই কারণেই, ‘বৈচিত্র্যে’র জন্যে আমাদের পক্ষে কিস্যুটি করা সম্ভব নয়!”
এর থেকে বড় ভুল কথা আর হয় না!
আমি কিন্তু একবারও বলছি না, যে, চিন্তাভাবনা না করেই – সরল, মোটাদাগের ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’ নেওয়া উচিত! একজন ‘সাধারণ’ সংখ্যালঘু প্রার্থীকে নির্বাচিত করে বৈচিত্র্যের এই আন্দোলনের যতটা ক্ষতি করা সম্ভব, তা বোধহয় আর কোনো উপায়েই সম্ভব না। একজন প্রার্থীকে নিয়োগ করার প্রাথমিক শর্ত হল, তাঁকে তাঁর কাজে অসাধারণ দক্ষ হতে হবে। কিন্তু পদার্থবিদ্যার গোলমালটা হল, এখানে ‘কাজ’টা যে ঠিক কী, তা কেউই নিশ্চিত করে জানে না আর সেই কারণেই – “কয়েকজন ‘অসাধারণ’ প্রার্থীকে আমরা সন্দেহাতীতভাবে দক্ষতার, সামর্থ্যের ক্রমানুসারে সাজিয়ে ফেলতে পারি” – এই ধারণাটিই ভ্রান্ত। পদার্থবিদ হিসেবে আমাদেরই কি সর্বাগ্রে জানার কথা নয়, ‘পরিমিত’ প্রশ্নমাত্রেরই যে উত্তর থাকে – তা ঠিক নয়? যেমন ধরুন, দু’টি ‘স্পেস-লাইক’ অন্তর (space-like interval) দিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা – তাদের মধ্যে কোনটি অন্যটির ‘আগে’ ঘটেছে?
আমার আসলে মনে হয়, কেবল বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে সমস্ত সামাজিক বাধার অপসারণেই এই সমস্যাটির পরিধি সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের এবার একটি সঠিক রূপক বেছে নেওয়ার সময় এসেছে – শুধু ন্যায্য বলে নয় – পদার্থবিদ্যা বিষয়টির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বলেও। এইখানে সরাসরি প্রথিতযশা পদার্থবিদদের উদ্দেশে কিছু কথা বলা যাক। আমি জানি, আপনাদের প্রত্যেকের কিছু অসামান্য দক্ষতা আছে, যেগুলোকে ঘষেমেজে নিপুণ করে তুলতে এবং সফলভাবে প্রয়োগ করতে আপনারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু এ কথাও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, যে, আপনাদের প্রত্যেকের এই ওস্তাদিগুলো আসলে অনেকরকম দক্ষতার সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা, আর যার অনুপাত – প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা। মানবচরিত্র পর্যবেক্ষণে সামান্য অভিজ্ঞতা থাকলেই এটা বুঝতে পারবেন। আমি নিজেই এটা অনেকভাবে দেখতে পাই। নিজের দিকে তাকালে বুঝি, কিছু কাজ আমি অন্যান্য কাজের থেকে অনেক ভাল করে করতে পারি। ঠিক তেমনই, আমার ছাত্রছাত্রী আর নবীন সহকর্মীদের দিকে তাকালেও, দক্ষতার সেই একই অদ্ভুত বৈচিত্র্য দেখতে পাই।
নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনের দিকে ফিরে তাকালে দেখি, কণা-পদার্থবিদ্যার যে বিশেষ অংশে আমার কাজ, সেই সঙ্কীর্ণ পরিসরেও, বহু মহীরুহের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি ভাগ্যবান, যে প্রায় নব্বইজন অসামান্য পদার্থবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি আমি, যাঁদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত। অবশ্যই, কাজের সূত্র ছাড়াও, আরও অনেককেই কাছ থেকে দেখার, জানার সুযোগ পেয়েছি। এড উইটেন (Ed Witten) -এর সঙ্গে বহু বছর একই অফিস ভাগ করে থাকার, নিজেকে ‘বিনম্র’-বানানো অভিজ্ঞতাও আছে আমার। এঁরা সকলেই ‘অসাধারণ’ মেধার অধিকারী, কিন্তু লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, এঁরা নিজেদের মত করে, নিজস্ব ‘অনন্য’ ভঙ্গিতে ‘অসাধারণ’। আমি কিন্তু পদার্থবিদ্যা-অধ্যয়নের কথা বলছি না – এঁদের নিজেদের পছন্দের ভাষা যা-ই হোক না কেন, সকলেই পদার্থবিদ্যার ভাষাতেই কথা বলেন। কিন্তু, একবার যদি এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশেন, এঁদের মগজ কীভাবে কাজ করে – তার আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করেন, দেখবেন কী অবিশ্বাস্য এঁদের চিন্তার বৈচিত্র্য!
‘পদার্থবিদ-পর্যবেক্ষণ’-এর এই অভ্যেস আমার বহুদিনের। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি, যদি “কীভাবে ‘মহান’ পদার্থবিদ নিরূপণ করা সম্ভব” – এই প্রশ্নটিকে সংখ্যায় প্রকাশ করতে হয়, তবে একটি বহু, বহু মাত্রার (ডাইমেনশন) স্পেস কল্পনা করতে হবে আমাদের – কোনো জটিল সমস্যার সমাধানে যতরকম সম্ভাব্য কায়দায় চিন্তা করা সম্ভব – সেই বহুরকমের পদ্ধতির প্রতিটির জন্যে নির্দিষ্ট থাকবে ওই স্পেসের একেকটি ডাইমেনশন।
পদার্থবিদ্যায় প্রতিভা-সন্ধানের জন্যে আমি মাঝেমধ্যে একটা N সংখ্যক ডাইমেনশনের “গোলাকার গরু” মডেল (গোল-গরু মডেল) [4] কল্পনা করি (N-এর মান খুব বড়), যেখানে প্রতিটি ডাইমেনশন, কেন্দ্রে (অরিজিন) ০ থেকে শুরু করে অন্য সীমায় ১ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘন জ্যামিতি-তে (সলিড জিওমেট্রি) একটি গোলকের positive octant বলতে আমরা যা বুঝতাম, তারই N-ডাইমেনশনে প্রতিরূপ। উইকিপিডিয়ায় পড়লাম, একে নাকি ‘Orthant’ বলে। আমার এই N-মাত্রার অর্থ্যান্টের প্রতিটি বিন্দু আসলে কোনো একজন পদার্থবিদের একটি সম্ভাব্য দক্ষতা-প্রতিভার সমষ্টি। ‘মহান’ পদার্থবিদরা কেন্দ্র থেকে বহুদূরে, সীমানার কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করেন। যদি ধরে নিই, আমার এই গোল-গরু মডেলে প্রতিভা সর্বত্র সমানভাবে ছড়ানো (uniformly distributed), তাহলে মোট প্রতিভার যে ভগ্নাংশটি সীমানার খুব কাছে, ϵ - আয়তনের [5] স্পেসে ছড়ানো, তাহলে তার মান হবে (N × ϵ)-এর সঙ্গে সমানুপাতিক (ϵ কে খুব ছোট ধরে)। তার মানে, যদি N-এর মান খুব বড় হয় (যেমন এখানে আমরা ধরেছি), তবে সীমানার কাছে মোট আয়তন বিশাল!
এর থেকে আমি যা বুঝি, তা হল, মহান পদার্থবিদ হওয়ার অসংখ্য রকমফের আছে, অতএব – এমন বহু রকমও নিশ্চিত আছে, যা হয়তো এখনো আমরা দেখিইনি! সেক্ষেত্রে, প্রতিভার যে অনাবিষ্কৃত বিশাল স্পেসটি পড়ে রয়েছে, তার অন্বেষণ তো আমাদের নৈতিক কর্তব্য! এর অর্থ, সেই সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা – যাঁরা একটু অন্যরকম, আর যাঁদের চিন্তা আর কাজ – দুইয়ের পদ্ধতিই আলাদা।
আপনারা স্বচ্ছন্দে আমার এই ‘গোল গরু অর্থ্যান্ট’-এর নানাবিধ খুঁত ধরতেই পারেন। আমি কিন্তু খুব আনন্দ পাব, যদি এই মডেল আপনাদের অন্তত এইটুকু উপলব্ধি করতে সাহায্য করে, যে, একজন গোটা মানুষের মূল্যায়নে একমাত্রিক, ক্রমানুসারে সাজানো তালিকার ব্যবহার ঠিক কতটা ক্ষতিকারক। যদি ধরেও নিই, তেমন কোনো তালিকা কিছুমাত্রও অর্থবহ, তাহলেও, সেটা আসলে কোনো এক বহুমাত্রিক স্পেসের, কোনো একটি অজানা একমাত্রিক প্রোজেকশন বা অভিক্ষেপ। আর ঠিক এই কারণেই আমি মনে করি, বৈচিত্র্যের সন্ধান শুধু যে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব – তা-ই নয়, আমাদের ছোট-বড় গবেষণার দল, আমাদের প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি আমাদের সবার প্রিয় এই পদার্থবিদ্যা বিষয়টির জন্যেই, সবচেয়ে লাভজনক রাস্তাও বটে! এই সন্ধান সবচেয়ে কার্যকরীভাবে করতে হলে, আপনাদের এই ‘গোল-গরু’ মডেলটা মাথায় রাখতেই হবে।
পড়ানোর সময় পড়ুয়াদের নিশ্চয়ই নম্বর দিতে হয় আপনাদের? আমার মনে হয়, নম্বর দেওয়ার সময় আপনাদের উচিত, পড়ুয়া কত বিভিন্নরকমভাবে ভাল ফল করছে, সেই রকমফের অনুযায়ী তাদের উপ-নম্বর বা টুকরো নম্বর দেওয়া, আর প্রত্যেকের আলাদা খতিয়ান রাখা। বিচিত্র রকমের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে জানা এবং উৎসাহ দেওয়াও সেক্ষেত্রে যেমন সম্ভব, তেমনই তাদের এটাও বোঝানো সম্ভব যে চূড়ান্ত ফলাফল আসলে এই বিভিন্ন উপনম্বরেরই কোনো একরকমের সংমিশ্রণ। পড়ুয়াদের মানুষ মনে করে মিশুন, তাদের নিজস্বতাকে নিজেও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করুন – তাদেরকেও সাহায্য করুন, যাতে তারা নিজেদের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পায় আর তা নিয়ে গর্ববোধ করে।
কারুর মেন্টর হওয়ার সময় [6], কনিষ্ঠ সহকর্মীকে জোর করে পুরোনো গবেষণার ছাঁচে না ফেলে, আপনার উচিত – তাদের নিজেদের বিশেষ ক্ষমতাগুলোর সন্ধান ও সঠিকভাবে প্রকাশ করতে উৎসাহ দেওয়া। অন্তত আমার তো তা-ই মনে হয়। কখনোসখনো, এর অর্থ নিজেদের বয়স্ক সহকর্মীকে নিত্যনতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে সাহায্য করাও বটে।
বৈচিত্র্যের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল – বিচিত্র মানবসম্পদের নিয়োগ। এর সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ আমি আমার বিভাগের অধ্যাপিকাদের মধ্যেই দেখেছি। আমাদের এখনো অনেক রাস্তা চলা বাকি, তবু, বিভাগে বেশ কিছু অসাধারণ মহিলাবিজ্ঞানীর উপস্থিতি – যাঁদের নিজেদের মধ্যেই আবার বিশাল বৈচিত্র্য – বিভাগের সংস্কৃতি আর পড়ুয়াদের মানসিক অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি, যখন এবছর তিনজন স্নাতকস্তরের ছাত্রী রোডস স্কলারশিপ পান। এঁরা সকলেই আমাদের ‘পদার্থবিদ্যায় নারী’ দলটির সক্রিয় সদস্য। আমার অপেক্ষা এখন সেইদিনের, যেদিন আমাদের বিভাগ একইরকমের জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরে উঠবে। মনে হয় তা তখনই সম্ভব – যখন আমরা চাকরিপ্রার্থীদের কোনো এক ক্রমানুসারে সাজানো তালিকার একেকটি সংখ্যা মনে না করে, নানাবিধ দক্ষতার অধিকারী একেকজন মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখব।
প্রতিভার এই অর্থ্যান্টে সর্বদাই কিছু এমন বিরল মহা-মহা-তারকা থাকবেন, যাঁদের বসবাস কিছু ডাইমেনশন-বরাবর, বহু-দূরে, সেই সীমানার কাছাকাছি। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁরা অনন্য, একক। কোনো আর একজন অ্যান নেলসন বা এড উইটেনকে দেখামাত্রই তাঁকে চাকরি দেওয়া দরকার – তিনি সংখ্যালঘু না গুরু – বিচার না করেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে, অধিকাংশ প্রার্থীই, আমাদের অধিকাংশের মতই, ‘শুধুই ভাল’ পদার্থবিদ – যাঁদের মধ্যে বেশ কিছু দক্ষতার মিশেল রয়েছে, আর তাঁদের ভাগ্য নেহাত ভাল হলে, সেই দক্ষতাগুলি জরুরি কোনো সমস্যা সমাধানে কাজে লাগতে পারে।
নিয়োগকারী, প্রার্থী-নির্বাচক কমিটিগুলির উচিত বিষয় নির্ধারণে খুব বেশি কড়াকড়ি না করা, যাতে বিস্তৃত বিষয়ের মধ্যে উপযুক্ত প্রার্থীর সন্ধান চালানো যায়। আক্রমণাত্মক বা সাবলীল স্বভাবের সঙ্গে দক্ষতাকে গুলিয়ে ফেলাও উচিত নয়। প্রার্থী যদি হুবহু নির্বাচক কমিটি বা বর্তমান বিভাগের অধিকাংশের মত দেখতে-শুনতে হয়, তবে তার প্রাপ্ত নম্বরে একটি ‘অন্তর্নিহিত পক্ষপাত ফ্যাক্টর’ (implicit bias factor) -ও বসানো উচিত। প্রতিভার সন্ধানে পূর্বপ্রচলিত ‘পদাধিকারীদের-মুখের-কথা/সুপারিশ’ (‘old-boy network’) [7] নীতিতে ভর না করে, চেনা রাস্তায় নাম-না-আসা সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের খুঁজে বের করার ঐকান্তিক চেষ্টা করা দরকার। এগুলোর কোনোটিই সহজ নয়।
জাতীয়স্তরে, আপনাদের নিজেদের বিষয়ের সঙ্কীর্ণ পরিসরে, ‘অসাধারণ’ সংখ্যালঘু পদার্থবিদদের সম্পর্কে জানুন। ডেকে আনুন তাঁদের, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতা করার জন্যে। পুরস্কারে মনোনীত করুন।
এই বিশেষ বিষয়টির আমার একান্ত পক্ষপাত থাকা সত্ত্বেও, আমি জানি, আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই সঙ্কীর্ণতা আর পক্ষপাত রয়েছে। সময় বদলাচ্ছে; হয়তো এদ্দিনে এই মতামতগুলো সেকেলে-ও হয়ে গেছে! সেই কারণেই, এই ভেবে আমার আনন্দ হচ্ছে – আমাদের এই প্যানেলে তিনজন নবীন পদার্থবিদ আছেন, যাঁদের থেকে আপনারা আরও সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাবেন। তাঁরা এই বিষয়ে নিজেদের মতামত ও চিন্তাধারা প্রকাশ করতে রাজি হয়েছেন, এ কারণে তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
এইরকম যে কোনো বক্তৃতা দেওয়ার সময়, অবধারিতভাবে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে – যখন মনে পড়ে আমার পুরোনো ছাত্রী অ্যান নেলসনকে হারিয়ে পদার্থবিদ্যার কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমার চেনা সমস্ত উজ্জ্বল মানুষের ভিড়ে অ্যান ছিল উজ্জ্বলতম। এ কথা আমি আগেও বলেছি, যে, আমার অনেক পড়ুয়াই অনেক বিষয়ে আমার থেকে ভাল ছিল বটে, কিন্তু অ্যান ছিল আমার একমাত্র ছাত্রী, যে ঠিক আমার ওস্তাদির বিষয়গুলিতেই আমার থেকেও ভাল ছিল। সে শুধু একজন অসামান্য পদার্থবিদই ছিল না, একজন অসম্ভব ভাল মানুষও ছিল। এই অধিবেশনে অ্যানের উত্তরাধিকারকে সম্মান জানাতে আমার কথা মনে পড়েছিল বলে আমি ডেভিন (Devin)-এর প্রতি কৃতজ্ঞ। ২০১৭ সালের ‘Physics Today’-র পিছনের পাতায় বেরোনো অ্যানের লেখা নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে আমার বক্তব্য শেষ করি...
“If your career is established and you are not making an explicit and continual effort to encourage, mentor, and support all young physicists, to create a welcoming climate in your department, and to promote the hiring of diverse faculty members, you are part of the problem. This is a critical issue of civil rights in our field.”
(“আপনি যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়ে থাকেন এবং তারপরেও – সমস্ত নবীন পদার্থবিদদের উৎসাহ, সাহায্য ও পরামর্শ দেওয়ার, নিজের বিভাগে সুন্দর, অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার এবং অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের প্রচার করার – সুস্পষ্ট এবং ক্রমাগত চেষ্টা না করেন, তবে আপনি নিজেই সমস্যার অঙ্গ। আমাদের এই বিষয়ে এটি এখন নাগরিক অধিকারের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।”)
এতক্ষণ আমি এটাই বলার চেষ্টা করলাম, যে এই বিষয়টির গুরুত্ব নাগরিক অধিকারের থেকেও বেশি কিছু। এ হল পদার্থবিদ্যার মহত্ত্ব ভবিষ্যতেও নিশ্চিত করার সেরা উপায়।
আপনাদের ‘বাড়ির কাজ’ কী থাকল তবে?
আপনাদের প্রথম কাজ হল – পদার্থবিদ্যায় দুর্দান্ত কাজ করা, তার থেকে আনন্দের রসদ পাওয়া আর সেই আনন্দের ভাগ পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এই বিষয়টির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করাটাও, আপনাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল – লেগে থাকা! এই কাজ কিন্তু আশাবাদী মানুষের কাজ। আমাদের ইচ্ছে যেমনই হোক না কেন, প্রগতির গতি তার থেকে কমই হবে। দুনিয়ার নিয়মই তাই। কিন্তু আজ যে ভাল মানুষগুলো ভাবছে, “আমার কিছুই করার নেই!” – তারা নড়েচড়ে না বসলে, কাজ শুরু না করলে – প্রগতির শুরুটুকুও যে হবে না!
সূত্রনির্দেশ:
[1] কণা পদার্থবিদ্যার একটি বৃহৎ শাখা
[2] পদার্থবিদ্যার এমন একটি শাখা, যেখানে তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে ‘পরিমেয়’ (মাপা যায় এমন) ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, আর পরীক্ষালব্ধ তথ্যের সঙ্গে সেই গণনার তুলনা করে দেখা হয়।
[3] M-theory-র ‘ব্যবহারিক’ জনক; Fields Medal-জয়ী প্রথম পদার্থবিদ।
[4] দৈনন্দিন সব ঘটনাই আসলে অত্যন্ত জটিল। তাদের সহজ করে না দেখলে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়াই অসম্ভব। এই অতি-সরলীকৃত মডেলের মজা করে দেওয়া নাম হল Spherical Cow Model - মূলত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় উদ্ভূত। নামটি আসলে যে কোনো সমস্যাকে সহজতম আকারে ছোট করে দেখার (এমনকি যখন তা প্রয়োগের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখনও) পদার্থবিদদের একরকমের প্রবণতার উদ্দেশে কটাক্ষ।
[5] অঙ্কে আর পদার্থবিদ্যায় সাধারণত খুব ছোট কিছু বোঝাতে ϵ ব্যবহার করা হয়।
[6] ছানাপোনা গবেষক যখন বিজ্ঞানসমুদ্রে খাবি খান, তখন যেসব অভিজ্ঞ, পোড়খাওয়া ঋষিপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তাঁদের হাল ধরেন, তাঁদের বলে মেন্টর। সহৃদয় ‘দাদা’-র আকাদেমি-সংস্করণ ভাবতে পারেন
[7] অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে: an informal system through which men are thought to use their positions of influence to help others who went to the same school or university as they did, or who share a similar social background.