পাঠসমলোচনা——ভোরের কলকাতা ,বিশেষ করে দক্ষিন কলকাতার বিভিন্ন অলিগলির বুক ফুড়ে উঠে যাওয়া ফ্ল্যাটবাড়ীর রমরমা, হারিয়ে যেতে বসা পুকুর আর পুকুরঘাট — বাঁশির সুরে কর্পোরেশন এর গাড়ীর আগমন, কিছুদূর অন্তর অন্তর সৌন্দর্য্যায়নকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উপচে পড়া ময়লার ভ্যাট, আর অসীম আশায় বুক বেধে ব্যবসা করতে বসা লটারী বিক্রেতা———৷
বৈশাখের ডাইরি, ইন্দ্রজিৎ রায়ের ধারাবাহিক —মাসিক কবিতাপত্রে প্রকাশিত এক খোলা ডাইরীর পাতা, যার মধ্যে থেকে উঁকি মারছে সভ্য সমাজের অসভ্যতার ছবি৷৷
প্রথম পড়তে গিয়ে মনে হয় মানেহীন কিছু এলোমেলো বাক্যের সমাহার৷৷
দ্রুত পটপরিবর্তন প্রশংসার দাবী রাখে৷৷
ছবি হয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষদের অভাববোধ যেখানে অভ্যাসে পরিনত সেখানে লেখকের বাড়ীর পাশের পুকুরে মা'য়ের অস্তিকে রেখে দেওয়া—বুকের গভীরে গিয়ে আঘাত করে৷৷
সভ্য সমাজের আরেক অসভ্যতা—
অভাবের তাড়নায় শৈশব ভুলে, শিক্ষার অধিকার থেকে বন্চিত লটারি বালকের আয় কত হয়েছিল সেদিন তার কথা লেখক বলেননি,কিন্তু বালকের মুখের যে ভাব লেখক ইন্দ্রজিৎ রায় এঁকেছেন তাতে পরিস্কার বালকের হাত খালিই যায় বেশীর ভাগ দিন৷৷
লেখক যখন রাস্তার অন্তহীন ধারন ক্ষমতার কথা বলছেন—তখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে এক অজগর সাপ, তার এবড়ো খেবড়ো গা নিয়েই আশ্রয় দিচ্ছে আশ্রয়হীনকে৷৷
গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া বয়া, হঠাৎ করে কাউকে ধরে জিজ্ঞাসা করলে অবাক চোখে তাকিয়ে ভাববে চাইনিজ ভাষায় কিছু বলতে চাইছি৷৷
ভূলে যাওয়া শব্দ লেখনীতে জায়গা করে নিয়েছে স্বমহিমায়৷৷
লেখক যখন লালন ফকিরের গানের কলি তুলে ধরছেন, "মনের ময়লা যাবে কি করে"——— কি গূঢ় অর্থবহ৷৷
বৃষ্টির রাতে ছাদের জমা জলে বসে তারজালি থেকে চুল সরানো এক আধিভৌতিক মানসিকতার জন্ম দেয়৷৷
লেখক ইন্দ্রজিৎ রায়ের "বিসেবিশের" আরেক অধ্যায়," পাটনার হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শায়িতা পিসিমা, প্রিয় মানুষের মুখ খুঁজছেন" —মানুষের সংর্কীণ মানসিকতার প্রকাশ৷৷
নিজেদের প্রয়োজন আর স্বার্থ মানুষকে কতটা নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে যেখানে অসুস্থ প্রিয়জনকে দেখতে যাওয়ার সময় হয় না৷৷
সত্যিই বর্তমান সমাজ যে আজ মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ জীবটির মধ্যে থেকে তার আসল essence' কে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে এ তারই প্রকাশ৷"
পিসিমা তার চাকুরী থেকে পাওয়া সব টাকা সরকারের ঘরেই রেখে দিয়েছিলেন, আদান্ত নির্লোভ মানুষের এক জ্বলন্ত উদাহরন৷৷ বন্যার জল থেকে দু হাতে শুধু বই গুলোকে আগলানো—বই এর প্রতি, পড়ার প্রতি সন্মান—লেখকের কলমে ফুঁটে উঠেছে৷৷
আর এক পর্যায়ে লেখক বাঘাযতীন রানীকুঠি এলাকার কলোনীর আঁকাবাঁকা গলির ছবি একেছেন৷৷
ধুলো ওড়া নিস্তব্ধ রাস্তায় ফিরে গেছেন শৈশবে৷৷
সত্যিই তো, ছোটবেলার বড় আলমিরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট হতে থাকে৷৷ এ এক গভীর উপলব্ধি৷৷
মায়েদের গন্ধমাখা আলমিরা পুরোন হয়, তবুও তার মাঝেই জমে থাকে কাপড়ের ভাজে ওনাদের লুকিয়ে রাখা স্নেহ৷৷ সন্তানের চোখে তার মূল্য নির্ভর করে সেই সন্তানের মানসিকতার ওপর৷৷ হয়তো কারুর চোখে ছোট হয়ে যাওয়া জং ধরা আলমিরা বিদায় করার ভাবনা জমে, কেউ বা তাকে সযত্নে আগলে রাখে৷৷
সন্তান নামক সস্পর্কের এক অমোঘ সত্যি এঁকেছেন লেখক এখানে৷৷
বাক্যবন্ধের অসগলগ্নতা কোথাও কোথাও পড়ার খেই হারিয়ে দিয়েছে যদিও, তবুও সার্বিক আঙ্গিকে ইন্দ্রজিৎ রায়ের "বৈশাখের ডাইরী,বিসেবিশ " অন্যমাত্রার এক স্বাদ এনে দেয়৷৷
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।