বাস্তবে আমরা সবাই স্বীকার করি যে, দেশে একটা আইন আছে। আর তার জন্যেই তো এত কমিটি, এত আলোচনা। কিন্তু আমার কাছে গোটা বিষয়টা সুরিয়াল অ্যাবসার্ডিটি মনে হয় কারণ; এদিকে ইরম শর্মিলা মণিপুরে আমরণ অনশন আন্দোলন শুরু করলেন, মালোম গণহত্যার পর তিনি অনুভব করেছিলেন সেখানে জীবনের কোন মর্যাদা নেই, বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তাই তিনি তাঁর জীবন শেষ করে দিতে চাইলেন গান্ধীবাদী পথে অনশন আন্দোলনের মাধ্যমে। তারপর তাঁকে বন্দী করা হল, মানে কাগজে কলমে যদিও তিনি হাসপাতালে, কিন্তু জেল আই জি–র অধীনে থাকে হাসপাতালের ওই অংশটি মোটামুটি জেল হিসাবেই বিবেচিত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, “আত্মহত্যার চেষ্টা”। এখন দেশের একজন সহ-নাগরিককে তুমি বেঁচে থাকার অধিকার দিচ্ছ না, আবার তার কাছ থেকে মরে যাবার অধিকারও কেড়ে নিচ্ছ। তার ওপর সে যখন তার বেঁচে থাকার অধিকারের জন্যে অনশন আন্দোলন করছে তুমি তার ওপর “আত্মহত্যার চেষ্টা”-র অভিযোগ চাপাচ্ছ! মানে তোমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই; মরে যাবারও কোন অধিকার নেই। তোমাকে একমাত্র বৈধ সন্ত্রাসের গুলি খেয়েই মরতে হবে। যে বৈধ সন্ত্রাস আফস্পা নামে এতদিন চলে আসছে। অ্যাবসল্যুট সুরিয়াল, যা একমাত্র লুই বুনুয়েলের কোন ছবিতে দেখা যায়। আমার প্রায়ই মনে হয় কোন ইবম শ্যাম শর্মা তার ক্যামেরা দিয়ে মণিপুরের সময়কে ধরে রাখছে না। মণিপুরের সময়কে তো ধরে রেখেছেন আর্মি অফিসাররা তাঁদের বন্দুক দিয়ে। কারণ তিনিই পারেন সময়কে নিয়ে খেলতে। তিনিই পারেন তোমার ভবিষ্যৎ দেখে ফেলে তোমায় গুলি করে মারতে। সেই আর্মি অফিসার যিনি মনোরমাকে কাছ থেকে গুলি করেন, ঘটনাটাকে এনকাউন্টার কিলিং হিসাবে উপস্থাপন করেন। ক্লোজরেঞ্জ কিলিং। গোটা চোদ্দ কি পনেরটা গুলি ছিল তাঁর শরীরে। যে জায়গাটায় দেহটা পড়ে ছিল, সেখানে একফোঁটা রক্তের ছিটে পর্যন্ত ছিল না। তার মানে কি, সব আন্ডারগ্রাউন্ড জঙ্গি বা তথাকথিত অ্যান্টিন্যাশনালিস্টরা সবাই রক্তহীন? সিমেনসহ অন্তর্বাসগুলি কলকাতার ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়। যেখানে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং সেই সাথে ধর্ষকের ব্লাডগ্রুপও চিহ্নিত হয়। ঘটনার তদন্তে নিযুক্ত উপেন্দ্র কমিশনের কাছে আর্মি থেকে সেনাদের একটা গোটা ব্যাটেলিয়ন পারেড করতে করতে চলে যায় যাদের কিনা একই ব্লাডগ্রুপ ছিল! ...এটা বুনুয়েলের ফিল্মের কোন সট্ ছাড়া আর কোথায় কল্পনা করতে পারি?
শান্তি পুনঃ স্থাপনের বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলি সবসময় টোকেনিজমের পথ গ্রহণ করেন। এখন যখন আফস্পা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে, মানবাধিকাররক্ষা সংস্থাগুলি এবং সেই সাথে আইকনিক চরিত্র ইরম শর্মিলা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচ্য হয়ে উঠেছেন, তাঁরা সত্যিই সরকারের সঙ্গে দরাদরি করতে পারতেন। কিন্তু এখানে আফস্পা তুলে দেওয়ার পরিবর্তে টোকেনিজম ব্যবহার করা হল। তাঁরা যেটা করলেন, আফস্পা কোন জায়গায় কেবল মাত্র তখনই প্রযোজ্য যখন সেটি উপদ্রুত হিসাবে ঘোষিত হয়। তাই তাঁরা ইম্ফলের মিউনিসিপ্যাল অঞ্চলের কিছু যায়গা থেকে এই “উপদ্রুত” ট্যাগটি উঠিয়ে নিলেন। সুতরাং সেই সব অঞ্চলে আফস্পা ইনভ্যালিড হয়ে গেল। এভাবে আফস্পা তুলে নেওয়ার পরিবর্তে তাঁরা কেবল কিছু অঞ্চলে সেটাকে সরিয়ে রাখলেন। এখন “আমরা কিছু করেছি” – এই অ্যাক্ট অফ টোকেনিজমের পরে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ইববি সিং যখন হাসপাতালে ইরম শর্মিলাকে দেখতে যান, তখন তাঁরা বলেন এর বেশী আর কি চান? এখন ইম্ফলে আর মানুষ মরছে না। তাহলে আপনি অনশন ভাঙ্গছেন না কেন? তো তিনি বলেন, না, এটা তো কেবল ইম্ফলের সাতটা মিউনিসিপ্যাল অঞ্চলের বিষয় নয়, এটা গোটা রাজ্যের বিষয়। সুতরাং সাধারণ ভাবে বলতে গেলে এখন পর্যন্ত এটাই রাজ্য সরকারগুলি করে চলেছেন। তাঁরা কখনোও সমস্যার মূলে আঘাত করতে উৎসাহী নন। তাঁরা সব সময়ই কোন না কোন রকম টোকেনিজম ব্যবহার করে দেখাতে চান যে তাঁরা তোমার আন্দোলনে রেসপন্ড করছেন।
জীবন রেড্ডী কমিশন রিপোর্টের পর প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং তো এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন। তিনি আফস্পা তুলে নেওয়ার কথাও বলেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। মনমোহন সিং মনিপুরে যান গত নভেম্বরে। ৫ই নভেম্বর ইরম শর্মিলা অনশন শুরু করেন, তারপর থেকে প্রতিবছর সমস্ত সাংবাদিক, সমাজসেবী, চিন্তাশীল মানুষ অনেকটা রিচুয়ালের মতোই ৫ই নভেম্বর সেখানে যান এবং ফিরে এসে আবার এক বছরের জন্যে আমরা ইরম শর্মিলাকে ভুলে যান। আমার নিজেরও এখন এটা ভেবে খুব খারাপ লাগে। তো শেষবার যখন আমি সেখানে গেছিলাম, আফস্পা বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, মনমোহন সিং সেখানে যান, সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করেন কঙ্গনা ফোর্টে। যেখান থেকে রাজারা এক সময় এই অঞ্চল শাসন করতেন, আসাম রাইফেলস এর হেড কোয়ার্টার ছিল এই কঙ্গনা ফোর্টে। কিন্তু সেখানে তিনিও আবার সেই টোকেনিজমই করলেন। তিনি আর্মি হেড কোয়ার্টার কঙ্গনা ফোর্ট থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। এটি গোটা ইম্ফলে অত্যন্ত সংবেদনশীল ঘোষণা ছিল, যে শেষ অবধি আর্মি চলে যাচ্ছে এবং আমরা মুক্ত হতে চলেছি। কিন্তু আসলে কী হল? কঙ্গনা ফোর্টেই রয়েছে মিউজিয়াম অফ ইম্ফল হিস্টরি, সেখানে গেলে গোটা মণিপুরের ইতিহাস দেখতে পাওয়া যায়। সবার শেষে রাখা, কঙ্গনা ফোর্টে মনমোহন সিংহের সেই ঘোষণা। এটা দেখে আমার এক ইউনিট মেম্বার, একদা উত্তর প্রদেশের “ইন্সাফ” কর্মী ভিজিটার্স ডায়েরীতে লিখে এসেছিলেন, “দেশ কা প্রধানমন্ত্রী ভি মিউজিয়াম কা পিস হো গয়া”।
গত বছরেও কেরালা থেকে এই বিষয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে। আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিও কেরালা থেকেই নির্বাচিত। দায়িত্ব গ্রহণের পর একজন হৃদয়বান মানুষ হিসাবে তিনি নিজেও এবিষয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। সেই বছর একটি কালচারাল পলিটিকাল ট্রুপ কেরালায় এ কে অ্যান্টনির কনস্টিটিউয়েন্সি চেরথালা থেকে মণিপুরের ইম্ফল পর্যন্ত পারফর্ম করতে করতে যায় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করে। অ্যান্টনিও সত্যিকারের কিছু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আর্মি থেকে খুব স্পষ্ট করে অলিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, এই আইন যদি তুলে নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যাবে। মানে আমরা আর কিছু করতে পারব না। তাই তোমার জীবন বা অন্য সকল রাজনীতিক-নেতা-মন্ত্রীর জীবনে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। এর পর এ কে অ্যান্টনি বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও কিছু করতে পারলেন না। যদিও আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ, সেনাতান্ত্রিক নয়। দু দুটো কমিশন, প্রথমে জীবন রেড্ডি কমিশন ৫-৬ বছর ধরে বিষয়টি অনুধাবন করে রিপোর্ট জমা দেন, তারপর বীরাপ্পা মইলিও তাঁর রিপোর্ট জমা দেন। যাতে সবার মনে হয় যেন দেশে গণতন্ত্র আছে, যেন সাধারণ মানুষের কথা বলার সুযোগ আছে। প্রধান মন্ত্রী উড়ে আসেন, আর্মি হেড কোয়ার্টার সরিয়ে ইম্ফলের মানুষকে মুক্ত করেন। সংবাদপত্রের শিরোনাম তৈরী হয়, মানুষের ইমোশনকে স্পর্শ করে। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন শুকিয়ে যায়। যতদিন না আবার একটা “মালোম” হচ্ছে, বা তা নিয়ে অন্য কোন ইরম শর্মিলা অনশন করছে। সুতরাং টোকেনিজম যে কেবল সরকারই চালাচ্ছে তা নয়, মানবাধিকার রক্ষা সংস্থা বা আমাদের মতো চিত্র পরিচালকরাও ...
আফস্পা ১৯৫৮ বা সোলজার্স ইনসাইড এর মত ছবি ফেস্টিভ্যাল চত্বরের বাইরে বেরোতে পারে না। দেশে বা দেশের বাইরে হাতে গোনা কয়েকটা ফেস্টিভ্যাল ঘুরেই এগুলোর দৌড় শেষ। বলতে গেলে এও এক ধরনের টোকেনিজম। ফেস্টিভ্যাল আহ্বায়করা এগুলো ফেস্টিভ্যালে রাখেন যাতে করে একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র আবহ তৈরী করা যায়। যেন মনে হয়, গণতন্ত্রে ‘সঠিক পথে’ ওঠা আওয়াজ কেবল যে শোনা হয়, তাই নয়, তাকে তার উপযুক্ত মর্যাদাও দেওয়া হয়। তাই যে রাষ্ট্রপতি গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড দেন, তাঁকেই দেখা যায় উত্তর পূর্বে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সেলুলয়েডে তুলে ধরা এক সংবেদনশীল পরিচালককে পুরস্কৃত করতে। আপাতভাবে গণতন্ত্রের উপস্থিতি প্রকাশ পায়। আফস্পা নামক একটা ড্রাকোনিয়ন আইন চাপিয়ে দিয়ে তারপর নাগরিকদের যন্ত্রনার কথা সহানুভূতির সাথে শোনার জন্য কিছু মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়, স্বীকৃতি দেওয়া হয়, অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। যাতে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে যন্ত্রনাকে আর ততটা যন্ত্রনা বলে মনে না হয়। ঠিক প্রেসার কুকারের মতো। ভিতরের প্রেসার খুব বেশি বেড়ে গেলে কুকার ফেটে যেতে পারে। তাই নজর রাখা হয় যেন কোন ভাবে ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি না হয়। এদিকে আফস্পা-র নাম করে গণহত্যা চলছে, ওদিকে বিশেষ মঞ্চে অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হচ্ছে। ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয় না কারণ, প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে দেওয়াই হয় না। পুরস্কার-স্বীকৃতি প্রদানের এই টোকেনিজম ব্যান করার থেকে বেশি কাজ করে। নাগরিক সমাজের পক্ষে এই দেখনদারি টোকেনিজম এর মোকাবিলা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
শর্মিলার অনশন উপলক্ষে এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার মাঝেমধ্যে বীতশ্রদ্ধ লাগে। কেউ কারো ওপর কোন রকম চাপ সৃষ্টি না করে আমরা শর্মিলাকে পুরস্কৃত করে চলেছি । একান্ন লক্ষ টাকা মূল্যের টেগোর অ্যাওয়ার্ড থেকে শুরু করে যত ধরণের অ্যাওয়ার্ড হতে পারে, সব দেওয়া হয়ে গেছে। সবাই সেখানে একবার যেতে চায়; ওঁর পাশে বসে একখানা ছবি তুলে আসতে চায়। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে শহীদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায়। প্রতি বছর কেবল নভেম্বর মাস এলেই লোকে সেখানে গিয়ে কিছু করবে। শেষবার যখন যাওয়া হয়েছিল, আমার সহকর্মী শ্রী কে পি শশী, ভদ্রলোক নিজেও একজন পরিচালক, এই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমরা কি এরপর আবার একবছর অপেক্ষা করে পরের নভেম্বরে পুনরায় একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, না কাজের গতি একটু বাড়াব?” ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন করেছিলাম মেধা পাটেকরকে, কেরালায় যখন ওনার সাথে দেখা হয়েছিল, তখন ওনাকে বলেছিলাম যে, মেধাজি, আপনি যখন যন্তর মন্তরে ধর্ণায় ছিলেন, আমরাও সেখানে গিয়েছিলাম। গোটা দেশের সংবাদ মাধ্যম সেখানে 24X7 কভার করেছিল আর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে মিনিস্টার পাঠাতে হয়েছিল আপনার সাথে নেগোশিয়েট করার জন্য। কিন্তু শর্মিলার ক্ষেত্রে এমনটা কেন হয় না? আন্না হাজারের ক্ষেত্রেও এরকম হয়েছিল। কিন্তু মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার কাছে ইরম শর্মিলা যেন আফস্পা সেলিব্রেট করার একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। ফ্যাশনের মতো, যেন বাৎসরিক হুজুগ। আমরা কাশ্মীর বুঝি, নর্থ-ইস্ট বুঝি, লোকপাল বুঝি, আন্না হাজারে বুঝি, মেধা পাটেকর বুঝি, নর্মদা বুঝি, সঅঅব বুঝি। কিন্তু আদৌ কিছু বুঝি কি? কারণ সবই তো কেবল ফেস্টিভ্যাল। এক ফেস্টিভ্যালের পর আরেক ফেস্টিভ্যাল। পবনের ছবিটা অ্যাওয়ার্ড পেল। শর্মিলাকে নিয়ে আমরা যে ছবিটা করেছিলাম, সেটাও দেখানো হচ্ছে। লোকে ছবিটার কথা বলছে। এর বেশি কিছু হচ্ছে না। ছবিটা সেন্সর করতে গিয়ে এক অফিসার বলেছিলেন, “এ যখন প্রকৃত বাস্তব, মহাশ্বেতা দেবীর মত প্রবীণ লেখিকাও একথা মেনে নেন, তখন আমি এ ছবি ভারতীয় দর্শকদের দেখতে নিষেধ করি কী বলে?”
ছবিটা যখন প্রথমবার একটা বড় ফোরামে দেখানো হয়, প্রেস কনফারেন্সে এক বিহারী ভদ্রলোক হঠাৎ এই অরাজকতার সঙ্গে বিহারের অরাজকতার তুলনা করতে শুরু করে দেন। কীভাবে সেখানেও মানুষ নির্যাতিত হন। গোটা আলোচনাটাই চলতে থাকে কিভাবে আইনের অপব্যবহারে সাধারণ নাগরিক নির্যাতিত হন। যদিও আমি সেখানে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলাম, এবং আমার কিছু বলার কথা ছিল না, তবু আমি সংশোধন করতে বাধ্য হই যে, এখানে আইনের অপব্যবহারের প্রশ্ন নয়, এখানে একটা গোটা আইনই রয়েছে যার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে চাইছি। আবার যখন লক্ষনৌ এর ছেলে মেয়েদের ছবিটি দেখানো হয়, ছবি শেষ হলে দেখি ওদের সবার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। দেখে আমি নিজেও নিজেকে আটকাতে পারিনি। সুদীর্ঘ বিরতির পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।
কাশ্মীরের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সবাই জানে। ভারত-পাকিস্তানের কাজিয়া, পশ্চিমী স্বার্থ, বিশেষতঃ আমেরিকার ভুমিকা, দুইদেশের রাজনীতি আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। উত্তর পূর্ব ভারত কিন্তু আগে কখনো সেরকমভাবে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়নি। আফস্পা খবরে এসেছে অনেক পরে। মনিপুরের অবস্থা কাশ্মীরের মত নয়। রাজধানী দিল্লি থেকে অনেক দূরে, চীনের কাছে তার ভৌগোলিক অবস্থান। চার-পাঁচ বছর আগেও ইরম শর্মিলাকে নিয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বিশেষ উৎসাহ ছিল না। আর এখন সবাই তাঁর পিছনে। ওখানকার লোকজন, যারা বিচক্ষণ, সত্যিই কথা বলতে চান, এইসব তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে তাঁদের আওয়াজই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটন ডিসির এক অধ্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সেনাবাহিনির ভূমিকা নিয়ে কাজ করেছিলেন। ভদ্রলোকের মতে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মিলিটারির বিকল্প নেই। একই দাবি দেখা যায় মণিপুরেও। রোজকার কাগজ পড়লেই টের পাওয়া যায়। ইম্ফলের কাগজগুলোয় সর্বত্র সেনাবাহিনির কথা। সেনাবাহিনি পানীয় জলের ব্যবস্থা করছে, নতুন কমিউনিটি সেন্টার গড়ে দিচ্ছে, আন্টি ভেনোম ওষুধ পৌছে দিচ্ছে, টিভি বিতরণ করছে – এ সবই গত চার পাঁচ বছরে মোটামুটি সরকার সমর্থিত প্রতিচ্ছবি। খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি। কিন্তু মূল প্রশ্নটা থেকেই যায়, কোন রাজনৈতিক সমস্যা কি আর্মি দিয়ে সমাধান করা সম্ভব? এ প্রশ্নের কিন্তু কোন উত্তর মেলে না। আসলে সিস্টেম যেটুকু করছে, তা কেবল একটা রাজনৈতিক সমস্যাকে লঘু করে প্রশাসনিক ইস্যু হিসাবে দাঁড় করানোর জন্য। তাই সেনাবাহিনিকে আর যোদ্ধা বা খুনে হিসাবে দেখানো হয় না। কাগজের প্রথম পাতা কিন্তু আর্মির ছবি আর খবরেই ভর্তি। আর্মি আর অসম রাইফেলস। তাঁরা রক্তদান করছেন বা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করছেন –এইসব। এবং খুব সুচিন্তিত ভাবে পুরো সমস্যাটাকে একটা নিছক প্রশাসনের ঘটনা বলে দেখানো হচ্ছে। উর্দি পরা এইসব গুড সামারিটানেরা তৃষ্ণার্থকে পানীয় জল দিচ্ছেন বা সাপে কেটে মরতে বসলে কেউ সেখানে ওষুধ পৌছে দিচ্ছে। সুতরাং এ সবই খুব শুভ উদ্যোগ।.
শ্রুতিলিখন ,অনুবাদ: পবিত্র ভট্টাচার্য , অরূপ কেশরী ও দীপ্তেন
সহায়তা: সুমেরু মুখোপাধ্যায়