যুদ্ধ দামামার তরঙ্গ উৎপাদঃ একদম প্রথম থেকেই অংক কষি। একদা ৭ জানুয়ারী ২০১১ ভোরে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত পার হয়ে দেশে ফেরার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে গেলে ফেলানী নামক কিশোরী চিৎকার শুরু করে। সে সময় বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে , পরে তার লাশ কাঁটাতারে ঝুলতে দেখা যায়। ঝুলতে থাকে তার চুল গুলো। সাথে সাথেই আমাদের আবেগও লটকে থাকা ফেলানীর চুলের সাথে পাল্লা দিয়ে দুলতে থাকে। মনের একদম গভীর থেকে এক অদৃশ্য ঘৃণা উপচে পড়ে। ঘৃণাগুলো দল বেধে ছুটতে থাকে সীমান্তের ওপাড়ে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, “ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বা স্বাভাবিকতার বীভৎস রূপ যখন আমাদের ইচ্ছার বিপরীতে প্রকাশিত হয় তখন ঘৃণা নামক আবেগের সৃষ্টি হয়”
একটি কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ স্বাভাবিক ভাবেই মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। হয়ত দুপুরে ভাত নাড়তে নাড়তে মনে মনে বি এস এফ কে এক চোট গালাগালি করি। এই ঘৃনার বহিঃপ্রকাশ মিডিয়ার লাফালাফি, কিছু লেখালেখি ও আমাদের গালাগালিতেই সীমাবদ্ধ। তারপর অসীম কৃষ্ণগহ্বরে ঝুপ করে ঝাপ দেয় ফেলানী স্মৃতি।
বেশ কিছুদিন বাদেই আমরা ভারতীয় টিভি এন্ডিটির সৌজন্যে বিভৎস এক ভিডিও দেখতে পাই। সেখানে বি এস এফ কতৃক বাংলাদেশীদের উপর নির্যাতন যে কতটা পাশবিক হতে পারে তার প্রমাণ মেলে। বি এস এফ এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবী এই ল্যাংটা কান্ড ঘটে ৯ ডিসেম্বর।
উল্লেখ্য বি এস এফ কতৃক সীমান্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশী হত্যার সংখ্যা গত এক দশকে ৯৯৬ জন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজিবি ও বিএসেফ বৈঠকে বসলে বি এস এফ গুলি বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই বিবৃতির পর আমাদের রাষ্ট্র নির্বাক থাকায় দেশের কিছু হ্যাকার গ্রুপ ভারতের ওয়েব সাইট ধারাবাহিক ভাবে হ্যাক করা শুরু করে । শুরু হয় দ্বিঘোষিত সাইবার যুদ্ধ।
সাইবার যুদ্ধের পেছনের কথাঃ কিছু মিডিয়া ও অতি উৎসাহী কিছুমানুষ এই বিষয়টিকে ঢালাও ভাবে প্রচার করে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সৃষ্ট ঘৃণা তথা ভারত বিদ্বেষের কারনে বিষয়টি ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু কিছু মিডিয়া এবং একটি হ্যাকার গ্রুপ দাবী করে, এই সাইবার যুদ্ধ বাংলাদেশের ওয়েবসাইট আক্রমনের মাধ্যমে ভারত শুরু করেছে। এই বলেই খালাস । কোন তথ্য বা প্রমান এখনো কোন মিডিয়া দেখাতে পারেনি। তবে একটি মন্ত্রণালয়ের সাইট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও তা কি আদেও ভারতীয় হ্যাকাররা হ্যাক করেছে সে সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট ধারনা দেয়নি।
আবার হ্যাক হওয়ার পর ডিফেইস পেজে যদি বার্তা নাই বা থাকে তাহলে মিডিয়া বা হ্যাকার গ্রুপ কোন যুক্তিতে ভারতের উপর দোষ চাপাল তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
এতে করে আরেকটি কথা এসেই যাচ্ছে। ডিফেইস পেজ খালি থাকলে ভারতীয় হ্যাকাররা কিভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করল তা এখনো পরিস্কার নয়।
হ্যাকারদের দাবীর যৌক্তিকতাঃ এই সাইবার যুদ্ধে নেতৃত্বে প্রধান তিনটি হ্যাকার গ্রুপ রয়েছে।
১. বাংলাদেশ সাইবার আর্মি
২. বাংলাদেশ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারস
৩. এক্সপায়ার সাইবার আর্মি
এছাড়াও অরিয়েন্টস হান্টার , ব্ল্যাক বার্ন, বার্ন জোন নামক কিছু হ্যাকার গোষ্ঠী এই সাইবার যুদ্ধে জড়িত। সাধারণ নেট ব্যবহার কারীরাও এই সাইবার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে নিচ্ছে।
বিভিন্ন দাবী নিয়ে এই সাইবার যুদ্ধ চলছে। এক্সপায়ার কতৃক হ্যাক কৃত একটি ডিফেইস পেজে আমারা দেখতে পাই , কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি, “STOP BORDER KILLING”
“Fuck all politics in Bangladesh and fuck the Indian BSF too, coward mother fuckers”
“w3 ar3 Bangladeshi UnderGround Hacker 3xp1r3 CyberArmy “...::-Go To Hell-::..”
“May God Curse upon you All ! ' Ameen”
“All Indian Lammers ! :) .. You'll be Fucked s00n “
...::UsA 3xp1r3 Cyber Army::......::s1r-3xp1r3::...::Mr.3xp1r3::...::3xp1r3-k1ng::..::Ethical-BD-HaXor..:::..:::3xp1r3-t3rr0r...::3xp1r3-n0pm...::split0-3xp1r3::..::_sYs_::..::3xp1r3-61::..::Ajob 3xp1r3::..3xp1r3 prem..::::.Hip hop 3xp1r3..::n3r0b::....::..Shadow008-...::...3xp1r3-!-!..::.....::...
AND All MuSliMS HaCk3Rs::..Will Return Soon Followed”
বিসিএ এবং ব্ল্যাক হ্যাট যেসব পেজ হ্যাক করেছে সেখানেও যে দাবী মূখ্য সেটি হছে সীমান্ত হত্যা বন্ধ।
কয়েকদিন পরেই হ্যাকারবৃন্দ তাদের দাবীগুলো আনুষ্ঠানিক ভাবে উপস্থাপন করেছে। দাবীগুলোর সারাংশ হচ্ছে,
১. সীমান্ত হত্যা বন্ধ।
২. টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান করা যাবেনা।
৩. তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর ।
৪. ভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রচার বন্ধ।
৫. ভারতকে বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ড থামাতে হবে।
প্রথম দাবীটি আমার তোমার আপনার সবার। সীমান্ত হত্যা নিয়ে চুনের মধ্যে অনেক ফু দেওয়া হয়েছে আমি আর ঘোলা করতে চাইনা। তবে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যখন কেউ অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে তখন বি এস এফ পশুরা নিশ্চয়ই বসে বসে ট্রিগার চুষবেনা। এক্ষেত্রে বিজিবির ভুমিকা কি? সীমান্ত হত্যা শুধু বিএসেফ এর পাশবিকতা নয় বরং বিজিবির অবহেলাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
২য় দাবী টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থামাও একটি সার্বজনীন দাবী। তবে ভার্চুয়াল জগতে শত চিল্লাফাল্লা করলেও বাস্তবে বিপ্লব আদৌ সম্ভব কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ।
“তিস্তা চুক্তি করতে হবে” বিষয়টি হাস্যকর। যেখানে ওপাড় থেকে মমতা গলার রগ ফুলিয়ে ধমক দেয়, সরকার আঙ্গুল চেটে চেটে ধমক খায় সেখানে ভার্চুয়াল জগৎএ মাথায় “মামা” ঠেকিয়ে দাবী আদায় করে নেওয়াটা যথেষ্ট ছেলেমানুষী। তবে দাবীটি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু বীর বাঙ্গালী কী বোর্ড চাপুক আর যাই চাপুক মাঠে নামা ছাড়া তিস্তা চুক্তি সম্ভব কিনা সে বিষয়টি সন্দেহের অতীত নয়।
ভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ করার ব্যাপারটিও ঠিক তিস্তা চুক্তির মত কল্পনায় ডাকাতি করা। মাননীয় হ্যাকারগন টিভি চ্যানেল বন্ধ করতে বললেও আপনারা কি ভারতীয় চ্চলচিত্র প্রদর্শন বন্ধে একবারও রাস্তায় নেমেছেন কি?
ভারতের দ্বারা আমরা কি পরিমান শোষিত হই তা কাউকে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আমাদের কি উচিত নয় যে ভারতের লাথি বন্ধের দাবীর আগে সরকারগনের ভারতের পা চাটানো বন্ধের দাবী জানানো?
শোষিত সমাজের দাবী গুলোকে আকাশে ছেড়ে উড়তে বললেই উড়বেনা। উড়ানোর জন্য প্রয়োজন প্রত্যক্ষ ভাবে দাবীগুলো আদায় করা। অধিকার কখনো হেটে আসেনা, আদায় করে নিতে হয়। তবে আদায়ের মাপকাঠিটি অবশ্যই যৌক্তিক ও মান সম্পন্ন হতে হবে।
কলুষিত রাজনৈতিক থাবা ও আবেগতান্ত্রিক হ্যাকিজম জটিলতাঃ ভারতীয় সংবিধানের ৩৬৭ ধারার ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “ ভারত ব্যাতীত যে কোন রাষ্ট্র বিদেশী রাষ্ট্র , কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে কোন রাষ্ট্রকে বিদেশী রাষ্ট্র নয় বলে ঘোষনা দিতে পারেন”
(সিকিম ও ভূটান এই ধারার আওতায় পড়েছে) সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল বিদেশী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে কিভাবে একটি রাষ্ট্রের সংবিধান সৃষ্টি হয়?
এবার আসি মোদের বাড়িতে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এই হ্যাকিংকে পুরোপুরি যুদ্ধাপরাধ ঠেকাতে নিয়ে গেছে। এর পরেই ব্ল্যাক হ্যাট এর এক বিবৃতিতে এর জবাব দেওয়া হয়।
আবার হ্যাকড কিছু ডিফেইস পেজে অনেকে সাম্প্রদায়িকতা খুজে পেয়েছেন। “May God Curse upon you All ! ' Ameen” এখানে হ্যাকার ধার্মিক হতেই পারে। তাই বলে একে সাম্প্রদায়িক অপবাদ দেওয়া যথেষ্ট নীচু মানসিকতার পরিচয় বহন করে। একে জামাত পন্থী বা শিবির বলারও কিছু নেই। তবে সাইবার যুদ্ধের প্রথম কয়েকশ ডিফেইস পেজে আরেক্টী কথা এসেছে, সেটি হচ্ছে গ্রিটিং এ AND All MuSliMS HaCk3Rs এই লাইন টি ব্যবহার হয়েছে। একটি গোষ্ঠীর মুখোশ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ভুল বোঝার পর লাইনটি অপসারিত করা হয়।
যখন দেশের কিছু দেশপ্রেমীরা আবেগে তাড়িত হয়ে হ্যাক শুরু করেছে সাথে সাথেই কিছু ভারতবিদ্বেষী তাদের সাথে পদক্ষেপ মেলায়। এখানেই এই পবিত্র কাজের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে। কিছু অতি উৎসাহী পেজ এই ভ্রান্তির মূল কারন। মূলত ভারতীয় সাইট ১৫০০০-১৭০০০ হ্যাক হয়েছে। কিছু গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষের মাঝে ভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
আবার প্রশ্ন যখন আন্তর্জাতিক মহলে। তখন বিষয়টি আরও ঘোলাটে আকার ধারন করে।সবচেয়ে বড় বিতর্কের নিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের অংশগ্রহন ও ধর্মীয় প্রচার। দেশপ্রেমী হ্যাকারগন কি এই ছোট ফাঁদটুকু বুঝতে পারেনি? নাকি আমরাই তাদের নিষ্পাপ মুখোশ ফাঁদের শিকার?
একটু ফেসবুকে যাই, কিছু কিছু পেজ আছে যারা তথ্যপ্রযুক্তির টিপস দিয়ে থাকে । এই টিপ্সের লোভেই অসংখ্য মানুষের লাইক পড়ে সেই পেজে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় মূলত এসব পেজেই হ্যাকিং এর যাবতীয় খুটিনাটি খবর (ভ্রান্তি) সরবারহ করা হয়। এই পেজের মূল হোতারা অতি সাবধানে (অ্যাডাল্ট জোক সহ) সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সরল মনে রোপণ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভাবের বীজ।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, হ্যাকারগ্রুপ গুলো হ্যাকিং ট্রিক গুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। শত হলেও আমরা সবাই সাধু নই। সাইবার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যে গৃহযুদ্ধ বাঁধবেনা সেই নিশ্চয়তা কি কোন গ্রুপ দিবে?
আর লিখমুনা , শ্যাষঃ একদম মূল কথায় ফিরে যাই। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার দাবী জোড়দার করা উচিত। তবে আগে এই হত্যা করার সুযোগ বন্ধ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের মানুষ যদি ভুল করেই ফেলে আর যদি গুলি করতেই হয় তবে এক্টাই দাবী গুলিটি যেন মেড ইন বাংলাদেশ হয়।
পাদটিকাঃ এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপ অ্যানোনিমাস এর সংশ্লিষ্টতা নেই। গ্রুপের এক দুইজন সদস্যের সম্মতি মানে গ্রুপের সম্মতি নয়। বিষয়টি পুরো পুরি মাইন্ড গেম।