মণিপুরী সিনেমা বানানোর মধ্যে দুটো ভাগ আছে। এক হলো রাজনৈতিক ছবিটা তুলে ধরা, আর দুই, তাকে রূপ দেওয়া সিনেমার। এটা বলতেই হবে যে হয়তো দুটো ভাগই সব সময় ঠিক 'সুক্ষ্ম'ভাবে করে ওঠা যায়না। বাস্তবকে তুলে ধরার কাজটা অনেক সময়েই খুব 'শৈল্পিক' হয়না। কিন্তু আমি সেই জিনিষটাই করতে চাই। হয়তো তার জন্য বাস্তব ঘটনাগুলোকে কোন রূপকের মাধ্যমে দেখাতে হবে। তাতে অসুবিধা তো কিছু নেই। একটা সেনাবাহিনির কথাই ধরুন, এই যে তার গড়ে ওঠা, এই যে তার মধ্যে ভালোমন্দ মানুষ... কারু হয়তো লোকের বুকে গুলি চালতে হাত কাঁপেনা, কেউ হয়তো লোককে বাঁচানোর জন্যই হাতে বন্দুক নিয়েছেন .... এই সবাইকে নিয়ে যখন শিল্প তৈরি হবে তখন ক্যামেরার লেন্স আর প্রিজমের মধ্যে দিয়ে অনেক কিছুকেই এমন ভাবে আঁকতে হয় যার সাথে কাঁচাকাঁচা বাস্তব ঠিক এক নয়। মানে আমি বলতে চাইছি 'ফর্ম'এর কথা। এই 'ফর্ম' জিনিষটা আসলে ভিজুয়াল বা অডিও-ভিজুয়াল শিল্পের ক্ষেত্রে খুব জরুরী। সাহিত্যে কিন্তু এ জিনিষটা সেভাবে না থাকলেও ক্ষতি হয়না। ভাষা, শব্দ এরা যেকোনো ফর্ম এর সীমা টপকেও একটা ছবি ঠিকই তুলে ধরতে পারে। কিন্তু অডিও-ভিজুয়াল শিল্পে দৃশ্য আর আওয়াজ দুটোই রূপ পরিগ্রহ না করলে তার কোনো মানে থাকেনা। এবার সেই 'ফর্ম' কেমন হবে সেই নিয়েই আমাদের একটু অন্যভাবে ভাবার সময় এসেছে। চিরাচরিত রাস্তা দিয়েই সব সময় হাঁটতে হবে তার তো কোনো মানে নেই? আমারা এতদিন তো মনে হয় যে সিনেমার যে ভাষা আমরা এতদিন ধরে ব্যবহার করে আসছি সেটা নেহাতই পুরনো হয়ে গেছে।
এই যে মণিপুরের কথা বলছি এখানে রাতদিন লোকগুলোর ঘাড়ের ওপর শুধু বন্দুকের নিঃশ্বাস, যেকোনো লোক যেকোনো সময় গুলির সামনে পড়ে যেতে পারে। ওরা ভোট দিতে যায়, কিন্তু তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক ভাবনা নেই। ওরা ভোট দেয় আঙুলে ঐ বেগুনী কালির দাগটুকু পাওয়ার জন্য। ঐ দাগ দেখলে সেনাচৌকি ওদের ছেড়ে দেবে, বিপ্লবী বলে সন্দেহ করবেনা। ঐ বেগুনী কালির দাগটুকু ওদের গুলি থেকে বাঁচাবে। এই লোকগুলোর গল্প সারা দেশের অন্য সবার গল্পের থেকে আলাদা। এবার সিনেমা বানানোর সময়ে এই গল্পটা,এর ভেতরের যত দ্বিধা, যত টানাপোড়েন তা আমরা তুলে ধরবো কেমন করে? একেক সময়ে মনে হয় যেভাবেই দেখাতে যাই না কেন, আসল ছবিটা কিছুতেই ফুটে ওঠেনা। মনে হয় আমাদের চেনা যত রকম পদ্ধতি আছে কোনটা দিয়েই ঐ ব্যথা-ভয়-কষ্ট গুলো তুলে ধরা যাচ্ছেনা। তখন নিজের ভেতরকার শিল্পী সত্বাটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আমি একটাই উত্তর পাই -- এই আসল ছবি তুলে ধরতে গেলে অচিরাচরিতের রাস্তাতেই হাঁটতে হবে। সেটা যদি সাধারণের চোখে 'পলিটিকালি ইনকারেক্ট' হয় তো তাই সই। হলিউড বা বলিউডের আর পাঁচটা ছবির মতো করে এগোলে এ গল্পের সাথে অবিচার করা হবে। এই যে আমি এখানে রয়েছি, এত কাছ থেকে লোকগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, এদের সুখ-দুঃখ-ভয়- ব্যথা চোখের সামনে রয়েছে, এই অঞ্চলের এই সত্যিগল্পকে সবার কাছে তুলে ধরতে গেলে আমাকে অন্যরকম ভাবেই ভাবতে হবে। আবার সাধারণ সিনেমা দর্শকরাও যাতে এ ছবি দেখতে উৎসাহ পান সেটাও মাথায় রাখা দরকার, সেইভাবে বানাবো কি করে তা বুঝতে পারছি না। সেটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। মেনস্ট্রীম ছবি হলে আমি জানি লোকে দেখবে, অর্থাৎ ছবি বিক্রী হবে ভালো, বাজারে কাটবে। এখন আমাকে এই পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সত্যিগল্পকে এমন একটা রূপ দিতে হবে যাতে লোকে দেখে। আমি বাজার নিয়ে চিন্তা করিনা, কিন্তু মানুষের এই ঘটনাগুলো দেখা দরকার।
পবনের পরে এই এলাকা থেকে আর কারুর প্রতিবাদ বা বক্তব্য কিছুই আর শোনা যাচ্ছেনা। এর কারণ কি রাজ্যের স্বার্থপরতা? নাকি কেউ গলা তুললেও তা চেপে দেওয়া হচ্ছে। দেশে আজ হাজারটা ভিডিওটেপেই দেখা যায় লোকজনের বক্তব্য সাধারণের সামনে তুলে ধরার অসুবিধে নেই। এই 'ইউটিউবে'ই কত জন নিজেদের কত কথা তুলে দেন। তাহলে এই এলাকার গলার আওয়াজ কেন শুনতে পাইনা?
পবনের সিনেমা দেখতে বসলে রাগে- দুঃখে চোখে জল আসবেই। এতে তো অত্যাচার, রক্তারক্তি, মানুষের যন্ত্রনা সবই খোলাখুলি দেখানো হয়েছে। অবশ্য এই দৃশ্যগুলো সিনেমার ক্যামেরাম্যানরা তোলেননি। অনেকগুলো সাংবাদিক চ্যানেলের ক্যামেরায় তোলা ফুটেজ সব। কিন্তু 'সিনেমা' বানাতে গেলে একজনকে তো নির্দেশকের পদটা নিতেই হবে, তাই পবন সেই জায়গাটা নিয়েছেন। তবে আমি বলতে বাধ্য হবো যে এ সিনেমায় কল্পনাশক্তির অভাব আছে। এখানে খুনোখুনি, রাষ্ট্র আর অ্যাফস্পার গুলিতে মানুষের ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া এসবই বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটা অন্যদিকও তো ছিলো। ইরম শর্মিলার কথাই যদি ধরি। ইরম শর্মিলার যে মণিপুর রাজ্যের প্রতি একসাথে পরম ভালোবাসা আর চরম ঘৃণা দুটোই ছিলো তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দেখানোর সময়ে রাজ্যের হাতে অত্যাচারিত শর্মিলাই প্রাধান্য পান; ওঁর ভালোবাসার গল্পটা হারিয়ে যায়। কেমন যেন মনে হয় আমরা ওঁর জীবন্ত সত্বাটাকে দেখতে চাইনা, বরং ওঁকে শহীদ ক'রে দেখানোতেই আমাদের আগ্রহ বেশি।
এখানেই শিল্পীর ব্যর্থতা। এখানেই শিল্পীর ব্যর্থতা। আবার এইই শিল্পীর কাছে চ্যালেঞ্জ। এখানে এসেই নিজের কল্পনাশক্তিকে প্রশ্ন করতে হয় যে কিভাবে বাস্তবকে ফিল্মে বন্দী করা যায়, যাতে যেটুকু চোখে দেখা যাচ্ছে তার পেছনের গল্পটাও ফুটে ওঠে। পবনের এই সিনেমাটা, 'অ্যাফস্পা ১৯৫৮' যদি দেখেন দেখবেন সেখানে পুরো দু'ঘন্টার মধ্যে একবারও সত্যিকার 'আর্মি'র কাউকে দেখানো হয়নি। এই যে গোলাগুলি বা খুনজখম করছেন ব'লে যাঁদের দেখানো হয়েছে তাঁরা সবাই মণিপুরের কম্যান্ডো দলের লোক। আমার মনে প্রশ্ন জাগে এটা কি সত্যিই হয়েছিলো? কম্যান্ডোরা তো অ্যাফস্পার আওতায় পড়েননা। আমরা সবাই সহজেই বিদ্রোহী-দমন আর ভায়োলেন্সের সাথে কম্যান্ডোদের কার্য্যকলাপ মনে মনে এক করে ফেলতে পারি। তাই হয়তো এখানে তাদের দেখানো হয়েছে। ইম্ফলে যত জায়গায় ছবিটা দেখানো হয়েছে কোথাও আর্মি কোনো আপত্তি করেনি। করবেই বা কেন, সমস্তটাই তো কম্যান্ডোদের ওপর দিয়ে চালানো হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারিনা এমনটাই হয়েছে। তবে দেখে মনে হয় হয়ে থাকতেও বা পারে। এই বিষয় নিয়ে এটাই প্রথম ছবি, কাজেই আমি কখনোই এর প্রয়াসকে ছোট করে দেখাতে চাইনা। কিন্তু আর্মির কাউকে দেখা গেলনা এতে আমার একটু ধন্দ লেগেছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে ছবিটা বানানোর সময়ে নির্দেশক কি নিজের কল্পনাশক্তি বা ক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাননি?
মণিপুর নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক সিনেমা বানিয়েছিলেন লোগেন্দ্র। উনি সিনেমাটাকে রাজনৈতিক নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা আদ্যন্ত শুধু রাজনীতিই ছিলোনা। এই ধরণের কাজ উনিই একমাত্র করে দেখিয়েছেন। আমি মনে করি যে এই রাজনীতি ভিত্তিক ফিল্মে আতংক, গোলাগুলি, উগ্রতা এসবের মধ্যেও রঙীন, সুরেলা, ছন্দময় যে মণিপুর আছে তাকে উপেক্ষা করলে চলবেনা। আমার মনে হয় তাহলে সে ফিল্মের প্রযোজনা করতে 'ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা' বা 'মিনিস্ট্রি অফ কালচার' বা 'হোম মিনিস্ট্রি' পিছপা হবেন না। তার মানে অবশ্য এ নয় যে হোম মিনিস্ট্রির সেক্রেটারী এসব সিনেমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাঁচি চালাবার ছুতো খুঁজে বার করলে আমার খুব ভালো লাগবে। আমি এটুকুই বলতে চাই যে একজন শিল্পবোধ সম্পন্ন নির্দেশক, কি নাট্যকারের এমন ভাবে বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন যাতে সে ছবি বা নাটাকটা বানানোর জন্য পয়সা দিতে কেউ এগিয়ে আসবেন।
এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, সংকটটা কি কল্পনাশক্তির, নাকি প্রদর্শনকামিতার? সংকটটাকে বাজারে বিক্রি করার সংকট? যেরকম সিরিয়াতে হল? আপনাকে যদি একটা 'রানী এলিজাবেথ' কিংবা 'ইরম শর্মিলা' বানাতে বলা হয়, সেটা আপনি কিভাবে করবেন? এর উত্তরে আমি একটাই কথা বলব, 'অন্যরকম' হতে গিয়ে আপনাকে পলিটিকালি ইনকারেক্ট হতে হবে এমন নয়। কিন্তু আলোচনাতেই হোক বা সিনেমায়, আপনাকে এই পুনরাবৃত্ত হয়ে চলা বিতর্কের চলার পথটাকে ভাঙচুর করতে হবে। যেমন ধরুন, আমি জানিনা এটা ছাপার অযোগ্য কিনা, যেকোনো ভাষার যেকোনো সিনেমাতেই যদি আপনি শরীরী দৃশ্য দেখান, তবে দেখানো ছেলেদেরই হোক বা মেয়েদেরই, যেকোনো যৌনাঙ্গেরই একটা চালু নাম থাকবে। কিন্তু আফস্পা যুগে, যদি এটা মণিপুরে বানানো হয়, তাহলে কোনো একটা যৌনাঙ্গের নাম বদলে দিয়ে আফস্পা করে দেওয়া যেতে পারে। এবং এইভাবে গোটা জিনিসটাকে একটা অভিজ্ঞতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এটা শুনে শুরুতে আপনি চিৎকার করে উঠতে পারেন, কিন্তু এটাকেই আমাকে বা আপনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। কারণ, আপনাকে প্রত্যাশিত উপস্থাপনার বাইরে যেতে হবে, কারণ আপনি এখানে অন্যান্য ফিল্ম বানিয়েদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ পাচ্ছেন না, চ্যালেঞ্জটা পাচ্ছেন একদম করকরে বাস্তব থেকে। অন্যান্য ফিল্ম নির্মাতাদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ এলে আপনি প্রতিযোগিতা করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতার কাছ থেকে এলে?
শ্রুতিলিখন, অনুবাদ, সহায়তা ঃ পবিত্র ভট্টাচার্য, অরূপ কেশরী, সুমেরু মুখোপাধ্যায়