ক. চিরিরবন্দরঃ জ্বলছে ভাওয়াইয়া গানের দেশ
ভাওয়াইয়া গানের দেশ দিনাজপুর, এ দেশেরই একটা উপজেলা চিরিরবন্দর, আর চিরিরবন্দরের একটা ছোট বেচাকেনার স্থল বলাই বাজার; প্রায় ১৪টির মতো দোকানঘর আছে এই বাজারে। বাজারের আশেপাশের এলাকায় অধিকাংশই হিন্দু বসতি, আশেপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মুসলিম বাড়ি নেই। এ এলাকাতেই ৪ আগস্ট জ্বলে উঠল আগুন, পুড়ে গেল ৩০টির মতো হিন্দু বাড়িঘর।
বলাইবাজারে অধ্যাপিকা হামিদা খাতুন একটা মার্কেট বানিয়েছিলেন; অধ্যাপিকার বাপের বাড়ি এই এলাকাতেই, আর তাঁর শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীতে। মার্কেটসংলগ্ন জমিতে একটা থান ছিলো, ঠাকুরের থান। আর থানের ১০০ গজের মধ্যে একটা মন্দির, মন্দিরটা তৈরি হওয়ার আজ ৭/৮ বছর হয়ে গেল। ঠাকুরের থানটা ছিলো হামিদা খাতুনের নিজের জমির মধ্যেই। ১ বছর আগে অধ্যাপিকা সেই থানের উপরে টিন শেড দিয়ে ছোট একটা অস্থায়ী মসজিদ বানিয়েছিলেন। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ঠাকুরের থানের উপরে টিনশেড দিয়ে মসজিদ বানানোর সময় কোনো আপত্তি করেন নি, করার কথাও নয়, কারণ জমিটা অধ্যাপিকার নিজের। সম্প্রতি সেই অধ্যাপিকা টিনশেডের ছোট মসজিদটি স্থায়ীভাবে পাকা করার উদ্যোগ নেন। মসজিদের ভিত্তি খোঁড়ার কাজও শুরু হয়েছিল, কিন্তু তিনি মসজিদের একটা অংশ বানাচ্ছিলেন সংলগ্ন রাস্তার উপরে। তাঁর তৈরি মার্কেটের একটা অংশও আছে সংলগ্ন রাস্তার উপরে।
এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় এবার আপত্তি তোলেন, আপত্তির কারণ মসজিদটির একটা অংশ বানানো হচ্ছিল রাস্তার উপরে, দ্বিতীয় কারণ সে স্থানের ১০০ গজের মধ্যেই আছে একটা মন্দির। তাঁরা ভাবলেন, মন্দিরের পাশেই একটা মসজিদ হলে, মন্দিরে পূজার সময়, ঢাক-ঢোলের শব্দে মসজিদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এ নিয়ে কোন্দল হতে পারে। উপরন্তু মসজিদটি চলে আসছিল রাস্তার উপরে। মার্কেটের ঠিক পেছনেই অধ্যাপিকার আরো ৪ বিঘা জমি খালি পড়ে আছে, তিনি বরং কেন সেখানে বানাচ্ছেন না মসজিদ? হিন্দুরা রাস্তা বাদ দিয়ে কিংবা এও হতে পারে যে মসজিদটি সরিয়ে তৈরি করতে বলেছিল। অধ্যাপিকা মহোদয়া আপত্তি কানে তোলেন নি, 'আমার নিজের জমির উপরে আমি মসজিদ বানাচ্ছি', এরকম ছিলো তাঁর বক্তব্য।
এ নিয়ে কোন্দল বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে উত্তেজনা। চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা আফতাবউদ্দীন মোল্লা, কোন্দলের পুরোটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন; হিন্দু সম্প্রদায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন; কিন্তু তিনি কোন্দল মেটানোর কোনো উদ্যোগ নেন নি, বলাই বাজারে একবারও আসেন নি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলতে। অধ্যাপিকার স্থানীয় প্রতিনিধি, জনৈক বাবলু মেম্বার এবং তার দুই সহযোগী রায়হান ও রফিকুল একটা কার্ড ছাপিয়ে প্রায় ৪০০র মতো মসজিদে বিলি করে, যে কার্ডের বক্তব্য ছিলো হিন্দুরা মসজিদ ভেঙে ফেলেছে, হিন্দুদের প্রতিহত করুন। রায়হান ও রফিকুল উপজেলার ঘুঘরাতলী মসজিদের ইমাম মো. আল আমিন-এর সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয়। বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের আহ্বান জানানো হয় হিন্দুদের প্রতিহত করতে। ৩ তারিখ শুক্রবার রাতে বিভিন্ন মসজিদে সকল মুসল্লিগণ করণীয় ঠিক করার জন্য মিলিত হন।
প্রচারিত হয়, হিন্দুদের দেখে নেওয়া হবে। এ অবস্থায় চিরিরবন্দর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. রশিদুল মোন্নাফ কবীর, যিনি জামায়াত সংশ্লিষ্ট হিসাবে পরিচিত, শুক্রবার রাত ১২টায় মাইকিং করে কার্ফ্যু জারির নির্দেশ প্রচার করেন। কার্ফ্যু বলবৎ হবে শনিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সেই প্রচারের ভাষা ছিলো এরকম, 'হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা প্রদান করার কারণে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় কার্ফ্যু জারির...'। নির্বাহী অফিসার এও কথা দেন যে তিনি পরদিন শনিবার দুপুর ১২টার সময় দুই পক্ষের সঙ্গে মীমাংসায় বসবেন। নির্মাণাধীন মসজিদের পাশে কিছু পুলিশও মোতায়েন করা হয়।
শনিবার মীমাংসার পরিবর্তে জ্বলে উঠল আগুন। শনিবার হিন্দুদের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাহী অফিসারের অফিসে মীমাংসায় বসার জন্য গিয়েছিলেন; কিন্তু নির্বাহী অফিসার তখন অফিসে নেই, তিনি বলাই বাজারে, কুস্থলে অবস্থান করছেন। শনিবার সকাল থেকেই বলাই বাজারে ট্রাকে, টেম্পুতে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছিল, প্রায় ৫/৬ হাজারের মতো, বেশিরভাগ বাইরের লোক। তাদের হাতে লাঠিসোটা, রামদা, অস্ত্রপাতি। কার্ফ্যু চলছে, প্রচার করা হচ্ছে হিন্দুরা যেন বাইরে সমাগম না করে। বলাই বাজারে তখন উপস্থিত আছেন নির্বাহী অফিসার, আর তাঁর সঙ্গে আছেন সেই অধ্যাপিকা। নির্বাহী অফিসারের সামনে দিয়েই হামলাকারীরা জড়ো হচ্ছে।
সকাল ১১টার দিকে হামলা শুরু হলো। দফায় দফায় হামলা, এলাকার তিনটি হিন্দু গ্রামে, মাঝাপাড়া, কবিরাজপাড়া আর বটতলীতে। হামলা চলল সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ৩০টির মতো ঘরবাড়ি; গরুছাগল, টাকাপয়সা, দামী জিনিসপত্র, সোনাদানা, ধানচাল লুটপাট; মারধোর, মহিলাদের কাপড়চোপড় খোলার চেষ্টা, শ্লীলতাহানি। আহত হলো ৬০ জনের মতো। না, হিন্দুরা কোনো পাল্টা আক্রমণ করে নি। পুলিশ বলেছে, আপনারা কেউ পাল্টা আক্রমণ করবেন না, করলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হবে। সুতরাং, পরিস্থিতি ভয়ংকর হয় নি, শুধু হিন্দুরা জ্বলেছে। নির্বাহী অফিসার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলতে থাকা কার্ফ্যু পর্যবেক্ষণ করেছেন, বেলা ২টার দিকে তিনি পর্যবেক্ষণ শেষ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। দমকল বাহিনীর কর্মীরা এসেছে, তারা কতদিকে নেভাবে আগুন? একদিকে নেভালে জ্বলে ওঠে আরেকদিকে। ৫টার দিকে এলাকায় উপস্থিত হন বিজিবির সদস্যরা। ঘটনার শেষে উপস্থিত হন উপজেলা চেয়ারম্যান।
শনিবার রাতে জ্বলে যাওয়া প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, ২০ কেজি চাল, ২টা লুঙ্গি, ২টা শাড়ি প্রদান করা হয়। ৮ তারিখ বুধবার দেওয়া হয় ২ বান করে ঢেউটিন।
৮ দিন পর এলাকায় এখনো মোতায়েন রয়েছে দেড়শতর উপরে পুলিশ এবং র্যাব। কোনো পরিবারই এখন পর্যন্ত বাড়িঘর তুলে উঠতে পারেন নি। নির্বাহী অফিসারকে ট্রান্সফার করা হয়েছে। অনেককে আসামী করে মামলা হয়েছে; আসামীদের মধ্যে আছেন অধ্যাপিকা হামিদা খাতুন, আছে বাবলু মেম্বার, রফিকুল এবং রায়হান। অ্যারেস্ট করা হয়েছে ১০/১২ জনকে, কিন্তু মূল হোতাদের কাউকে এখনও অ্যারেস্ট করা হয় নি।
উপরের ঘটনার বিবরণটি পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় নি, তৈরি করা হয়েছে বলাই বাজার এলাকার মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলে।
হাটহাজারী, কালীগঞ্জ-এর পর এবার ভাওয়াইয়া গানের দেশ দিনাজপুর। সে দেশে আগুন নিভেছে, কিন্তু জেগে আছে আগুনের তাপ, আর ঘর পুড়ে যাওয়া ছাই।
চিরিরবন্দর ও পত্রিকা
নয়াদিগন্তঃ নয়াদিগন্ত এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট করেছে মসজিদ নির্মাণে হিন্দুদের বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ হিসাবে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা হিসাবে। তারা এও রিপোর্ট করেছে যে ঘটনার প্রায় সাথে সাথেই পুলিশ এবং র্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। 'গত শনিবার সকালে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ মসজিদের কাজ শুরুর দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা রাজাপুর কবিরাজপাড়ায় হামলা চালায়। এ সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।'
দি ইন্ডিপেন্ডেন্টঃ ঘটনার মোটামুটি সঠিক বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছে, কিন্তু তাদের রিপোর্ট পড়ে মনে হয়েছে প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর ছিলো যেন খারাপ কিছু না ঘটে।
আমার দেশঃ আমার দেশ ঘটনাকে রিপোর্ট করেছে মসজিদ নির্মাণে হিন্দুদের বাধাদানকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হিসাবে। 'এ সময় মুসল্লিরা সংঘবদ্ধ হয়ে পার্শ্ববর্তী কবিরাজপাড়া, বানিয়াপাড়া, ছোট হাসিমপুর এলাকায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুটপাট, ২৩টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ায় মুসলমান ও হিন্দুর উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে।'
প্রথম আলোঃ ঘটনার মোটামুটি বিবরণ দিয়েছে, তবে তাদের রিপোর্টের ধরন দেখে মনে হয়েছে এটা একটা গড়পড়তা সাধারণ ঘটনা। '১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, বিরামপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে টেম্পো, রিকশাভ্যান, ট্রাক্টর, নছিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে লোকজন এসে আজ সকাল আটটা থেকে নয়টার মধ্যে বলাইবাজারে সমবেত হন। এ সময় তাঁরা মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এতে হিন্দুরা বাধা দিলে তাঁরা বাজারের পূর্ব পাশে রাজাপুর কবিরাজ পাড়ায় হামলা চালান। তাঁরা হিন্দুদের ২৫টি বাড়ি ও খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেন।'
মানবজমিনঃ চরম দায়সারা রিপোর্ট করেছে মানবজমিন। তারা এটাকে বলেছে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, উপরন্তু এটাও বলার প্রয়োজন মনে করে নি এই দুই পক্ষ কারা কারা। 'গতকাল ভোরে কে বা কারা রাজাপুর বসতির ২২টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে লোকজন। তারা পাল্টা হামলা চালায়। এতে ছড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। আহত হয় কমপক্ষে ২০ জন।'
জনকণ্ঠঃ ঘটনার মোটামুটি সঠিক বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছে, এবং তারা রিপোর্ট করেছে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার কথা। হামলার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা বলেছেঃ 'হামলায় আক্রান্তরা ঘটনাটিকে একাত্তরের হানাদার বাহিনীর হামলার চেয়েও বর্বর ও নির্মম বলে উল্লেখ করেছেন।'
ডেইলি স্টারঃ চরম দায়সারা রিপোর্ট করেছে ডেইলি স্টার। তার এই ঘটনার রিপোর্ট করেছে দেশের আরো ৩টি জেলায় কতজন কেন আহত হয়েছে সেসব ঘটনার সঙ্গে। কারা কাদের উপরে হামলা করেছে সে কথাও বলার প্রয়োজন তারা মনে করে নি।
সংবাদঃ ঘটনার মোটামুটি সঠিক বিবরণ দিয়েছে এবং তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেঃ 'দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার উসকানিমূলক মাইকযোগে প্রচারের কারণে গতকাল ২ থেকে আড়াই হাজার লোক সংঘবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দুটি গ্রামের ৩০টি হিন্দু পরিবারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে।' তারা ৯ আগস্ট সাম্প্রদায়িক এ হামলার জন্য নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ঘুঘরাতলী মসজিদের ইমামকে দায়ী করে একটি সম্পাদকীয় ছাপে।
যুগান্তরঃ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছে মসজিদ নির্মাণে হিন্দুদের বাধা প্রদানকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ হিসাবে। 'প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হলে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন তা ভঙ্গ করে সকাল ১০টার দিকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালীন ২টি হিন্দু গ্রাম ও ১টি মুসলমান গ্রামে অগ্নিকাণ্ডে ১৬টি বাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে।'
ভোরের কাগজঃ ঘটনার মোটামুটি সঠিক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে একটা রিপোর্ট করেছে।
ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ এই ঘটনার কোনো রিপোর্ট করে নি। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়েছে জনকণ্ঠ, সংবাদ এবং দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, শুধু এই ৩টি পত্রিকা। অধিকাংশ পত্রিকা হয় বিকৃত না হয় দায়সারা অথবা গুরুত্বহীনভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
খ. ধারাবাহিক সব ঘটনাঃ কারো আর দায় নেই
হাটহাজারী, চট্টগ্রামঃ নামাজের সময় মসজিদের পাশ দিয়ে হিন্দুদের একটি শোভাযাত্রা ঢাকঢোল বাজিয়ে অতিক্রম করে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া তাণ্ডবে হিন্দুদের ১০টি মন্দির, ১৫টি দোকান এবং ৪/৫টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট। সে ঘটনায় প্রশাসন হিন্দুদের রক্ষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ঘটনার সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার।
কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরাঃ একটি স্কুলে মঞ্চায়িত নাটকে মহানবীর চরিত্র কলংকিত করা হয়েছে এমন অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব। ৩১ মার্চ হামলাকারীরা নাটকের পাণ্ডুলিপি রচয়িতা শাহীনুর রহমান শাহীন, শিক্ষিকা মিতা রানী বালা, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম ও লক্ষীপদের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। তারা ২টা স্কুল এবং একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেও ভাঙচুর করে। এর পরদিন ১লা এপ্রিল এই স্থান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামের এক হিন্দু মহিলা মহানবীকে কটাক্ষ করেছেন এমন অভিযোগে ৭টি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ। সাতক্ষীরার এসব হামলায় জামায়াত নেতা কর্মীরা প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছে। প্রশাসন এবং পুলিশ দায়িত্ব পালনে শুধু অবহেলাই দেখায় নি, বরং পরোক্ষ সহযোগিতা করেছে। অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় জাতিয় পার্টির নেতা, আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধেও।
প্রতিটি ঘটনাতেই অসহনীয় নিস্পৃহতা দেখিয়েছে সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়া। তারা কী ভাবছে আসলে? এসব ঘটনা ফলাও করে প্রচার করলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আরো বাড়বে? আসলে সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়াও ক্রমশ চলে গেছে নষ্টদের দখলে। তাদের নিস্পৃহতা এসব ঘটনাকে বিচারহীনভাবে অন্তরালে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে, ফলে উৎসাহিত হয় আরেকটি নতুন ঘটনা।
হাটহাজারীর ঘটনায় চট্টগ্রামে মানববন্ধন হয়েছে; শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব মানববন্ধন কর্মসূচিতে কতজন মানুষ উপস্থিত ছিলেন আমি দেখি নি, কিন্তু পত্রিকাওলা ও মিডিয়ার চোখে পড়ে নি, হয়ত চোখে পড়ার মতো নয়। তবে একটি পত্রিকা জানাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববন্ধনে ছাত্রনেতৃবৃন্দসহ শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রতিবাদ করেছেন জগন্নাথ হলের, যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের হল, এ হলের শিক্ষার্থীরা। দেশের একাধিক স্থানে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন।
সাতক্ষীরার ঘটনায় প্রতিবাদ হয়েছে আরো কম। এ ঘটনায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, একটি পত্রিকা জানাচ্ছে সমাবেশে অর্ধশতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদ ও মশাল মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীরা।
চিরিরবন্দরের ঘটনার পর একমাত্র দিনাজপুর ছাড়া আর কোথাও কিছু হয় নি। খুব সম্ভব দেশের অধিকাংশ মানুষই জানেন না দিনাজপুরে কিছু ঘটেছে কিনা। আমি বিভিন্ন স্থানের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা শোনে নি। ঘটনার প্রতিবাদ ও দায়ীদের শাস্তির দাবিতে একটা যৌথ বিবৃতি প্রদান করেছে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' এবং 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন'। যে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারী হিসাবে আছেন পঞ্চাশ জনের উপরে, যাঁদের মধ্যে সুপরিচিত কিছু লেখক, কবি, অধ্যাপক, শিল্পী, সাংবাদিক রয়েছেন।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। ক্রমশ বাড়ছে ধর্মান্ধ আর সাম্প্রদায়িক শক্তি। প্রশাসনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মবুদ্ধিতে আক্রান্ত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বুদ্ধিজীবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের শুভবোধের তাড়নার ক্রমবর্ধমান অভাব, তাঁদের বড় একটা অংশই এখন ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কুবুদ্ধিচর্চায় নিয়োজিত। মোটা দাগে উপরের তিনটি ঘটনাতেই বুদ্ধিজীবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরা ছিলেন নিস্পৃহ। যাঁরা পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন তাঁদের কেউ এক লাইন খরচ করেন নি। প্রতিবাদে এগিয়ে আসে নি কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন।
লোকে বলছে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, কিন্তু এই সম্প্রীতি কাজে আসছে না সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার সময় কিংবা হামলার পরে।