এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আবার সোহম 

    Suvasri Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ মে ২০২৪ | ৫০৭ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • সোহম সরকারের ছোটবেলার আরো কিছু ঘটনা বলি। 

    সে সময় তাঁর বছর পাঁচেক বয়স। আমার কাছে মাঝেমাঝেই পড়তে আসতেন। পড়তে এসে নানা রকম ফরমাশ এবং বলা বাহুল্য দুষ্টুমিও করতেন। এক দিন বিকেলে পড়তে এসে যা করেছিলেন সে একটা লিখে রাখার মতো ঘটনা বটে। তিনি আমার কাছে একটা নির্দিষ্ট খাতায় লিখতেন। তো সে দিন তাঁর সেই খাতাটা সংশোধন করে তাঁকে আমি দেখাইনি। বলেছিলাম- "একেবারে তোর মা'কে দেখাব।" সোহমের মা অর্থাৎ তেজী বৌদি। সেই সময় অবশ্য তেজী নামটা দেওয়া হয়নি। এখানে তাঁকে নবঝর্ণা বৌদি বলেই উল্লেখ করব। আসল নাম বললে তাঁর তেজে আমাকে পুড়ে যেতে হ'বে।

    যাই হোক, আমার কথা শুনে সোহম ভাবলেন, খাতা সংশোধন করতে করতে আমি এমন কিছু লিখেছি যা তাঁর জন্য বিপজ্জনক। তিনি বলতে শুরু করলেন, "খাতায় কী লিখেছিস আমাকে দেখা। খাতাটা আমাকে দে। আমি চেক করব।" আমারও সে দিন জেদ চেপে গিয়েছিল। সোজা বলে দিলাম, তোকে দেখাব না। বেশ কয়েকবার "আমি চেক করব, আমি চেক করব" বলে ফল না হওয়ায় ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি আমার পোষাকটা পিঠের দিক থেকে টেনে ছিঁড়ে দিলেন। ব্যাস, দর্জির দোকান থেকে সাত দিন আগে আনা মিডি জাতীয় বাড়িতে পরার ঢোলা পোষাক এক মুহূর্তে দু' আধখানা! 

    এ প্রসঙ্গে বলি, একেক দিন তাঁর দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে আমি বলতাম - "বাড়ি চলে যাও। তোমাকে আর পড়াব না।" সে রকম হ'লে তিনি বিপদ গুণতেন। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে মা ঠিক ধরে ফেলবে কিছু একটা গন্ডগোল করে এসেছে! বিপদ এড়াতে আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলতেন - "আর কব্ব না, ও মৌ পিসি আর কব্ব না, পড়াও।" এ রকম করলে পাথর গলে যাবে তো আমি কোন ছার!

    এক দিন আমার কাছে পড়তে এসে তিনি আমাকে হাসাচ্ছিলোন। বেশ মনে পড়ে, শীতকাল লেপ ঢাকা দিয়ে বসে আমি তাঁকে পড়ানোর কাছাকাছি কিছু একটা করছিলাম। এ দিকে সোহম সমানে হাত মুখের নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করছিলেন যেসব দেখে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে হাসি চেপে রাখা অসম্ভব। ফলে সোহম ও আমি দু' জনেই হেসে গড়াচ্ছিলাম। আমার মা পাশের ঘর থেকে দিদিমণি ও ছাত্রের হাসিপড়া দেখছিল। তারপর এক সময় ছুটে এসে সোহমকে ও আমাকে, দু' জনকেই মার। বুঝুন কান্ড- মার খাওয়া ছাত্রের সামনেই দিদিমণিও মার খাচ্ছে।

    একবার হয়েছে কী, ছ' বছুরে সোহম বারাসাতে মামাবাড়ি যাবেন। সেখানে তাঁর ভারি মজা, সীমাহীন আদর।

    কিন্তু তিনি না থাকলে আমাদের খুব খারাপ লাগত, বিশেষ করে আমার। তখন তিনি ওপরে এসে ঘোষণা করেছেন, আজ মামাবাড়ি যাব, শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, ছ' দিনের জন্য যাবেন তাঁরা। শুনে আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম- "বাবাই ছ' দিনের জন্য যেও না প্লিজ! আমরা থাকব কী করে?" শুনে কেন জানি না তাঁর বেশ মজা লেগেছিল। তিনি আমার ডান গালে একটি শক্তিশালী চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। চরম মজাই বটে!

    পাঁচ বছরের সোহমকে নিয়ে এক দিন দমদম স্টেশনের কাছাকাছি বেড়াতে গেছি। একটা মিষ্টির দোকানে টানা বেঞ্চে বসে কী সুন্দর এক বাটি রসমালাই খেলেন তিনি! এখনো মনে পড়ে, দোকানদার ভারি যত্ন করে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছিল। শান্ত হয়ে বসে চামচ দিয়ে তাঁর নিজে নিজেই রসমালাই খাওয়া এখনো মনে পড়ে। 

    তারপর একটা কেক ও আইসক্রিমের দোকানে  ঢোকা হয়েছিল। সোহম আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করলেন। দিলাম। একটু মুখে দিয়েই বললেন- "উফ্ কী ঠান্ডা, খাব না।" তখন আমি চামচ দিয়ে একটু একটু করে তাঁকে আইসক্রিম খাইয়ে দিলাম। দোকানটায় বসার জায়গা ছিল না। পাঁচ বছরের মাখনের পুতুল সোহম লাফাতে লাফাতে আমার হাতের কাঠের চামচ থেকে আইসক্রিম খাচ্ছেন, সে দৃশ্য এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

    আইসক্রিম পর্ব শেষ করে সোহমের হাত ধরে আমি পত্রপত্রিকার একটা স্টলের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। উদ্দেশ্য নিজের জন্য একটা পত্রিকা কিনব। সোহম বললেন - "আমাকে একটা আনন্দমেলা কিনে দে।" শুনে অবাক হয়েছিলাম, কিনে দিয়েছিলাম তবে খুব হেসেও ছিলাম, মনে পড়ে। ভাবতে পারিনি তিনি আনন্দমেলার জন্যও বায়না করবেন। 

    সোহম ছিলেন আমাদের বাড়ির সমস্ত গন্ডগোলের প্রতিকার। মনখারাপের ওষুধও। তাঁকে দেখলেই আমি সব দুঃখ ভুলে যেতাম। বাড়িতে গোলমাল পাকিয়ে উঠছে টের পেলেই মা সোহমকে নিয়ে আসত। অবশ্য যখন যখন আনা সম্ভব আর কী! 

    একবার আমাদের ফ্ল্যাটে মিস্তিরি লেগেছিল। পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজ হচ্ছিল বলে সময় লাগছিল। বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা শব্দ আর শব্দ, সেই সঙ্গে ধুলো উড়ছে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। এক দিন বেলার দিকে আমি বলতে শুরু করেছি, আর নেওয়া যাচ্ছে না, সাতেরো দিন ধরে কাজ হচ্ছে, এক মুহূর্ত শান্তি নেই.... এই সব। বাবাও রেগে গিয়ে অনেক কিছু বলতে শুরু করল। অশান্তি ঘনিয়ে ওঠার উপক্রম। 
      
    তখন মা গিয়ে সোহমকে নিয়ে এল। তিনি একটা গামছা নিয়ে হাজির। আমাদের ফ্ল্যাটেই স্নান করবেন আর কী! এসেই বললেন - "সাতেরো দিন ধরে কাজ হচ্ছে?" ব্যাস বাবা আর আমি ঠান্ডা হয়ে গেলাম। তাঁকে জড়িয়ে ধরে আমি বলে উঠলাম - "তুমি তো আমাদের বাড়ি রোজ আস। তাহলে এত ক্ষণ আসনি কেন?"

    এরকম সাত সাতেরো অনেক আছে। জীবন আমাদের অনেক কিছু দেয় আবার দেয়ও না। তাছাড়া কিছু জিনিস দিয়েও নিয়মানুসারে কেড়ে নেয়।
     
    সোহমের শৈশব অনেক দিন অতিক্রান্ত। সেই আনন্দময় দিনগুলো পার করে আমিও আর এক  প্রান্তে। কোনও কিছুই আগের মতো নেই। এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এখন আমার জীবনে অমোঘ শূন্যতা। সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য সদাব্যস্ত, ঝকঝকে তরুণ সোহম আর ওপরে আসেন না। তাঁর সময় নেই। কিন্তু আমার মন থেকে তাঁর নিষ্পাপ শৈশবের অসংখ্য স্মৃতি কে কেড়ে নেবে? জীবন থেকে এটাই আমার মস্ত পাওয়া বলে আমি মনে করি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Rouhin Banerjee | ২৯ মে ২০২৪ ০০:৫৫532461
  • স্মৃতির সরণী, ঝরঝরে লেখা।
  • Suvasri Roy | ২৯ মে ২০২৪ ০৪:২৮532467
  • @Rouhin Banerjee 
    পাঠপ্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বলে ভালো লাগছে। 
  • Ranjan Roy | ২৯ মে ২০২৪ ১০:০৩532472
  • শেষ প্যারাগ্রাফটা -- ছুঁয়ে গেল। আমিও তো এখন জীবনের আরেক প্রান্তে। আমার শিশু সোহিনীরা যাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিলাম --তারা আজ হয়ত পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন। কোন যোগাযোগের প্রশ্ন ওঠে না । তাই স্মৃতির অ্যালবামের পাতা উলটে বিবর্ণ ছবি দেখাই নিয়তি।
  • Suvasri Roy | ২৯ মে ২০২৪ ১১:০৯532476
  • @Ranjan Roy
    মতামত পেয়ে ভালো লাগল।
  • শমীক | 2409:40e0:1031:8672::***:*** | ১০ জুন ২০২৪ ১৬:০৯532983
  • স্মৃতি সবসময় সুখের। বর্তমান রুক্ষ। ভবিষ্যৎ আশার। এটাই জীবন। বাঙালির শৈশবের অতলে তলিয়ে যাওয়ায় চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। আপনার লেখায় নিজের শৈশবের অফুরন্ত ভালোলাগার ছোয়া পেলাম নতুন করে। এরকম আরও লেখা চাই।
  • Suvasri Roy | ১০ জুন ২০২৪ ১৭:০৯532984
  • @শমীক
    পাঠকদের মতামত কলমচি হিসেবে আমাকে সমৃদ্ধ করে। শুভেচ্ছা রইল।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন