"নিজেকে 'লেখক' বলতে প্রবল অনীহা বরাবরই। যখনই বলতাম, এইবার 'ফার্স্ট পার্সন'গুলো জড়ো করে একটা বই করো, উৎসাহের আঁচে জল ঢেলে তাঁর নিরাসক্ত জবাব ছিল, 'আমি আবার লেখক না কি!' বই বার করা তো লেখকদের কাজ। ঋতুপর্ণ ঘোষ সত্যিই হয়তো লেখক ছিলেন না, বরং তিনি জীবনের এক অনর্গল কথক।"
দে'জ পাবলিশিং থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত 'ফার্স্ট পার্সন' যাঁরা পড়েছেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের কলমের স্পর্শ পাওয়ার আগেই চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পাতা তিনেকের ছোট লেখাটি, 'শেষ কথা কে বলবে'। পরের প্রায় সাড়ে সাতশো পাতা জুড়ে বিস্তৃত এক শিল্পীর রেখে যাওয়া জীবনগানের প্রারম্ভে অনিন্দ্যবাবুর সংবেদী লেখাটি সাধারণ পাঠকের চোখে ঋতুপর্ণ ঘোষকে আরেকটু বিশদে চেনায়। উপরের কথাটি পড়লেই অনিবার্যভাবে যা মনে পড়ে তা হলো, চলচ্চিত্রকারও তো শেষ অব্দি আমাদের একটি গল্পই বলছেন, সাহিত্যিক-কথাশিল্পীর মতোই। কেবল মাধ্যম আলাদা।
কাজেই, সাহিত্যনির্মাণে কলম সেভাবে না ধরলেও, ঋতুপর্ণ লেখনী বা কথনের থেকে দূরে ছিলেন না কোনদিনই। কবি যেমন কবিতাটি আবার পড়তে গিয়ে দুয়েক জায়গায় জুড়ে দেন মাত্রা, ঔপন্যাসিক যেমন একবেলার চকিত সিদ্ধান্তে কেটে নেন কোনও চরিত্রের কিছুটা আয়ুষ্কাল, আর এইসব সংযোজন-বিয়োজন মাপতে মাপতে সাহিত্য যেমন জীবনের মতো একটা কিছুর দিকেই এগিয়ে চলে, ঋতুপর্ণও তেমন তাঁর বছরে একটা করে সিনেমায়, এবং হয়তো নিজের ব্যক্তিজীবনের প্রতিক্ষণেই এমন বহু মাত্রা কেটেছেন, আমাদেরই মতো কী যেন ভেবে মূর্ধ-ণ এর ডাঁটিটা আরেকটু টেনে দিয়েছেন স্পষ্টতার খাতিরে, এবং নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন এক নিরবচ্ছিন্ন অন্তর্কথনের জালে। সেই কথনেরই কিছুটা চুঁইয়ে আমাদের আঁজলায় আসে কালির অক্ষরে, 'ফার্স্ট পার্সন' মারফৎ।
ফরমায়েশি লেখকের পেশাদারিত্বের যে ভার, তা থেকে মুক্ত ঋতুপর্ণের এই চারণগুলি প্রত্যেক পাঠকের একার একার বাঙ্ময় নির্জনতা। একাই হাঁটছেন আপনি সেইসব শব্দের কুয়োতলা, রাজপথ পেরিয়ে; কিন্তু শব্দগুলো তো আপনার নয়, লেখকের। তবে? তিনি কোথায়? আছেন তিনি, নির্ভয়-নির্ভার হয়ে, আপনারই ভিতরে; তাঁর সেই গুঞ্জরণই আপনার পথ।
দক্ষ সম্পাদনায় 'ফার্স্ট পার্সন'-এর দুটি খণ্ডের বিক্ষিপ্ত মণিমুক্তোকে সাজানো গিয়েছে সর্বমোট বারোটি বিভাগে। ঋতুপর্ণের প্রয়াণদিনে পাতা ওলটাতে ওলটাতে হাত থেমে যায় 'অন্তরমহল'-এ এসে। পাঠকদের বিশেষ ঘনিষ্ঠ একটি অংশ 'অন্তরমহল' --- যাঁদের কাছে বইটি নেই, তাঁরাও যদি রোববারের 'ফার্স্ট পার্সন' কিঞ্চিৎ স্মরণ করেন, মনে পড়তে বাধ্য, ২০০৮ থেকে ২০১০ অব্দি দমকে দমকে পরিচালকের কলমে উঠে এসেছিল পরিবারের কথা, তাঁর মায়ের ও বাবার কথা, ভরা সংসার থেকে এক এক করে তাঁদের ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িটার একা হয়ে যাওয়ার কথা। মাতৃ ও পিতৃবিয়োগের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ পশ্চাৎপট বর্ণন ও শোকযাপন বাংলায় আত্মকথনের সুবিশাল ভাণ্ডারে আর দ্বিতীয় কেউ লিখেছেন কিনা সন্দেহ। 'অন্তরমহল'-এর বেশিটা জুড়েই সেইসব স্মৃতির চলাচল। কোনও মানুষের অতিব্যক্তিগত, গোপন ডায়রি খুলে হঠাৎ যদি দেখা যায় নিজেরই ভয়গুলো লেখা আছে, এ'সব লেখা পড়ার অনুভূতি কিছুটা তেমন। বিভাগটি শুরুই হয় -
"একা মানে কী? ...অনেক কাজের মধ্যে বাইরে কখন যে রাত ঘন হয়ে এসেছে, হঠাৎ যখন খেয়াল হল যে এবার মধ্যরাত্রি - অথচ কেউ খেতেও ডাকেনি; তখন নিজের ওপর অজানিত রাগ আর স্মৃতির বা কল্পনার কোনও অনুপস্থিত মানুষের জন্য কোনও নিভৃত অভিমানী দীর্ঘশ্বাস? ... কিংবা, কে জানে, বুঝিবা আরও কোনও অনেক বিশিষ্ট, অনেক তীব্র, অনেক কাতর কতকগুলো অনুভূতির নিত্যবিরচিত স্মৃতিমালা?" (১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭)
সে বছরই, মায়ের প্রয়াণে লিখছেন ---
"মা বলত আমাকে
- আমি আসবো তোর কাছে। ঠিক আসব, দেখিস। ...
সবাই খুব অবাক হয়েছিল দেখে, যে যতটা ভেঙে পড়ার কথা আমার -- তার তুলনায় আমি যেন অনেক বেশি শক্ত। আসলে মা'র ওই সান্ত্বনাটাই ছিল আমার শক্তি। জানতাম, মা যখন বলেছে ঠিক আসবে। আমাদের আবার দেখা হবে, কথা হবে।
মা তো আমাকে 'আসি' বলেও গেল না। তা কেমন করে হয়?" (২৮শে অক্টোবর, ২০০৭)
তাঁর পিতৃপরিচয় আসে মাতৃবিয়োগের হাত ধরেই, "মা ছাড়া বাবারা বড্ড অসহায়।" (২রা সেপ্টেম্বর, ২০০৭) কিন্তু তার পরে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সেই নড়বড়ে মানুষটি কিছুটা রুক্ষ, সোজাসাপ্টা খোঁজখবর, খেয়াল রাখা দিয়ে মাতৃহীন ছেলের একাকিত্ব ভরিয়ে রাখতে চান, বা হয়তো নিজের। এ সময়ের লেখায় মাঝেমাঝেই এক উষ্ণতা নির্দেশ করেন ঋতুপর্ণ, পিতৃপরিচয় বদলে যায় "উলিকটে ছাইরঙা শালে মোড়া এক পৃথিবী মঙ্গলাকাঙ্খা"-য়; বা ওই একই লেখায় ফিরে আসে ---
"- তোমার জন্য বড়দিনের কেক এনেছিলাম। ছবি রেখে দিয়েছে। একটু খেও।
কলকাতার তাপমাত্রা যেন কিছুটা বাড়ল। কনকনে শীতে আরামের উত্তাপ।
শীর্ণ শরীর জড়িয়ে রাখা ছাইরঙা চাদরটা যেন এক পৃথিবী ওম নিয়ে জাপটে ধরল আমায়। আর অত শীত করছে না।" (৬ই জানুয়ারি, ২০০৮)
সম্পূর্ণ মৃত্যুর বাতাবরণে লেখা, জরাগন্ধী এই অংশগুলিতে ঋতুপর্ণ মধ্যবিত্তের সেই আনমনা প্রথম সন্তান যে অসহায়তার দায় নিতে, এবং তা থেকে পালাতে সমানভাবে অপারগ। বাবা-মায়ের বাৎসল্যের প্রচ্ছন্ন উষ্ণতায় প্রশমন খোঁজা ছাড়া তাঁর হাতে আর কিছুই পড়ে নেই।
পথিক আরেকবার দু' দণ্ড থামে 'ফার্স্ট পার্সন'-এর 'এলিজি' বিভাগে এসে। আট বছর আগে এই দিনে চলে গেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। আর তারও আগে, দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অগণিত মৃত্যুসংবাদ শোনার প্রান্তে থেকেছেন আমাদের মতোই। তারই কিছু ঝুরো আনাগোনা ধরা পড়ে এই বিভাগের শোকগাথাগুলিতে। কখনও 'রোববার'-এর দপ্তরে কাজের ফাঁকে আচমকা মেসেজ আসছে ফোনে, "Bergman is no more"; খবরের কাগজের পাতা ওলটাতেই ভেসে আসছে জ্যোতিভূষণ চাকীর প্রয়াণের খবর, যাঁর কথা ছিল 'রোববার'-এ বুড়োবয়স নিয়ে লেখার। পরের পাতাগুলিতে একে একে এলোমেলো ছেড়ে যাওয়ার খবর তপন সিংহের, জ্যোতি বসুর, রমাপ্রসাদ বণিকের, মল্লিকা সেনগুপ্তের, বা কখনও টাইগার পতৌদির। ম্লান কৌতুকে ঋতুপর্ণ একবার লিখছেন,
"এক-এক করে সাধের মানুষগুলো চলে যান আমাদের ছেড়ে, যেন প্রায় চুক্তি করে নিজেদের মধ্যে। আমার 'ফার্স্ট পার্সন'-এর পাতাটা, ভয় হয়, এবার থেকে হয়তো অবিচুয়ারির পাতা হয়ে যাবে।" (১৯শে জুন, ২০১১)
ঋতুপর্ণ চলে গেলেন যে বছর মে মাসে, তার কয়েক মাস আগে ২০১২-র অক্টোবর মাসে আরেক বাঙালির শোকে কেঁপে উঠেছিল দুর্গানবমী --- সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুও নথিবদ্ধ করেছেন 'রোববার'-এ ঋতুপর্ণ। যখন লিখছেন, "অষ্টমীর রাতে, যখন সন্ধিপুজোর একশো আট-টা প্রদীপের ছটা পিছলে যায় গর্জন তেলের মুখখানির ওপর, আমার জানলার কোন পর্দা একটুখানি ফাঁক করে পালিয়ে যায় নীললোহিত", জানেন না বাঙালি বিদ্বানসমাজের পরবর্তী নক্ষত্রপতনে যে শোক গ্রাস করবে মানুষকে, তার জন্য দায়ী থাকবেন স্বয়ং তিনিই।
তাঁর চলে যাওয়ার দিনে, আজ, মনে আছে শহরে বৃষ্টি হয়েছিল খুব। মনে আছে, যে গাড়িতে শায়িত ছিলেন তিনি, জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছিল তার কাঁচ বেয়ে। যেমনটা নিজেই লিখেছিলেন, নিজের মৃত্যুদিন জেনে যেতে পারেন নি তিনি; পারে না কেউই। কারণ, মৃত্যু তো আসলে তাঁদের যারা রয়ে গেল সেই খবর শোনার জন্য। রাস্তায় ঢল নামলো, গান স্যালুট হলো, আগুনে চলে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। মৃত্যু গ্রাস করলো আমাদের। আট বছর পরেও, তিনি ঠিকই আছেন। যে কথনকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন কালিতে, কলমে, কিছুটা হাসি আর কিছুটা বিষাদের আখ্যানে, সে ঠিকই আছে। গুঞ্জরিত হচ্ছে 'ফার্স্ট পার্সন'-এর শব্দে, অক্ষরে। ৩০শে মে আমরা ঋতুপর্ণের মৃত্যুভার বইতে বইতে তাঁরই সঙ্গে একটু করে বেঁচে নিচ্ছি এই আটপৌরে জীবনচারণ।