করোনা মোকাবিলার জন্য ঘোষিত লকডাউন এখন চতুর্থ সপ্তাহ পার করে পাঁচ নম্বর সপ্তাহে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একথা বলাবাহুল্য যে লকডাউনের অভিজ্ঞতা কারুর পক্ষেই খুব একটা সুখপ্রদ নয়। সমগ্র জনজীবনের উপরে এই অতিমারী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে আর একথা বলাই যায় ভবিষ্যতের ছবিটাও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে জনস্বাস্থ্য অভিযানের পক্ষ থেকে এই রিপোর্টে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের অতিমারী মোকাবিলার হালহকিকত আলোচিত হয়েছে । দেশের অন্য বড়ো রাজ্যগুলির তুলনায় এই রাজ্যের অস্বাভাবিক কম আক্রান্তের সংখ্যা এবং এই রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের "মেডিক্যাল অডিট সিস্টেম" এর ঠিক করে দেওয়া করোনাসংক্রান্ত মৃত্যুহার একইসাথে মনোযোগ আর আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজ্যের ব্যবস্থাপনা, কম টেস্টের সংখ্যা, এইরকম মাপের একটি বিপর্যয় সামলানোর মতো রাজ্যের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ক্ষমতা বা অপ্রতুলতা আর সেইখান থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু নির্দেশিকা - এইসবকটি বিষয়ই আলোচিত হয়েছে এই রিপোর্টে । এই লকডাউন এমনিতেই একটা সঙ্কটের চেহারা নিয়েছে আর সেইসঙ্গে সরকার যদি সংক্রমিত রোগী আর তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে চিহ্নিত করতে বারবার ব্যর্থ হয়, যদি এই লোকজনদের যথেষ্টসংখ্যায় টেস্ট আর আইসোলেশনের আওতায় না আনতে পারে তাহলে এই লকডাউন শুধু লক্ষ্যচূত হবে তাই নয় এই অতিমারী তখন মহামারীর আকার নেবে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃতের সংখ্যা কম দেখানো:
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুকে নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। এইরকম অভিযোগও উঠেছে, করোনা আক্রান্ত রুগী যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাদের যদি অন্য কোনো রোগ থেকে থাকে, তাদের মৃত্যু এই কমিটির ঠিক করে দেওয়া করোনাজনিত কারণে মৃতের তালিকায় স্থান পাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাজনিত মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোই এই কমিটি তৈরী করার পিছনের মূল উদ্দেশ্য। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু জুনিয়র ডাক্তার ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর শংসাপত্র লিখতে বাধ্য করেছেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ লুকোনোর জন্য মৃতের শংসাপত্র দিতে দেরি করা করার অভিযোগও উঠে এসেছে বেশ কিছু জায়গায়।
এই সবকটি উদাহরণ মেলালেই স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকার খর্ব করা ও সর্বোপরি জনসাধারণের কাছে এই অতিমারীর সংক্ৰান্ত সঠিক তথ্যগোপনের এক বিপজনক প্রবণতা চোখে পড়ছে। কিন্তু তথ্যগোপনের এই চেষ্টা আদতে করোনা রোগ মোকাবিলার সার্বিক ক্ষমতাকেই খাটো করছে আর এই রাজ্যের পরিস্থিতিকে আরো দুর্বল করে তুলছে।
আক্রান্ত রুগীর সংখ্যায় গরমিল:
যে গরমিল সবচেয়ে আগে চোখে পড়ছে তা প্রতিদিন কেন্দ্র সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক আর রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত আক্রান্ত রুগীর সংখ্যার পার্থক্য দেখলেই পরিষ্কার করে বোঝা যাবে। রাজ্যের স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রতিদিন 'একটিভ' বা বর্তমানে কজন ভর্তি আছেন সেই সংখ্যা প্রকাশ করে, যেখানে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তর প্রকাশ করে মোট আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সংখ্যার পার্থক্য যদি আমরা মেনেও নিই, তাহলেও মোট মৃত ও সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা ও 'একটিভ’ রোগীর সংখ্যার যোগফল কেন্দ্রীয় দপ্তরের মোট কেস সংখ্যার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে যুক্ত বহু চিকিৎসক ইতিমধ্যেই আশংকা প্রকাশ করেছেন রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের বুলেটিনে প্রকাশিত আক্রান্তের সংখ্যা প্রকৃত রুগীর সংখ্যার থেকে অনেকটাই কম দেখানো হচ্ছে।
রাজ্যে কম সংখ্যায় করোনা টেস্ট:
এখনও এই রাজ্যে প্রতিদিন ৪৫০ কাছাকাছি টেস্ট হচ্ছে কিন্তু দেশের অন্যান্য রাজ্যেই এই সংখ্যাটা ৫০০ থেকে ৬০০র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
পশ্চিমবঙ্গ প্রতি দশলক্ষ প্রতি ২৫জনের টেস্ট করছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমান জনসংখ্যার অন্যান্য রাজ্যে যেমন মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু , গুজরাট, রাজস্থানে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে ১২৬, ১৩৯, ১৪১, ১৭০, ৩৬৫। গোটা দেশের ক্ষেত্রে এই গড় সংখ্যা ১০৫এর কাছাকাছি। কলকাতা বাদে এরাজ্যে অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজে টেস্ট এখনও অবধি হওয়ার খবর নেই।
নিচের সারণীতে পশ্চিমবঙ্গে দিনপ্রতি করোনা টেস্টের সংখ্যাটা দেখলেই ছবিটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
উপরে উল্লিখিত সরঞ্জাম রাজ্যের ২৭টি বেসরকারি হাসপাতালসহ ৮৮টি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনুপস্থিতি:
সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, দেশের অগ্রণী জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথের কলকাতা অফিসকে কিভাবে সামগ্রিক পরিকল্পনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও জনস্বাস্থ্য ও মহামারীর মতো বিষয়ে তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তবুও তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে এখনও অবধি একটুও ব্যবহার করা হয়নি, পরামর্শও চাওয়া হয়নি। নাইসেডের আঞ্চলিক অধিকর্তাও একই অভিযোগ করেছেন একটি সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের কাছে যে তাঁদের কাছে দিনে ১৫-২০টার বেশী নমুনা সরকারের কাছ থেকে পাঠানো হচ্ছে না পরীক্ষার জন্য। এবং সবচেয়ে মজার কথা রাজ্যের করোনা চিকিৎসার মূল ভরকেন্দ্র বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল ও নাইসেডের আঞ্চলিক দপ্তর একই চত্বরে অবস্থিত।
জনস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে সুপারিশ: