গত কয়েকদিন ধরে আসামের উত্তর অঞ্চলের বাসিন্দারা সাক্ষী হয়ে চলেছেন রাজ্য পুলিশ এবং সিআরপিএফ এর দমননীতির। এই দমননীতি বাঁধ বিরোধী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য। উক্ত বাঁধটি ২০০০ মেগাওয়াটের লোয়ার সুবনসিরি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট, তৈরি হওয়ার কথা আসাম-অরুণাচল প্রদেশের বর্ডারে।
মে ১১ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় এনএইচ ৫২র কাছে ঠেকেরাগুড়ি গ্রামে এনএইচপিসি-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি ১১০০০ লিটার ডিজেল সমৃদ্ধ ট্যাঙ্কারের সামনের অংশে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা ঘটে সুবনসিরি নদীর ব্রিজ ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে। এই ব্রিজটা পড়ে আসামের লখিমপুর জেলায় আর লাগোয়া ধেমাজি জেলার ২-৩ কিমি আগে। নদী পেরোলে বাম দিকে যে পর্বতশ্রেণী দেখা যায়, সেটা পড়ে অরুণাচল প্রদেশে।
একই সন্ধ্যেবেলায় ঘাঘোরে একটা চেকপোস্ট ও একটা বিরোধী ক্যাম্প ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ঘাঘোর এনএইচ ৫২র ওপরেই পড়ে, ব্রীজের কয়েক কিলোমিটার আগে। রাস্তা যেটা বাঁদিকে দু’ভাগ হয়ে গেছে, সেটা সোজা চলে গেছে গেরুকামুখ (ধেমাজি জেলার অন্তর্গত)। গেরুকামুখ ২০০০ মেগাওয়াটের লোয়ার সুবনসিরি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্টের কন্সট্রাকশন সাইট এবং প্রজেক্ট হেড কোয়ার্টার। এই চেকপোস্ট এবং ক্যাম্পটি যৌথভাবে আটটি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী সংস্থা জানুয়ারি ২০১২-তে তৈরি করে গেরুকামুখে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন বন্ধ করার জন্য একটা বিশাল গণ আন্দোলনের পরে পরেই।
মে ১১ তারিখ রাত্রে এবং পরের দিন সকালে ট্যাঙ্কারে আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১৪ জন পুরুষ ও মহিলাকে মারধর করে ও গ্রেফতার করে। একটা ১৩ বছরের ছেলেকে বারবার মাথায় মারা হয় এবং দু’ঘন্টা ধরে আটকে রাখা হয়। পরের দিন আরও কয়েকজনকে মারধর করা হয় ও গ্রেফতার করে টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মে ২০ তারিখ সকাল পর্যন্ত মোট ২৩ জনকে গ্রেফতার করি হয়। পাকা খবর হল এর মধ্যে প্রথমে গেফতার হওয়া ১৪ জনের বিরুদ্ধে আইপিসি ১২০বি (ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি), ১৪৯ (বেআইনি জনসমাগম), ৩৮৪ (এক্সটরশন), ৪২৭ (সম্পত্তির ক্ষতিসাধন) এবং ৪৩৫ (অগ্নিসংযোগের দ্বারা ক্ষতিসাধন) ধারা লাগানো হয়েছে। শেষের তিনটে জামিনযোগ্য অপরাধ হলেও ১২০ব ধারাটি অনেক বেশি কড়া। যে সমস্ত মহিলা এবং পুরুষ গ্রেফতার হয়েছেন তাঁরা হয় পেশায় চাষি, নয়ত ছাত্র বা দোকান বা ধাবা চালানো ছোট ব্যবসায়ী।
গত কয়েকদিন ধরে আমি আন্দোলনকারীদের, বিভিন্ন উপজাতির স্থানীয় নেতা, অভিযুক্তদের পরিবার, এনএইচপিসির পদস্থ কর্মচারী, পুলিশ আধিকারিক, এমনকি জেল হাজতে বন্দিদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এই লেখাটা চলার সময়ও দমননীতি চলছে – আরও ৪ জন, যারা ২০ তারিখ থেকে অনশন শুরু করেছিলেন, তাঁদের সিআরপিসি-র ১৪৪ ধারা অমান্য করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এর পরের কয়েকটি রিপোর্টে গত কয়েকদিনের সরকারী নিপীড়নের থেকে যা কিছু বোঝা গেছে সেটা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করব।
--x--
আজাদ হাজারিকা উত্তর লখিমপুর টাউনে একটা হেলথ ক্লাব চালান। লোয়ার সুবনসিরি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্টের বিরোধীতা করার জন্য আসামের মানুষকে ডাক দিয়ে যে সভাগুলো হত সেগুলোয় যাওয়া শুরু করেন এবং ২০১১র ডিসেম্বরের প্রতিরোধের সময় যখন এনএইচপিসি টার্বাইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রজেক্ট সাইটে পাঠানোর চেষ্টা করে, তিনি সেই বিরোধীদের একজন ছিলেন যারা কোনোরকম নির্মাণ সামগ্রীর সাইটে যাওয়া আটকাতে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। আজ অলিখিতভাবে তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগকারী হিসেবে কাজ করেন। আর সেটা এমন একটা সময়ে যখন জনগনের মধ্যে খবর প্রচার করাটা এই আন্দোলনের সবথেকে জরুরী অংশ হয়ে উঠেছে।
তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী এবং বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আটটি যৌথ সংস্থার মধ্যে অলিখিত চুক্তি হয় যে ডিজেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলোকে শুধু কুড়ি দিনে একবার গেরুকামুখের প্রকল্প স্থলে যেতে দেওয়া হবে। প্রকল্প স্থলে একটা নির্দিষ্ট পরিমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখার জন্য এই ডিজেল প্রাথমিক জ্বালানী হিসেবে প্রয়োজন। যে সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শেষমেশ ট্যাঙ্কারে আগুন লাগানো হয়, তার একটা প্রেক্ষাপট হাজারিকা সাহেব আমাদের জানানঃ
“আটটি সংস্থা তখন ‘বড় বাঁধের নির্মাণ সামগ্রী অবরোধ (Big dam’s construction material blockade)’ ক্যাম্প তৈরি করে এনএইচ ৫২র ওপর ঘাগোরে। এখানের চেকপোষ্টে সবসময় চারজন ছেলে পাহারা দেবে, যারা বাঁদিকের রাস্তা ধরে গেরুকামুখে প্রোজেক্ট সাইটে যাওয়া সব গাড়ির চালান পরীক্ষা করে দেখবে। যে সব গাড়ির চালানে এনএইচপিসি লেখা তাদের ফেরত পাঠানো হয় আর অন্য প্রাইভেট গাড়িকে যেতে দেওয়া হয়। চেকপোষ্ট থেকে একটু এগিয়ে ক্যাম্পে জানুয়ারি ২০১২ থেকে প্রায় ৫০ জন লোক দিনরাত থাকত।
মে ১১ তারিখে চেকপোষ্টের ছেলেরা একটা ট্যাঙ্ককে ওই রাস্তার দিকে আসতে দেখে। ড্রাইভার বলে পুলিশ চালান রেখে দিয়েছে এবং ছেলেরা তাকে থামানোর আগেই সে প্রোজেক্ট সাইটের দিকে জোরে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। একটা জরুরি মিটিং ডাকা হয় আর সেখানে কিছু পদস্থ কর্তা বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হন। আমি মিটিঙএর খবর পেয়ে ঘাগোরে ছুটে যাই – এটা উত্তর লখিমপুর থেকে ৩৫ কিমি দূর। সব থেকে আশ্চর্য লেগেছিল যখন দেখেছিলাম যে ঘাগোর ক্যাম্প ছাড়িয়ে গিয়ে পুলিশ আর সিআরপিএফ এনএইচ ৫২-তে পেট্রলিং করছে। ক্যাম্পে আলোচনা চলাকালীনই আরও দুটো গাড়ি জোরে সেখান দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর পরে পরেই গুজব ছড়ায় ট্যাঙ্কারে আগুন লাগানোর আর তারপরেই শুরু হয় অযৌক্তিক গ্রেফতার অভিযান।
মূল লেখা ঃ http://www.priyanka-borpujari.blogspot.com/2012/05/damning-dam-protesters.html
লেখিকার যোগাযোগ - aa.priyanka@gmail.com
অনুবাদ : মীনাক্ষী মণ্ডল
(চলবে)