এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • চিরিরবন্দর: জ্বলছে ভাওয়াইয়া গানের দেশ

    জলধি রায়
    অন্যান্য | ১০ আগস্ট ২০১২ | ৭৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জলধি রায় | 190.149.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২১:২৫571454
  • চিরিরবন্দর: জ্বলছে ভাওয়াইয়া গানের দেশ

    ভাওয়াইয়া গানের দেশ দিনাজপুর, এ দেশেরই একটা উপজেলা চিরিরবন্দর, আর চিরিরবন্দরের একটা ছোট বেচাকেনার স্থল বলাই বাজার; প্রায় ১৪টির মতো দোকানঘর আছে এই বাজারে । বাজারের আশেপাশের এলাকায় অধিকাংশই হিন্দু বসতি, আশেপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মুসলিম বাড়ি নেই । এ এলাকাতেই ৪ আগস্ট জ্বলে উঠল আগুন, পুড়ে গেল ৩০টির মতো হিন্দু বাড়িঘর ।

    বলাইবাজারে অধ্যাপিকা হামিদা খাতুন একটা মার্কেট বানিয়েছিলেন; অধ্যাপিকার বাপের বাড়ি এই এলাকাতেই, আর তাঁর শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীতে । মার্কেটসংলগ্ন জমিতে একটা থান ছিলো, ঠাকুরের থান । আর থানের ১০০ গজের মধ্যে একটা মন্দির, মন্দিরটা তৈরি হওয়ার আজ ৭/৮ বছর হয়ে গেল । ঠাকুরের থানটা ছিলো হামিদা খাতুনের নিজের জমির মধ্যেই । ১ বছর আগে অধ্যাপিকা সেই থানের উপরে টিন শেড দিয়ে ছোট একটা অস্থায়ী মসজিদ বানিয়েছিলেন । এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ঠাকুরের থানের উপরে টিনশেড দিয়ে মসজিদ বানানোর সময় কোনো আপত্তি করেন নি, করার কথাও নয়, কারণ জমিটা অধ্যাপিকার নিজের । সম্প্রতি সেই অধ্যাপিকা টিনশেডের ছোট মসজিদটি স্থায়ীভাবে পাকা করার উদ্যোগ নেন । মসজিদের ভিত্তি খোঁড়ার কাজও শুরু হয়েছিল; কিন্তু তিনি মসজিদের একটা অংশ বানাচ্ছিলেন সংলগ্ন রাস্তার উপরে । তাঁর তৈরি মার্কেটের একটা অংশও আছে সংলগ্ন রাস্তার উপরে ।

    এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় এবার আপত্তি তোলেন, আপত্তির কারণ মসজিদটির একটা অংশ বানানো হচ্ছিল রাস্তার উপরে, দ্বিতীয় কারণ সে স্থানের ১০০ গজের মধ্যেই আছে একটা মন্দির । তাঁরা ভাবলেন, মন্দিরের পাশেই একটা মসজিদ হলে, মন্দিরে পূজার সময়, ঢাক-ঢোলের শব্দে মসজিদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এ নিয়ে কোন্দল হতে পারে । উপরন্তু মসজিদটি চলে আসছিল রাস্তার উপরে । মার্কেটের ঠিক পেছনেই অধ্যাপিকার আরো ৪ বিঘা জমি খালি পড়ে আছে, তিনি বরং কেন সেখানে বানাচ্ছেন না মসজিদ? অধ্যাপিকা মহোদয়া আপত্তি কানে তোলেন নি, ‘আমার নিজের জমির উপরে আমি মসজিদ বানাচ্ছি’, এরকম ছিলো তাঁর বক্তব্য ।

    এ নিয়ে কোন্দল বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে উত্তেজনা । চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা আফতাবউদ্দীন মোল্লা, কোন্দলের পুরোটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন; হিন্দু সম্প্রদায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন; কিন্তু তিনি কোন্দল মেটানোর কোনো উদ্যোগ নেন নি, বলাই বাজারে একবারও আসেন নি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলতে । অধ্যাপিকার স্থানীয় প্রতিনিধি, জনৈক বাবলু মেম্বার এবং তার দুই সহযোগী রায়হান ও রফিকুল একটা কার্ড ছাপিয়ে প্রায় ৪০০র মতো মসজিদে বিলি করে, যে কার্ডের বক্তব্য ছিলো হিন্দুরা মসজিদ ভেঙে ফেলেছে, হিন্দুদের প্রতিহত করুন । রায়হান ও রফিকুল উপজেলার ঘুঘরাতলী মসজিদের ইমাম মো. আল আমিনের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয় । বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের আহ্বান জানানো হয় হিন্দুদের প্রতিহত করতে । ৩ তারিখ শুক্রবার রাতে বিভিন্ন মসজিদে সকল মুসল্লিগণ করণীয় ঠিক করার জন্য মিলিত হন ।

    প্রচারিত হয়, হিন্দুদের দেখে নেওয়া হবে । এ অবস্থায় চিরিরবন্দর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. রশিদুল মোন্নাফ কবীর, যিনি জামায়াত সংশ্লিষ্ট হিসাবে পরিচিত, শুক্রবার রাত ১২টায় মাইকিং করে কার্ফ্যু জারির নির্দেশ প্রচার করেন । কার্ফ্যু বলবৎ হবে শনিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত । সেই প্রচারের ভাষা ছিলো এরকম, ‘হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা প্রদান করার কারণে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় কার্ফ্যু জারির...’ । নির্বাহী অফিসার এও কথা দেন যে তিনি পরদিন শনিবার ১২টার সময় দুই পক্ষের সঙ্গে মীমাংসায় বসবেন । নির্মাণাধীন মসজিদের পাশে কিছু পুলিশও মোতায়েন করা হয় ।

    শনিবার মীমাংসার পরিবর্তে জ্বলে উঠল আগুন । শনিবার হিন্দুদের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাহী অফিসারের অফিসে মীমাংসায় বসার জন্য গিয়েছিলেন; কিন্তু নির্বাহী অফিসার তখন অফিসে নেই, তিনি বলাই বাজারে, কুস্থলে অবস্থান করছেন । শনিবার সকাল থেকেই বলাই বাজারে ট্রাকে, ট্যাম্পুতে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছিল, প্রায় ৫/৬ হাজারের মতো, বেশিরভাগ বাইরের লোক । তাদের হাতে লাঠিসোটা, রামদা, অস্ত্রপাতি । কার্ফ্যু চলছে, প্রচার করা হচ্ছে হিন্দুরা যেন বাইরে সমাগম না করে । বলাই বাজারে তখন উপস্থিত আছেন নির্বাহী অফিসার, আর তাঁর সঙ্গে আছেন সেই অধ্যাপিকা । নির্বাহী অফিসারের সামনে দিয়েই দাঙ্গাকারীরা জড়ো হচ্ছে ।

    সকাল ১১টার দিকে হামলা শুরু হলো । দফায় দফায় হামলা, এলাকার তিনটি হিন্দু গ্রামে, মাঝাপাড়া, কবিরাজপাড়া আর বটতলীতে । হামলা চলল সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত । জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ৩০টির মতো ঘরবাড়ি; গরুছাগল, টাকাপয়সা, দামী জিনিসপত্র, সোনাদানা, ধানচাল লুটপাট; মারধোর, মহিলাদের কাপড়চোপড় খোলার চেষ্টা, শ্লীলতাহানি । আহত হলো ৬০ জনের মতো । না, হিন্দুরা কোনো পাল্টা আক্রমণ করে নি । পুলিশ বলেছে, আপনারা কেউ পাল্টা আক্রমণ করবেন না, করলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হবে । সুতরাং, পরিস্থিতি ভয়ংকর হয় নি, শুধু হিন্দুরা জ্বলেছে । নির্বাহী অফিসার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলতে থাকা কার্ফ্যু পর্যবেক্ষণ করেছেন, বেলা ২টার দিকে তিনি পর্যবেক্ষণ শেষ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন । দমকল বাহিনীর কর্মীরা এসেছে, তারা কতদিকে নেভাবে আগুন? একদিকে নেভালে জ্বলে ওঠে আরেকদিকে । ৫টার দিকে এলাকায় উপস্থিত হন বিজিবির সদস্যরা । ঘটনার শেষে উপস্থিত হন উপজেলা চেয়ারম্যান ।

    শনিবার রাতে জ্বলে যাওয়া প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, ২০ কেজি চাল, ২টা লুঙ্গি, ২টা শাড়ি প্রদান করা হয় । ৮ তারিখ বুধবার দেওয়া হয় ২ বান করে ঢেউটিন ।

    এলাকায় এখনও মোতায়েন রয়েছে পুলিশ এবং র‍্যাব । কোনো পরিবারই এখন পর্যন্ত বাড়িঘর তুলে উঠতে পারেন নি । নির্বাহী অফিসারকে ট্রান্সফার করা হয়েছে । অনেককে আসামী করে মামলা হয়েছে; আসামীদের মধ্যে আছেন অধ্যাপিকা হামিদা খাতুন, আছে বাবলু মেম্বার, রফিকুল এবং রায়হান । অ্যারেস্ট করা হয়েছে ১০/১২ জনকে, কিন্তু মূল হোতাদের কাউকে এখনও অ্যারেস্ট করা হয় নি ।

    ভাওয়াইয়া গানের দেশে আগুন নিভেছে, কিন্তু জেগে আছে আগুনের তাপ, আর ঘর পুড়ে যাওয়া ছাই ।

    (লেখাটি পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় নি, তৈরি করা হয়েছে বলাই বাজার এলাকার মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলে । বেশিরভাগ মিডিয়া এই ঘটনাকে প্রচার করেছে হিন্দু-মুসলিম দ্বিপাক্ষিক দাঙ্গা হিসাবে । কোনো কোনো মিডিয়া ঘটনাটিকে প্রচার করেছে মসজিদ নির্মাণে হিন্দুদের বাধা প্রদানকে বিশেষভাবে ফলাও করে ।)
  • জ রা | 190.149.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২২:৩৩571455
  • হাটহাজারী (চট্টগ্রাম), কালীগঞ্জ (সাতক্ষীরা), ফকিরহাট (বাগেরহাট)-এর পর এবার দিনাজপুর ।
  • একক | 24.96.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২২:৩৪571456
  • রাজনৈতিক আস্কারা না থাকলে বাইরে থেকে এতো লোক জোটালো কেমনে ? এতো পাকানো কেস মনে হচ্ছে ।
  • জ রা | 190.149.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২২:৩৬571457
  • বোঝাই যাচ্ছে, পাকানো কেস ।
  • Raj chatterjee | 113.246.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২২:৪২571458
  • Amar iPad ea font porte parching na. Kichu suggest kroon please.
  • গান্ধী | 213.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১২ ২২:৪৬571459
  • চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে কি হয়েছিল যদি বলেন এই প্রসঙ্গে ভালো হয়, কারন ফেবুতে বা পেপারে যা একটূ-আধটু যা দেখেছি সেগুলো একপক্ষের বক্তব্য।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন