হাতে রইল পেনসিল
ভারতে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। এখন অবধি ২ কোটির কাছাকাছি কেস,দু লাখের ওপর মানুষের মৃত্যু হয়েছে,এবং ২০২১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে প্রায় ৪ লক্ষ লোক প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন,এবং হাজার তিনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। সংবাদ মাধ্যমে পড়ছি যে ভারতের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন নেই, যা আছে,তাতে ৬০% মানুষকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ভ্যাকসিনেট করা দূর অস্ত। শুধু তাই নয়, অক্সিজেন বাড়ন্ত, ওষুধের আকাল, এদিকে লাফিয়ে বাড়ছে ইনফেকশনের আর মৃত্যুর অন্তহীন যাত্রা। ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আমাদের হাতে রইল কি?
হাতে রইল পেনসিল, :-), এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে একটি নোটবই আর পেনসিল আমাদের কোন কাজে লাগবে, এবং মহামারী থামাতে সাহায্য করবেই বা কেন, কিভাবে, একটু দেখে নেওয়া যাক।
কোভিড সর্বত্র এক রকমভাবে শুরু হয় নি, ছড়ায়ও নি
কোভিড নিয়ে গত এক বছরের ওপর ধরে আমরা ভুগছি, এবং এখনো বহু প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। ইদানীংকালে ভারতের কথাই যদি ধরি, ভারতের সর্বত্র কোভিড এক রকম ভাবে প্রবল হয় নি, মহারাষ্ট্রে যতটা, তার চেয়ে কম পাশের রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক কম সিকিমে, আবার দিল্লির পরিস্থিতি ভয়াবহ। শুধুই জনসংখ্যা, লোক যাতায়াত, এমনকি ভিড় বা নির্বাচন হয়েছে এই দিয়ে পুরোটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এবং এই ব্যাপারটি কোভিড শুরুর থেকেই হয়ে আসছে। যেমন গত বছর ইতালির উত্তর প্রান্তে যতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল, ইতালির অন্যত্র কিন্তু সেইভাবে হয়নি। নিউ ইয়রকের মত মারাত্মক অবস্থা অন্য শহরগুলোতে হয় নি।
কেন?
আরো একটি ব্যাপার দেখুন | যদিও ডিসেমবার মাসে চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে কোভিডের সূত্রপাত হয়েছিল, সব দেশে সমান ভাবে সমান কালে সে ছড়ায় নি। কোন দেশে আগে, কোন দেশে বেশ কিছুকাল পরে কোভিডের সংক্রমণ হয়েছে। এবং বিভিন্ন দেশে একাধিকবার বারংবার সংক্রমণ হতে হতে একসময় সে দ্রুত ছড়িয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝান যাবে। যেমন, জিনোম নিয়ে নিউজিল্যাণ্ডে জেমা জিওগহিগান এবং সঙ্গীদের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে এখানে গত বছরে প্রথমদিকে ১০০ টি প্রাথমিক ইনফেকশনের মাধ্যমে সূত্রপাতের মধ্যে মাত্র ১৯ টি কেসে একজনের থেকে একাধিক মানুষের মধ্যে সংক্রমণটি ছড়িয়েছিল। বাকী ৮১ টি কেসে কিন্তু একজন বড়জোর আরেকজনকে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ফলে মহামারী দানা বাঁধতে সক্ষম হয় নি।
R0 র সমস্যা: ২০ শতাংশ লোকের মাধ্যমে ৮০% মানুষের সংক্রমণ হয়
এক জায়গায় বেশী, এক জায়গায় কম, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ধরে কোভিডের সূত্রপাত, এই সমস্ত বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন যে কোভিডের সংক্রমণ যেভাবে হয় তাতে অল্প সংখ্যক মানুষের (ধরুন ২০%) সূত্রে অধিকাংশ মানুষের (বাকী ৮০%) সংক্রমণ ঘটে | একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে কি বলতে চাইছি লিখি।
মনে করুন x বাবুর কোভিড হয়েছে, কিন্তু তিনি Asymptomatic বা প্রিসিমপটোমাটিক। তাঁর কোন উপসর্গ দেখা দেয়নি, তাই তিনি পরীক্ষাও করান নি। এই অবস্থায় তিনি তাঁর পাড়ার ক্লাবঘরে গিয়ে আড্ডা দিয়েছেন, আর তাঁর থেকে তাঁর পাঁচ বন্ধু a, b, c, d, e - এনাদের কোভিডের সংক্রমণ হল। এই যে পাঁচজন, তাঁরা আবার দিন কয়েকের মধ্যে একেক জন আরো একজনকে সংক্রমণ করলেন (f, g, h, i, j) কে | সব মিলিয়ে দিন চারেকের মাথায় প্রথমে পাঁচ জন এবং তার পরে আরো পাঁচ জনেের কোভিডের উপসর্গ দেখা দিল (চিত্র ১):
চিত্র ১: ছোট নেটওয়ারক
যেহেতু x বাবু তখনো জানেন না যে তাঁর কোভিড সংক্রমণ হয়েছে, তিনি তার পরের দিনও আরেকটি জনবহুল রেস্তোঁরায় গেলেন, এবং সেখানেও তাঁর সূত্রে আরো ৪ জন কোভিড আক্রান্ত হলেন। এই চারজনের একেক জন কেউ এক জনকে, কেউ দু জন কে, কেউ আর কাউকে নয়, এই করে আরো চার জন আক্রান্ত হলেন। এখন যেহেতু বেশ কয়েকদিন এর মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে, দেখা গেল প্রায় ১৮ জন কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন বিভিন্ন সূত্রে (চিত্র ২):
চিত্র ২: আরো বড় নেটওয়ারক
এক হিসেবে দেখলে মনে হবে যে ৯ জন মানুষের সূত্রে আরো ৯ জন আক্রান্ত হলেন, গড়ে একেকজন ১ জনকে সংক্রমিত করলেন। পরিভাষায় এই সংখ্যাটিকে বলা হয় Basic Reproduction Number বা R0 | গত এক বছরের বেশী সময় ধরে আমরা এই সংখ্যাটি সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি। মহামারীর চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা এই সংখ়্যাটির দিকেই নজর রাখেন, মহামারী কমে আসছে না কি বাড়ছে বোঝার জন্য R নামে সংখ্যাটি কতটা বাড়ছে বা কমছে তার প্রতি নজর রাখেন। R যখন ১ এর নীচে নেমে আসে তখন মহামারীর প্রকোপ কমে আসে, আর R যতক্ষণ ১ এর অধিক থাকে, ততক্ষণ আমরা বিপন্মুক্ত নই | R সংখ্যাটি ১ হয়ে যাওয়া মানে মহামারীর প্রকোপ কমে আসবে। আমরা R এর সূত্রে হার্ড ইমিউনিটির কথা জেনেছি, যেখানে কত শতাংশ মানুষ যদি সংক্রমণ হবার পরে ইমিউনিটি গড়ে তোলেন, তাহলে সমাজের বাকী মানুষেরা, যাঁদের এখনো সংক্রমণ হয়নি, তাঁরা সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাবেন। R যদি ২ হয়, তাহলে হার্ড ইমিউনিটির শতাংশ হবে ১/২ = ৫০%, R যদি ৩ হয়, তাহলে হার্ড ইমিউিটি ২/৩ = ৬৬%, এইরকম ব্যাপার। সেই হিসেবে কোভিডের গড় চীনের গবেষকদের প্রাথমিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত R আমাদের জানা আছে 2.5, তাই আমরা ভাবি যে যদি ৬০% মানুষের সংক্রমণ হয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠে, তাহলে বাকীরা কোভিড সংক্রমণ থেকে রেহাই পাবেন। এরই ভিত্তিতে স্থির করা হয় যে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে যদি সমাজের ৬০% মানুষকে ভ্যাকসিনেট করে ফেলা যায়, তাহলে সেই সমাজে কোভিড সংক্রমণ আর হতে পারবে না, কার্যত আমরা কোভিড মুক্ত সমাজে বসবাস করতে পারব। কোন কোন অসুখের R অত্যন্ত বেশী, যেমন হাম, যার R = 20'র কাছাকাছি, যে কারণে প্রতি বছর হামের টিকা নিতে হয়, যাতে করে সমাজের প্রায় ৯৫% মানুষ হামের ইমিউনিটি গড়ে সমাজে বাদবাকীরা হামমুক্ত থাকতে পারেন।
মুশকিল হল, গড় সংখ্যা দিয়ে সব সময়ে সব কিছু বিচার করা যায় না। বিশেষ করে যেসব ব্যাপারে মানুষে মানুষে বিস্তর ফারাক থাকে। যেমন এই আর সংখ্যাটিরও ব্যক্তিবিশেষে তারতম্য হতে পারে। আমাদের এই ছোট উদাহরণটুকুই দেখুন না। চিত্র ২ তে দেখছি x একাই ১৮ টি কেসের মধ্যে ৯ টি কেসের জন্য দায়ী, সে হিসেবে x এর R হওয়া উচিৎ ৯, আর l এর সূত্রে ১ টিও কেস হয়নি, সুতরাং তাঁর R হবার কথা ০ | সব মিলিয়ে গড় R ১ | শুধু তাই নয়, x একাই ১৮ টি কেসের মধ্যে ৯ টি কেসের জন্য (৫০%) প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, বাকীদের মধ্যে k ১১% কেসের জন্য আর বাকীরা ৫% কেসের জন্য দায়ী | এই ধরণের যে প্যাটার্ণ, তাকে গাণিতিক পরিভাষায় overdispersion বলা হয়, এবং মনে করা হয়, এইভাবেই কোভিড জনসমাজে আজ অবধি ছড়িয়েছে। একজন বা অল্প কয়েকজন বহু লোককে সংক্রমিত করেছেন, বাকীরা একেকজন একেকজন কে, কেউ কাউকে নয়, এই করে একেকজন একেক রকম ভাবে সংক্রমণ সমাজে ছড়িয়েছেন, ও এই ধারাটি চলছে। যাঁরা বা যে ঘটনার সূত্রে বহু মানুষ আক্রান্ত হন, সেই ঘটনাগুলোর নাম দেওয়া হয় সুপারস্প্রেডার বা সুপারস্প্রেডিং ঘটনা। ব্যাপারটি পড়ে মনে হতে পারে একেবারে শুধুই শুকনো অঙ্কের , তা নয়, সেই আলোচনায় আসছি, তার আগে আরো দু-একটি কথা লেখার আছে।
২০০৫ সালের নভেমবর মাসে, প্রথম সার্স মহামারীর কয়েক বছর পরে, বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস লয়েড-স্মিথ, একটি প্রতিপাদ্য প্রকাশ করেন, সেখানে তিনি যুক্তি পেশ করেন যে, যেহেতু সার্স গোত্রের মহামারী ওভারডিসপারস্ড, একে বুঝতে গেলে একেকটি সংক্রমণ একেকটি "ঘটনা", এইভাবে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে। অল্প কথায়, তিনি লিখলেন, যে, ওভারডিসপারস্ড এপিডেমিকের গড় সামগ্রিক ভাবে হয়ত R0 হতে পারে, তবে তার বিস্তারের অঙ্কটি বোঝাতে আরেকটি রাশির কথা তিনি বললেন, যার গাণিতিক পরিভাষায় নাম "dispersion factor" ও এর চিহ্ন তিনি দেন "k" | k সংখ্যাটি যত কম হবে, বোঝা যাবে যে তত কম সংখ্যক মানুষের সূত্রে বেশী মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে। অর্থাৎ k যত কম, অসুখটির ক্লাসটারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা তত বেশী। যেমন, ১৯১৮ সালে যে ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারী হয়েছিল, তার k পরিমাপ ছিল ১, যাতে করে বোঝা যাচ্ছে যে সেই মহামারীতে ক্লাসটারের ভূমিকা বিশেষ ছিল না। আগের বারের সার্স যে ধরণের করোনাভাইরাসের সূত্রে হয়েছিল, তার k হয়েছিল 0.16; লয়েড-স্মিথের ফরমুলা অনুসরণ করে আকিরা এণ্ডো এবং সমবেত গবেষকরা কোভিডের k সংখ্যাটি দেখিয়েছেন শূন্য দশমিক ১ এর কাছাকাছি, অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ১০% মানুষ ৮০-৯০% সংক্রমণ ঘটাচ্ছেন, এবং এই মহামারীতে ক্লাসটারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তো এই ক্লাসটার ব্যাপারটি ঠিক কি?
আমাদের খেলনা উদাহরণটিতে আমরা x বাবুর সূত্রে দেখলাম প্রায় ৯ জন, আর দু-দিনে পাঁচ পাঁচ দশ আর চার-চার আটজন আক্রান্ত হলেন । এই যে একেকজনের সূত্রে আরো বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেল যে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, সকলে মিলে একটি "সংক্রমণ চক্র" গড়ে তুললেন বলা যায়; এই "সংক্রমণ চক্রটিই ক্লাসটার"। x বাবুর ক্লাবের পাঁচ বন্ধু যদি কাছাকাছি থাকেন, তাহলে আমরা বলতে পারি যে ক্লাবের সূত্রে একটি সংক্রমণের চক্র তৈরী হয়েছে, অতএব এখানে একটি ক্লাসটার তৈরী হয়েছে। আবার জনবহুল রেস্তোঁরায় যাবার সুবাদে x বাবু আরো কয়েকজনকে সংক্রমিত করেছেন, কাজেই রেস্তোঁরাটিকে কেন্দ্র করে আরেকটি চক্র বা ক্লাসটার তৈরী হয়েছে। এখানে x বাবু যদি কালক্রমে উহ্য থেকে যান, যেহেতু তাঁর নিজের সেরকম কোন উপসর্গ আর দেখা দেয়নি, এবং দিন পনেরো পরে আরো বেশ কয়েকজনকে সংক্রমিত করে নিজে সুস্থ হয়ে যান, তাহলে আমরা শুধু দুটি ক্লাসটারের সূত্রে মহামারীটির খবর পাব। আর x বাবু যদি ধরা পড়ে যান, তাহলে আমরা বলতে পারি একটি বড় ক্লাসটার, ব্যাপারটা এইরকম।
ক্লাস্টার নিয়ে কোয়েনটিন লে ক্লারক নামে জনৈক ব্রিটিশ গবেষক একটি ডাটাবেস প্রকাশ করেছেন (এখানে দেখুন, https://figshare.com/articles/dataset/COVID19_settings_of_transmission_-_collected_reports_database/12173343/3) | লেক্লারক এবং সাথীরা এই নিয়ে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছেন যেখানে তাঁরা দেখিয়েছেন যে তাঁদের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি ২২ রকমের সেটিং থেকে ক্লাসটার তৈরী হতে পারে, এবং মোটামুটি ভাবে বেশীর ভাগ ক্লাসটারে শ'খানেক মতন মানুষ থাকেন। তার মানে এনাদের তথ়্য অনুযায়ী, আমরা যদি এখনকার ভারতে প্রতিদিন এই যে ৩,০০,০০০ মতন কেস দেখছি, তাতে প্রতিদিন প্রায় হাজার তিনেক করে নতুন ক্লাসটার তৈরী হচ্ছে। এ এক আদিম খেলা: পুরনো ক্লাসটার নিশ্চয় কিছু ভাঙছে এবং একটি ক্লাসটার আরেকটির সঙ্গে জুড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্লাসটার গুলোকে যদি আলাদা করে ফেলা যায়, ও ক্লাসটারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের পরীক্ষা ও সকলকে আলাদা করে ফেলা যায়, তাহলে মহামারীটিকে পলকে থামানো সম্ভব। এবং সেইটেই বিভিন্ন দেশে হয়েছে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে (তাইওয়ান, জাপান, জাপানের কথায় পরে আসছি), বা অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যাণ্ডে | এবং এই সমস্ত দেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ বা ওষুধের প্রভাব ব্যতিরেকেই করোনার মহামারী আটকানো সম্ভব হয়েছে।
এই কাজটি করতে গেলে যেটি সর্বাগ্র করা প্রয়োজন, সেটি কনট্যাকট ট্রেসিং, মানে কে কে কার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই নেটওয়ার্কটি সম্পূর্ণ ভাবে চিহ্নিত করে ফেলা । এইখানে কয়েকটা কথা বলা দরকার। ধরুণ আমরা সচরাচর যেভাবে কনট্যাকট ট্রেসিং করি, তাতে প্রথমে যিনি আক্রান্ত হলেন, তিনি, RT-PCR এর দ্বারা নির্ণিত আক্রান্ত হয়েছেন, চিহ্নিত হবার ৪৮ ঘন্টার আগে কার কার সঙ্গে মিশেছেন, এবং তাঁর নিজের কাছের লোকজন যাঁদের সঙ্গে তিনি মেলামেশা করেন, তাঁদেরকে চিহ্নিত করে তাদের সকলের টেস্ট করে তাদের আলাদা করে রাখার একটা বন্দোবস্ত করা হয়, যাতে পরবর্তীকালে এই সব মানুষের সূত্রে আর কেউ আক্রান্ত না হতে পারেন। অর্থাৎ ধরুণ আমরা A, B, C এই তিনজন পজিটিভ রোগীকে চিহ্নিত করতে পেরেছি, আমরা কনট্যাকট ট্রেসিং করে চেষ্টা করব যাতে করে D, E, F এঁদের মধ্যে সংক্রমণ আর না ছড়ায় (চিত্র ৩) | এই ধরণের কনট্যাকট ট্রেসিংকে পরিভাষায় Forward Contact Tracing নামে অভিহিত করা হয়।
চিত্র ৩: ফরওয়ার্ড কনট্যাকট ট্রেসিং
ফরওয়ার্ড কনট্যাকট ট্রেসিং খুব কাজের, এবং এতে সন্দেহ নেই যে একটি কেস ধরা পড়ার পর পরবর্তী কেসগুলো যাতে না বেরোয় তাতে কাজ হয়। বস্তুত এই যে সর্বব্যাপী টোটাল বা আধা বা পারশিয়াল লকডাউনের বন্দোবস্ত দেখেন, এর মূলেও কিন্তু এই ধরণের চিন্তা কাজ করে যে, একবার কেউ আক্রান্ত হয়েছেন মানে ধরে নিতে হবে যে এনার থেকে আরো দু-তিনজন আক্রান্ত হতে পারেন, অতএব "এবার থেকে" আর যাতে কেউ আক্রান্ত না হন, তার ব্যবস্থা করা। এ সবই ভাল, তবে এতে করে যে ব্যাপারটি উহ্য রয়ে যায়, এতে করে ইনফেকশনগুলোর উৎস সন্ধান আর হয়ে ওঠে না। উৎসের সন্ধানে যেতে গেলে যেটা করা উচিৎ, সে ব্যাপারটা এইরকম: মনে রাখতে হবে পজিটিভ কেস বেরিয়েছে মানে কোথাও একটি সুপারস্প্রেডিং ঘটনা ঘটেছে, কেউ একজন বা একাধিক কোথাও সুপারস্প্রেডার রয়েছেন। কোথায় তিনি? এই গোয়েন্দাগিরিটা না করতে পারলে মূল সূত্রটিতে যাওয়া যাবে না। তার মানে আমাদের হাঁটতে হবে উল্টো রাস্তায় | সেটা না করলে সাময়িক একটি দুটি কেস, বা একাধিক কেস থামানো যাবে, কিন্তু মূলোৎপাটন করা অসম্ভব, আর সেইটে না করতে পারলে করোনার লাগাতার অনন্তগতির যাত্রা থামানো যাবে না, :-) (চিত্র ৪):
চিত্র ৪: উল্টো প়থের কনট্যাকট ট্রেসিং
এবারে একই ধরণের ব্যাপার, মনে করুন A, B, C থেকে D, E, F এর সংক্রমণ হয়েছে, আমরা সোজাপথেও হাঁটলাম, অর্থাৎ D, E, F এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের আলাদা করলাম, তার সঙ্গে গত পাঁচ দশদিন ধরে এরা যে যে মানুষের সংস্পর্শে বা যে যে পরিস্থিতির সংস্পর্শে এসেছেন তাকে পিছন দিকে হেঁটে চিহ্নিত করলাম। এতে করে দেখা গেল যে, শুধূ A, B, C নন, বা একজন থেকে একজন নন, X নামের সুপারস্প্রেডারকেও চিহ্নিত করা গেল, এবং তাঁকে যদি আলাদা করে ফেলা যায়, তাহলে তাঁর সূত্রে যাবতীয় সুপারস্প্রেডার বা সুপারস্প্রেডিং ঘটনাগুলোকেও আলাদা করে ফেলা যায়, এবং সরিয়ে ফেলে তাদের টেস্ট, ও অন্যান্য ব্যবস্থা করে সুপারস্প্রেডিং ঘটনাগুলোকে থামিয়ে মহামারীর "রথের রশি" নিজেদের কন্ট্রোলে নিয়ে আসা সম্ভব। এই ধরণের কনট্যাকট ট্রেসিং এর নাম Reverse contact tracing বা Backward contact tracing |
কি করে ক্লাস্টার গড়ে ওঠে - তিনটি "জ": জটলা, জনতা
তো এই সুপারস্প্রেডিং ঘটনা আর ক্লাসটার গঠন নিয়ে Muge Cevic নামে জনৈক বৈজ্ঞানিক এবং সম্প্রদায়ের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে (১) অনেকক্ষণ ধরে সংস্পর্শ (অন্তত ১৫ মিনিট তো বটেই), (২) এক বা একাধিক আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শ যাঁরা বেশ জোরে গান গাইছেন বা কথা বলছেন, বা মাস্ক পরেন না, (৩) চাপা জায়গায় জটলা, এবং (৪) এমন জায়গা যেখানে ভেনটিলেশন ভাল নয়, এইরকম অবস্থায় সুপারস্প্রেডিং ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা। আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি জটলা, এবং জনতার, যেখানে মানুষ প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছেন, এমন পরিবেশে সুপারস্প্রেডিং ঘটনাবলী এবং তারপর ক্লাসটার হবার সমূহ সম্ভাবনা । এখানে যে ব্যাপারটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য সেটি এই যে, মনে রাখতে হবে খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মাধ্যমে বেশী সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ায়, এবং ক্লাসটার তৈরী হয় |
অতএব সবকটা ক্লাসটারকে চিহ্নিত করে যদি থামিয়ে দেওয়া যায়, মহামারীর মহাযাত্রা আপাত ভাবে যতই ভয়ঙ্কর দেখাক, থামানো সম্ভব, ও শুধু তাই নয়, অনাগত ভবিষ্যতে যদি সামান্যতম ঈঙ্গিত মেলে যে কোথাই ক্লাসটার তৈরী হচ্ছে, তাকে তৎক্ষণাৎ চিহ্নিত করে থামিয়ে দেওয়া যেতে পারে। দু-একটি উদাহরণের মধ্যে একটি: জাপানে কয়েকদিন আগে, এপ্রিলের (২০২১) এর শেষের দিকে দেখা যাচ্ছিল যে করোনা মাথাচাড়া দিচ্ছে, জাপান সরকার তৎক্ষণাৎ টোকিও/ওসাকা অঞ্চলে লকডাউন ঘোষণা করলেন, জাপানটাইমস বলছে
"Tougher coronavirus measures were introduced in Tokyo and the western prefectures of Osaka, Kyoto and Hyogo on Sunday under a third state of emergency amid a nationwide surge in coronavirus cases. Under the new restrictions, operators of restaurants serving alcohol and movie theaters are required to temporarily close and sports events will be held without spectators. The emergency declaration will be effective for 17 days through May 11 in a bid to curb infections during the upcoming Golden Week holidays from late April to early May. While the state of emergency does not entail a hard lockdown of the kind some other countries have imposed and largely relies on the cooperation of the public and businesses, the measures have more teeth than the previous declaration in January."
(সূত্র: https://www.japantimes.co.jp/news/2021/04/25/national/third-coronavirus-emergency-japan-starts/)
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখুন বলছে খেলার মাঠে দর্শক থাকবে না আর রেস্তোঁরায় আর সিনেমাহল বন্ধ করে দেবে, আর "the state of emergency does not entail a hard lockdown of the kind some other countries have imposed" । এদের লক্ষ্য প্রথম থেকেই ক্লাস্টার ভাঙার খেলার। জাপানের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিতোশি ওশিতানির কথায়:
"In short, Japan’s strategy was “to see the forest to understand the whole”. Western countries, including New York City, focused more on seeing the trees instead. Western countries thoroughly tested those who had come into contact with confirmed cases. By finding new cases, they focused on eliminating the virus one by one. However, data out of not only Japan but other countries have shown that positive rate among people who came into contact with cases are very low. On the other hand, transmissions can occur from mild and asymptomatic cases, which are difficult to find. Therefore, these measures were not very effective in containing the infection and led to a war of attrition.
The core of Japan’s strategy was not to overlook large sources of transmission. By accurately identifying what we call “clusters”, which are sources that have a potential to become a major outbreak, we were able to take measures for the surroundings of the clusters. By tolerating some degree of small transmissions, we avoided overexertion and nipped the bud of large transmissions. Behind this strategy is the fact that, for this specific virus, most people do not infect others, so even if we tolerate some cases go undetected, as long as we can prevent clusters where one infects many, most chains of transmissions will be dying out."
(সূত্র: https://www.japanpolicyforum.jp/diplomacy/pt20200605162619.html )
রিভার্স কনট্যাকট ট্রেসিং আর ক্লাসটার গুলোকে আলাদা করে ফেলতে পারলে ছোট বড় প্রায় যে কোন মহামারীকে আটকানো সম্ভব | সেটি করতে গেলে চাই দ্রুত পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া যে কাদের মধ্যে বা কোথায় ক্লাসটার তৈরী হচ্ছে। কোন একটি জনমণ্ডলীতে ক্লাসটার যে তৈরী হচ্ছে সেটি বোঝার চটজলদি উপায় বাড়ি থেকে নির্গত বর্জ্য জলের মধ্যে টেস্ট করে দেখে নেওয়া যে সেখানে কোথায় কি পরিমাণে করোনাভাইরাসের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে (Wastewater analysis)। পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ সেই অঞ্চলকে ঘিরে ফেলে সকলের পরীক্ষা, সবাইকে আলাদা করে দেওয়া এবং নজর করা যে কে বা কোথায় সুপারস্প্রেডার বা ওই জাতীয় ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন দেশে (যেমন নিউজিল্যাণ্ডে স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে) কোভিডের ট্রেসার অ্যাপ পাওয়া যায়। ব্লুটুথ দেওয়া সেল ফোনে দোকানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অফিসে, রেস্তোঁরায়, সুপারমার্কেটে বার কোড স্ক্যান করলে রেকর্ড রাখা যায় কে কোথায় কখন প্রবেশ/প্রস্থান করছেন। পরে যখন কোথাও বা কারো কোভিড পজিটিভ বেরোয়, অ্যাপ পর্যালোচনা করে backward contact tracing করে দেখে নেওয়া যে গোটা নেটওয়ারকের কে কোথায়, কারা সুপারস্প্রেডার, ও তাঁকে দ্রুত আলাদা করে ফেলা।
খেরোর খাতা আর পেনসিল?
ধরুণ আপনার কাছে সেই App নেই, কি করবেন? একটা ছোট নোটবই বা ডাইরী (যাতে হাতে, পকেটে, পার্সে সহজে ধরে যায়) রাখুন, একটা পেনসিল রাখুন সঙ্গে (পেনও চলবে) | যখন যেখানে যাবেন, দোকানে, সুপারমারকেটে, লাইব্রেরীতে, রেস্টুরেন্টে, যেখানেই যাবেন, প্রবেশ ও প্রস্থান করার দিন ও সময় লিখে রাখুন। কার কার সঙ্গে কথা বললেন, কতক্ষণ রইলেন, একটা হিসেব রেখে দিন। মনে করুন, আপনার কোভিডের পরীক্ষায় পজিটিভ বেরোল। তখনই, হাতের কাছে যদি ডাইরিটি থাকে, আর তাতে যদি দিনক্ষণ লেখা থাকে, তাহলে তিন চারদিন আগে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, কতক্ষণ ছিলেন, কার কার সঙ্গে কথা বললেন, সমস্ত কিছু লেখা থাকলে স্বাস্থ্য দফতরের বা চিকিৎসকের কাছে যদি সেই তথ্য দেন, ও তাঁরা যদি আরো অনেকের সেইরকম তথ্য মিলিয়ে দেখেন, তাহলে সুপারস্প্রেডারের উৎস অনুসন্ধান করা দ্রুত ও সহজ। সঙ্গে ওই জাতীয় App থাকলে তো কথাই নেই, নিয়মিত ব্যবহার করুন।
বলার কথা এই যে, ক্লাসটার গুলোকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কোভিড নিয়ন্ত্রণন করা খুব সম্ভব, যত ভয়ঙ্করই সে লাগুক এই মুহূর্তে |
কত নতুনভাবে কত শক্ত বিষয় কত সহজে বোধগম্য হল।
মাথায় নতুন পথে চিন্তার সলতে জ্বালিয়ে দিল। আহা!
এটা যে কবে করা হবে! ঃ+