১৭-ই মে রাজ্যের নন-বোড়োগ্রুপের একটা জোটের পক্ষ থেকে বন্ধ ডাকা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দিনটা রজনী ফুকানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রজনী “সুমা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড”-এ চাকুরি করতেন। এই সুমা এন্টারপ্রাইজ এবং আরও তিনটি কোম্পানি- এল.এন্ড.টি., অ্যালস্টম আর টেক্সম্যাকো কে এন.এইচ.পি.সি দুই হাজার মেগা ওয়াটের নিম্ন সুবনসিড়ি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মানের বরাত দিয়েছে। ঠিক আগেরদিন ফুকান ও তাঁর ৪৬২ জন সহকর্মী একসাথে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবতঃ সেদিনই তাঁদের প্রাপ্য টাকা পয়সা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ মিটে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ এর পরে গেলে আর প্রোজেক্ট সাইটে সম্ভাব্য প্রবেশের উপায় থাকত না। ফুকান শুরু থেকেই বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক আবার অক্লেশে একথাও স্বীকার করেন চাকরীটা তাঁর প্রয়োজন ছিল। হয়তো বাঁধটারও। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে।
৫২ নম্বর জাতীয় সড়কে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র যানবাহন চলছিল। যে কয়েকটা মাত্র চলছিল, সেগুলোও যথা সম্ভব পুলিশ আর সি.আর.পি.এফ. এর নজরদারীতে। সেদিন হাইওয়ের সবুজ আর নীল রঙ যেন খাঁকিতে চাপা পড়ে গিয়েছিল। একটু বড় বস্তা কাঁধে ছোট ছোট ছেলেরা রাস্তা দিয়ে গেলে তাদেরকেও আটকানো হচ্ছিল। খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে। কারণ, অন্যান্য দিন অনেক বড় বড় বস্তা বয়ে নিয়ে গেলেও এইসব বাচ্ছা ছেলেদের আটকানো হয় না। খুব সম্ভবতঃ এইরকম বন্ধের দিনে ছোট ছেলের সারল্যের ওপর বিশ্বাস করার চেয়ে সাধারণ দিনে শিশুশ্রমকে হজম করা অনেক বেশি সহজ।
হাইওয়ের ১০ কিলোমিটারে যে চারটে পেট্রোলপাম্প ছিল, সেগুলো অর্ধেক খোলা। প্রবেশ পথে লম্বা বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে, ব্যবসা বন্ধ আছে তা বোঝাতে। আমার সঙ্গে গাইড হিসাবে যে ছাত্রটি ছিল, সে যাতে সি.আর.পি.এফ. এর খপ্পরে না পরে, তাই আমরা ভায়া ঘাগর হয়ে না গিয়ে অন্য একটি পথে গেলাম। কুড়ি কিলোমিটারের সেই যাত্রাপথ অসম্ভব সুন্দর। দূরে অরুণাচল প্রদেশের পর্বতমালা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে আছে, আর তার মাঝে দুই পাশ থেকে হেলে পড়া বাঁশের ছায়ায় ঢাকা পথে আমরা এগিয়ে চলেছি!
অবশ্য এই পথেও পাহারা কিছু কম ছিল না। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা গোডাউন আর প্রায় পঞ্চাশটার মতো বৃহদাকার ধাতব বলয় চোখে পড়ল। ড্যামের জন্য এনে রাখা নির্মানসামগ্রী। লোহার তৈরী এক বিশাল কাঠামো পর্বতের পটভুমিকায় রাখা।
রজনী ফুকান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সঙ্গে কোন এক শ্রমিক সংগঠনের সেক্রেটারি জীবন বড়া। দুজনেই বিগত সতেরো বছর ধরে বিভিন্ন ড্যাম কন্সট্রাক্সন সাইটে কাজ করে আসছেন। লখিমপুরে রঙ্গনদী ড্যাম নির্মান দিয়ে শুরু। ফুকান বললেন, “২০১১-র ডিসেম্বরে রেসিস্ট্যান্ট মুভমেন্টের পর এখানে প্রায় কোন কাজ নেই। নির্মানের কাঁচামাল এসে পৌছাচ্ছে না। কোম্পানিও ধীরে ধীরে রবিবারের বেতন আর ওভারটাইম দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আমরাও বুঝতে পারি বর্তমান অবস্থায় প্রোজেক্টের হাল ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। সেজন্যেই আমরা কাজ ছেড়ে দেব স্থির করি।” দুইমাস আগেও এল.এন্ড.টি. থেকে প্রায় পাঁচশ জন কর্মী ঘরে ফিরে যান। ফুকানের কথা অনুযায়ী এন.এইচ.পি.সি তে এখন হাতে গোনা কয়েকজন বাকি আছেন।
আমরা নিম্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মূখ্য কার্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে কিছুক্ষন ঘুরে এলাম। প্রধান ফটকের লেখা অনুযায়ী এটি একসময় ছিল “কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় হাই স্কুল”। যদিও এখন আর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। একটা সাইনবোর্ডে দেখানো আছে শপিং কমপ্লেক্স, ব্যাঙ্ক, রেসিডেন্সিয়াল কোয়ার্টার ইত্যাদি যাওয়ার পথনির্দেশিকা। সোমা এন্টারপ্রাইজের গেটে দেখলাম কয়েকজন বয়স্ক গার্ড দাঁড়িয়ে আছেন। বড়া বললেন, সব নির্মান সা্মগ্রী ওখানে মজুত থাকে। চারপাশ থেকে উঁচু পাঁচিল আর কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। কিছুক্ষন আগে আসার পথে যেরকম ধাতব বলয় দেখেছিলাম সেরকমই কিছু ধাতব বলয়ের উপরের অংশ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল।
এন.এইচ.পি.সি অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফেরা সবাই স্থানীয় ছেলে-মেয়ে। কিন্তু পরিচালন ক্ষমতা প্রধানতঃ অভিজ্ঞ লোকাদের হাতে যাঁরা স্থানীয় নন। ফুকান আমার সাথে প্রোজেক্টের জিওফিসিক্স বিভাগের প্রধান এস.মুরুগাপ্পনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রলোক আমাকে সেখানকার টি এস্টেটের কফি অফার করেন। তিনি অন রেকর্ড আমার সাথে আলোচনা করতে পারবেন না বললেন। বললেন, সদ্য ঠিক করা হয়েছে, একমাত্র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ছাড়া কেউ সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলতে পারবেন না। বলতে গেলে ফরিদাবাদে এন.এইচ.পি.সি-র প্রধান অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে। তিনি বললেন, “তাও আপনি যখন এত দূর থেকে এসেছেন, আমি কিছু বিষয় আপনাকে বোঝাতে পারি, তবে কিছু নোট ডাউন করতে পারবেন না”। প্রকল্পটি কারিগরি দিক দিয়ে কতটা উন্নত ছিল তা বোঝাতে ভদ্রলোক যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন; কিভাবে এটি সমগ্র এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম ড্যাম হতে পারত, কেন ভাকরা-নাঙ্গাল ড্যাম-কে পন্ডিত নেহেরু “আধুনিক ভারতের মন্দির” বলে অবিহিত করেছিলেন ইত্যাদি। এন.এইচ.পি.সি-র বিভিন্ন প্রকল্প সমন্ধে একগাদা ব্রোসিওর-এ ভরিয়ে দিলেন। তারপর তাঁর জনসংযোগ আধিকারিক মিস্টার টপ্পো কে বললেন আমাকে প্রোজেক্ট সাইটে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। যাতে আমি ভালো করে বুঝতে পারি, কেন এই প্রকল্প “অত্যন্ত প্রয়োজনীয়”।
মুরুগাপ্পনের গাড়িতে করে আমরা বেরোলাম। কিছু দূরে একটা চড়াই এর মতো যায়গায় এসে থামি। কাঁটা তারের বেড়ার ওপাশে নদীর ওপারে একটা বিশাল পাথর ভাঙ্গার মেশিন দেখা যাচ্ছিল, এপারের সাথে কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে যুক্ত। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে বড়ো বড়ো পাথর কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়। টপ্পো হেঁসে বললেন, “ডানদিকে অনেক দূরে সবুজ রঙের যে ছোপটা দেখতে পাচ্ছেন? ওখানে এন.এইচ.পি.সি. সবুজায়ন করেছে।” তারপর হঠাৎ জিগ্যাসা করলেন, “আপনারা কোন এন.জি.ও. থেকে আসেন নি তো?” আমি ভদ্রলোককে আস্বস্ত করি যে, না আমি একজন সাংবাদিক মাত্র। কোন এন.জি.ও. থেকে নই। টপ্পো নিজেও নাকি তাঁর গনসংযোগ জীবনের শুরু করেছিলেন দুটো এন.জি.ও. দিয়ে। তারপর বুঝতে পারেন কাজটা খুব একটা লাভজনক নয়। দুই বছর আগে তিনি এন.এইচ.পি.সি. জয়েন করেন। প্রকল্প সমন্ধে ভালো করে বুঝতে এবং সাংবাদিকদের জন্য এই রকম গাইডেড ট্যুর করার মতো যায়গায় আসতে তাঁর ছয় মাস লেগেছিল।
কয়েক মিনিট পরে আমরা যখন মনোরম পথ দিয়ে [এক সময় এখানে নাকি ঘন জঙ্গল ছিল] আরো উপরে যাচ্ছি যেখান থেকে ড্যাম কন্সট্রাকশন ভালো করে দেখা যায়; সি.আই.এস.এফের একটা চেকপোস্টে আমাদের আটকানো হয়। অবশ্য টপ্পোকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ছেরে দেয়। কংক্রিটের কন্সট্রাক্সন ক্রমশই আরো বিশাল হয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে সুবনসিড়ি নদী দেখা গেল। দূরে পর্বতমালা একের পর এক সাজানো আছে। আর তাদের পায়ের তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে সুবনসিড়ি! তারপর আমরা ড্যামের ভিউ পয়েন্টে পৌছলাম।
সে কি ভয়ঙ্কর বিশাল কাঠামো। একদিকের পাহারে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। সম্মুখে আরেকটা পাহার আর মাঝখানে একটা লম্বা লাল রঙের ক্রেন। অনেক নিচে একটা প্লাটফর্ম তৈরী করা হয়েছে, কিছু লোকও আছে সেখানে। এত উপর থেকে ওদের পিঁপড়ের মতো ছোট দেখাচ্ছে। ডানদিকে একটা টানেল তৈরী করা হয়েছে যার মধ্য দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। দুই পাহারের মাঝের দূরত্ব অর্থাৎ নদীর আসল বেধের তুলনায় টানেলের বেধ নগন্য। আর বাঁ দিকে এক কোনে নদী সবেগে বেড়িয়ে আসছে –ওটা হল “এক্সিট পয়েন্ট”।
টপ্পো বোঝালেন, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার নইচে রাখা টানেলের মধ্য দিয়ে নদীর দিক ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। “আসলে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই ড্যামটার বেড়নোর কথা ছিল- পুরো ১১৬ মিটার দীর্ঘ। কিন্তু তারপর সবকিছু শুধু কল্পনাতেই থেকে গেল। ভয়টাও তো কল্পনাই। এখন আমি যদি লোককে ডেকে বলি এই পাঁচিল নিরাপদ; ওরা তাও ভয়ে ভয়ে হাঁটবে, যেন এখুনি ভেঙ্গে পড়ল বলে! তা বলি, ভাঙ্গবেটা কি করে? এটা হল শক্ত ইস্পাত! একইভাবে লোকে ঠিকই করে নিয়েছে, যে ড্যাম থেকে তাদের ক্ষতি হবে। যেন এখুনি একটা ভুমিকম্প হবে আর ওমনি গোটা ড্যামটা হুরমুরিয়ে ভেঙ্গে পরবে! যতসব আজগুবি চিন্তাভাবনা!” টপ্পো হেঁসে উঠলেন।
প্রধান ড্যাম তৈরী হচ্ছে ধাপে ধাপে বিশাল আকারের স্ল্যাব দিয়ে। দূর থেকে পাথর ভাঙ্গার যন্ত্রটা দেখা যায়। বালি আর সিমেন্টের মন্ড কনভেয়ার বেল্ট আর ক্রেনের মাধ্যমে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। টপ্পোর কথা অনুসারে, এটি অত্যন্ত অভিনব ক্রেন, এগুলো বৃত্তাকার পথে ঘোরে যাতে মালমশলা সহজে ড্যামের যে কোন যায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
উনি আমাকে আটটা টানেলের গেট দেখালেন যা দিয়ে জলপ্রবাহ হওয়ার কথা ছিল। টানেল গুলি বাঁদিকে অনেক দূরে পাহেরের অন্য দিকে একটা পাওয়ার গ্রিডের সাথে যুক্ত। নদীর জল উপরে উঠে টানেলের মধ্য দিয়ে গিয়ে স্যাফটের উপর চাপ সৃষ্টি করবে যা থেকে টারবাইন ঘুরবে আর তা থেকে কিনা তৈরী হবে বিদ্যুৎ।
আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম মানুষের কারিগরী দক্ষতার সম্ভবনার কথা। দেখছিলাম, বিশাল সবুজ প্রকৃতির মাঝখানে ভিনগ্রহী মনে হওয়া ধূসর কংক্রিটের কাঠামো। পাখীর ডাককে চাপা দিয়েছে মেশিনের তীব্র শব্দ। প্রায় আধঘন্টা ছিলাম সেখানে। “আপনাকে এবার পাওয়ার হাউস দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি”, টপ্পো বললেন। “প্রগতি সেতু” নামক একটা ব্রীজের উপর দিয়ে গাড়ীটা পৌছালো পাওয়ার হাউসের পাশে। প্রায় সবকটা বিশাল আকারের লোহার যন্ত্রই হলুদ - এল.এন্ড.টি. –র রং। টপ্পো আমাকে ভিতরে এক যায়গায় নিয়ে যান যেখানে প্রেসার স্যাফট এর বিভিন্ন অংশ জোরা লাগানো হচ্ছিল। প্রেসার স্যাফট টারবাইনের অংশ বিশেষ। একই রকম প্রেসার স্যাফটকে ২০১১-র ডিসেম্বরে লখিমপুর থেকে গেরুকামুখ নিয়ে যাওয়ার পথে টারবাইন ভেবে ভুল করা হয়েছিল। সেই বিরোধিতা থেকেই আন্দোলন আকার নেয় এবং চেকপোস্ট, ঘাগরে প্রোটেস্ট ক্যাম্প ইত্যাদি তৈরী হয়। প্রায় সাড়ে চার মাস যাবৎ সেই আন্দোলন নির্মান সামগ্রীর যোগান আটকাতে সফল হয়।
“লোকে এত অবুঝ, একটা সামান্য প্রেসার স্যাফটকে টারবাইন ভেবে অহেতুক ঝামেলা শুরু করে দিল”। চারতলা পাওয়ার হাউজের গোটাটাই মেশিনে ভর্তি। কিন্তু সেগুলো অপারেট করার কেউ নেই।“কোন কাজ নেই বলে সকলকে চলে যেতে বলা হয়েছে। এখন এখানে শুধুমাত্র সিকিউরিটি গার্ডরা আছে”, টপ্পো বললেন।সিকিউরিটি গার্ডেরা সব বয়স্ক অসমীয় পুরুষ। এক কোনে ওঁদের টিফিন বাক্সগুলো রাখা আছে। আমরা চলে গেলে ফুরসুৎ পেলে খাবেন বলে।
তারপর একসময় আমরা এন.এইচ.পি.সি-র অফিসে ফিরে এলাম। সাইট ট্যুরের জন্য মুরগাপ্পনকে ধন্যবাদ জানাতে যাব, তার আগেই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, “তাহলে, কেমন বুঝলেন?”