১৯৪৭ সালে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান আর ভারত, এই দুই পড়শি দেশ স্বাধীন হল। আজ, স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বছর পর, উপমহাদেশের এই দুই দেশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থানের নিরিখে টিক কোথায় দাঁড়িয়ে, গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
দু হাজার বারো সালের আগস্ট মাসে, প্রায় পঞ্চাশহাজার মানুষের এক জমায়েত, যারা মূলত মুসলিম, মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে এক হল আসাম আর মায়ানমারে মুসলিমদের ওপর হয়ে চলা অত্যাচারের প্রতিবাদে। উস্কানিমূলক কিছু ভাষণ আর ততোধিক উস্কানিমূলক কিছু পোস্টার আগুনে ঘি ঢালল। জমায়েত হিংস্র হয়ে উঠল এবং তাদের রাগ গিয়ে পড়ল মিডিয়ার গাড়িগুলোর ওপর, কারণ মিডিয়া নাকি জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া আসামের বড়ো-মুসলিম সংঘর্ষের ঘটনা তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে নি। এ কথা আজ সবাই জানে যে প্রায় আশি জনের মৃত্যুর কারণ হয়েছে সেই সংঘর্ষ, আর অন্তত চার লক্ষ মুসলিম-বড়ো মানুষ গৃহহীন হয়েছেন, প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে। তো, তার প্রতিবাদে নেমে মুম্বাইয়ের এই জনতা কিছু ওবি ভ্যান পোড়াল, কিছু পুলিশও তাদের হিংসার শিকার হল, মহিলা পুলিশদের যথেচ্ছ শ্লীলতাহানিও করল তারা। উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সামলাতে পুলিশকে শেষমেশ গুলি চালাতে হল, যার পরিণতিতে দুজন যুবক মারা গেল। খণ্ডযুদ্ধে প্রচুর পুলিশও আহত হয়েছিল। এর পর রাজা অ্যাকাডেমি, এই জমায়েতের আহ্বায়ক, প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইল এবং জানাল, বেশ কিছু “বহিরাগত’ ঢুকে পড়েছিল এই জমায়েতে। মূলত তাদের উস্কানিতেই হিংসা ছড়ায়। কিন্তু আহ্বায়ক হিসেবে তারা এই মর্মান্তিক ঘটনার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ সর্বদাই হবে অহিংস, এবং ভাষণে থাকবে না কোনও রকমের উত্তেজনার সুড়সুড়ি। এই ধরণের হিংসায় উস্কানি দেওয়া কাজকর্ম সবসময়েই নিন্দার যোগ্য।
একই সপ্তাহে আরও একটা খবর দেখা গেল, প্রায় তিনশো হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে তারা “তীর্থ” করতে এসেছে, কিন্তু আসার পর জানা যাচ্ছে তাদের অনেকেই আর পাকিস্তানে ফিরতে চায় না, পাকিস্তানে তারা নিরাপদ বোধ করছে না। বেশির ভাগ হিন্দুই সিন্ধ আর বালুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দা। হিন্দু মেয়েদের অপহরণ এবং জোর করে ধর্মান্তরকরণ সেখানে সাধারণ ঘটনা, সংখ্যালঘুরা সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আর এই সংখ্যালঘু বলতে পাকিস্তানে কিন্তু শুধুই হিন্দু, শিখ বা খ্রিস্টান বোঝায় না, বোঝায় শিয়া আর আহমদীয়াদেরও, যারা মুসলিমদের মধ্যেই একটা গোষ্ঠী।
স্বাধীনতার ছয় দশক বাদে, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ওড়াতে ওড়াতে, আজ আমরা ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? ভারত জন্ম থেকেই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, আর পাকিস্তান, যার সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামের নামে, ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানপ্রধান অংশগুলোকে কেটে নিয়ে, ১১ই আগস্ট ১৯৪৭-এ কায়েদ-এ আজম জিন্নার ভাষণ অনুযায়ী তারও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে চলার কথা হয়েছিল। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনও বিরোধ নেই, মানুষ তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং পছন্দমত মন্দিরে, মসজিদে বা গির্জায় যাবে। তিনি আরও বলেছিলেন যে পাকিস্তানের পতাকায় সাদা রঙ সংখ্যালঘুদের জন্য উৎসর্গীকৃত। তবুও, ধর্মীয় ভেদাভেদের বীজ আগে থেকেই বোনা ছিল সে-দেশের সিস্টেমে। যতই সেকুলার ভাষণ দেওয়া হোক না কেন সমাজের অচলায়তন তাতে একচুলও নড়ে না। সাম্প্রদায়িকতা ধীরে ধীরে তাই ছড়িয়ে পড়ল পাকিস্তানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবং সত্তরের দশকের শেষ দিকে, জিয়া-উল হক এবং মৌলানা মাউদুদির নেতৃত্বে ধর্মান্ধ মোল্লারা ক্ষমতার অলিন্দে আসতে শুরু করল। এই মোল্লা আর মিলিটারির আঁতাত, সঙ্গে আমেরিকার ইন্ধন, সমস্ত একসাথে লঙ্ঘন করতে লাগল জিন্নার সেই ধর্মীয় স্বাধীনতার বাণী, এতটাই লঙ্ঘন করল যে আজ মুসলিম ধর্মের মধ্যেই শিয়া বা আহমদীয়া গোষ্ঠীর মত সংখ্যালঘুরাও সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হতে লাগল পাকিস্তানে, যার সরাসরি প্রভাব পড়তে থাকল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে।
অন্যদিকে ভারতে, গান্ধী আর নেহরুর অভিভাবকত্বে ধর্মনিরপেক্ষতার স্তম্ভগুলি সময়ের সাথে সাথে মজবুত হতে শুরু করল। গান্ধির মত ঘোষিত হিন্দু আর নেহরুর মত ঘোষিত নাস্তিক, দুজনেরই দৃষ্টিভঙ্গী ছিল এক সুরে বাঁধা, রাষ্ট্রের প্রতিটা ধর্মকে সমান সম্মান দেওয়া, এবং সমস্ত ধর্মবিশ্বাস থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র আর রাজনীতিকে সমদূরত্বে রাখা। এই কাজ করতে গিয়ে নেহরু প্রধানত দুটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রথমত, যদিও আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, কিন্তু হাজারো ধর্মীয় নিয়মকানুনের নিগড়ে বাঁধা ভারতীয় সমাজ সেই সংবিধানের কাছে এক দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর নিজের পার্টি, যা একদিন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে গড়ে তোলা হয়েছিল, হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির আঁতুড়ঘর। কেউ এসব বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখে নি, এবং ফলস্বরূপ যথাসময়ে কিছু কংগ্রেস নেতার কীর্তিকলাপ সাম্প্রদায়িক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশকে এক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পথে নিয়ে যাওয়া।
যে কোনও দেশেই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পরিমাপ করা হয় সে দেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং তাঁদের প্রতি সেই দেশের সাম্যবাদী ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। সময়ের সাথে সাথে রাজনীতির কুম্ভীপাকে এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিরা গত তিন দশকে ক্ষমতার শিখরে গিয়ে পৌঁছেছে। দুই পড়শি দেশের ইতিহাসে এইখানেই তফাৎ। এক দেশে যখন সাম্প্রদায়িকতা অবাধে বেড়ে ওঠার জন্য যথেচ্ছ স্পেস পেয়েছে, তখন তাকে আরও অবাধে বাড়তে দিয়ে গেছে মিলিটারি একনায়কতন্ত্র। আফগানিস্তানে আমেরিকা এবং মার্কিনী নীতির অবৈধ নাকগলানো সেই আগুনে সময়মত আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।
ভারতে, এই ছবিটা তৈরি করে সুযোগসন্ধানীদের দল, নির্বাচনপদ্ধতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে উদ্বেগ বাড়িয়ে, ক্ষুদ্রতম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থেকে বৃহত্তম সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মনে সাম্প্রদায়িক অশান্তির আগুন ঢেলে, রামমন্দিরের নামে জনগণের ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে। আজ যেখানে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৪ শতাংশ মুসলমান, উন্মত্ততা আর হিংসার বলির পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা নব্বই শতাংশ। আজ দেশের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর সবচেয়ে নিচের স্তরে তাদফের অবস্থান। সাচার কমিটির রিপোর্টে না সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে কমে এসেছে, আর তাদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা এসে ঠেকেছে তলানিতে। এক দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অবিচার কখনোই অন্য দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারকে বৈধতা দেয় না। কিন্তু রাজনীতি তার আপনার প্রয়োজনেই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে চলে। ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুদের দুরবস্থাকে, আসামের দাঙ্গাকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের তকমা লাগায়। অন্যদিকে পাকিস্তান তার দাঁত নখ শানিয়ে সে-দেশের হিন্দুদের ছিন্নভিন্ন করে, ভারতে মুসলমানদের ওপর অবিচার অত্যাচারকে অজুহাত করে। ভারতে এক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে গুঁড়িয়ে যায় অসংখ্য মন্দির।
অথচ, এতদ্সত্ত্বেও পাকিস্তান আর ভারতের পরিস্থিতির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েই যায়। এত সাম্প্রদায়িক হিংসার মধ্যেও সেগুলো দাবিয়ে ফেলা যায় মূলত ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটার জোরেই, যদিও গণতন্ত্রের কাঠামো নিজেই অনেক পালটে গেছে, গত কয়েক দশকের ভারতে। কিন্তু অন্যদিকে, পাকিস্তানে গণতন্ত্র নিজেই কোণঠাসা, তার বিশেষ কোনও অস্তিত্ব নজরে আসে না। সেখানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে নিরন্তর, কিন্তু উপর্যুপরি বাধার সম্মুখীন হতে হয় সেই প্রচেষ্টাকে। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার দু দেশেই হয় কিন্তু সেই অত্যাচারের মাত্রা দুই দেশে দুই রকম।
এই সমস্ত সামঞ্জস্য এবং পার্থক্য, আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে? সাম্প্রদায়িকতা যে কোনও দেশের উন্নতির পক্ষেই এক সুবিশাল বাধা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সদর্থক কিছু করার প্রচেষ্টা, তাদের সুরক্ষা দেবার জন্য প্রয়োজনের থেকেও বেশি ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের বৃহত্তর সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসাই হওয়া উচিত দেশের প্রধান কর্তব্য। ঔপনিবেশিকতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পঁয়ষট্টি বছর পরে আজ আমাদের নতুন করে বুঝতে হবে স্বাধীনতা আমরা কী মূল্যে পেয়েছি, সাম্য কথাটার প্রকৃত মানে কী, আর বৈচিত্র্য বলতে কী বোঝায়। এইগুলোই কিন্তু ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখ্য চালিকাশক্তি। ভারতের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় একটা বড় ধরণের রদবদল দরকার যাতে তা আজকের সময়ের নিরিখে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটগুলির দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে সাহায্য করতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু-নিপীড়ন দুটিই দেশের জাতীয় স্বাভিমান এবং মানবতার পক্ষে এক অপূরণীয় ক্ষতি। এটা আমাদের বুঝতে হবে এবং আমাদের দৈনিক জীবনচর্যায় এই বোধ সম্পৃক্ত করে ফেলতে হবে, তবেই আমরা সত্যিকারের ভারতীয় হতে পারব। আর পাকিস্তানের আজ ফিরে শোনা দরকার ১১ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে জিন্নার সেই ভাষণ। সুকৌশলে সংখ্যালঘুদের পরিসংখ্যান কমিয়ে আনা আর তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা, এ আসলে স্বয়ং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার অপমান।
অনুবাদঃ শমীক মুখোপাধ্যায়