আজ ভারতে ঈদ। পরবাসে ঈদ বলে অবশ্য আলাদা কোনো অনুভূতি নেই। এবছর ঈদটা বাড়ির সঙ্গে করার ইচ্ছা ছিলো। মেঘের প্রথম জন্মদিন আর ঈদ দুইই পরিবারের সাথে পালন করে জার্মানী ফেরার ইচ্ছা ছিলো। করোনার জন্য তা হলো না। অবশ্য বহু মানুষ করোনার ভয়ে জার্মানী থেকে দেশে পালিয়েছে। আমার আর এদেশ থেকে রোগের জীবানু নিজের দেশে বহন করার সাহস হয়নি। অগত্যা পরবাসে লকডাউনে মনখারাপ নিয়ে দিব্যি আছি।
এই নিয়ে তিনবছর ঈদ উদযাপন বাইরে । গতবছর মিউনিখে ছিলাম.. তার আগের বছর আমেরিকায় আর এই বছর প্যাডারবর্ণে। । বাইরের দেশে ঈদের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। তবে এখানেও ঈদের জামাত হয়। ছেলে মেয়ে উভয়েই মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। আমাদের দেশের মতো ঈদের নামাজ এখানে পুরুষকেন্দ্রিক না। তৌসিফ যাওয়া উচিত হবে কি হবে না সেই নিয়ে দোনামোনা করতে করতে অবশেষে নামাজ পড়তে গেছিলো স্থানীয় মসজিদে। আগে থেকে মসজিদে রেজিস্ট্রেশন করে রাখতে হয়েছিলো। প্রচুর নিয়মকানুন সহকারে মসজিদে নামাজ পড়তে হয়েছে। একে অপরের সাথে দেড় মিটার দূরত্ব রেখে স্যানিটাইজার আর মাস্ক পরে নামাজ। আমি অবশ্য ল্যাদ কাটিয়ে নামাজ পড়তে যাইনি। ঘরে বসে ভাবছিলাম পুরোনো দিনের কথা।
ঈদ বলতেই গুচ্ছের স্মৃতি মনে ভীড় করে। চাঁদরাত, ঈদের চাঁদ, ঈদের নামাজ, নতুন জামা, সিমুই, লাচ্ছা আরো কত কি!
চাঁদরাত কথাটা খুব মিষ্টি। মায়ের ভালোবাসার মতন মিষ্টি। আলতো করে চোখ বুজলাম। আমি আমাদের বর্ধমানের গোলাপি বাড়িটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে। পুরো পাড়াটা সবুজ নীল টুনি বাল্বে মায়াময়। ক্লাবের সামনে প্যান্ডেল... সুভানসাহেবের বাড়ি সামনেও প্যান্ডেল। ছোটো ছোটো বাচ্চারা নতুন জামা পরে সেজে গুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কাছে ছোট্ট টাকার ব্যাগ। তাতে আছে জমানো টাকা। কাল অনেকে ঈদ সালামি পাবে।
সূরযদের বাড়ির সামনে আচার আর আইসক্রিমওলা বসেছে। খুব ভীড়... ফুচকাওলাও আছে... আর আছে বারোভাজা।
আমি গ্রীলের দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকলাম। সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলায় উঠে গেলাম। আম্মু রান্নাঘরে... সিমাই, লাচ্ছা , পেস্তা, কাজু, কিসমিস সব রেডি করে রাখছে। খুব ভোরে উঠে ক্ষীর, সিমাই বানাবে। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। আম্মু কাল বিরিয়ানি কি বানাবে?
পাড়ার সব মেয়েরা একহাত মেহেন্দি পরেছে আজ। অনেকে রাতের বেলায় পরবে। মোমসদের বিউটি পার্লারে আজ অনেক রাত অবধি মেয়েরা আসবে। অনেকে রাতের খাওয়ার পরে যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন আসবে। দোকানে দোকানে আজ চরম ভীড়... শেষ মূহুর্তের কেনাকাটা। গরীব থেকে বড়োলোক সবাই সাধ্যমতো জামাকাপড় কিনছে প্রিয়জনের জন্য। তেঁতুলতলা বাজারে আজ রাত একটা দুটো অবধি দোকান খোলা থাকবে ।
সব্জিবাজারের চুড়ির দোকানগুলোতে চরম ভীড়... নানা রঙ এর আলো ঝলমল চুড়ি। কাঁচের রেশমি চুড়ি, ডিজাইন করা চুড়ি... অভ্র দেওয়া ঝকমকে চুড়ি, রাজস্থানী চুড়ি আরো কত রকমেই।
আমার অবশ্য সবথেকে প্রিয় হলো রেশমী চুড়ি... প্রজাপতির মতন রঙিন।
সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করবে চাঁদ কি দেখা গেছে? কাস্তের মতো একফালি চাঁদ। যে অফুরন্ত আনন্দের সঙ্গে খুশীর ঈদের পরোয়ানা পাঠায়। আজ আলমারী থেকে কাঁচের তস্তুরী, বাসন বের হবে। অতিথির জন্য নকশা করা অদ্ভুত সুন্দর সব দস্তরখান।
প্রতিবার ঈদ এলেই আমার দাদার কথা মনে পরে। আব্বু ছাড়া যে লোকটা আমাদের তিনভাইবোনকে জামা কিনে দিতো সে হলো দাদা। যতদিন বেঁচে ছিলেন এর অন্যথা হয়নি। দাদার কেনা জামাগুলো অন্যরকম সুন্দর হতো। বান্ধব সু আর সুরানা ব্রাদার্সের মাঝামাঝি যে কাপড়ের গুমটিটা ওখানে দাদা জামা কিনতেন। ছোট্টো দোকান হলে কি হবে... বেশ সুন্দর জামা পাওয়া যেতো। ওখান থেকে দাদা বেগুনি ভেলভেটের ফ্রক, সবুজ লাচ্ছা ঘাগড়া এরকম সব অদ্ভুত সুন্দর রঙের ঝলমলে জামা কিনে দিয়েছিলেন।
গতবছর আমাদের ঘর আলো করে আমার বোনঝি মেঘ এসেছে। নতুন অতিথির নতুন ঈদ। তাকে ঘিরেই আমাদের যাবতীয় শখ, আনন্দ। আমরা কেউই নতুন জামা কিনিনি এবছর। তবে মেঘের জন্য নতুন জামা কেনা হয়েছে।
বাচ্চারা এই সময় দ্রুত বড়ো হয়। জামাকাপড় দ্রুত ছোটো হয়। পুনেতে দুমাস ধরে লকডাউন। কিচ্ছু কেনা যায়নি। জামাগুলো প্রায় সব ছোটো হয়ে গেছে। তাই লকডাউন একটু আলগা হতেই ওর জন্য জামা কেনা হলো। ওটুকুই ঈদের শপিং।
এবছরটা বড্ডো দুঃখের বছর। শুরু থেকে একের পর এক দুঃখ নিয়ে আসছে। দুঃখের বছরে খুশীর ঈদ হয়ে গেলো দুঃখের ঈদ।
বহু মানুষ সর্বস্বান্ত। করোনা আর আমফান তাদের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। বহু শিশু আজকে নতুন জামা তো দূর অস্ত, দু মুঠো ভাতের জন্য অপেক্ষা করছে।
মনমেজাজ একেবারে ভালো নেই। নিজেরা জামা কাপড় না কিনে সেই টাকায় কিছু গরীব মানুষের মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করেছি। তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। আমি জানি বাচ্চারা সারাবছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে। নতুন জামা, একটু আনন্দ, একটু ঈদি।
আমার মনে আছে ছোটোবেলায় ঈদের জামা কেনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম । ২০ টা রোজার পর থেকেই উসখুশ। পাড়ার সবার ঈদের জামা কেনা হয়ে গেছে আমাদের এখনো হয়নি। নিউ নিয়ম করে সন্ধ্যেবেলা হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতো। তারপর এক সুখের সন্ধ্যেয় আম্মু আমাদের নিয়ে ঈদের জামা কিনতে যেতো। বহু দোকান ঘুরে সস্তায় সুন্দর ফ্রক, হেয়ারব্যান্ড কিনে খুশী মনে বাড়ি ফিরতাম।
মনে প্রশ্ন জাগে আমার মেঘ যখন বড়ো হবে আমাদের ছেলেবেলার মতোই ঈদে জামা কেনার জন্য বায়না করবে? মেহেন্দি না পরা হলে কাঁদবে?
বোধহয় না... আমাদের মতো মধ্যবিত্ত টানাটানির পরিবারে মেঘ জন্মায়নি। সে হয়তো কখনোই বুঝবে না অভাব কি... নতুন জামার জন্য অধীর আগ্রহে পুরো রোজা পার করার আনন্দ কি।
এক হাত মেহেন্দি পরে দুই বোনে আনন্দ করার মজা কি! বাড়ির সবাই একসঙ্গে বসে রোজা খোলা... পাড়ার সবার কটা জামা হলো সেই আলোচনা কোনোটাই হয়তো তার জীবনে থাকবে না।
একরাশ মনখারাপ নিয়ে এ লেখা লিখছি। জানিনা কবে আবার পৃথিবী সুস্থ হবে। কবে আমার দেশের সহায়সম্বলহীন মানুষগুলো একটু ভরসা পাবে।
ঈদের চাঁদের পবিত্র আলোয় পৃথিবী রোগমুক্ত হয়ে উঠুক। শিশুরা নতুন জামা পরে আনন্দে ঝলমল করুক। সিমুই , লাচ্ছা, বিরিয়ানির গন্ধে চারপাশ ভরে উঠুক।এই দুঃখের ঈদ আবার হয়ে উঠুক খুশীর ঈদ। এটুকুই চাওয়া।
খুব খুবই সুন্দর লেখাটা
একেবারে কলজের গোড়ায় টান পড়ল। আমাদের সেই মধ্যবিত্তের আশানিরাশার দোলাচলের দিনগুলো খুব মনে পড়ে। ভালো থাকবেন।
খুব ভালো লেগেছে।
শাহ আব্দুল করিমের গানে একটি এরকম কথা আছে, "দিন হতে দিন, আসিতেছে কঠিন, দীনহীন করিম বলে, কোন পথে যাইতাম?"
লেখার মায়াটুকু ভাল লাগলো। শুভ কামনা