এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • কাঠাবেড়া৯

    ছাতিম ঢ্যাং
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪১৩ বার পঠিত


  • মুখের ওপর দিনের প্রথম রোদ এসে পড়ল। অনির্দেশকে খিঁচিয়ে উঠল কাঠবেড়া৯। এসময়টায় বড়ো বিরক্ত লাগে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। তবু রাজ্যের আলো মাখামাখি হয়ে যায় চোখে। আরও একটুক্ষণ গড়াতে ইচ্ছে করে ঠাণ্ডায়। এ সময়েই সব শান্তি খানখান করে ডেকে ওঠে বাজখাঁই কাক। ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে থাকার আর উপায় থাকে না।

    উঠে পড়ে ৯ নামের কাঠবেড়া৯। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতেই টের পায় পেটটা বড্ড খালি। গা-ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাদামের খোঁজে। বাদাম যোগাড়ের সময়েই ঘুম ভাঙার দু:খটা চলে যায়। বরং মনে হতে থাকে, ভোর ভোর ঘুম ভেঙেছিল ভাগ্যিস! না হলে বাদামগুলো সব ভাই, ভাদ্রবউরা মিলে সাবড়ে দিত এতোক্ষণে। তারপর বহুদুর গেলে তবে পাওয়া যেত বাদাম। তাই মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নেয় কাকের কাছে বিরক্ত হয়েছিল বলে।

    এমনিতে দূরে যেতে খারাপ লাগে না ৯র। দূরে গেলে তার নিজের হয়ত পেট ভরে খাওয়া জুটে যায় সারাদিন, কিন্তু দাদু বেচারাকে সারাদিনে অনেকটা উপোস দিতে হয়। যত উপোসের জ্বালা বাড়ে বেলা বাড়ার সাথে সাথে, দাদুর মুখে তত গালাগালির ছররা ফোটে।

    মানুষগুলোকে দুচোখে দেখতে পারে না দাদু। দাদু যখন জোয়ান ছিল তখন ৯র থেকেও অনেক বেশি শক্তি ধরত, পেতও বেশি, খেতও বেশি। তার ওপর দাদুকে তার অথর্ব দাদুর জন্য খাবার বয়ে বয়ে আনতে হতো না সারাদিনে চব্বিশবার। সারাদিন দাদু খেলত, খেলত আর খেলত। মাঝে মাঝে প্রেমও করত।

    ৯র কিন্তু সারাদিন কেটে যায় নিজের আর দাদুর খাবারের খোঁজে। দুর-দূরান্ত থেকেও ৯ দাদুর জন্য খাবার নিয়ে আসে। দাদু যে এক্কেবারে চলতে ফিরতে পারে না। এদিকে এমন কেউ নেই যে ৯র সাথে কাজটা ভাগ করে নিতে পারে। ৯র বাবা-মা ৯র ছোটবেলাতেই মোটর গাড়িতে চাপা পড়ে আর ইলেক্ট্রিক তারে পুড়ে মারা গেছে। এই জন্যই দাদু মানুষগুলোকে সহ্য করতে পারে না। ওদের কেবল নিজেদের ভালো থাকা নিয়েই কথা। জগতে আর বাকি কে কেমন আছে তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। দাদুর মতে ৯র ভোগান্তির জন্য বজ্জাত মানুষগুলৈ দায়ী। না শুধু ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর জন্যই নয়; দাদুর খাবার বয়ে আনার ঝক্কিটাই নাকি ৯র থাকত না যদি দাদুর ছোটবেলার মতো গাছ আর খেত থাকত এখন।

    দাদুর ছোটবেলায় অনেক গাছ আর খেত ছিল। গাছে ছিল বাদুর, চিল, শকুন। বুড়ো কাঠবেড়া৯রা বসে বসে ঝিমোত যখন তখনই তাদের সদগতি করে দিত পাখিগুলো। এরকম করেই ৯র দাদুর দাদু, বাবা, মা, ঠানদি সবাই একে একে ইহকাল থেকে পরকালে পাড়ি দিয়েছিল। অথচ দাদুর বেলায় দেখ! গাছ, খেত, পাখি সব গায়েব। শুধু দাম্বা দাম্বা বাড়ি আর বাড়ি; সেসব বাড়ির দেয়ালে, তাকে, কোনায়, খাঁজে ফরসা, ফ্যাকাসে, দামড়া কালো, গুটকে, ভল হাজার রকম মাকড়সা আর মাকড়সা। বাড়ি বানিয়ে মানুষগুলোর আর সাধ মেটে না। একপাল বাড়িতে ঢোকে আর পিলপিলিয়ে আরেকপাল আসে; লাউ মাচা বাঁধে খালপাড়ে।

    দাদুকে পাখিতে নিল না। এদিকে হাঁটুর বাতে চলচ্ছক্তিরহিত দাদু। কোথাও যেতে পারে না। তাই দাদুর মানুষের মোটরে কিংবা ইলেক্ট্রিক শকে মারা পড়ারও কোনো উপায় নেই। দাদু সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করে, কেন হাঁটুর মতো বুকের ধুক ধুকিটাও থেমে যাচ্ছে না যে।

    এসব শুনতে শুনতেই ৯র পেটে হয় চাপ লাগে, ঝটপট মাটি খুঁড়ে হালকা হয়ে নিতে হয় তাকে; নয়তো খিদেতে পেটটা পাক দিয়ে ওঠে। তখনি ছুটতে হয় বাদামের খোঁজে। এতসব ব্যস্ততার মধ্যে তিন-চার দিনে অন্তত একবার চোখাচোখি হয়ে যায় ৯নির সাথে। ৯নি থাকে দু তিন পাড়া পরে। দাদু অনেকবার তাড়া দিয়েছে ৯কে ৯নির সঙ্গে প্রেম পর্ব শুরু করার জন্য। কিন্তু খাবার খাবার করে দৌড়ে ৯নিকে একলা পাওয়াই যায় না কখনও। কখনও কখনও ৯ ভাবে যে কি হবে ৯নির সাথে প্রেম করে; ৯৯ আসবে। ব্যস; তারপর সেই দৌড় খাবার খাবার খাবার।
    একদিন দুপুরে ৯ দাদুর পাকা লোমের থেকে পোকা বাছছিল। সে সময় ৯নিদের পাড়ার অনেকে এলো দৌড়ে দৌড়ে ৯দের পাড়ায়। ওদের ওখানে নাকি সব গাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। গাছের ওপর দিয়ে মানুষদের গাড়ি না রেলগাড়ি কিসব যেন যাবে । পুরো পাড়া থেকেই কাঠবেড়া৯দের বাস উঠে গেল। উঠে গেল যে কটা পাখ-পাখালি পরিবার ছিল সে সব্বাই। ৯নিকে নতুন আস্তানায় থিতু হতে সাহায্য করতে এল ৯। তখনই ৯ জানতে পারল যে ৯নি একদম একা। ওর আর কেউ নেই। তারপর দাদুর সাথে ৯নি যখন ভাব করতে এল, তখন দাদুই ৯নিকে বললেন আলাদা আস্তানায় একা না থেকে ওঁদের সাথেই থেকে যেতে। ৯নি খানিকক্ষণ লেজ খাড়া করে চোখ পিটপিটিয়ে রাজি হয়ে গেল।

    কিছুদিন পরে খুব বৃষ্টি নামল। দাদু আপন মনে গুন গুন করতে করতে নাক ডাকাতে শুরু করল। ৯ ৯নিকে খুব খুব আদর দিল।
    তারপর কিছু মাস, কিছু বছর কেটে গেল। সারাদিন অনেক দৌড়োদৌড়ি করে তবে ৯ আর ৯নি দুজনের খোরাক জোটে। ৯নি আসার পরে ৯দের সাবেক আস্তানা ছাড়তে হয়েছিল। সে পাড়াতেও মানুষের কেঁচোকল মাটি খুঁড়ে সব গাছ উপড়ে ফেলছিল। বেচারা দাদুও এই সময়ে মুক্তি পায়। হুড়োহুড়ির মধ্যে গাছের ডালে না কোনো যন্তরের ঘায়ে, নাকি মানুষের পায়ে পিষে সত্যি সত্যিই থেমে যায় দাদুর বুকের ধুকধুকি। শুধু চুপি চুপি ৯নিকে বলে যায় দাদু নাকি ৯৯ হয়ে ফিরে আসতে চায়। আজও খুব বৃষ্টি পড়লে ৯নি ঘন হয়ে এসে ৯কে মনে করিয়ে দেয় সে কথা।

    ৯ জানে না ঠিক কি কারণ। ৯৯কে আনার ফুরসত নেই তার নাকি সাহসে কুলোচ্ছে না। দাদু মারা গিয়ে ইস্তক পাঁচবার আস্তানা বদলাতে হয়েছে ৯ আর ৯নিকে। বাদাম তো দূর; কোনো খাবারই আর পেট ভরার মতো পাওয়া যায় না। তার ওপর ৯নির বুকে বাতাস ধরে না। বেচারি দৌড়ঝাঁপ করতেই পারে না মোটে। একটু চললেই বাতাসের অভাবে বেচারির চোখ ঠেলে গোঁফ খুলে বেরিয়ে আসে যেন। ৯ একলা দুজনের খোরাকি এনে ঝিম মেরে যায়। ৯নিকে আদর সোহাগ করতেই পারে নি সেই বৃষ্টির রাতের পর থেকে আর একবারও। তবুও ৯নি ৯৯র কথা পাড়লে মন ভালো হয়ে যায় ৯র। তারপর বুকে যেন একটা পাথর চেপে বসে। খাবে কি ৯৯? থাকবে কোথায়? বুকে বাতাস পাবে তো?

    সমস্ত উদ্বেগ নিয়েই ঘুমে ঢলে পড়ে ৯। আবার ভোর হয়। আবার আস্তানার গোটানোর দিন আসে। এভাবে চলতে চলতে অবশেষে এক আস্তানায় পাঁচটা বর্ষা কাটিয়ে দিল তারা। ৯নির বুকের বাতাসের কষ্টটাও একটু একটু করে কমে গেল। ৯নি আবার বেরোতে লাগল খাবারের খোঁজ?এ। এবারের আস্তানার কাছে পিঠেই অনেক বাদাম পাওয়া যায়।

    পরের বর্ষায় ৯৯ এল। ৯ আর ৯নি খুব যত্ন করে ৯৯কে বাদাম চেনায়। কিন্তু এ জায়গাটা ছেড়ে যদি যেতে হয় ভেবে আজকাল ভোরের অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যায় ৯র। পরদিন সকালেই তিনজনে তিনদিকে চলে যায়, দূরে দূরে। এবারের আস্তানাটা গোটাতে হলে কোথায় থাকবে সে জায়গাটা আগে থেকে দেখে রাখবে বলে। এ জায়গাটায় মানুষের বাড়ি কিংবা বাজার কিংবা রাস্তা কিংবা রেলগাড়ি হলে, সরাসরি চলে যাবে আগে থেকে দেখা রাখা এরকমই আরেকটা জ?আয়গায়, যেখানে খাবার নেই, বাতাস নেই নেই-নেইতে রাত জ?এগে কাটাতে হবে না। ৯ ঠিক করে ফেলেছে; উত্তরাধিকারে ৯৯কে দিয়ে যাবে ঘুম ভেঙে আলসেমি মাখার ভোরটাই।

    ছবি- মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন