অন্নদা মুন্সীর চা-পান বৃত্তান্ত
ওদের চা... মোদের চা
সবার চাই স্বাদের চা !
বিজ্ঞাপন দুটি শ্রী অন্নদা মুন্সীর সৃষ্টি।
ওনাকে ভারতের Commercial Art
এর জনক বলে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।
মানুষটি ছিলেন স্বদেশীয়ানার "ফ্লেভারে" ভরপুর।
Lipton Co. র কাজ হাতে নিয়েছিলেন এই শর্তে
-- " আমি কিন্তু স্বদেশী চা বাগানের মালিকের বিজ্ঞাপনও বানাবো সাহেব ! ইচ্ছে হয় আমায় রাখো, নয়ত চল্লুম। "
দেশের মানুষের জন্য বিজ্ঞাপন করতেন বিনা পারিশ্রমিকে।
★
শ্রী অন্নদা মুন্সি মশাই ছিলেন এক অন্যতর ব্যক্তিত্ব।
এবং মনে প্রাণে, যাকে বলে... Upto Bone Marrow বাঙ্গালি ( এবং অবশ্যই ভারতীয়)।
অন্নদাবাবু কে বলা হয় ভারতে কমার্শিয়াল আর্ট -এর আদিগুরু -পিতৃপ্রতিম ।
সঙ্গীতের হাতেখড়ি ছোটকাকার কাছে। রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন অসাধারণ । বেহালা-এস্রাজের হাত ছিল মধুক্ষরা। আর পিয়ানো? বাখ - সোঁপা - মোৎজার্ট ছেড়েই দিন, পিয়ানোয় মেঘমল্লার বাজাতেন আকাশে মেঘ জমলে !
কত দেশ ঘুরেছেন তার সঙ্গীত নিয়ে... চাকরিসূত্রে। তখনকার বোম্বাই রেডিও তে নিয়মিত রবীন্দ্র গান গাইতেন... এমনকি বেশ কিছুদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা করেছেন সেই Tinsel Town এ।
তাছাড়া, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আসর তো ছিলই -- সেখানেও সমান মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বহুদিন।
কি খেয়াল হ'ল --বোম্বাই তেই Times of India র পাতায় কার্টুন আঁকতে শুরু করলেন। পরিচালকমন্ডলী ধরলেন তাদের কাগজের বিজ্ঞাপন এঁকে দেবার জন্য। কিছু কাজ করলেনও।
তারপর , পাইকপাড়ার জন্য বড্ড মন কেমন করতে লাগল একদিন। ব্যস, ধুতি-পাঞ্জাবি প'রা মানুষ টি একহাতে স্যুটকেস, অন্যহাতে বেহালার বাক্স নিয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে নামলেন।
****
এবার হাতে উঠল রঙ-তুলি-প্যাস্টেল। ডি. জে. ক্র্যামার তখন খুব নামজাদা বিজ্ঞাপন সংস্থা। প্রচুর খোসামোদ করে তারা অন্নদাবাবুকে রাজি করালেন যোগ দিতে।
তবে শর্ত আছে -- ধুতি-পাঞ্জাবি আর লাঞ্চ টাইমে রবীন্দ্রসংগীত।
(তার চেম্বারে তিনি বিভোর হয়ে গাইতেন...বেহালা বাজাতেন আর বাইরে নাকি গোরা-সাহেবরা ঠায় দাঁড়িয়ে শুনতো ... ডেসার্টের আইসক্রিম ততক্ষণে গলে ক্ষীর !)
এই ক্র্যামার কোম্পানিতে থাকার সময়ই তিনি Commercial Art কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসেন। কতো বিষয়ের বিজ্ঞাপনী তৈরী করেছেন রঙ-তুলিতে।
এই সময়ে, Indian Tea Planters Association থেকে বরাত পান চা-য়ের ওপর বিজ্ঞাপন করার।
বেশ কিছু Ad করলেন Lipton, Brooke Bond দের জন্য। দারুন সুনামও পেলেন। ইংরেজ চা-বাগান মালিকদের কাজ করতে গিয়ে বুঝলেন যে, ভারতীয়দের কাছে চা-পান কিন্তু বিলিতি নেশাই হয়ে রয়েছে... যতোই তিনি ছবি এঁকে পকেট ভরান না কেন! অথচ, দেশীয় শ্রমিকরা রক্তজল করে চাষ করছে, দেশের মাটিতেই !
যে কয়েকজন ভারতীয় চা-বাগান মালিক ছিলেন তাদের অন্নদাবাবু প্রস্তাব দিলেন :
বিশুদ্ধ বাঙ্গলা ভাষায় তিনি "ছবি-লেখার" বিজ্ঞাপন তৈরি করে দেবেন যাতে চা-পানের বহুল প্রচার হয় । তাদের দায়িত্ব জনবহুল স্থানে সেগুলি বিজ্ঞাপিত করা।
আর হ্যাঁ, তার পারিশ্রমিক নেবেন না।
*******
১৯৩০ - ৩২ সাল।
এই সিরিজে তিনি বেশ কয়েকটি পোস্টার প্যানেল করেন। তার মধ্যে থেকে অন্তত তিনটি একসাথে বিজ্ঞাপিত হতো
হাওড়া, শিয়ালদহ সহ বেশ কিছু জংশন স্টেশনে, কোর্ট-কাছারির বাইরে, থিয়েটার পাড়ায় আর গড়ের মাঠে যেখানে ফুটবল খেলা হ'ত !
ইংরেজ মালিকের নিষেধ উপেক্ষা করে ইংরেজিতেও এঁকেছিলেন ছবি -- ঘরের মা-বৌ চরকা কাটছে... পাশে চায়ের কাপ।
একবার সুইডিশ কোম্পানির জন্য দেশলাই বাক্সের লেবেল ডিজাইন করলেন।
INDIAN BEAUTY .
নেবেন তো নিন... আমি এই আঁকবো !
ভারতীয়ত্বের মেজাজ !
বাঙ্গালি তখনো আমাদের মতন সরীসৃপ হয় নি, মশাই।
*****
সত্যজিৎ রায় নামে এক শিল্পী তাকে গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন,
কাজ করেছেন তার সাথে আর বারংবার প্রণাম জানিয়েছেন তার প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব আর বাঙ্গালিয়ানাকে।
তাঁর পথে হেঁটে সত্যজিৎ নিজেও করেছিলেন কয়েকটি "চা-পান " বিজ্ঞাপন।
Matter of fact, এ কথাও বলে রাখি,
রবিশংকর আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে আরও দুজন বাঙ্গালি ভদ্রলোকও তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন বলে শুনেছি।
তার প্রতি রইল এই অলেখকের অনেক শ্রদ্ধা।
( দ্রিঘাংচুর দিগ্ দর্শন /দ্বিতীয় খন্ড /
সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।