সলিলদা, সলিল বিশ্বাস এর প্রথম পরিচয় শিক্ষক। সলিলদার পেশা কলেজ শিক্ষকতা। সলিলদার নেশা শিক্ষা, শিক্ষা নিয়ে ভাবনা, অন্য শিক্ষা ভাবনা, অন্য শিক্ষা প্রয়োগ।
তখন সত্তর। রাজনীতিতে 'নকশালবাড়ি আন্দোলন'। যারা নকশালবাড়ি আন্দোলনের রাজনীতিতে, কাজে না হলেও ভাবনায়, তারাই অন্য অন্য বিষয়ের আন্দোলনে। সেই সময়ের আন্দোলন যতটা মনে পড়ছে বলে যাচ্ছি। বন্দীমুক্তি আন্দোলন, গণবিজ্ঞান আন্দোলন, কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন, গণসঙ্গীত, সুস্বাস্থ্য আন্দোলন, পথ নাটক, ছোটো পত্রিকা আন্দোলন, পথ শিক্ষা আন্দোলন, অন্য অর্থনীতি ভাবনা, পরিবেশ আন্দোলন, সাক্ষরতা আন্দোলন, নারী আন্দোলন, তৃতীয় লিঙ্গের আন্দোলন, অন্যমনের মানুষ আন্দোলন, অধিকার আন্দোলন, যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলন। 'গ্রামে চলো'র ডাক তখন অন্য অনেক পথে চলোর ডাকের জন্ম দিয়েছে।
সলিলদা সেই ডাকে সাড়া দিয়ে অন্যপথে চলার পথিক। সলিলদার অন্যপথ 'অন্য শিক্ষা'। পথের সাথী আমার জানা দীপাঞ্জনদা, দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী, দেবাশিস, দেবাশিস সরকার, আরও কয়েকজন। খানিকটা সময় আমি।
সলিলদা খুঁজে পেলেন অন্য শিক্ষার ধারণা পাওলো ফ্রের-এর লেখায়। প্রয়োগে আমরা। আমার প্রয়োগে থাকার গল্প বলে সলিলদা, সলিলদা দের গল্প বলি। দেবাশিস আমি বেছে নিলাম নিউ আলিপুরের পিছনে সাহাপুরে গরীব পরিচারিকাদের বসতি। পরিচারিকাদের পরিবারের বসতি। সলিলদা আমাদের বোঝালেন কী করতে হবে। আমরা সেই মতো অন্য লেখাপড়ার আন্দোলনের কর্মী হয়ে গেলাম। সপ্তাহের কয়েকটা দিন সন্ধাবেলা আমরা পরিচারিকাদের নিয়ে বসতাম। প্রথামাফিক অ আ ক খ বর্ণমালা শেখাইনি।
পাওলো ফ্রের দর্শনে, সলিলদার, সলিলদাদের পরিচালনায় অন্যভাবে শুরু। একটা উদাহরণ দিই।
একদিনের বিষয় ছিল 'হাত'। আমরা তিনটে বড়ো বোর্ডে 'হ' 'া' 'ত' লিখে নিলাম। এদের কী বলে বললাম । এদের যোগ করে 'হাত' হয় বললাম। ওরা বললেন। তারপর তিনটে অক্ষর কী করে লিখতে হবে শেখালাম। পেন্সিল, কলম, ধরে ওদের শেখানো যাবে না। আঙুলে, হাতে, কবজিতে একটা জড়তা সেই বয়সে এসে গেছে। কেউ কেউ পারতেন। আমরা কখনো দেশলাই কাঠি দিয়ে, কখনো সুতলি দড়ি দিয়ে অক্ষর বানাতাম। ওরা পারতেন।
তারপর শুরু হতো পরের অধ্যায়। বলা হতো 'হাত' এই কথাটার মতন আর কী কী কথা ওরা জানেন, বলতেন হাতা, হাতল, হাতুড়ি হাতাহাতি, হাতসাফাই। জানা যেতো ওদের শব্দ/কথা সংগ্রহ। আমরা লিখে রাখতাম।
এবার শুরু 'হাত' নিয়ে কথা বলা। শব্দের পরে কথা, জানাজানির পরের ধাপ। ওঁরা বলে যেতেন, আমরা লিখে রাখতাম। এমন নয় যে একজনের কথা শেষ হলে আর কয়েকজন। একজনের কথার মাঝে, কথার পিঠে আরেকজন। উৎসাহে, ইচ্ছেয়, স্বতঃস্ফূর্ততায়। দুটো একটা এতদিন বাদে মনে পড়ছে। যেমন একজন : হাত আছে, তাই আমরা কাজ পাই, খাটি, রোজগার করি, পেট চলে। আরেকজন : রোজগার করে কি হবে, টাকা পয়সা তো আর আমাদের হাতে থাকে না। স্বামীরা নিয়ে নেয়। অন্য আরেকজন : আমি তো সবটা বলি না, খানিকটা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখি। বাকিদের সায় : হ্যাঁ, এটা তো করাই যায়।
নারীপুরুষ সম্পর্ক, স্ত্রী স্বামী সম্বন্ধ, এই সম্বন্ধে অর্থনীতির ভূমিকা, স্ত্রীদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ধরন। নিজেদের 'সিলেবাস' নিজেরাই বানিয়ে চলেন। ওঁদের এই চলমান কথায়, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক বানানোয় আমরা কেউ কথা বলতাম না, লিখে রাখতাম। এমনভাবে যতটা মনে আছে, 'টাকা', 'কয়লা', 'জল' এইসব।
বেশ চলছিল আমাদের 'অন্য ইস্কুল'। মাঝে মাঝে আমরা বলতাম অভিজ্ঞতা বিনিময়। সলিলদা, দীপাঞ্জনদা, দেবাশিস আরও কেউ। বুড়ো হয়ে গেছি নাম মনে রাখতে পারি না । একদিন পরিচারিকাদের স্বামীরা এসে বলল আমরা যেন আর না যাই। পরিচারিকারা স্কুলে আসছেন বলে বাড়ির কাজের সমস্যা হচ্ছে। আমরা আর যাইনি।
অনেক পরে একদিন গিয়েছিলাম। ওঁরা যা যা বলেছিলেন, আমরা যতটা লিখে রেখেছিলাম, তা দিয়ে হাতে লেখা একটা বই বানিয়ে 'আমাদের বই' ওঁদের হাতে দিয়ে এসেছিলাম। ওঁরা অবাক। আমরা বলেছিলাম আপনাদেরই কথা দিয়ে আপনাদের বই। কী খুশি ওঁরা। আমাদের মন খারাপ। হয়তো ওঁদেরও।
আমি এরপর আর সলিলদাদের প্রকল্পে থাকিনি। তবে সলিলদাদের ছেড়েও যাইনি মনন জগতে। সলিলদারা যা শিখিয়েছিলেন সেই অন্য শিক্ষাভাবনা নিয়ে অন্য অন্য জায়গায় গিয়েছি অন্য পাঠশালা বানাতে।
সলিলদারই মতো অন্য রাজনীতির পথে হাঁটা অন্য শিক্ষক অশোকদা, অশোকবাবুর সঙ্গে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরের কাছে হরিহর পাড়া গ্রামে। বানানো হল 'গাছতলা ইস্কুল'। যারা লেখাপড়া করবে তাদের বানানো বই দিয়েই লেখাপড়া। সলিলদার ধরিয়ে দেওয়া পথ।
আর একবার অন্যরাজনীতির পথে হাঁটা আমার বন্ধু কুণাল, কুণাল দেবের অন্য কাজের জায়গায়। কুনাল অন্য কাজ করতো বীরভূমে মল্লাারপুরে গ্রাম গড়িয়ায় পথের খাদানে কাজ করে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে। কুনাল তাদের ছোটোদের নিয়ে পাঠশালা বানিয়েছিল। 'মচেরা'। সেখানে পড়ানোর বিষয় তারা যা চারপাশে দেখে তাই নিয়ে।
সলিলদা জীবনভর অন্যশিক্ষা নিয়ে ভেবে গেছেন। লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। এমন মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি যিনি যে বিষয়টা নিয়ে অন্যপথে হাঁটা শুরু করেছিলেন সেই পথটা ছেড়ে যাননি। সেই পথে হাঁটাকে জোরদার করতে সেই পথ নিয়ে বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
সলিলদার সঙ্গে শেষ দেখা একটা আলোচনা সভায়। সলিলদাই ডেকেছিলেন বলতে। অন্য শিক্ষাভাবনা নিয়ে সলিলদার বই ধরে আলোচনায়। সেই যে সত্তর দশকে অন্য পথে হাঁটা শুরু, অনেকের অনেক বিষয়ে হাঁটা শুরু, তা এখন কমে গিয়েছে। এখন কমে গেলেও আমার বিশ্বাস যা এখন থেমে যাওয়া তা আবার শুরু হবে, কমে যাওয়া আবার জোরদার হবে।
'সত্তর দশক' নিছক একটা দশক কাল নয়। একটা দর্শন, একটা ভাবনা, একটা রাজনীতি, একটা আন্দোলন পথ।
নতুন করে আসা 'সত্তর দশক' এ অন্য লেখাপড়া বানানোয় সলিলদাকে দরকার পড়বেই।
নমস্য মানুষ। ওনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। শুভেন্দুদা কেও ধন্যবাদ এত প্রাঞ্জল ভাবে ওনার সম্পর্কে পাঠকদের জানানোর জন্য।
বড্ড ভালো লাগলো
এই পরম শ্রদ্ধেয় মানুষটির সম্পর্কে আরো জানতে পারলাম। লেখককে ধন্যবাদ।
গুরুর সম্পাদকদের বলি, ওঁর সম্পর্কে লেখাগুলি বড়ো বিচ্ছিন্নভাবে আসছে। একত্র হয়ে একটা সিরিজ হতে পারতো। একই কথা ডা স্মরজিৎ জানা সম্পর্কিত লেখাগুলির ক্ষেত্রেও।