ফাঁক গাছতল।ছয়-সাত ফুটে দূরে দূরে চাঁটাই পেতে গোল করে বসেছে তারা।পাশে বইয়ের ব্যাগ।সামনে খোলা খাতা। মাঝখানে আসন পেতে বসেছেন মাস্টারমাশাই।মুখে মুখোশ।ছাত্রের মুখও মুখোশে আবৃত।পড়াশোনার কাজ চলছে।সেই মধ্য -মার্চ থেকে লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, জেলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক এভাবে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে।করোনায় কম আক্রান্ত জেলাগুলোর বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক প্রাথমিক উদাসীনতা কাটিয়ে পড়াশোনা কাজকে সচল রেখেছেন আন্তরিক ভাবে।নিজের অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে, লেখাপড়াকে জরুরি পরিসেবা হিসেবে মেনে এ কাজ এখনও করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে ।কেউ আবার সন্ধেবেলায় সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে।গল্পের ছলে সমাধান করে দিচ্ছেন কঠিন অঙ্ক।ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণ অনুশীলন চলছে সমানতালে । চলমান গ্রন্থাগার ও পাঠশালা গ্রামে গ্রামে ঘুরছে।কয়েকটি জেলার উৎসাহী শিক্ষকরা নিজেদের পয়সায় কিনেছেন লোকাল কেবেলের স্লট।পালা করে প্রতিদিন দু ঘন্টা ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। কোনো কোনো শিক্ষক আবার পাঠ্য বিষয়ের নাট্যরূপের অভিনয়, আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে, ভিডিও তৈরি করেছেন।সেই ভিডিও সচেতন অবিভাবকের হাত ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে।শহর এলাকার দিদিমণিরা সশরীরে পৌঁছে যাচ্ছেন বস্তি অঞ্চলে।ফুটপাতের এক চিলতে পরিসরে পড়াশোনা এবং হাতের কাজ চলছে সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে।কিছু কিছু জেলায় অভিজ্ঞ অবিভাবক,প্রাক্তন ছাত্র,শিক্ষকরা আলোচনা করছেন করোনা পরিস্থিতিতে কিভাবে পড়াশোনার কাজ সচল রাখা যায়।রাজ্যের সরকার পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা ক্ষুদ্র অংশের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট উৎসাহ ব্যঞ্জক।তাঁরা এটা অনুধাবন করেছেন যে শিক্ষাদানের কাজ চালু রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক বজায় রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু বিদ্যা চর্চার জায়গা নয়,বিদ্যালয় অনুভূতিক এবং সামাজিক বিকাশের আদর্শ পরিসর। অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল, কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার উপায়, সহপাঠীদের সঙ্গে সাবলীল মেলামেশায় আয়ত্ত করে নেওয়ার সুযোগ থাকে।নিজের জীবনের জটিল পরিস্থিতি প্রিয় বন্ধু বা মাস্টারমশাইএর সান্নিধ্যে সমাধানের পথ খুঁজে পায় কখনও কখনও।আমরা যদি আমাদের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থ করি তাহলে দেখব অনেক কথা যা বাড়িতে বলা নিষিদ্ধ, তা অবলীলায় সহপাঠীর সঙ্গে বলেছি।শুধু বলিনি,সেখান থেকে একটা সামাধানের পথ খুঁজে বের করেছি।আর যৌথ -দুষ্টুমির অনাবিল আনন্দ এখনও স্মৃতিতে আমিল হয়ে আছে আজও ;তা অমূল্য সম্পদ।আদরের ধন।বার্ধ্যকের বারানসি।এই কারণেই তো বিখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিংহ লিখেছেন-আমার সম্পদ নিয়ে নাও।যশ,খ্যাতি প্রতিপত্তি সব নিয়ে নাও। তার বিনিময়ে আমার শৈশব ফিরিয়ে দাও।কাগজের নৌকা বানিয়ে আমি যে জলে ভাসাতাম তা আমি ফিরে পেতে চাই।আসাধারণ সেই আকূতি।সেই কারণেই বলছি বাচ্চাদের উদ্বেগ, বিষন্নতা বা মন খারাপ অনেকটা প্রশমিত হয় বন্ধুর সাহচর্যে।সহপাঠীকে সব কথা উজার করে বলতে পেরে, প্রতিকূলত পরিবেশে বন্ধুর লড়াই করার গল্প শুনে তারা অনুপ্রেরণিত হওয়ার অবসর পায়।স্কুল এই সুযোগ করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সক্ষমতাকে নাম দিয়েছে Life Skills বা জীবন শৈলী যা শৈশবে এবং বয়ঃসন্ধিতে পুরোটাই স্কুল থেকেই শেখার কথা।WHO তার ঘোঘনায় লিখছে জীবন শৈলী হল " adaptive and positive bebaviour that enable individuals to deal effectively with the demands and challenges of everyday life."সিদ্ধান্ত নির্মাণ,সমস্যার সমাধান,সৃজনশীল চিন্তা,জটিল চিন্তা,কার্যকরী যোগাযোগ,পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের শৈলী,আত্ম সচেতনতা,সমানুভূতি,মানসিক চাপ এবং অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা এই দশম মহাবিদ্যা শেখার সুযোগ মানুষ স্কুল জীবনেই পায়। সর্বোপরি অবিভাবকতুল্য শিক্ষিকা- শিক্ষকদের পরিচর্যা এবং স্নেহ- স্পর্শ ছাত্রদের রূপান্তরের সুযোগ করে দেয়।মনের ভেতর জমে থাকা ক্লেদ- কালিমা ধূয়ে মুছে যায় মাস্টারমশাইয়ের সামান্য প্রশ্রয় পেলে।
করোনা আবহে স্কুল বন্ধ।বাড়িতে বন্দী শিক্ষার্থীরা। নিষেধের বেড়াজালে তাদের প্রাণ হাফিয়ে উঠেছে।বন্ধুর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ নেই।আড্ডা, মজা,দুষ্টুমি সব অতীত। কতদিনে শেষ হবে অতিমারির প্রকোপ তা তাদের আজানা।বড়োরাও কোনো দিশা দিতে পারছে না।কোনো পরিকল্পনা করে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।পড়াশোনা নিয়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা। বেসরকারি স্কুলের সম্পন্ন ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস চলছে। সেখানে অনিচ্ছা থাকলেও "অন "হতে হচ্ছে দিনের মধ্যে একাধিক বার। চলছে পড়াশোনার ঝকমারি। লেখাপড়ার হদ্দ মুদ্দ। সোনার খাঁচায় বন্দি করে ইন্টানেটের ডগা দিয়ে শিশুর মুখে ঢুসে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা। "তোতাকাহিনি"র পাখির খবর যেমন কেউ রাখেনি,এখানে বাচ্চাদের খবর কেউ রাখছে না।এ অবস্থায় উদ্বেগ তো জমাট বাঁধবেই ছোট্ট মনে।রাগও হওয়া অস্বাভাবিক নয়।অসহ্য উৎকন্ঠা-রাগ বেরিয়ে আসতে না পেরে আসাদের জন্ম নিচ্ছে শিশু মনে।তারমধ্যে আগে থেকেই যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে তাদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। পারিবারিক হিংসার আবহে যে সমস্ত বাচ্চা থাকতে বাধ্য হচ্ছে তাদের অবস্থা সাংঘাতিক ।বাবা কিংবা মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অথবা মাদকাসক্তি থাকলে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বন্ধুবিহীন বন্দি জীবনে যে আরো দফারফা হবে এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।তাই এই মুহূর্তে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা বড়ো স্বস্তির জায়গা হয়ে উঠতে পারে। স্কুল ভালো লাগার পরিসর।অসহ্যতাকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ।নিজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিরীক্ষাগার।অসংযত অনুভূতিকে আয়ত্তে রেখে মূল স্রোতে ভেসে থাকার পরিমন্ডল।ঠিক এই কারণেই শিশু মনোবিদরা করপোরাল পানিসমেন্ট বা স্কুল- বহিষ্কারের বিরোধী। কারণ স্কুলের বাইরে চলে এলেই অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা শত গুণ বেড়ে যায়।নেশা,চুরি,অসুস্থ যৌনতা ইত্যাদিতে ঢুকে পড়তে পারে।বাস্তবে ঘটেও তাই।আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে হোমে আছে যে সমস্ত শিশু তাদের বেশির ভাগ স্কুল ছুট অথবা বহিষ্কৃত।প্রত্যেকটা অপরাধের একটা সরনি(pathway) থাকে।সেটা খুব জরুরি।
সম্প্রতিক পরিস্থিতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সংকটের কথা মাথায় রেখে এবং পাঠদানের কাজকে সচল রাখার জন্য কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছেন। স্বল্প হলেও সাধু উদ্যোগ।তবে অন্যদিকে এই অবস্থায় ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি। তানাহলে হয়ত অনেক কুঁড়িকে ঝরে যেতে দেখতে হবে আমাদের। মানসিক স্বাস্থ্যে মহামারির জন্য দায়ী থাকতে হবে।সরকারের উচিত সমস্ত রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্রদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল ফিরিয়ে দেওয়া।অন্তত আর পাঁচটা পরিসেবার মত পড়াশোনাও যে অত্যন্ত জরুরি এটা সরকার মান্যতা দিক এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনায় বসুক।ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ফিরিয়ে দিতে সরকার উদ্যোগী হোক।