কালো পর্দায় সাদা লেখা ফুটে ওঠে-
আগে যা ঘটেছে-
দৃশ্য ক, খ, গ, ঘ পরপর আসে। সঙ্গে নেপথ্য পুরুষ কন্ঠ।
সূচনা দৃশ্য- ক
গ্রামের হেলথ সেন্টারে আছে এক পাগল ডাক্তার। মল মূত্র থুতু রক্ত মাইক্রোস্কোপের তলায় স্লাইডে করে নিয়ে সারাদিন মূহ্যমান থাকেন তিনি। তার চোখের সামনে শূন্যতা, নীরবতার ছবি ভেসে ওঠে একের পর এক। তার সামনে খুলে যেতে থাকে বিমূর্ততার এক জগৎ।
সূচনা দৃশ্য- খ
এ গল্প জানে শুধু রাজকুমারী। বিশাল ভাঙনে কোনরকমে আটকে থাকা প্রকান্ড রাজবাড়িতে আছে কেবল রাজা রবীন্দ্রনাথ ও রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা। রাজার কুষ্ঠ, জানা গেছে সেটা সংক্রামক। বয়েস হয়েছে, সকলেই ত্যাগ করেছে তাকে। ডাক্তারের রাজবাড়িতে অবাধ প্রবেশ। রাজকুমারী তার একাকীত্ব কাটাতে সঙ্গী হয় তার থেকে ঢের বয়েসে বড় ডাক্তার। রাজকুমারীর মনে হয় প্রাণহীণ মানুষের সঙ্গে তার কথপোকথন। সন্ধ্যেবেলা গির্জায় গেলে তবু কয়েকজনকে পাওয়া যায়।
সূচনা দৃশ্য- গ
জলের মধ্যে এক দ্বীপ, তাতে ছোট্ট গির্জায় থাকেন ফাদার আলবার্ট রীভস। সকালে বাজার করে ফেরেন নিজের হাতে নৌকা চালিয়ে। একটু বাদে আসে চার-পাঁচটা শিশু। তাদের ইংরাজী পড়ান রীভস। সন্ধ্যেবেলার নৌকা নিয়ে আসে কিছু প্রেমিক প্রেমিকাকে। এই সময় গির্জায় সারসার মোম জ্বলে ওঠে। সবাই বিদায় নিলে নিজের হাতে মানচিত্র তৈরি করেন রীভস। বিভিন্ন দেশের, সময়ের, কালের(period- detail/references will be given)। একাকার হয়ে হয়ে গড়ে ওঠে প্রিয় পৃথিবীর ছবি। প্রগতির বিশ্ব (লাল)। শান্তির দেশ (সাদা)। স্বপ্নের রাজ্য (সবুজ)।
সূচনা দৃশ্য- ঘ
শহরে যাওয়ার বাস একটাই। সেটাই যায় আসে সারাদিনে চারবার। জানালায় বসে ছোট্ট মেয়ে কুসুম অপেক্ষা করে বাবার ফেরার। কয়েক বছর হল পাইলট বাবা গেছে সীমান্তে যুদ্ধের মহড়ায়। তখন সে ভারী ছোট্টটি ছিল। বাবাকে মনেও পড়ে না সেভাবে। তার মা কল্যাণী তাকে ঘুম পাড়ায় তার বাবার গল্প বলে। বাস্তব আর কল্পনা সেখানে মিশে যায়।
... (কল্যাণীর কন্ঠ) এক যে ছিল ছোট্ট রাজপুত্র। সে এমন একটা গ্রহে বাস করত যেটা তার মতই ছোট এবং তার একজন বন্ধুর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল...
কালো পর্দায় সিনেমাটির নাম ফুটে ওঠে-
একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে
Antoine de Saint-Exupéry এর The Little Prince দ্বারা প্রাণিত।
সুমেরু মুখোপাধ্যায়ের গল্প “মলিন মর্ম মুছায়ে” অবলম্বনে।
দৃশ্য এক।।
দূর থেকে দেখা। ডানা ভাঙা পাখির মত নেমে আসে এক যুদ্ধ বিমান (ফকার)। নিস্তব্ধ বালির ঝড় ওঠে। চাকাগুলো ক্রমশ বালিতে আটকে থেমে যায়। পাখাগুলো ঘোরে আটকে আটকে।
দরজা সরে গেলে দেখা যায়, সামরিক পোশাকে এক ব্যক্তিকে, নামতে উদ্যত।
পাইলট একমাত্র যাত্রী। নামলে বোঝা যায় তার অসহায়ত্ব, সে খুব ক্ষুদ্র।
চারপাশে বালির ঝড়। সে আবার ঢুকে পরে যুদ্ধ বিমানে। দরজা বন্ধ হওয়ার পর বোঝা যায় কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে এসেছে চামচিকের থেকে অতিকায় সব প্রাণী, কালো রঙের। বিমানের পাখাগুলো আস্তে আস্তে থেমে যায়। দৃশ্যপট ঢেকে যায় চামচিকের মত পাখিতে বস্তুত কালো রঙের টোনে।
Credit appears- all main Credits till end of the scene
Sound fx- storm, rain and snow fall
সময়ান্তরে সেই যুদ্ধ বিমান ছেয়ে গেছে বরফে। চারপাশ ঝকঝকে সাদা তুষার আবৃত।
দশ বছরের এক ফর্সা চেহারার বালক হেঁটে যায় বরফের উপর পা ফেলে ফেলে।
পা ফেলে আর সে অবাক হয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে পিছনে ফেলে আসা পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে। পায়ের চাপ দেওয়া রাস্তা। দূরের ছাপ মিশে যাচ্ছে বরফে।
হঠাৎ মুখ তুলে যুদ্ধবিমানটা দেখে অবাক হয়। খেলনা ভেবে খুশিও হয়।
আঙ্গুল দিয়ে বিমানের পিছনের ছোট্ট পাখা ঘোরালে সেটা পাক খেয়ে থামে। হাতের তালুর উপর যেন লাট্টু। ফুঃ দিয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করলে ঘোরে না।
জানলার বরফ পড়া কাঁচে আঙুল চালিয়ে বরফ মোছে।
হঠাৎ বিমানের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে পাইলট। দুজনে দুজনকে দেখে অবাক হয়।
পাইলটের হাতে যন্ত্রাংশ। প্রচুর তেল কালি মোবিল মাখা। ফোঁটায় ফোঁটায় কালো মোবিল পড়ে সাদা বরফের উপর। পারদের মত তা বরফ স্পর্শ করে না, দৌড়ে বেডায়। বালকটি দৌড়ায় পেছন পেছন। মজা পায় সে।
গড়াতে গড়াতে নামে বিন্দু বিন্দু কালো। পরস্পর জোড়া লেগে দ্রুত লয়ে চলে।
Music Theme One- ‘Friendship’ starts
চাকার উপর পা দিয়ে, হাতে ভর করে লাফিয়ে পাইলট আবার বিমানের পেটে ঢুকে পড়ে। মেশিনের অশান্ত শব্দের গর্জন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। হঠাৎ তার কানে একটি ডাক এসে পৌঁছায়
‘বন্ধু...’।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য দুই।।
প্রশস্ত খাটে শুয়ে কল্যাণী ও কুসুম। মা তার ছোট্ট মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই পড়েছে ঘুমিয়ে। Off voice এ কল্যাণীর বলা গল্পঃ
..বিশ্বকর্মা জানেন কেবল সৃষ্টির মন্ত্র। নবীকরণের মন্ত্র তাঁর জানা নেই। সকলে মিলে গেল প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে।…
(দধীচি, আত্মত্যাগ, শক্তি নির্ধারণে তৈরির প্রাচীন উপাখ্যান- VO text will be given) কানে নিয়ে বিছানা থেকে সন্তর্পণে উঠে পড়ে কুসুম। সিঁড়ি দিয়ে উঁকি মারে বাইরে, দেড়তলা থেকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য দুই- ক।।
বিরাট অশ্বত্থ রাত্রি ঘন করে দাঁড়িয়ে। বাসস্ট্যান্ডে চার-পাঁচটা বাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। শহর থেকে শেষ বাস এখনো ফেরেনি, গুমটির ক্ষীণ আলো তার প্রমাণ। গুমটির বাইরে একটা বেঞ্চে দুজন বসে জোরে জোরে গুলতানি করছে। পরিচিত দৃশ্যে গান গাইতে গাইতে সাইকেলে রামেশ্বর। সাইকেলের হাতলে সে হাত দেয় না সাইকেলের ক্যারিয়ারে আটকানো ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে সাইকেল চালায় সে। দূর থেকে চোখে পড়ে দুটো আলো, শেষ বাস ফিরছে শহর থেকে।
গাছতলার অন্ধকারে সন্তর্পনে একা দাঁড়ায় কুসুম। বাস এসে দাঁড়ায় ক্লান্ত শরীরে। প্রথমে আলো, পরে শব্দ বন্ধ হয়। দু’চার জন চেনা- অচেনা মানুষ নামে বাস থেকে। কন্ডাক্টর বিমল তার চেনা কিন্তু বিমল তাকে দেখতে পায় না। গুমটির বাইরের বেঞ্চিতে বসে ব্যাগ থেকে সমস্ত খুচরো পয়সা ঢালে বেঞ্চির উপর। একটাকা, দু’টাকা, আটআনা সমস্ত ভাগ করে রাখে। তারপর গুনতে শুরু করে। রাস্তার ওপাশের মোটর সাইকেল সারাই করার দোকান। মস্ত মস্ত টায়ার দিয়ে তৈরি একচালা। ছোট্টু বাঁ হাতে মুখোশ ঢাল ধরে ডান হাত দিয়ে গ্যাস ঝালাই করছে। ছোট্টু আর বিমলের কথা হয় শহর নিয়ে।
ছোট্টুঃ তোমার শহরে থাকতে ইচ্ছা করে না বিমলদা? ঝকঝকে রাস্তাঘাট মানুষ, সব সিনেমার মত।
বিমলঃ না রে ছোট্টু। শহরে মানুষের ঘাড়ে মানুষ। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। এই মনে হয় ফ্ল্যাটগুলো সব ভেঙ্গে পড়ল। সাংঘাতিক।
ছোট্টুঃ দাঁড়াও না। যেদিন আমি গাড়ি চালাতে শিখে যাবো, সেদিন আমি শহরে চলে যাবো।
বিমলঃ দাঁড়াতে হবে? (বলে হাসে) যদি ইচ্ছে করে থাকিস। তবে চলার মজা অন্য বুঝলে ছোটেলাল। শুধুই চলা। হিউএন সাঙ, ফা হিয়েন এদের নাম তো শুনিস নি। সারা জীবন ঘুরেই বেড়িয়েছে।
ছোট্টুঃ তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে না বিমলদা? বাবা, মা?
বিমলঃ নাহ, কিস্যু মনে নেই। কি জানি আমার বোধ হয় কোন বাড়ি ছিল না।
ছোট্টুঃ তুমি আকাশ থেকে নেমে এসেছ নাকি?
বিমলঃ হুঁ। তাই হবে হয়ত!
বিমলের পয়সা গোনা শেষ, আবার সমস্ত পয়সা মিলিয়ে এক করে দেয় সে।
ছোট্টুঃ খুব মজা না বিমলদা!
বিমল লক্ষ্য করে, ছোট্টু তার দিকে তাকিয়ে। হাতে গ্যাস-আগুন এমনি এমনি করে জ্বলে যাচ্ছে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য দুই-খ।।
কুসুম ও কল্যাণী খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
Off voiceএ বিমল ও ছোট্টুর কথা।
ছোট্টুঃ ও, তুমিও তাহলে আমার মত আকাশ থেকে এসেছ!
বিমলঃ কই তোকে তো আগে দেখিনি। তুইও কি অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছিস?
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তিন।।
হলুদ প্রান্তরে মৃত নীল মাছির মত পড়ে যুদ্ধবিমান। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির মধ্যে খারাপ হয়ে পড়া উড়োজাহাজ, তার পেট থেকে বেরনো যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে, সেটা সারানোর মরিয়া প্রচেষ্টা করছে পাইলট। ছোট্ট বালকটি তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছে পাইলটকে—
বালকঃ এই উড়োজাহাজে করে তোমরা কোন গ্রহে যাও?
পাইলটঃ আমরা নিজেদের গ্রহের মধ্যেই যাতায়াত করি।
বালকঃ আমি তো আমার গ্রহে এমনি এমনি ঘুরে বেড়াই।
লাফ দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে দেখায় সে।
বালকঃ আমাকে একটা এরোপ্লেন বানিয়ে দেবে?
বালকটি হাঁটতে হাটঁতে এরোপ্লেনের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। (আকাশের সরণ ঘটে-এমন পশুপাখি ওড়ে যারা মৃত। যাদের কোনো ডানা নেই।) মনে হয় আকাশ জুড়ে কে যেন এলুমিনিয়ামের পর্দা পরিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে এক একঘেয়ে বিরক্তিকর শব্দ।
বালকটি বেরিয়ে এসে বসে পাইলটের মুখমুখি। পাইলট একটা বিশাল map মাটিতে ছড়িয়ে হিসেব করছিল।
বালকঃ আমাকে একটা ভেড়া এঁকে দাও না।
পাইলটঃ আচ্ছা তুমি এখানে এলে কি করে?
বালকঃ please আমাকে একটা ভেড়া এঁকে দাও।
পাইলটঃ এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ, দুম করে আঁকা যায় নাকি? অন্য প্রশ্ন-টশ্ন- ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক হলে নাহয় কথা ছিল, আঁকা-আঁকি আমার দ্বারা হবে না।
বালকঃ তা হোক।
পাইলটঃ (বিরক্ত হয়ে) বললাম তো আমি আঁকতে জানি না।
বালকঃ তাতে কিছু এসে যায় না। তুমি একটা ভেড়া এঁকে দাও…
পাইলটঃ না।
বালকঃ (ভীষণ অবাক হয়ে) দেখো না একটু চেষ্টা করে, আমার ভীষণ দরকার ছিল।
অনন্যোপায় পাইলট স্ক্র্যু দিয়ে বালিতে আঁকে----ছবি
বালকঃ না, না, আমি অজগর সাপের আর হাতির ছবি চাই না। অজগর সাপ আমার ভয় করে, আর হাতি ভীষণ ঝামেলার। আমি যেখানে থাকি সেখানে সব কিছু খুব ছোট্ট ছোট্ট। আমার একটা ভেড়া দরকার। তুমি আমাকে একটা ভেড়া এঁকে দাও।
অগত্যা পাইলট আঁকে ভেড়ার ছবি। বালিতে আঙ্গুল চালিয়ে মুছে ফেলে আগের ছবি, স্ক্র্যু ড্রাইভারের টানে তৈরি হয় নড়বড়ে এক ভেড়া।
এটা, ওটা খুঁত ধরতে থাকে সে। পাইলট বিরক্ত হয়।
বালি খুঁড়ে গুহা তৈরি করে দেয় বৈমানিক।
পাইলটঃ এটা তোমার ভেড়ার ঘর।
বালক লাফিয়ে উঠে হাততালি দেয়।
বালকঃ ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলাম আমি। আচ্ছা ওর জন্যে কি প্রচুর ঘাস লাগবে?
পাইলটঃ না ত। গুহায় ও ঘুমিয়ে আছে, তুমি জাগাতে চাইলে তবেই ও জেগে উঠবে। একদম ঝুট ঝামেলা নেই। খাই খাই করবেই না। আর কতই বা আর ঘাস লাগবে? এইটুকু একটা তো পেট।
বালকঃ জানো, আসলে আমাদের দেশে সবকিছুই খুব ছোট ছোট..
পাইলটঃ সেটা আন্দাজ করেই তো তোমাকেও তো ছোট্ট ভেড়া এঁকে দিয়েছি আমি। আচ্ছা আমায় একটা কথা বল, এই ভেড়াটাকে নিয়ে তুমি কোথায় যেতে চাও? তুমি যেখানে থাকো সেই জায়গাটা কোথায়?
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চার।।
শাপলা- শালুকে ঢাকা জলাশয়ে টলটল করে নিকষ কালো রঙের জল। মাঝামাঝি বর্শার ফলার মতো ঢুকে পড়ে এক নৌকা, তার উপর এক রঙিন টিভির বাক্স। বাক্সে ঢাকা পরে গেছে চালক, ছোট্ট ছোটেলাল। নৌকা ঘাটে বেঁধে বাক্স নামায় ঘাটে।
আনুভূমিক পথে হেঁটে আসে ছোটেলাল, মাথায় রঙিন টিভির খালি বাক্স।
সকালের ব্যস্ততা গির্জায় তখনো শুরু হয়নি। গির্জায় দাবার ছকের মতো সাদা-কালো মেঝেয় একবার সাদা একবার কালোয় পা ফেলে হাঁটে ছোটেলাল।
যীশুর পিছন থেকে ছুট্টে বেরিয়ে আসে এক ছাগলছানা। বাক্স মাথায় ছোটেলালকে দেখে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাক্সটা রেখে দিয়ে তাকে তুলে নেয় ছোটেলাল। ছাগলছানাটা ছোটেলালের বাহুতে বাঁধা তাবিজ (মাদুলি) প্রথমে জিভ দিয়ে চাটে, তারপর পুরে দেয় মুখে, যেন চকোলেট। ছোটেলাল সেটা ছাড়িয়ে ছাগলছানাটাকে পুরে দেয় টিভির খালি বাক্সটার ভিতর।
ছাগলটা চেঁচাতে থাকে, গোঁত্তা দেয় বাক্সটাকে।
ছোটেলালঃ তুমি যদি লক্ষ্মী হয়ে থাকো, আমার কথা শোনো, তাহলে তোমাকে একটা দড়ি দেব। দিনের বেলা তুমি ওতে বাঁধা থাকবে। একটা খুঁটিও দেবো তোমায়।
ছোটেলালের পিছনের দরজায় সদ্যস্নাত মধ্য তিরিশ পাদ্রী রীভস্ এসে দাঁড়ান গাউনের বোতাম আটকাতে আটকাতে। সাদা গাউনে গির্জার কাঁচের দেওয়াল/ ছাদের বিভিন্ন রঙ।
পাদ্রীঃ সে কি সর্বনাশের কথা ছোট্টু, তুমি ওকে বেঁধে রাখবে কেন?
ছোট্টু লজ্জা পায়, তাদের নিভৃত আলাপচারিতা শুনে ফেলায়। যীশুর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে কনফেশনের ভঙ্গীতে। মাথা নিচু।
ছোটেলালঃ বেঁধে না রাখলে তো ও ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যেতে পারে!
রীভস্ এসে ছোটেলালের কাঁধে হাত দেয়।
পাদ্রীঃ হারিয়ে যাবে কোথায় বলতো ছোটেলাল?
টিভির বাক্সের মধ্যে ছাগলটা শুয়ে নিজের পা চাটছে।
O.V- (ছোটেলাল) যেখানে সেখানে। কেউ চুরি করতে পারে, জলে পড়ে যেতে পারে।
পাদ্রীঃ এতো একটা ছোট্ট জায়গা, আমরা কি কখনো হারিয়ে যাই?
গির্জার প্রধান দরজা দিয়ে কল্যাণীর সঙ্গে কুসুম ও আরও দু/চারিটি সমবয়েসী মেয়ে আসে ঠিক যেন চালচিত্রে দুর্গাপ্রতিমা। তাদের কাঁধে ব্যাগ/ হাতে বইপত্র।
কল্যাণীঃ ছোটেলাল, তোমার নৌকা দেখলাম জলে ভেসে যাচ্ছে।
সাদা-কালো খোপকাটা মেঝের উপর দিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যায় ছোটেলালের পা।
Theme Music Starts- separation
নদীর পাড়ে এসে ছোটেলাল দেখে তার নৌকা পাড়ে বাঁধা নেই। সে দেখে ইতি উতি।
শালুক-শাপলা ঠেলে এগিয়ে চলেছে একটা নৌকা, একা একা।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পাঁচ।।
ডাক্তার ট্রেতে করে প্রচুর স্লাইড নিয়ে ঘরে ঢোকে। উপর থেকে দেখলে ডাক্তারের বুকের কাছে ধরা হারমোনিয়াম, স্লাইডগুলো যেন হারমোনিয়ামের রীড। টেবিলে রেখে মাক্রোস্কোপ ঠিকঠাক করে ডাক্তার।
O. V. এ মেয়েলী কন্ঠে কেঁপে ওঠে মাইক্রোস্কোপ।
O.V. – কী যে দেখেন আপনি রাতদিন?
ডাক্তারঃ রাজকুমারী তুমি দেখবে?
ঘরের পিছনদিকে দেখা যায় কুড়ি/ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। সে মুখ ভ্যাংচায়। বিরিক্ত।
রাজকুমারীঃ ধুস। আমাকে রাজকুমারী বলেন কেন? আমার একদম ভালো লাগে না এইসব।
ডাক্তার নিরুত্তর। নিজের মনে স্লাইড দেখে, স্লাইড পালটায়।
আয়নার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবিম্বে রাজকুমারী বিভিন্ন ঢঙে কথা বলে—
-আমার নাম প্রিয়াঙ্কা।
আমি প্রিয়াঙ্কা। আমায় প্রিয়াঙ্কা বলে ডাকতে পারেন না।
প্রিয়াঙ্কা। বা শুধু প্রিয়া। যেটা আপনার খুশি। কিন্তু ওইসব রাজকুমারী-ফুমারী একদম শুনতে চাই না।
চাই না চাই না চাই না। বলে দিলাম ব্যাস। যদি আর কখনো ডেকেছেন ওইনামে-
আয়নায় হাত তোলে, হেসে ফেলে ফিক করে তার পর হাত দিয়ে স্পর্শ করে নিজের কান, ওষ্ঠ, আঙ্গুল বোলায়।
রাজকুমারী হাসে বিভিন্ন প্রতিবিম্বে, আয়নার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। চুমু খায় আয়নার ঠোঁটে।
ডাক্তার একের পর এক স্লাইড দেখে যায়। VFX- পরপর স্লাইডে ঘটে দ্রুততায়- দুটি জোড়া লাগা ঠোঁট সরে যায় দূরে।
ডাক্তারঃ এই দ্যাখো একেকটা কোষ একেকটা solar systemএর মতো, জানো এত অদ্ভূত। এ এক অন্য জগৎ। এই রক্ত প্লাজমা, অনুচক্রিকা, নাইট্রোফিল, এরা কেমন এক অন্য রঙ, আশ্চর্যময়তা তৈরি করে। আমার কেমন ছবির মতো লাগে। কখনো রাতের আকাশের মতো, কখনো আতসবাজির মতো। জানি না এই রকম শিহরণ শিল্প সৃষ্টির মুহূর্তে শিল্পী মাত্রেই অনুভব করে কি না? আমার বড় শিল্পী হতে ইচ্ছে করে, জানো!
ডাক্তার মাইক্রোস্কোপে তন্ময়, পেছনে প্রিয়াঙ্কাকে দেখা যায় শাড়ি খুলে আবার গুছিয়ে পড়ছে, বুকের উপর আঁচল ফেলে, কুচি দেয়। চুড়ির শব্দ শুনে হয়ত ডাক্তার মুহূর্তে থামেন, আবার মনোযোগ দেন মাইক্রোস্কোপে।
ডাক্তারঃ কী অদ্ভূত এইসব ঘটনা ঘটার কোনো নিয়ম নেই জানো। অথচ এটা একটা দুর্ঘটনা হতে পারে? এই যে সুন্দর হয়ে ওঠা এর পেছনে ….আচ্ছা এই যে সৃষ্টিটা হলো, এটা কে ঘটাল? তোমার কি মনে হয় আমি কেবলই দর্শক?
প্রিয়াঙ্কা ডাক্তারের চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ায়। ডাক্তার বুঝতে পেরে আরও আড়ষ্ট। মনোযোগ দিয়ে স্লাইড দেখে, মাইক্রোস্কোপ ঠিক করে। দেবী মূর্তির সামনে ডাক্তার যেন নতজানু হয়ে বসে।
Sound fx- ঝড়, সাইক্লোন।
প্রিয়াঙ্কা হাত বাড়িয়ে টেবিলের টেস্টটিউব স্ট্যান্ডে পড়ে থাকা টেস্টটিউবগুলোকে নখে করে করে বাজায়। প্রিয়াঙ্কা আঙুল ঢুকিয়ে দেয় টেস্টটিউবের মধ্যে। আঙ্গুল আটকে গেলে টেনে তোলে।
ডাক্তারঃ অথচ দ্যাখো প্রতিটা আলাদা। হয়ত উৎস এক। একই স্যাম্পল। একই রক্ত একই tissueর অংশ। অথচ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ভিন্ন তাৎপর্য, ভিন্ন সারাৎসার। হয়ত একটাই ছবি, বিভিন্ন ডাইমেনশন। তুমি পিকাসোর কথা শুনেছ?
প্রিয়াঙ্কা পেছনে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে দীর্ঘ হওয়া ডাক্তারের ছায়া দেখছিল।
O.V.( ডাক্তার) এই স্লাইডগুলো তুমি দেখবে প্রিয়াঙ্কা?
প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে এসে চেয়ারের পেছনে দাঁড়ায়, স্পর্শ দিয়ে। ডাক্তার প্রিয়াঙ্কাকে মাইক্রোস্কোপ দেখার আমন্ত্রণ জানালেও চেয়ার ছেড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র প্রয়াস দেখায় না, কেমন মুড়ে যায় শুকনো ফুলের মতন যেন দেবীর পাদ্যঅর্ঘ।
Music theme- destruction stars.
কেউ কোনো কথা বলে না।
ডাক্তারের চুলের মধ্যে রাজকুমারীর আঙুল সরে সরে যায়। চুড়ির গোছায় একটা চুড়ি আরেকটা চুড়ির গায়ে কাত হয়ে পড়ছে, স্তবক ধরে হেলেপড়ে, ঠুন ঠুন, ঠুন ঠুন ধ্বনিতে।
ডাক্তারের মাথা ঝুঁকে পড়েছে টেবিলের উপর। এই অলৌকিক মুহূর্তে তার বিশ্বাস হয় না। রাজকুমারীর স্পর্শ নেয় চোখ বুজে। টেবিলে ঠেকানো মাথা, সামনে শিবলিঙ্গের মত পড়ে মাইক্রোস্কোপ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছয়।।
লাল রঙ।
লাল রঙের মধ্যে ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু সাদা।
লালটা ধীরে ধীরে রঙ পরিবর্তন করে হয়ে যায় কালো। কালোর মধ্যে অসংখ্য আলোকবিন্দু। রাতের আকাশ।
মাথার উপরের অনন্ত আকাশ। পূর্বে- পশ্চিমে। উত্তরে- দক্ষিণে বিস্তৃত। এক রাশ জোনাকি যেন জ্বলছে নিভছে, কানে বাজে ঝিঁঝি পোকার তীব্র গুঞ্জন।
O.V. (পাদ্রী)- আমরা ভালকরেই জানি বিরাট বিরাট গ্রহগুলো, যেমন পৃথিবী, বুধ, মঙ্গল, শুক্র- যাদের আমরা নামকরণ করেছি, তারা ছাড়াও শত শত গ্রহ আছে যারা এত ছোট যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও তাদের কোনমতে দেখা যেতে পারে। জ্যোতির্বিদেরা এমন গ্রহ আবিষ্কার করলে তাদের নাম দেন না, একটা নম্বর দিয়ে দেন। এই রকম নাম, ধর, গ্রহাণু-৩২৫।
গির্জার ছাদে মস্ত টেলিস্কোপ, রাতের আকাশ দেখার বন্দোবস্ত। ডাক্তার, প্রিয়াঙ্কা, কুসুম আরও দু’একজন, একটু দূরে সাদা ছাগলছানা কোলে বসে আছে ছোটেলাল। সাদা গাউন পরে lecture দিচ্ছিলেন পাদ্রী।
একেকটি মুখ এসে টেলিস্কোপে চোখ লাগায়। এক চোখ বন্ধ, এক চোখ খোলা একেকটি মুখ আসে অন্ধকারের গোলাকৃতি জানালায়। পাদ্রীর lecture এর reaction তাদের চোখে মুখে।
প্রথমে কুসুমের মুখ। তারপর প্রিয়াঙ্কা। ডাক্তার। আবার প্রিয়াঙ্কা। ডাক্তার। প্রিয়াঙ্কা।..
অন্য একজন।
পাদ্রীর মুখ।
ছোটেলাল।
শেষ মুখ আসে ছাগলছানার। সে দু’চোখ খুলে বোবা গলায় ডাকে। চেটে দেয় লেন্স।
O.V. (রীভস্)- এই গ্রহাণুটার নাম বি-৬১২। মাত্র একবারই দূরবীক্ষণ যন্ত্রে এই ছোট্ট গ্রহটাকে দেখা গিয়েছিল। দেখেছিলেন একজন তুর্কী জ্যোতির্বিদ, ১৯০৯সালে। আবিষ্কার করার পরে তিনি খুব ঘটা করে এর তথ্য পেশ করেন আন্তর্জাতিক এস্ট্রোনমিক্যাল কংগ্রেসে। কিন্তু তার পরনে ছিল তুর্কী পোষাক তাই তার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন রীভস্। পিছনে একে একে অন্যরা নামে। তাদের নেমে আসা যেন মহাপ্রস্থানের পথ। সঙ্গী ছাগলছানা সবার সামনে।
রীভস্- ঐ গ্রহাণু-বি ৬১২ এর সৌভাগ্য যে এক তুর্কী স্বৈরাচারী শাসক এমন আইন করে দিলেন যে দেশের সমস্ত প্রজাকে সাহেবি পোষাক পরতেই হবে, নাহলে মৃত্যুদণ্ড। তাই জ্যোতির্বিদ যখন ১৯২০ আবার তার তথ্য প্রমাণ বিশ্বের দরবারে হাজির করলেন, তখন তার পরনে ছিল সাহেবি কায়দার পোশাক। এইবার তার বক্তব্য সকলে স্বীকার করে নিল।
গির্জার অভ্যন্তরে; মেরীমুর্তির চারপাশে মোমবাতি জ্বালাচ্ছিলেন রীভস্। পাশে কুসুম। তার হাতে একগুচ্ছ মোমবাতি। সে একটা একটা করে মোমবাতি তুলে দেয় রীভসের হাতে।
রীভস্- এই যে গ্রহাণু সন্মন্ধে তোমাদের এতকিছু বললাম নম্বর টম্বর দাখিল করলাম, সাল, এই সব কেবল বড়দের জন্যে। বড়রা সংখ্যা টংখ্যা ভালবাসে।
সার সার শূন্য বেঞ্চির পিছনে বসে ছোটেলাল ঘুমপাড়ানি গান গুনগুন করে ঘুম পাড়াচ্ছে ছালছানাকে। কান ভাঁজ করে কানের মধ্যেটা দেখে, ঘুম পাড়ায়। এক সময় ঘরের মধ্যে রাখা টিভির বাক্সে শুইয়ে দেয়।
O.V. (রীভস্)… যদি তাদের বল, যে…. তোমার একজন নতুন বন্ধু হয়েছে, তারা কখনো তোমায় আসল ব্যপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন করবে না। তারা কখনো তোমার কাছে জানতে চাইবে না তোমার বন্ধুর গলার স্বরটা কেমন? কোন খেলাটা ওর সবচেয়ে ভাল লাগে? ও প্রজাপতি সংগ্রহ করে কিনা?
লম্বা ঘরাঞ্চিতে উঠে গির্জার ঝাড়লন্ঠনে একটা একটা করে মোমবাতি লাগানো হয়। নীচে কুসুম হাত বাড়িয়ে মোমবাতি দেয় রীভস্কে। কাঁচের জটিল জ্যামিতির অভ্যন্তরে আলো ফুটে ওঠে, আলোর সংখ্যা বেড়ে বেড়ে যায়। কখনও আলোকিত কাঁচের পেছনে রীভস্ (কখনো sync করে O.V)-…তার বদলে বড়রা জিজ্ঞাসা করবে বন্ধুর বয়স কত? তার কয়টা ভাই? কোন ক্লাসে পড়ে? এইসব সংখ্যা থেকেই যেন বন্ধুর পরিচয়টা জানা যাবে।...
বাইরে গির্জার সামনে ছোট্ট টিলায় বসে ডাক্তার, পিছনে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়িয়ে, যেন উড়ে যেতে চায় হাওয়ায়। আঁচল উড়ছে, হাওয়া কমলে এসে আঘাত করছে ডাক্তারের মুখে। ডাক্তার চোখ বুজে সেই প্রাপ্তি অনুভব করছে, সরাচ্ছে না। পিছনে রঙিন কাঁচের গির্জা জ্বলছে ফসফরাসের মত।
O.V. (রীভস্)- যদি তোমরা বড়দের কাছে গিয়ে বল যে, একটা সুন্দর বাড়ি দেখে এলাম, পোড়া মাটির ইঁটে গাঁথা, জানলা বেয়ে মাধবীলতা উঠেছে, চালার উপরে বসে ঘুঘু পাখি গলা ফুলিয়ে ডাকছে- ওরা বাড়িটার সৌন্দর্য কিছু বুঝতে পারবে না, ওদের বলতে হবে, একটা বাড়ি দেখে এলাম যার দাম দশ কোটি টাকা বা একশো তলা উঁচু। তখন তারা নড়ে চড়ে উঠবে, বাঃ বেশ বাড়ি তো!
জলেতে গির্জার ছায়া। লাল নীল হলুদ সবুজ সব রঙ পাশাপাশি। হাওয়ায় ছায়া কাঁপে। লাল নীল হলুদ সবুজ সব রঙ নিউটনের বর্ণচক্রের মত মিশে সাদা হয়ে যায়। দূর থেকে ভেসে আসা রেডিওর শব্দে যুদ্ধের প্রস্তুতির খবর। কার কত সৈন্য অস্ত্রের হিসেব।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য সাত।।
সাদা পিটুলি গোলা বাটিতে। কল্যাণী ঘরে দাওয়ায় বসে তুলো চুবিয়ে পিটুলি দিয়ে আলপনা দেয় উঠোনে। দূরে কুসুমের হাতেও ছোট বাটিতে পিটুলি গোলা (চাল বাটা)। কুসুম দরজায় নক্সা কাটে।
কুসুমঃ মা, বাবা যুদ্ধ করে কেন?
কল্যাণীঃ যুদ্ধটা তো ওনার চাকরি। ডাক্তারকাকা যেমন ডাক্তারি করেন, পাদ্রীদাদা যেমন মাস্টারি করেন। সেই রকমই।
কুসুমঃ যুদ্ধটা আমাদের এখানে হয় না কেন? বাবা তাহলে আমাদের কাছে থাকতো?
কল্যাণীঃ এ কেমন কথা কুসুম! যুদ্ধ কি আমাদের মানুষদের সাথে হয়, যুদ্ধ হয় রাজায়-রাজায়। মন্ত্রীতে মন্ত্রীতে।
কুসুমঃ রাজা রাজার সাথে যুদ্ধ করবে। মন্ত্রী মন্ত্রীর সাথে, বাবা কার সাথে যুদ্ধ করবে মা?
কল্যাণীঃ আমি অতসব জানি না। তুমি পাদ্রী দাদাকে জিজ্ঞেস কোরো।
কল্যাণী [পিটুলি দিয়ে একটা ধানের পুঁটুলী, একটা সিঁদুরের কৌটো, একটা ধনের(টাকার) পুঁটুলী এবং একটা কাঁচা আম-সুপুরির পুঁটুলীর ঘর আঁকে/ তাতে প্রথম ঘরে রাখে ধান। দ্বিতীয় ঘরে রাখে সিঁদুরের কৌটো। তৃতীয় ঘরে রাখে মুদ্রা(coin)। চতুর্থ ঘরে আম/সুপুরি]
রণে এয়ো ব্রতর আলপনা দেয়। মন্ত্র বলে কল্যাণী। পরম নিশ্চিন্ত মনে, যেন এই জোরেই যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসবে পাইলট। একটা রাষ্ট্র পরাভূত করবে অন্য রাষ্ট্রকে।
রণে রণে এয়ো হবো।
জনে জনে সো হবো।
আকালে লক্ষ্মী হবো।
সময়ে পুত্রবতী হবো।
রণে এও সনে যান।
আকালের ভাত সকলে খান।
সরু ধানে কালো পুতে,
জন্ম যায় যেন এয়তীতে।
এক গঙ্গা গঙ্গাজলে, শুক্ল মল্লিকার ফুলে,
মরন হয় যেন সোয়ামী পুত্রের কোলে।।
রণ এয়ো ব্রত করে হই যেন স্বামীর সো।
যতকাল বাঁচি যেন না পড়ে আমার নো।।
দরজা খুলে ছোটেলাল আসে। বুকে ছাগলছানা। কুসুম দৌড়ে গিয়ে ছাগলছানা কোলে নেয়।
কুসুমঃ ছোট্টু, যুদ্ধের খবর কিছু পেলে?
ছোট্টুঃ ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছে। রাত্রে শুয়ে দু’চারটে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি আমি।
কল্যাণীঃ ওরে সর্বনাশ! কুসুম আজ পড়তে যাবে না। তুমি পাদ্রীদাদাকে বলে দিও।
ছোট্টুঃ বাসগুমটিতে ট্রানজিসটরে যুদ্ধ বলছে, কুসুমকে নিয়ে শুনতে যাব কল্যাণীমাসী?
কুসুমঃ ওরা বাবার কথাও বলছে, না মা?
কল্যাণীঃ না না কুসুম কোথাও যাবে না। ছোট্টু তুমি পাদ্রী দাদাকে বলে দিও কিন্তু। (কুসুমকে) যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে, শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। যুদ্ধ শেষ হলেই বাবা ফিরে আসবে, ততদিন তোমাকে কোথাও বেরুতে হবে না।
কুসুম অন্যমনস্ক থাকায় তার দেওয়া আলপনা চেটে খেয়ে ফেলেছে ছাগলছানা। কুসুমের কান্না পায়। কল্যাণী নিজের বাটি থেকে অবশিষ্ট পিটুলি ঢেলে দেন কুসুমের বাটিতে। হাত উঁচিয়ে চড় দেখান ছাগলছানাকে। ছাগলছানা দৌড়ে পালায় ছোট্টুর দিকে।
দূরে কোথাও বন্দুকের গুলির আওয়াজ হয়। কুসুমের হাত থেকে পিটুলির বাটি ছিটকে পড়ে। ছাগলছানা ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় দরজা দিয়ে। পেছন পেছন ছোট্টুও।
Music- Preparation of war starts.
পিটুলিগোলা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উঠোন থেকে কল্যাণী কুসুমকে বলেন-
কল্যাণীঃ দৌড়ে ঘর থেকে একটা ছেঁড়া কাপড় নিয়ে আয়..
কুসুম উঠে ঘরে যায়, সঙ্গে যায় পিটুলিগোলার পায়ের ছাপ/ যেন লক্ষ্মী আহবানের চিহ্ন।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য আট।।
গত দৃশ্যের ময়লা রঙের উপর সাদা ছোট ছোট পায়ের ছাপটা ঠিক reverse হয়ে যায়, অর্থাৎ সাদা রঙের উপর ময়লা রঙের ছোট ছোট পায়ের ছাপ। বরফের উপর দিয়ে অত্যাশ্চর্য বালক দৌড়ে আসছে বিকল হয়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের দিকে।
বিমানের নীচে বসে পাইলট। পাইলট স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা করছিল। স্টোভ পাম্প করে, আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
Music- Preparation of war ends.
বালক এসে হাত সেঁকে আগুনে।
বালকঃ আচ্ছা ভেড়ারা ছোট ছোট ঝোপ খেতে পারে তাই না?
পাইলটঃ হ্যাঁ। পারে।
বালকঃ ব্যস্, বাঁচা গেল।
পাইলট কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে দেখে বালকটিকে।
বালকঃ তাহলে ভেড়া নিশ্চয়ই বটগাছও খায়?
পাইলটঃ বটগাছ কি ছোট ঝোপ নাকি? সে তো মস্ত, বরং বিশাল বাড়ির মত। যদি একপাল হাতিও যায়, সকলে মিলে একটা বটগাছ খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
বালকঃ (হাততালি দিয়ে) এক পাল হাতি, তাই না; তার মানে একটা হাতির উপর আর একটা বসিয়ে তৈরি।
পাইলটও দুই হাত মেলে দিয়ে আগুন পোহায়। প্রথমে হাতের উপর হাত পরে পাশাপাশি।
O.V. (বালক)- বটগাছ অত বড় হয়ে ওঠার আগে তো ছোটই থাকে তাই না?
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য নয়।।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। গির্জা যেন বিচ্ছিন্ন প্রদেশ। যুদ্ধের কোন নিষ্ঠুর স্পর্শ সেখানে নেই। তেমনই কাজলা জল, লাল-সাদা শাপলা ফুল। ভিন্ন ভিন্ন গোলাকৃতি সবুজে সাজানো থালা- যেন ভোজসভা। সাদা বক, শামুকখোল, রঙিন মাছরাঙারা অতিথি সেখানে।
গির্জার সামনে অনুচ্চ সব টিলা, পেছনে নীল আকাশ।
ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কুসুম সহ পাঁচ- ছয় ছাত্র-ছাত্রী। পাদ্রী রীভস্ তাদের শোনান বিবর্তনবাদের গল্প। চার্লস ডারউইনের কথা। কোষ বিভাজন থেকে বংশগতি।
ক্রোমোজমের মত সারি বদল হয় পিঁপড়ের। এক শাপলা থেকে অন্য শাপলায় এসে বসে প্রজাপতি/ মথ/ মৌমাছি। বীজ থেকে কী করে তৈরি হয় মহীরুহ, কখনো তৈরি হয় ঘাস তা বহুবছরে বিশাল বটগাছের মত হয়ে অঠে না কখনই।
নরম ঘাসে ডুবে আছে সকলের পা। কুসুমের সাদা পায়ের পাতায় খেলা করে পিঁপড়ে। সুড়সুড়ি লাগলে পা সরিয়ে নিয়ে যায় অন্যত্র।
রীভস্ শোনান ডারউইন বাদে যোগ্যতমের উদ্বর্তন। (will be written)
সকলে DNAর মত প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে ছাদে। দেখান পাখিরা কত বীজ নিয়ে এসেছে, ফেলেছে ছাদে। অন্য গাছ না জন্মালেও ছাদের কোণে গজিয়ে উঠেছে বট/ অশ্বত্থের চারা। সেগুলো উপড়িয়ে নিচে ছুঁড়ে দেন রীভস্।
রীভস্- না হলে এরাই একদিন গ্রাস করবে গির্জাকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য দশ।।
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিরাট অশ্বত্থ গাছ। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে শুরু করে একরাশ কাক। এই গাছেই তাদের আশ্রয়।
Main theme Music/Motief – Preparation of war starts.
গাছ থেকে নেমে এসেছে অজস্র ঝুরি। ঝুলছে সাইকেলের টায়ার ঝুলিয়ে দোলনা। অজস্র কাকের চীৎকারে অস্থির দৃশ্যপট।
অশ্বত্থের চাতাল বাঁধানো হয়েছিল বহুবছর আগে, অর্ধেক ভেঙ্গেছে অর্ধেক শিকড়ই ধরে রেখেছে মুষ্ঠির মত।
কন্ডাক্টর বিমল চাতালে বসে পড়ছিল খবরের কাগজ। বুকে ঝুলছে কন্ডাকটরি ব্যাগ, ঠিক যেন বুলেটের ফিতে। সার সার বাসের পিছন থেকে হঠাৎ দেখা যায় কল্যাণী ও কুসুমকে, মা, মেয়ে ফিরছে ঘরে।
বিমলের হাতে খবরের কাগজ দেখে এগিয়ে আসে কুসুম ও কল্যাণী।
কল্যাণীঃ বিমলদা, যুদ্ধের কী খবর?
বিমলঃ না, দিদি যুদ্ধ শুরু হল কই! তবে তোড়জোড় চলছে।
কল্যাণীঃ শুরু হয়নি যুদ্ধ?
বিমলঃ না তো!
কল্যাণীঃ শুনলাম যেন শুরু হয়ে গেছে।
বিমলঃ আয়োজন চলছে। ওসব গুজবে কান দেবেন না। এই তো পরিষ্কার লিখেছে। রাষ্ট্রসংঘ আসছে দুইদেশের অস্ত্র-শক্তি পরীক্ষা করতে।
কল্যাণীঃ যুদ্ধ না হলেই বাঁচা যায়।
বিমলঃ সে কি আমাদের হাতে? দেখুন বৌদি, অনেকেই তো যুদ্ধ চায়। Politicianরা চায় তাদের ক্ষমতা জাহির করতে, কালোবাজারিরা চায়, এমনকি এই সব খবরের কাগজওয়ালারাও চায় যে যুদ্ধ হোক।
কুসুমঃ আর চায় না কে কে!
বিমলঃ অনেকেই তো চায় না কুসুমদিদি। তবে যারা চায় তাদের ক্ষমতা অনেক বেশি। আমাদের না চাওয়ার কোনো দাম নেই।
রাস্তার ওপাশের গুমটি থেকে হাঁক আসে। টাইম হয়ে গেছে, বাস চালু করতে হবে।
বিমল উঠে পড়ে কাগজ ভাঁজ করে। মা মেয়ে যায় ঘরের দিকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য এগারো।।
যুদ্ধবিমানের ভিতরে আশ্চর্য বালক ও পাইলট।
ভেতরের কারুকার্যে জটিলতা ভয়ানক জটিলতা। ভয়ানক শব্দমুখর স্থান। প্রচুর levelএ প্রচুর। information আসে চলে যায়। পাইলট ও বালকের আলাপে সেসব অপ্রয়োজনীয়।
বালকঃ সূর্যাস্ত আমার খুব ভাল লাগে।মাঝে মাঝেই আমি দেখি। একদিন জানো আমি চুয়াল্লিশটা সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। চল না একটা সূর্যাস্ত দেখে আসি।
পাইলটঃ তাহলে তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে!
বালকঃ অপেক্ষা? কিসের জন্যে?
পাইলটঃ সূর্যের অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আমাদের তো অপেক্ষা করতেই হবে।
বালক প্রথমে অবাক হয় ভীষণ, পরে যান্ত্রিকতার শব্দ ছাপিয়ে হেসে ওঠে সে।
বালকঃ সব সময় ভুল হয়ে যায় আমার, মনে হয় আমি যেন নিজের দেশেই আছি।
পাইলটঃ যুক্তরাষ্ট্রে যখন বেলা বারোটা তখন ফ্রান্সে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তুমি যদি যুক্তরাষ্ট্রে থাকো আর এক মিনিটের মধ্যে ফ্রান্সে যেতে পারো, তবে দুপুরেই সূর্যাস্ত দেখতে পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্স এতটাই দূর যে এক মিনিটে যাওয়া যায় না।
বালকঃ আমার গ্রহে জানো? চেয়ারটা কয়েক পা সরালেই হল, যখনই তোমার ইচ্ছে করবে দেখতে পাবে দিনটা কেমন ঢলে পড়ছে, সন্ধ্যা নামছে...
পাইলটঃ আমি একবার কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছানোর সময় দু’বার সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। একদম পাশাপাশি কিন্তু আলাদা দেশ তো! একবার কলকাতায় দেখলাম, আবার ঢাকায়। আধ ঘন্টা তফাতে দু’বার সূর্যাস্ত!
ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখে বিভিন্ন digital signalএর জ্বলে ওঠা- নিভে যাওয়া।
বালকঃ জানো, মনটা খারাপ থাকলে সূর্যাস্ত ভারি ভালো লাগে…
পাইলটঃ যেদিন চুয়াল্লিশটা সূর্য অস্ত যেতে দেখলে সেই দিন কি তোমার খুব দুঃখ ছিল?
বালক কোনো উত্তর দেয় না। যান্ত্রিক শব্দ, radio informationএর noiseএর কাটাকুটিতে দুজনে বসে থাকে, হতবাক।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য বারো।।
গির্জার অভ্যন্তর। মেরীমূর্তির চারিদিক ঘুরে ঘুরে মোমবাতি লাগাচ্ছিলেন ফাদার রীভস্। মেরীর পেছন থেকে কথা বলেন রীভস্। শ্রোতা মাত্র একজন। ডাক্তার। কেমন জড়োসড়ো হয়ে একা বসে, সামনের সার সার চেয়ারে।
উপর থেকে দেখলে সার সার খয়েরি রেখা। মধ্যে একবিন্দু কালো। মাথা নীচু করে বসে আছে একমাত্র শ্রোতা।
তার ঠিক বিপরীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মাতা মেরী। ঋজু। শ্বেত পাথরের সুষমতা সর্বাঙ্গে। (নীচের চারপাশে একটা একটা করে মোমবাতি জ্বালাতে থাকেন ফাদার)
মেরীর এক একটা পাশ ক্রমশ আলোকিত হয়ে ওঠে।
রীভস্- তুমি কি কখনো সমুদ্রের দিগন্তে সূর্য অস্ত যেতে দেখেছ ঋত্বিক? নিশ্চয় দেখেছ। সূর্যের উপরকার কিনারাটা দিগন্ত স্পর্শ করতে ও তারপরে অদৃশ্য হওয়া অবধি লক্ষ্য করেছ কি? তাও হয়ত করেছ। কিন্তু আকাশে যখন কোনো মেঘ নেই, সেই নির্মেঘ নীল অম্বরে আমাদের উজ্জ্বল আলোকদাতা যখন তার শেষ রশ্মি বর্ষণ করে, সেই মুহূর্তটিতে কি ঘটে খেয়াল করেছ কি? করনি তো? এই সুযোগ ছেড়ো না, লাল রশ্মির পরিবর্তে তুমি অপূর্ব এক সবুজ রশ্মি দেখতে পাবে। এরকম সবুজ শিল্পী কখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। স্বয়ং প্রকৃতিও বিভিন্ন রঙের গাছপালা বা সর্বাপেক্ষা স্বচ্ছ সমুদ্রেও এমন সবুজের শোভা সৃষ্টি করেননি।
গির্জার বাইরে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরের মৃদু আলোয় সবুজেরা পরস্পর মিশে থাকা পৃথক পৃথক অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। অনুচ্চ টিলার উপর দিয়ে সাদা ছাগলছানার পিছু ছুটে চলেছে প্রিয়াঙ্কা।
রীভস্ (O.V)- সংবাদপত্রে এই খবর পড়ে জুল ভার্নের গল্পের স্কটিশ মেয়েটি প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখতে পায়নি। তা না গেলই বা, ঘটনাটা কিন্তু সত্যি। এটা কোনো পৌরাণিক কল্পনা না, যদিও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক কিংবদন্তী। প্রকৃত প্রেমিক মাত্রেই এটি ভোগ করতে পারেন।, তার সেই মুহূর্তটির জন্যে কষ্ট স্বীকার করতেই হবে।
সাদা-কালো দাবার ছকের মত ছককাটা মেঝেয় ডাক্তারের এক পায়ের পাতার উপর রাখা অন্য পা, সঙ্কুচিত, পাশে শুয়ে ছাগলছানা। জিভ বাড়িয়ে চেটে দেয় পায়ের পাতা।
Theme Music- friendship 02 starts
ডাক্তার চোখ বুজে আচ্ছন্নের মত শুনছিলেন রীভসে্র কথা। ছাগলছানার স্পর্শে থরথর করে কেঁপে ওঠে ডাক্তারের মুখমণ্ডল।
(চঞ্চললতায় সঙ্গী সমুদ্রের গর্জন।–Sound advances)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তের।।
সমুদ্র থেকে ছুটে আসছে সেই আশ্চর্য বালক, যেন সমুদ্র থেকেই উঠে এল সে। তার এগিয়ে আসার সাথে মনে হয় সমুদ্র দূরে সরে যাচ্ছে, সমুদ্রের গর্জনও। সমুদ্রের গর্জন কমতে থাকলে একসময় তা ছাপিয়ে কানে আসে বিমানের সংবেদন।
বিকল হয়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের কাছে এসে সে থামে। মুখ উঁচিয়ে খোঁজে পাইলটকে।
যুদ্ধবিমানের সম্মুখভাগ সম্পূর্ণ খোলা, বিমানের পাদদেশে তা নামানো রয়েছে, বালির উপর, শিরোস্ত্রাণের মত। বিমানের যান্ত্রিক কোটরে বসে কিছু একটা খোলার চেষ্টা করছে প্রাণপণ।
বালক নীচে থেকে এসে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাইলটের।
পাইলটের ইশারায় বোঝা যায় সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বালকের দিকে তাকিয়ে সে আবার মন দেয় কাজে। ভীষণই ব্যস্ত সে।
বালক চড়ে বসে বিমানের খুলে রাখা সন্মুখভাগের উপর। এবার হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাইলটের। যান্ত্রিকতার শব্দ ছাপিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় পাইলটকে।
বালকঃ তুমি যে বললে ভেড়া ছোট ঝোপ খায়, তাহলে কি ফুলও খেয়ে নেয়?
পাইলটঃ ভেড়া যা পাবে তাই খেয়ে নেবে।
বালকঃ এমনকি যে ফুলে কাঁটা আছে তাও?
পাইলটঃ হ্যাঁ। হ্যাঁ তাও।
বালকঃ তাহলে কাঁটাগুলো — তাদের কাজটা কি?
পরিশ্রান্ত পাইলট জামার আস্তিনে ঘাম মোছে। পানীয় জলের বোতলের ছিপি খুলতে গিয়ে সেটা হাত ফস্কে গড়িয়ে পড়ে।
ছিপিটা বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ঠেকতে ঠেকতে নামে।
বালির উপর এমন ভাবে পড়ে, মনে হয় কোনো বোতল সেখানে পোঁতা আছে, সন্মুখভাগই কেবল দৃশ্যমান।
বালক(O.V): তাহলে কাঁটাগুলো—তারা কী কাজ করে?
পাইলটের পানীয় জলের শেষ জলবিন্দু এসে পড়ে মুখে। বোতল সরিয়ে পুনরায় সে মনোসংযোগ করে কাজে। একটা বল্টু সে খোলার চেষ্টা করছে প্রাণপণ।
পাইলটঃ (কাজ করতে করতে) কাঁটাগুলোর কোনো কাজই নেই। ফুলেরা কাঁটা রাখে কেবল অন্যকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে।
এই কথায় যেন কষ্ট পায় আশ্চর্য বালক। সে দৃশ্যত হতাশ। বসে পড়ে যুদ্ধবিমানের সন্মুখভাগের উপর।
বল্টুর চারপাশে রেঞ্জ ফলস্ পাক মারে। বল্টু খোলে না।
পাইলট রেঞ্জ রেখে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে চেষ্টা করে বল্টুটা ভেঙ্গে ফেলার।
বিশাল বালুচরে ক্ষুদ্র এক বিমানের গর্ভজাত শব্দ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে।
বালক উঠে দাঁড়ায় আবার। গলা তুলে জিজ্ঞাসা করে-
বালকঃ তাহলে তুমি সত্যিই ভাব যে ফুলেরা—
পাইলট হাতুড়ি থামিয়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে –
পাইলটঃ না। আমি কিছু ভাবি না। যা মনে এসেছে তাই বলেছি। তুমি কি বুঝতে পারছ না, আমি একটা দরকারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি?
Music- Preparation of war starts.
আশাহত চোখমুখে বালক তাকিয়ে থাকে পাইলটের দিকে।
বালকঃ কী বললে? দরকারি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত?
পাইলট ভ্রুক্ষেপ করে না। দাঁতে দাঁত চিপে সে ব্যস্ত বল্টু ভাঙ্গার কাজে।
ক্রমান্বয়ে হাতুড়ি এসে পড়ছে বল্টুর উপর।
বালক(O.V): তুমি ঠিক বড়দের মত কথা বলছ! কেমন জানো…
মুহূর্তের জন্য হাতুড়ি বন্ধ হয়। আবার শুরু হয় আক্রমণ, হাতুড়ির আওয়াজে ঢাকা পরে যায় বালকের কন্ঠ। ঠাক্ ঠাক্ ধাং ঠাক…
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চোদ্দ।।
ঠাং ঠাং ঠাং ঠাং। কাঁসরের আওয়াজ, মিশ্রিত হয় পূর্ববর্তী ধ্বনির সঙ্গে। নদীর ভাঙ্গনে কাত হওয়া রাজবাড়ির সংলগ্ন মন্দির।
মন্দিরের দাওয়ায় বসে প্রিয়াঙ্কা। পা ঝুলিয়ে, মন্দিরের দিকে পিছন ফিরে। দু’হাত কোলের উপর, পা গোড়ালির কাছে ক্রস করা। চোখ বোজা, এলো চুল—যেমন ছবিতে কিশোরী মানায় ভালো। বক্ষ বিভাজিকা থেকে হাঁটু পর্যন্ত একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি প্যাঁচানো।
বৃদ্ধ পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করে পিতলের ঘড়া থেকে জল ঢেলে দেন প্রিয়াঙ্কার মাথায়।
বন্ধ চোখের মুখমণ্ডল দিয়ে গড়িয়ে নামে জল।
কোলে জল টলমল করে পদ্মপাতার মতন।
এয়োস্ত্রীরা এসে ঝোট ঝুড়ি বা থালায় করে ফল ঢালতে লাগে প্রিয়াঙ্কার কোলে। পুরোহিত বাদে আর একমাত্র পুরুষ কোটেশ্বর মাহাতো মন্দিরে দাওয়ার নিচে ঘাসের উপর লাঠি হাতে বসে বসে লক্ষ্য করছিল সমস্ত। (সে রাজবাড়ির দারোয়ান, পুরুষানুক্রমে লেঠেল।)
আবহঃ বন্দে কাত্যায়নীমাতা ব্রহ্মার জননী মাগো।
ব্রহ্মার জননী।।
কি দিয়া পূজিব মাগো চরণ দু’খানি।
মাগো চরণ দু’খানি।।
পুষ্প দিয়া পূজিব মাগো ভ্রমরায় মধু খায়।
মাগো ভ্রমরায় মধু খায়।।
… … … …
বিল্বদলে পূজিব মাগো চরণ দু’খানি।
মাগো চরণ দু’খানি।।
প্রিয়াঙ্কার কোল উপচিয়ে ফল পড়তে থাকে।
সাদা ভিজে পায়ের উপর দিয়ে দিয়ে একটা আপেল গড়িয়ে নামে।
ঘাসের উপর এসে পড়ে আপেল, বেদানা ন্যাশপাতি ইত্যাদি ফল।
ঘাসের মধ্যে তারা বিভিন্ন দিকে গড়িয়ে যায়।
একটা ফল গড়িয়ে গিয়ে আঘাত করে সাইকেলের চাকায়।
রাজবাড়ির সামনে সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে ডাক্তার। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে প্রিয়াঙ্কাকে। যেন অলৌকিক ভাবে সে এই মুহূর্তে রাজবাড়িতে দাঁড়িয়ে।
আবহঃ বন্দে কাত্যায়নীমাতা ব্রহ্মার জননী মাগো।
ব্রহ্মার জননী।।
……………..
বিল্বদলে পূজিব মাগো চরণ দু’খানি।
মাগো চরণ দু’খানি।।
কোটেশ্বর মাহাতো নীচু হয়ে সাইকেলের চাকায় ধাক্কা খেয়ে থেমে যাওয়া ফলটা তুলে নেয়।
কোটেশ্বরর মুখ, বেশ লোভী, দৃষ্টি হাতে ধরে রাখা আপেলটার দিকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পনের।।
বাসগুমটির ভেতর। সরু বেঞ্চে শুয়ে বিমল। মুখ ঢেকে আছে খবরের কাগজে। যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের ঢক্কানিনাদ। রঙিন ছবি।
প্রায় অন্ধকার গুমটির ছোট্ট খুপরি জানালায় একটা মুখ আসে সরে যায়। ছোটেলাল।
ছোট্ট সাদা ছাগলছানাকে দেখা যায় গুমটির মধ্যে, গলা বাড়িয়ে চিবুচ্ছে খবরের কাগজ। বিমলের মুখ থেকে খবরের কাগজ সরে যায়। চোখে হয়ত আলো লাগে। বিমল হাত তুলে ভাঁজ করে রাখে চোখের উপর।।
চারপেয়ে বেঞ্চির নিচে আরেকটা চারপেয়ে, সাদা ছাগলছানা মনের সুখে খাচ্ছে খবরের কাগজ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পনের-ক ।।
একটা জানালা। একটা আঙুল তারজালির ফাঁক দিয়ে পর্দা সরানোর চেষ্টা করছে।
খাটে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে কুসুম। কল্যাণী মেয়েকে জড়িয়ে শুয়ে, চোখ বোজা। কুসুমের পিঠে মৃদু থাবা এসে পড়ছে। ঘুম পাড়ানি গান গাইছে কল্যাণী। পিছনের জানালায় উঁকি মারে একটা মুখ। ছোটেলাল।
গানঃ খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি সঙ্গে যাবে কে?
বাড়িতে আছে হুলো বেড়াল কোমর বেঁধেছে।
আম-কাঁঠালের বাগান দেব ছায়ায় যেতে
শান বাঁধানো ঘাট দেব পথে জল খেতে।
ঝাড় লন্ঠন জ্বেলে দেব আলোয় আলোয় যেতে।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব শাশুড়ি ভুলাতে।
জানালায় ছোটেলালের মুখের সামনে একটা প্লাস্টিকের তৈরি প্যানপাইপ। প্যানপাইপ থেকে মৃদু আওয়াজ বের হয়।
কল্যাণী মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকান। জানালার পর্দা টানানো, বাতাসে সেটা অল্প অল্প দুলছে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পনের –খ।।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে একা দাঁড়িয়ে অশ্বত্থ গাছ। তাতে টায়ার দিয়ে তৈরি দোলনায় দুলছে ছোটেলাল। দূরের সমস্ত কিছু ঝলসে আছে রোদ্দুরে।
O.Vএ কল্যাণীর গান ভেসে আসছে। প্যানপাইপে সেই সুরটাই বাজানোর চেষ্টা করছে ছোটেলাল।
O.V. গানঃ খুকি ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে
কিসের মাসি কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন
সারা গাছে ফুল ফুটেছে মা বড় ধন।
দৃশ্যপট দুলতে থাকে, যেন দোলনা থেকে দেখা।
গতির ত্বরণের ফলে অস্থির দৃশ্যপট কিছু অস্থির রেখায় পর্যবসিত হয়। বাসস্ট্যান্ডে পড়ে থাকা বাসগুলি। কতগুলি লোকের হাঁটা চলা, চঞ্চল সুতোর মত রেখা আসে-যায়, ঠিক যেন ক্রোমোজোমের চলন।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ষোল।।
সাদা কাগজ, ভিজে, তার উপর তুলির আঁচড়ে জলরং ছড়িয়ে পড়ে।
কতগুলি ধাবমান রেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় পৃথিবীর মানচিত্র। বর্তমান পৃথিবীর।
এর মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে একশো বছর আগের পৃথিবীর মানচিত্র।
তার মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে আরও প্রাচীন কোন পৃথিবীর মানচিত্র। এইভাবে চলতে থাকে পিছিয়ে যাওয়া।
আবহঃ চার্চসঙ্গীতে [আদম ও ঈভের।] প্রাচীন উপাখ্যান। মহাকাশ থেকে সৌরমণ্ডলের জন্ম, পৃথবীর জন্ম ইত্যাদি।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য সতের।।
চৌকো ফ্রেমের মধ্যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দ্রুতগতিতে পেছন দিকে সরে যেতে থাকে।
চলন্ত বাসের জানালায় প্রকৃতি সরে সরে যায়।
বিমল(O.V): যান দাদা, পেছন দিকে এগিয়ে যান।
এক যাত্রী জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখছিল, সে মুখ ঘুরিয়ে বিমলকে উত্তর দেয়-
যাত্রীঃ আর কত লোক নেবা?
বিমল কোন উত্তর দেয় না। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে সে হাওয়া ভাঙছে। তার চুল খাগের মত উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।
ইঞ্জিনের বনেটের উপর বসে ছোটেলাল। দু’দিকে পা ঝুলিয়ে সে বসে। কোলে সাদা ছাগলছানা। ছোটেলালের কৌতুহলী চোখ ড্রাইভার পরীক্ষিতের দিকে।
স্টিয়ারিং ধরে পরীক্ষিত বসে আছে রাজার মত।
বাঁ হাতে অবহেলায় স্টিয়ারিং বদলায় পরীক্ষিত। পা সরিয়ে আরো কুঁকড়ে বসে ছোটেলাল। ঘন ঘন হর্ণের শব্দে সে ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকায় সামনের দিকে।
বাসের সামনের কাঁচের মধ্যে থেকে দেখা যায় রাস্তার উপর ছোট বড় পাথর সাজানো। বাস-ইঞ্জিনের একজায়গায় থেমে থাকার, গুমরানির শব্দ।
ড্রাইভার পরীক্ষিত চোখ ছোট করে, মাথাটা ঝুঁকিয়ে সামনের কাঁচে ঠেকায়।
পরীক্ষিতঃ না লাগেনি। এ শালা ইস্কুলের ছোঁড়াগুলোর কাজ।।
বিমল লাফ দিয়ে রাস্তায় নামে।
পরীক্ষিত পাশের জানালা দিয়ে মুখ বার করে থুতু ফেলে রাস্তার উপর।
সামনের কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখা যায় বিমল দ্রুতহাতে রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরগুলো তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছে রাস্তার পাশের জঙ্গলে।
Off voiceএ যাত্রীদের কথা শোনা যায়।
যাত্রী১- এ স্কুলের ছেলেগুলোর কাজ। ঠিকই তো করেছে। আজ বাস লেট আধঘন্টা। সব বোধ হয় হেঁটেই বাড়ি চলে গেছে!
যাত্রী২- বাঁচা গেছে। ছোঁড়াগুলো সুবিধের নয় খালি মুখে খারাপ খারাপ কথা।
যাত্রী৩- কোন স্কুল?
যাত্রী৪- যাবে তো সব বিনে পয়সায়। একটা ছোঁড়া টিকিট কাটে না।
যাত্রী২- ওদের মাশুলও তো আমাদের গুনতে হয়। বছর বছর ভাড়া বাড়ছে।
যাত্রী৪- বাবা-মার কাছ থেকে কি আর পয়সা নেয় না? সে সব পয়সা দিয়ে দ্যাখো বিড়ি ফুঁকছে… ভিডিও দেখছে…
যাত্রী৫- দেশের তো দেখছি এই হাল। এরা বড় হলে তো সব উচ্ছন্নে যাবে।
যাত্রী১- আরে বাবা আধঘন্টা লেট তো গিয়ে একঘন্টায় দাঁড়াবে… একটু তাড়াতাড়ি সাফ করুন।
যাত্রী৪- বাবু মানুষ, পাথর ঠেলতে হাত সরছে না। পয়সা দিয়ে দেখুন, সঙ্গে সঙ্গে খপাৎ।
(O.V) – সমবেত হাসির রোল ওঠে। কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় ছাগলছানা কোলে ছোট্টু গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিমলের পাশে।
বাসের অদূরে বিমল রাগে গজগজ করতে করতে পাথর সরাচ্ছে। পাশে ছোট্টু এসে দাঁড়ায় কোলে ছাগলছানা।
বিমলঃ ঠিক টাইমে বাস না চালালে তো হ্যাপা বাড়বেই।… কত লোকের অসুবিধা হয়… এরপর লোকে যখন ক্ষেপে যাবে... তখন বুঝবে…। ….ইস্কুলের ছেলেগুলো তো ক্ষেপেছে।… আর লোকেরও বলিহারি… তাদের যাবতীয় রাগ ঝাড়বে এই বাসখানার উপর। পার্বতীর কাঁচ ভাঙবে, বডি দুমড়ে দেবে, পার্বতীর দোষটা কি? … অবোলা জীব কথা বলতে পারে না।
পরীক্ষিত ড্রাইভারের সীটে বসে আছে রাজার মত। রিয়ার ভিউ মিরর হাতে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে।
প্রতিচ্ছবিতে চুল আচঁড়ায়।
হাত দিয়ে রিয়ার ভিউ মিরর ঠিক জায়গায় সরিয়ে রাখে। আয়নায় দেখা যায় পরের বাস আসছে পিছনে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য আঠেরো।।
বিকল হয়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের কাঁচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছিল পাইলট।
প্রতিচ্ছবির মধ্যে দেখা যায় দূর থেকে ছুটে আসছে আশ্চর্য বালক। দূর থেকে ধেয়ে আসছে বৃষ্টি। ফোঁটায় ফোঁটায় জল এসে পড়ে কাঁচের উপর, প্রতিচ্ছবি ঝাপসা হয়ে যায়।
উত্তপ্ত বালির উপর আছড়ে পড়ে বৃষ্টি।
দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।
Theme Music- Friendship (separation) starts.
বালকঃ বিদায়।
পাইলট কোন কথা বলে না। বালক আবার বলে- বিদায়।
পাইলটঃ আমি বোকার মত কাজ করেছি… তুমি ক্ষমা কর আমাকে। ভালো থেকো…
… তোমাকে সত্যিই ভালবাসি আমি। এতদিন তুমি যদি সেটা বুঝতে না পেরে থাকো সে দোষ আমার… যাক্গে এই উইন্ডচিটারটা তুমি রেখে দাও… এভাবে বৃষ্টিতে ভিজো না তুমি।
নিজের গা থেকে উইন্ডচিটারটা খুলে বালককে পরিয়ে দেয়-
বালকঃ ঠান্ডায় কষ্ট হবে না তোমার?
পাইলটঃ(হাসি) ঠান্ডা লাগার ব্যপারটা তেমন মন্দ কিছু নয়, কী বল?
বালকঃ আর বৃষ্টি?
পাইলটের হাতের তালু পাতা, তার উপর এসে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা।
পাইলটের চোখ বন্ধ, মুখ কাত করে বৃষ্টি নিচ্ছে মুখে।
পাইলটঃ (চোখ বন্ধ) তুমি চলেই যাবে ঠিক করেছ?
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য উনিশ।।
কুসুম একা শুয়ে আছে খাটে। কল্যাণী এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকে।
কল্যাণীঃ উঠে পড়, উঠে পড় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
কুসুমের চোখ পিটপিট করে।
কল্যাণীঃ (O.V): নে ওঠ। ছোট্টুরা এসেছে ধর্মঠাকুরের পাল্কি নিয়ে।
বাইরে সমবেত কন্ঠে ছড়া আওড়ায় ছেলের দল (O.V)। ঘেঁটু পুজোর ছড়া। কুসুম একটু উঠে ফের শুয়ে পড়ে কল্যাণীর কোলে মাথা দিয়ে।
উজানেতে থাকিরে কন্যা
ভাটির দেশে বাড়ি
সত্য করে দিলাম পরিচয়
বিয়ে নাকি করি।।
একেলা ঘরে শুইয়া থাকি
মুশুরি টানিয়া
নয়া যৈবন বাহির হইতে চায়
অঞ্চল ছিঁড়িয়া
কাঙ্খের কলসি ফেইলা দিয়া
যাব তোমার সনে।।
Off screen soundএ প্যানপাইপের আওয়াজ। কুসুম উঠে বসে তড়াক করে।
বাইরের আধো অন্ধকারে ৮-১০জন ছেলের দল দাঁড়িয়ে।
কাঁধে বাঁশে ঝোলানো রথের মত ঘর। ভেতরে মোমবাতি জ্বলছে। চারপাশ উপচে পড়ছে ঘেঁটু ফুলে। সবুজ বড়বড়া পাতা আর সাদা থোকা থোকা ফুল। দু’পাশে বাঁশে ঝোলানো হ্যাজাক।
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কুসুম। পেছনে কল্যাণী।
ছড়া আউড়ায় ছেলের দল। সুর করে করে।
নাও চাপাও নাও চাপাও
ওহে সুন্দর নাইয়া
আমার এইহি ঘাটে।
খাটা খোটা নাইয়ারে তুমি
মুখে চাপ দাড়ি
সত্য করে বল রে নাইয়া
কোথায় তোমার বাড়ি?
কুসুম মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে।
পেছনে দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর দেন কল্যাণী, হাসিতে। যেন মাতা মেরী। হাত বাড়িয়ে পয়সা দেন কুসুমকে।
কুসুম এগিয়ে এসে পয়সা রাখে ধর্মরাজের কাছে। সুর করে ছড়া আউড়ায় ছেলের দল।
ছড়া আউড়াতে আউড়াতে বাঁশ কাঁধে বেরিয়ে যেতে থাকে বালকের দল।
উজানেতে থাকিরে কন্যা
ভাটির দেশে বাড়ি
সত্য করে দিলাম পরিচয়
বিয়ে নাকি করি।।
একেলা ঘরে শুইয়া থাকি
মুশুরি টানিয়া
নয়া যৈবন বাহির হইতে চায়
অঞ্চল ছিঁড়িয়া
কাঙ্খের কলসি ফেইলা দিয়া
যাব তোমার সনে।।
সবার পেছনে আনন্দে প্যানপাইপ বাজাতে বাজাতে চলেছে ছোট্টু।
Off voiceএ কুসুম ডাকে তাকে-… বন্ধু…
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য কুড়ি।।
কুয়াশা মাখা ভোর। নদীর বাঁক ধরে হেঁটে চলেছে রাজকুমারী। হাতে ফুলের সাজি। পেছন পেছন চলেছে কোটেশ্বর মাহাতো। ঠান্ডাতেও তার উর্ধাঙ্গে কোন আবরণ নেই। পোড়া রঙের তেল চকচকে শরীরে ঠিকরে পড়ছে সকালবেলার রোদ।
নদীর বাঁকে শিবমন্দির। পোড়ো মন্দির।। চারপাশে বেশ কিছু ফুলের গাছ। জবা, টগর, কল্কে। গাছের তলায় এসে থামে দুজনে।
লাফিয়ে লাফিয়ে ফুল পাড়ে প্রিয়াঙ্কা। পেছনে দাঁড়িয়ে কোটেশ্বর তাকিয়ে আছে প্রিয়াঙ্কার শরীরের দিকে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে।
একটা ডাল। তাতে ঝুলছে বেশ কিছু ফুল। প্রিয়াঙ্কার হাত বারবারের চেষ্টাতেও নাগাল পায় না ফুলের। কোটেশ্বরের হাত এসে নামিয়ে ধরে ডালটা।
কোটেশ্বর তার পেশীবহুল হাত দিয়ে ডালটা নামিয়ে মাথা নীচু করে অপেক্ষা করছে রাজকুমারীর জন্যে। প্রিয়াঙ্কা কোটেশ্বরর অযাচিত ব্যবহারে কিছুটা থতমত। লাফালাফির জন্যে তার বুকের আঁচল সরে গেছে একপাশে, কিঞ্চিত হাঁফিয়ে উঠেছে। জোরে শ্বাস নেয় কোটেশ্বরর দিকে তাকিয়ে।
আবহ- সিলেটি ধামাইল/বিজয়া গান- জুড়ো করি ঐরাবত/ সাজাইয়া পুষ্পরথ/ শিবের সনে যাইতা রে কৈলাস/ যায় রে গৌরী ভেসে যায়।।
রাজকুমারীর দিকে পিছন ডাল নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোটেশ্বর, ইচ্ছে থাকলেও সে তাকাতে পারে না প্রিয়াঙ্কার দিকে। প্রিয়াঙ্কার ধবধবে সাদা হাত এসে পড়ে কোটেশ্বরর তুলে রাখা ডান হাতের উপর। প্রিয়াঙ্কা ফুলের সাজি সমেত হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কোটেশ্বরর বক্ষদেশ। প্রিয়াঙ্কার শরীরের সমস্ত ভার এসে পড়ে কোটেশ্বরর শরীরের উপর।
রাজকুমারীর শরীর আছড়ে পড়ে মন্দিরের পাশের দেওয়ালে-টেরাকোটায় চিত্রিত-রাবণের সীতাহরণ- ম্যুরালের উপর।
ফুলের সাজি মন্দিরের চাতালে ঠোক্কর খেয়ে কাত হয়ে পড়ে ঘাসে, ঠিক যেন শকুন্তলার অঙ্গুরীয়র অবগাহন যাত্রা।
সাদা-লাল জবা-টগর ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ ঘাসের মধ্যে। ঠিক যেন প্রকৃতি মুখ ঢেকেছে কুমারী রক্ত ও শ্বেত বীর্যে।।
মন্দিরের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কা। এলো চুল, চোখ বোজা। বুক থেকে আঁচল খসে লুটোচ্ছে মন্দিরের চাতালে। প্রিয়াঙ্কাকে মন্দিরের দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে কোটেশ্বর। পাগলের মত চুম্বন করছে ঘাড়, গলা। কোটেশ্বর তার মুখ ঘষতে থাকে প্রিয়াঙ্কার ব্লাউজের উপর।
আবহঃ নদীর ওপার থেকে ভেসে আসে নাফিল নামাজের আজান।
কোটেশ্বরের কৃষ্ণবর্ণ হাত প্রিয়াঙ্কার সাদা টান টান চামড়ার পেটের উপরিপথ পরিভ্রমণ করে প্রবেশ করে পেটিকোট/শায়ার মধ্যে।
আবহে- গির্জার ঘন্টাধ্বনি মিশে যায় পূর্ববর্তী আবহের সঙ্গে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য একুশ।।
সাদা-কালো খোপ খোপ কাটামেঝের মধ্যে দুই সার দেওয়া বেঞ্চ-চেয়ার। মধ্যে প্রশস্ত পথ সেই সেই পথের শেষে দাঁড়িয়ে কালো গাউনে ফাদার রীভস্ নিবিষ্ট চিত্তে বাইবেল পাঠ করে চলেছেন। শ্রোতা যদিও কেউ নেই। সুর করে করে বাইবেলের গল্প বলে চলেছেন রীভস্। সাদা ছাগলছানা হেঁটে আসে দুই সারির মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়ে। তার ডাকে পাঠ থামিয়ে বাইবেল থেকে মুখ তুলে তাকান ফাদার।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য বাইশ।।
আশ্চর্য বালক হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় এক বালির ঢিবির নিচে। বালির ঢিবির উপর বসে আছেন এক বৃদ্ধ রাজা।
সহজ ডিজাইনের জমকালো ফুলকারী নক্সায় সাজানো সিংহাসনে বসে তিনি যেন প্রতীক্ষা করছেন কারো জন্য। তাঁর জমকালো পোশাক এতটাই লম্বা যে পায়ের দুপাশ বেয়েও গড়িয়ে পড়েছে অনেকটাই। বেগুনী পোশাক বিছিয়ে আছে হলুদ বালির উপর।
রাজাঃ এস এস।
বালক চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে রাজার পোশাক। ভারি ক্লান্ত সে। দাঁড়িয়ে থেকে হাই তোলে সে।
রাজা বিরক্ত হন। মুখের সামনে হাত এনে আবার হাই তোলে বালক।
রাজাঃ এসব কী হচ্ছে? তুমি কি ভুলে গেছো রাজার সামনে হাই তোলা দণ্ডনীয় অপরাধ? আমাকে অবজ্ঞা করছ তুমি?
বালকঃ (লজ্জা পেয়ে) আসলে অনেক দূর থেকে আসছি তো… ঘুম হয়নি পথে…
রাজাঃ আচ্ছা তাই… তাহলে আমি হুকুম করছি তুমি হাই তোল। আসলে বহুবছর বাদে আমি কাউকে আমার সামনে হাই তুলতে দেখলাম… মন্দ লাগছে না!
বালক জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চুপ করে।
রাজাঃ কী হল হাই তোলো? এটা আমার হুকুম।
বালকটি মুখ নামিয়ে নেয়-
বালকঃ আমার ভীষণ ভয় করছে। আমার আর হাই উঠছে না।
রাজাঃ আমি কোন অবাধ্যতা বরদাস্ত করি না। আমার হুকুম তুমি-
বালকঃ আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি… অন্য হুকুম করুন না যা পালন করা যায়!
রাজা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেন।
বালকঃ আমি কি একটু বসতে পারি?
রাজাঃ আমি তোমাকে বসতে হুকুম করছি।
রাজা খুবই রাজকীয় কায়দায় লোমের পোশাকের একপ্রান্তে বসতে অভ্যর্থনা জানান।
বসার পর বালক লক্ষ্য করে রাজার সিংহাসন ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে বালির মধ্যে। খুব ধীরে ধীরে।
বালকঃ আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
রাজাঃ আমি তোমাকে প্রশ্ন করতে হুকুম করছি।
বালক হেসে ফেলেও তা সম্বরণ করে নেয়।
বালকঃ আপনি কাদের নিয়ে রাজত্ব করেন?
রাজাঃ সমস্ত কিছুর উপরে।
বালকঃ সমস্ত কিছুর উপরে?
রাজাঃ এই গ্রহ, অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ আর নক্ষত্রদের উপরে।
বালকঃ এই সমস্ত কিছুর উপরে!
রাজাঃ হ্যাঁ সমস্ত কিছুর উপরে। সর্বত্র।
বালকঃ আপনিই... ঈশ্বর…
রাজাঃ ঈশ্বর? … না না আমি রাজা, অন্য সকলেই আমার প্রজা।
বালকঃ সূর্য…সূর্যও আপনার কথা শোনে?
রাজাঃ সবাই। আমি যা হুকুম করি সবাই তক্ষুণি তক্ষুণি সেটা পালন করে। অবাধ্যতা আমি পছন্দ করি না।
বালকঃ আপনি যদি সূর্যকে অস্ত যেতে বলে্ন, সে তক্ষুণি অস্ত যাবে? চুয়াল্লিশ, একশো, দুশো- যতবার আপনি বলবেন?
রাজাঃ (হেসে) হুঁ।
বালকঃ আমার একটা সূর্যাস্ত দেখতে ইচ্ছে করছে… দেখান না…
রাজাঃ আমি কী করব?
বালকঃ সূর্যকে অস্ত যেতে হুকুম করুন।
রাজাঃ আমি যদি মন্ত্রীকে হুকুম করি প্রজাপতির মত একটা কদম ফুলের উপর বসতে কিম্বা সেনাপতিকে বলি জীবনানন্দের মত একটা কবিতা লিখতে তা কি কোনদিন সম্ভব। অসম্ভব জিনিস আমি হুকুম করতে পারি না। একজন যে কাজটা করতে সক্ষম তার কাছ থেকে ততটাই দাবি করতে হয়। যুক্তিহীন দাবি নিয়ে লোকের উপর কর্তৃত্ব করা অসম্ভব। দেশবাসীকে যদি হুকুম করা হয়, যে তোমরা সমুদ্রে ঝাঁপ দাও, তাহলে তারা বিদ্রোহ করে উঠবে। আমি এমন আদেশই করি যেগুলো পালন করার যোগ্য। সেজন্যেই আমি কর্তৃত্ব করতে পারি। আমি কাউকেই অখুশি করতে চাই না।
বালকঃ আমার সূর্যাস্ত?
রাজাঃ তোমার সূর্যাস্ত তুমি পাবে। সেই আদেশ আমি দেব। ... কিন্তু আমার নীতি অনুসারে আমাকে সময়োচিত পরিস্থিতির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
বালির ঢিবির মধ্যে রাজা সিংহাসন সমেত ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছেন। তার শরীরের প্রায় অংশই বালির মধ্যে।, মুকুটধারী রাজার মাথাটুকুই এখন জেগে, এ যেন অন্য সূর্যাস্ত।
বালকঃ (O.V) কখন সে সময় আসবে?
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তেইশ।।
রাজবাড়ির বিশাল ছাদে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন রাজা রবীন্দ্রনাথ। সারা শরীর ঢাকা চাদরে, মুখটাই কেবল বাইরে।
আবহ-দূরে রেডিওতে ভেসে আসছে (কার্গিল) সীমান্তের খবর।
ইজিচেয়ারে অর্ধশায়িত রাজা রবীন্দ্রনাথ দেখছিলেন বুকের কাছে তুলে ধরা এক পঞ্জিকা। কুষ্ঠ আক্রান্ত হাত দিয়ে পঞ্জিকার পাতা ওল্টান রাজা। ওল্টানোর পরই সেই হাত ঢুকিয়ে নেন চাদরের তলায়।
ধীর পায়ে ডাক্তার এসে দাঁড়ায় সামনে। রাজা বুকের উপর পঞ্জিকা নামিয়ে তাকান ডাক্তারের দিকে।
ডাক্তারঃ গুড আফটার নুন। পঞ্জিকায় কী দেখছেন? প্রিয়াঙ্কার বিয়ে ঠিক করলেন নাকি?
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ নাহ, কুঠো রুগীর ঘরের মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না ডাক্তার। এই দেখছিলাম, সংক্রান্তিটা কবে পড়েছে। তা তুমি আমার কাছে? কী দাবি বলে ফেল।
ডাক্তারঃ এখানে আমার কিছুই করার নেই, তাছাড়া ডাক্তারি করতেও ভাল্লাগছে না… ভাবছি কলকাতাতেই ফিরে যাব,
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ থাক। থেকে যাও। যেও না। হেলথ সেন্টারে যদি তোমার ভাল না লাগে… তোমাকে অন্য কাজ দেব আমি।
ডাক্তারঃ কী কাজ? রাজবৈদ্যের?
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ (হাসি) আমি বৃদ্ধ হয়েছি সবকিছুর উপর ঠিকঠাক নজর রাখতেও পারি না… বাড়িটার এই দশা… তাছাড়াও জমিজমা...
আকাশে একদল পাখি সরল জ্যামিতি তৈরি করতে করতে উড়ে যায়
ডাক্তারঃ(দেখতে দেখতে) ওসব আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ (হাসি) আর রাজবৈদ্য… সেটা তো হতে আপত্তি নেই?
ডাক্তারঃ আমি তো বলেইছি আপনার কলকাতায় গিয়ে নিয়মিত স্পেশালিস্ট দেখানো উচিত। এই কুষ্ঠ সেরে যাবে তবে সময় লাগবে।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ আহা আমি কি আমার জন্যে থাকতে বলেছি? চিকিৎসা করার জন্য আমি ছাড়া কি কেউ নেই রাজবাড়িতে?
ডাক্তারঃ তালাবন্ধ সব সারি সারি ঘর। লোকজন কোথায়?
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ কেন প্রিয়াঙ্কা?
প্রিয়াঙ্কার কথায় কুঁকড়ে যায় ডাক্তার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নিচের দিকে। কাত হওয়া রাজবাড়ির পাশ দিয়ে তিরতির কয়ে বয়ে চলেছে এক নদী।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ আমার বয়েস হয়েছে… প্রিয়াঙ্কাকে ঠিকমত বুঝতেও পারি না আজকাল…ওর মা-ও নেই… ও তো তবু তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলে…আগে তো একা একা ঘর বন্ধ করে কাঁদত…
ডাক্তারঃ রবীন্দ্রনাথবাবু, আমিও ঠিক ওকে.. বুঝতে পারি না!
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ তুমিই বিচার কর। সেটা অবশ্য শক্ত। অন্যদের বিচার করার চাইতে নিজের বিচার করা আরো কঠিন। যদি সত্যি সত্যিই নিজের উপযুক্ত বিচার করতে পার তাহলে যথার্থ তুমি একজন বিজ্ঞ মানুষ।
ডাক্তারঃ হুঁ…কিন্তু নিজের বিচার আমি যেখানে সেখানে করতে পারি। তার জন্য এখানে থাকার কোন দরকার নেই।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ তা ঠিক…তা ঠিক। এখানে থাকার দরকার নেই... একা থাকারও তো দরকার নেই, ডাক্তার। বয়স বলে তো একটা জিনিস আছে, বিয়েটা করে ফেলা উচিত।
ডাক্তারঃ এবার আমায় যেতে হবে। আমি আসছি।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ না।
ডাক্তারঃ মহারাজা যদি আমাকে দিয়ে তাঁর আদেশ পালান করাতে চান তাহলে একটা যোগ্য আদেশ দিন।… যেমন তিনি আমাকে হুকুম করতে পারেন…এক মিনিটের মধ্যে বিদায় হও।
রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
রাজাঃ মেয়েটাকে কষ্ট দিও না ডাক্তার। প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে একবার কথা বল!
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলতে শুরু করেন।
সিঁড়ি দিয়ে স্লো মোশনে আস্তে আস্তে নামতে থাকেন ডাক্তার।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ (O.V.) তোমাকে আমার রাজদূত করে পাঠালাম।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চব্বিশ।।
গান।। টুসু গান
আমার টুসু ধনে বিয়া দিব কেমনে
প্রায় অন্ধকার নিষ্প্রভ আলোয় সহজপাঠ বর্ণিত এক রান্নাঘরে রান্না করে কল্যাণী।
কল্যাণী পিঠে তৈরি করে।
কুসুম দাওয়ায় বসে পিঠে খায়। বাইরে সম্পূর্ণ চাঁদ।
কুসুম ও কল্যাণী পিঠে খায়, খাওয়া দাওয়া করে নিষ্প্রভ আলোয়। একটা ছাইরঙা বিড়াল কুসুমের কাছে ঘোরাঘুরি করে।
ছাইরঙা বিড়ালের মুখ, চোখ বুজে বোবা গলায় ডাকে।
উঠোনের একপাশে বিড়ালকে খেতে দেয় কল্যাণী।
বিড়াল বাঘের মত পা ভাঁজ করে খাবার খায়, একা একা।
প্রশস্ত খাটে মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে ছোট্ট কুসুম। মা কুসুমের গায়ে মৃদু আঘাত করে করে ঘুম পাড়ায়।
কুসুম ও কল্যাণী জড়াজড়ি করে শুয়ে। আস্তে আস্তে কল্যাণীর হাত থেমে যায়। কুসুম খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে।
প্রশস্ত খাটে শুয়ে কুসুম ও কল্যাণী। কুসুম অপেক্ষা করছে উঠে যাওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে মায়ের হাত সরিয়ে উঠে পড়ে কুসুম। প্রশস্ত খাটে একা শুয়ে কল্যাণী, আলুলায়িত পোশাক, পায়ের দিকে শাড়ি উঠে গেছে অনেকটা, খোপা আলগা, বুকে শাড়ি জায়গায় নেই ঠিকঠাক, ঠিক যেন প্রতীক্ষারতা উমা। (রেফারেন্স- বেঙ্গল স্কুল- নন্দলাল)
দেড়তলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একা কুসুম তাকিয়ে আছে বাইরে।
বিরাট অশ্বত্থ রাত্রি ঘন করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্নান করছে জ্যোৎস্নায়। শহর থেকে শেষ বাস এখনো ফেরেনি, গুমটির ক্ষীণ আলো তার প্রমাণ। গুমটির বাইরে একটা বেঞ্চে বসে দুজনে গুলতানি করছে। পরিচিত দৃশ্যে সাইকেলে গান গাইতে গাইতে রামেশ্বর। সাইকেলের হাতলে সে হাত দেয় না। ঢোল বাজিয়ে গাইতে গাইতে সে সাইকেল চালায়। দূর থেকে চোখে পড়ে দুটো আলো, শেষ বাস ফিরছে শহর থেকে।
গাছতলার অন্ধকারে সন্তর্পণে একা দাঁড়ায় কুসুম। ‘পার্বতী’ এসে দাঁড়ায় ক্লান্ত শরীরে। প্রথমে আলো পরে শব্দ বন্ধ হয়। একে একে সমস্ত যাত্রী ফিরে জয়ায় ঘরে। গুমটির চায়ের দোকান থেকে একটা বাচ্চা এসে দু’জনকে দিয়ে যায় দু’বোতল মদ, গ্লাস, জল।
কুসুম দোলনা আঁকড়ে গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকে একা একা। মাথার উপর সহস্রনাগের মত ফণা ধরে আছে বিরাট অশ্বত্থ। দূরের আকাশে বিষন্ন একাকী চাঁদ।
মোটর সারাই এর দোকান বন্ধ। পাশেই একটা নতুন খোলা কামারশালা। সেখানে উত্তপ্ত লাল লোহা পিটিয়ে পিটিয়ে ধারালো অস্ত্র বানায় কামার। সামনে সাজানো নতুন ঝকঝকে সব অস্ত্র, হাতলহীন, ছোরা, ছুরি, ভোজালি, কাস্তে।
গুমটির সামনের বেঞ্চে রাজার মত বসে মদ্যপান করছে পরীক্ষিত। নীচে বিমল পা ছড়িয়ে বসে মাটিতে খুচরো ঢেলে গুনে চলেছে। পাশে একাধিক বোতল, মদের। কুসুম ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ায় বিমলের কাছে।
পরীক্ষিত বেঞ্চে বসে গুমটিতে ঠেস দিয়ে, যেন রাজার মত আরামকেদারায় বসে। কুসুমকে হাত দিয়ে কাছে ডাকে। মাথায় শহর থেকে কেনা ইন্ডিয়া লেখা টুপি। টুপি খুলে অভিবাদন জানায় কুসুমকে। কুসুম হাততালি দেয়। মাতাল পরীক্ষিত টুপি খুলে তার অভিনন্দন গ্রহণ করে। যতবার কুসুম তালি দেয় মাতাল পরীক্ষিত ততবার টুপি খুলে কুসুমের অভিনন্দন গ্রহণ করে।
মাটিতে দু’পাশে পা ছড়িয়ে বসে বিমল। দুই দিকে ছড়ানো দুই পা মধ্যে খুচরো পয়সা, গ্লাস, উলটানো বোতল। কুসুম উবু হয়ে তার পাশে বসে মাটিতে। বিমল খুচরো পয়সার tower ভাঙ্গে আর মেশায়, বাচ্চা ছেলের মত খেলায় মেতেছে সে। কুসুম উঠে চলে আসে।
প্রশস্ত খাটে শুয়ে কুসুম ও কল্যাণী। মা-মেয়ে দুজনেই ঘুমোচ্ছে। পিছনে জানালার পর্দা অল্প অল্প দুলছে হাওয়ায়।
বেঞ্চির উপর বসে, গুমটির গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে পরীক্ষিত।
বেঞ্চির নিচে পা ছড়িয়ে বসে একা একা পয়সা গুনে চলেছে বিমল।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পঁচিশ।।
সমুদ্রতীর, একা দাঁড়িয়ে এক লাইট হাউস। তীরে বালি- তটে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র। তার উপর খাড়া দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল দিনের আকাশ। ঢেউএর শব্দ ছাড়াও অন্য এক শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চরাচরে।
(O.V.)- দুশো ছাপ্পান্ন… দুশো ছাপ্পান্ন… সাতান্ন… সাতান্ন…
পাকদণ্ডী সিঁড়ি ঘুরতে ঘুরতে স্পর্শ করেছে নিচ, লাইট হাউসের ঘোরালো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে আশ্চর্য বালক।
(O.V.)- দুশ সাতান্ন... দুশ সাতান্ন... দুশ সাতান্ন... আর এক... দুশ আটান্ন... দুশ আটান্ন..
লাইট হাউসের ছাদে এক ব্যক্তি টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে বসে। তারই কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ছিল চরাচরে। মনে হয় সে কিছু গুনছে। তার পিছনে এসে দাঁড়ায় আশ্চর্য বালক।
সে এত ব্যস্ত মাথা তুলে দেখার সময়ও তার নেই। সে টেলিস্কোপ একটু ঘুরিয়ে আবার গুনতে থাকে।
বালকঃ তোমার সিগারেট নিভে গেছে..
লোকটার হাতে ধরা একটা লম্বা সিগারেট, টেলিস্কোপের মতই, কিছুটা জ্বলে নিভে গিয়েছে সেটা।
(O.V.)- আটান্ন আর তিন একষট্টি… আর দুই তেষট্টি… আর পাঁচ আটষট্টি… ওটা জ্বালবার মত সময় এখন নেই আমার..আটশষট্টি… তাহলে হল পঞ্চাশ কোটি ষোল লক্ষ বাইশ হাজার দুশ আটষট্টি।
আশ্চর্য বালক ঝুঁকে পড়ে তার ঘাড়ের কাছে।
বালকঃ পঞ্চাশ কোটি কী?
লোকঃ – তুমি এখনো আছো? আটষট্টি… আটষট্টি… আমার হাতে একদম সময় নেই তুমি এখন কেটে পড়ো। আমি এখন ব্যস্ত।… আজেবাজে প্রশ্ন নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে পারব না।… আটষট্টি... আর দুই সত্তর… সত্তর…
বালকঃ পঞ্চাশ কোটি কী?
লোকঃ ...ঝামেলা… পঞ্চাশ কোটি ষোল লক্ষ বাইশ হাজার দু’শ সত্তর.. দু’শ সত্তর..
বালকঃ পঞ্চাশ কোটি কী?
লোকঃ ঐ ক্ষুদ্র বস্তুগুলো যেগুলো মাঝে মাঝে আকাশে দেখা যায়.. সত্তর … সত্তর…
বালকঃ মাছি?
লোকঃ সত্তর… আরে না, ছোট ছোট... চকচকে…
বালকঃ জোনাকি?
লোকঃ ধুস্.. নারে বাবা না, .. সত্তর … সত্তর… আরে তুমি জানো না… এগুলো আকাশে ভাসে… দপদপ করে.. অলস লোকেরা স্বপ্ন দেখে… কবিতা লেখে…
বালকঃ আর তুমি?
লোকঃ দেখছ না আমি ব্যস্ত.. স্বপ্ন টপ্ন দেখার সময় নেই আমার।… সত্তর… সত্তর…
বালকঃ আমি ভেবেছিলাম তুমি ঢেউ গুনছ!
লোকঃ পাগল!... সত্তর আর এক… একাত্তর… একাত্তর…
বালকঃ তুমি কি নক্ষত্র গুনছ?
লোকঃ হ্যাঁ... হ্যাঁ... নক্ষত্র... তারা... একাত্তর... একাত্তর…
বালকঃ কোটি কোটি তারা নিয়ে তুমি কী কর?
লোকঃ দেখছ না গুনছি… পঞ্চাশ কোটি ষোল লক্ষ বাইশ হাজার দু’শ একাত্তর…আমার গুনতিতে কোন ভুল নেই।
বালকঃ এত তারা নিয়ে তুমি কী কর?
লোকঃ একাত্তর আর তিন.. চুয়াত্তর চুয়াত্তর.. চুয়াত্তর..কিছুই না.. আমি ওদের মালিক।
বালকঃ তুমি তারাদের মালিক?
লোকঃ হ্যাঁ.. রে বাবা হ্যাঁ.. চুয়াত্তর… চুয়াত্তর…
বালকঃ কিন্তু আমি একজন রাজাকে চিনি যে—
লোকঃ রাজারা কখনো মালিক হয় না, তারা শাসন করে। দুটো আলাদা বিষয়।…চুয়াত্তর…
বালকঃ তারাগুলো তোমার হল কী করে?
লোকঃ তবে ওরা কার?
বালকঃ সে জানি না। সম্ভবত কারো নয়।
লোকঃ সেইজন্যেই ওরা আমার...চুয়াত্তর…চুয়াত্তর… ধর তুমি যদি একটা হীরে খুঁজে পাও সেটা কারও নয় তবে সেটা তোমার। আবার তুমি এমন একটা দ্বীপ আবিষ্কার করলে যেটা মানচিত্রে নেই… তাহলে সেটা তোমার। সেইভাবেই তারাগুলো যদি কারোর না হয়ে থাকে তবে সেটা আমার।…চুয়াত্তর…চুয়াত্তর..
বালকঃ কিন্তু দিনের বেলা…? লোকে তো আকাশ দেখে রাত্রে?
লোকঃ চুয়াত্তর আর এক পঁচাত্তর…পঁচাত্তর…আমি রাত-দিন সব সময়েই গুনি…সেইজন্য আমার গণনা নির্ভুল।…পঁচাত্তর পঁচাত্তর
ঝকঝকে নীল আকাশে কতগুলো মিটমিটে তারা। যেন নীল রঙের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা রঙের কনা।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছাব্বিশ।।
নীল রঙের উপর সাদা রঙের ছিটে।
রঙ পরিবর্ত্তন করে, নীল হয় সবুজ, সাদা হয় হলুদ।
সবুজের উপর হলুদ ছাপ ছাপ শাড়ীতে প্রিয়াঙ্কা, সারা বাংলাদেশের প্রকৃতি ঘিরে আছে তার সর্বাঙ্গে।
এক চৌবাচ্চার পাশে বসে প্রিয়াঙ্কা।
চুড়ি পরা সাদা হাত দিয়ে সে জলের উপরের বিন্দু বিন্দু কচুরি পানা সরায়। অন্য হাত থেকে মুড়ি ফেলে জলে।
কচুরিপানা সরতে সরতে একটা উপবৃত্ত সৃষ্টি করে। তার মধ্যে একটা বৃত্ত, সাদা, জলের উপর মুড়ি ভাসছে। তার মধ্যে ভেসে ওঠে আরেকটি বৃত্ত, রাজকুমারীর পোষা কচ্ছপ উঠছে ভেসে ওফেলিয়ার মত।
রাজকুমারী তাকে ধরেই উলটে ফেলে। সামনের পরিষ্কার জলে ছায়া, প্রিয়াঙ্কার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ডাক্তার। প্রিয়াঙ্কা কচ্ছপ কোলে নিয়ে শুশ্রুষায় মগ্ন, কচ্ছপের পিঠে লেগে থাকা কচুরিপানাগুলোকে হাতে করে একটা একটা করে ফেলে, যেন শকুন্তলা সেবায় মত্ত তার প্রিয় শাবকের।
ডাক্তার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। রাজকুমারীর কথায় কেঁপে ওঠে তার সারা শরীর। (আবহঃটুসু গান- আমার টুসে ধনের ২য় অন্তরা ফিরে আসে)
প্রিয়াঙ্কাঃ (O.V)- আমার নীলের জন্যে একটা দময়ন্তীর খোঁজ দিন না।
ডাক্তারঃ নীল?
প্রিয়াঙ্কাঃ এই সোনাটার একটা বিয়ে দেব। আমায় একটা মেয়ে কচ্ছপ এনে দেবেন?
ডাক্তারঃ বিয়েতে আমায় নেমন্তন্ন করবে তো?
প্রিয়াঙ্কাঃ ওমা আপনি না কনেপক্ষ? আমি তো বরপক্ষ।
ডাক্তারঃ আচ্ছা প্রিয়াঙ্কা, তুমি ছোটবেলায় পুতুল খেলেছ? রান্নাবাটি? সখীর পুতুলের সঙ্গে নিজের পুতুলের বিয়ে দেওয়া?
প্রিয়াঙ্কাঃ কী যে বলেন? জানেন না আমি রাজকন্যা। আমি খেলবটা কার সঙ্গে? আমার পুতুলের পাত্রই জুটত না, তাই খেলাও হত না।
ডাক্তারঃ প্রিয়াঙ্কা.. আমি ভাবছি কলকাতায় চলে যাবো… হেলথ সেন্টারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে…. ওখানে গিয়ে প্র্যাকটিশ করবো… অনেকেই করে।
প্রিয়াঙ্কা কোন উত্তর দেয় না। মাথা নামিয়ে সব কথা শোনে। ধীরে ধীরে কচ্ছপটা তুলে আবার ছেড়ে দেয় চৌবাচ্চার জলে।
কচ্ছপ ওফেলিয়ার মত ভাসতে ভাসতে আস্তে আস্তে ডুবে যায় জলে। ধীরে ধীরে কচুরিপানা দখল করে জলের উপরিভাগ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছাব্বিশ(ক) ।।
নদীর ধার ধরে দুই কচ্ছপের মত হেঁটে চলেছে প্রিয়াঙ্কা ও ডাক্তার।
দুজনে দাঁড়িয়ে নদীতে তাদের ছায়া দেখে, কত কাছাকাছি।
প্রিয়াঙ্কা তার নূপুর লাগানো আলতা পরা পা দিয়ে জল ছোঁয়, ছায়া ভাঙে, পা থেকে আলতার লাল আস্তে আস্তে জলে ছড়িয়ে পড়ে।
আবহ।। ভবা পাগলার গান
ডুববি যদি প্রেম সাগরে ডুব দে রে তুই মন ডুবুরী।
এক ডুবে তুই পাবি রতন মনের মতন জমিদারী।
সে রতন গভীর জলে দু’একজনার ভাগ্যে মেলে।
সে আসে না আর এমন কূলে ফেলে আট মোকাম আর দশ কাছারী।
(সেথায়)যম-যাতনা দূরে রয় পাহারাওয়ালারা করে ভয়।
(আছে)বিবেক নামে মহাশয় সদা দণ্ডায়মান, রাজদণ্ডধারী।
কুমতি আর সুমতি *কেউ)উর্ধগতি কেউ অধোগতি।
ভবা তায় করে ঘোষণা সাবধানে রাখ নয় কুঠুরী।।
নরম বালিতে পড়ে থাকে দুই জোড়া পায়ের ছাপ, ক্রমশ তারা আকারে ছোট হতে হতে রচনা করেছে আরেক নদী। শুকনো নদী প্রবাহ।
নদীতে সশব্দে জাল ফেলে কোটেশ্বর।
জালের ভেতর দিয়ে দেখা যায় কাছাকাছি হেঁটে যাচ্ছে ডাক্তার ও রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা। একসময় তারা বেরিয়েও যায় জাল থেকে। দৃশ্যপথ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরলে দেখা যায় জল কাদা মাখা কোটেশ্বর আটকা পড়েছে জালে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছাব্বিশ(খ) ।।
রাজকুমারীর ঘরে বিশাল ছত্রী দেওয়া পালঙ্ক। বালিশ বুকে রাজকুমারী উবু হয়ে শুয়ে, যেন বয়ে যাওয়া এক নদী।
খাটের গায়ে চেয়ারে বসে ডাক্তার। বঙ্কিম রচনাবলী খুলে কপালকুণ্ডলা পড়ে শোনাচ্ছে প্রিয়াঙ্কাকে। প্রিয়াঙ্কার চোখে মুখে বিস্ময় ঝরে পড়ছে, কাহিনির ভেতর সে ডুবে গেছে।
ডাক্তার হঠাৎ বই বন্ধ করে দেন।
ডাক্তারঃ এবার তুমি একটা গান শোনাও প্রিয়াঙ্কা।
প্রিয়াঙ্কাঃ বইটা শেষ করুন তো আগে। … আপনার কি মনে হয় সব মেয়েই গান গাইতে পারে?
ডাক্তারঃ জানি না… তবে আমার ধারণা তুমি গান গাইতে পার .. গাইবে প্রিয়াঙ্কা?
প্রিয়াঙ্কাঃ না। পড়ুন… শেষ করুন তো আগে!
ডাক্তারঃ তাহলে সুনীল গাঙ্গুলি দাও, পড়ি। এটা আর ভাল লাগছে না।
প্রিয়াঙ্কাঃ আমার লাগছে। বঙ্কিম ছাড়া আমার কারো লেখা ভালো লাগে না।
ডাক্তারঃ সে কী! শরৎচন্দ্র?
প্রিয়াঙ্কাঃ না।
ডাক্তারঃ রবীন্দ্রনাথ। নষ্টনীড়- চোখের বালি।
প্রিয়াঙ্কাঃ পড়ি না… ভালো লাগে না… আপনি কপালকুণ্ডলা শোনান!
ডাক্তারঃ আগে তুমি এই অংশটা একটু পড়ে শোনাও তো।
ডাক্তার বইটা তুলে দেন প্রিয়াঙ্কার হাতে, বার করে দিয়েছেন সেই পরিচ্ছেদগুলি যেখানে বনপথে নবকুমার পথ হারিয়েছে, কপালকুণ্ডলার সঙ্গে দেখা।
প্রিয়াঙ্কাঃ আমার পড়া ভালো নয়।
ডাক্তারঃ ঠিক আছে, এইটুকু পড়, এক লাইন। পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?
প্রিয়াঙ্কাঃ পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?
ডাক্তারঃ ওয়ান্ডারফুলেস্ট! এই তো এই তো...
প্রিয়াঙ্কা ফুলের মত হেসে ওঠে, দুলে দুলে। মুখে বলে-
প্রিয়াঙ্কাঃ ঢঙ! খুব শখ না পথ হারানোর!
ডাক্তার বই টেনে নিয়ে লজ্জা ঢাকতে পড়তে থাকেন কপালকুণ্ডলা। সেই অংশ যেখানে নবকুমার পথ হারিয়েছেন, কপালকুণ্ডলার সঙ্গে দেখা।
খাটের ছত্রী ধরে দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কা, যেন বৃক্ষকে আঁকড়ে আছে স্বর্ণলতা। অদ্ভুত কৌতুহলী চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে।
প্রিয়াঙ্কাঃ আচ্ছা, আপনি কেমন মানুষ হ্যা? মানুষের শরীরে রক্ত দেখে আমোদ করেন?
ডাক্তারঃ রক্ত!
প্রিয়াঙ্কাঃ ঐ যে কী দেখেন না আপনি রক্ত, প্লাজমা, অণুচক্রিকা?
ডাক্তারঃ এসব কথা থাক।
প্রিয়াঙ্কাঃ থাকবে কেন? সন্ধান পেলেন আপনি অন্য পৃথিবীর?
ডাক্তারঃ জানি না। আজকাল সব একরকম লাগে। মাইক্রোস্কোপে দেখা রক্তকণিকা, কৃষ্ণচুড়া, গাছের নীচে পড়ে থাকা ফুল, টেলিস্কোপে দেখা রাতের আকাশ, নদীতে মাছের খেলা।… সবই কেমন এক বলে মনে হয়, তফাৎ বুঝি না আমি।…. কেবল দেখে যাই। আমি এক দর্শকমাত্র! শিল্পী হয়ে ওঠা বুঝি আর হল না আমার।
প্রিয়াঙ্কাঃ আপনার মুখে এইসব কথা শুনলে আমার খুব ভয় করে…
ডাক্তারঃ ভয়?
নিচ থেকে এক অমানুষিক চিৎকারে কেঁপে ওঠে দৃশ্যপট।
দেউড়ির কাছ থেকে ভেসে আসছে মত্ত কোটেশ্বর মাহাতোর চিৎকার।
কোটেশ্বরঃ (O.V.)- রাজকনিয়া- আ- আ-আ –আ রাজকনিয়া- আ-আ- আ
জানলার পর্দা ধরে শূন্যে তাকিয়ে আছে রাজকুমারী।
আবহে ফিরে আসে সিলেটি ধামাইল বিজয়া গান- জুড়ো করি ঐরাবত।
নীচে মন্দিরের সামনে পাহাড়ের মত এক মানুষ, আবছা। সে চেঁচাচ্ছে, আকাশের দিকে মুখ তুলে, যেন তার রাজকুমারী আছে আকাশে।
কোটেশ্বরঃ রাজকনিয়া-আ, তোর জন্যে ফুল আনেছি। বকুল ফুল। মালা গাঁথব নাই…
ছত্রীর চৌকো ফ্রেমে প্রিয়াঙ্কা ও ডাক্তার যেন টেলিভিশনের পর্দায় দুই নায়ক- নায়িকা।
প্রিয়াঙ্কাঃ মাতাল কোথাকার! ভীষণ অসভ্য লোকটা।… এবার বাবার ঘুমটা ঠিক ভেঙ্গে যাবে।
ডাক্তারঃ আমি যাই… ওকে থামিয়ে আসি…
ডাক্তার যেতে উদ্যত হলে তার পথরোধ করে দাঁড়ায় প্রিয়াঙ্কা। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের দিকে।
প্রিয়াঙ্কাঃ না, না। আপনি যাবেন না-
দ্রুতগতিতে প্রিয়াঙ্কা ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের বুকে, তাকে আঁকড়ে ধরে দুই হাতে।
প্রিয়াঙ্কাঃ তুমি যেও না ঋত্বিক... তুমি কোথাও যেও না…
কোটেশ্বরর চিৎকার ভেসে আসে- রাজকনিয়া আ- আ-আ
ডাক্তারের বুকের মাঝে মুখ ঘসে আর কাঁদে রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা।
আবহের লয় বেড়ে যায়।
রাজপ্রাসাদের মধ্যবর্তী গড়াগড়ি খায় কোটেশ্বর।
হাওয়ায় রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে উড়ে উড়ে কোটেশ্বরের শরীরের উপর এসে পড়ছে রাজকুমারীর শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক।
জানালার বাইরে থেকে দেখা আলিঙ্গনবদ্ধ ডাক্তার ও প্রিয়াঙ্কা। ডাক্তার মুখ জানালার দিকে ঘুরিয়ে বলেন-
ডাক্তার- ঝড়! ঝড় উঠেছে বাইরে।
প্রিয়াঙ্কা- উঠুক।
হাওয়ায় জানালার পাল্লা বন্ধ হয়ে যায়।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য সাতাশ।।
যেন কেউ চলে যায়, দূরে গেলে বোঝা যায় ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে আশ্চর্য বালক। আশ্চর্য সুন্দর সাঁকোর উপর দিয়ে ক্রমশ সে অন্তর্হিত হচ্ছে।
সাঁকোর ঢালু পাড়ের উপর দিয়ে আশ্চর্য বালক নামতে থাকে এক ছোট্ট দ্বীপে। ভারী ছোট্ট সেই দ্বীপ, এক লম্বা টাওয়ার আর তার পাদদেশে গোলাকৃতি এক কাঁচের ঘর, যেন একটু বড় এক পেপারওয়েট, রুমালের মত দ্বীপ পাছে উড়ে যায় তাই বোধ হয় চাপা দেওয়া পেপারওয়েটে।
বালক চমকে দেখে সেই পেপারওয়েট একবার জ্বলছে একবার নিভছে, যেন কোন বাল্বের প্রান্তভাগ। বালক আনন্দে লাফাতে লাফাতে যায় সেই দিকে।
সেই কাঁচের ঘরের মধ্যে ঢুকে আরও অবাক হয়ে যায়। ঘরের ঠিক মাঝখানে এক গোল টেবিল আর তার উপরে এক মস্ত main change over switch এক লোক টুলে বসে এটাই একবার এদিকে একবার ওদিক ঠেলছে। একা একা খেলে চলা কোন টাগ অব ওয়ার।
বালকটি বাতিদারের একটু কাছে যেতেই সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
বালকঃ এ কী তুমি বাতি নিভিয়ে দিলে কেন?
বাতিদারঃ সুপ্রভাত। এটাই হুকুম।
বালকঃ হুকুমটা কী?
বাতিদারঃ আমি যা করছি সেটাই হুকুম।
একটা হাত change over switchটা ঠেলে পরিবর্তন করে, চারিদিকে আবার আলো জ্বলে ওঠে।
বাতিদারঃ শুভসন্ধ্যা।
বালকঃ এক্ষুণি আবার আলো জ্বাললে?
বাতিদারঃ হুকুম তাই জ্বালালাম।
বালকঃ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বাতিদারঃ বোঝার কিছু নেই। হুকুম মানে হুকুম। সুপ্রভাত।
বালকের আশ্চর্যান্বিত মুখের সামনে একটা হাত এসে আবার change over switchটা বদল করে।
বালকটি এবার ভীষণ মজা পায়।
বালকঃ সুপ্রভাত। বেশ ব্যপার তো। একটু অস্বাভাবিক লাগছে বটে, কিন্তু তুমি আমার দেখা রাজা, দাম্ভিক লোকটা, মাতাল লোকটা কিংবা ব্যবসায়ীটার মত অতটা উদ্ভট নও। তোমার কাজেরই একমাত্র মানে খুঁজে পাচ্ছি। তুমি যখন আলোটা জ্বালালে মনে হল একটা নক্ষত্র যেন প্রাণ পেল। আবার এখন বাতি নিভিয়ে দিয়েছ মনে হচ্ছে একটা ফুলকে যেন তুমি ঘুম পাড়াচ্ছ। তোমার কাজটা ভারি সুন্দর।
বাতিদার নিজের মুখের সামনে হাত বাড়িয়ে change over switchটা পরিবর্তন করে।
বাতিদারঃ আমার কাজটা ভীষণ বাজে আর একঘেয়ে। আগে অনেক সুবিধা ছিল। সকালে বাতি নেভাতাম আর সন্ধ্যেবেলা জ্বালাতাম। একবার-একবার, ব্যস, বাকি দিনটা আরামের আর রাত্রিটা ঘুমের।
বালক উঠে বসে টেবিলটার উপর। বাতিদার টেবিলের উপর ঝুঁকে অপেক্ষা করছে change over switchটা বদলানোর জন্য।
বালকঃ এখন কি হুকুমটা পালটে গেছে?
বাতিদারঃ হুকুমটা পাল্টালো না আর তাতেই আমার কাল হলো।
বালক ও বাতিদার ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করতে থাকে, change over switch কখনো এদিকে আসে কখনো ওদিকে। ঘরময় কখনো আলো জ্বলে ওঠে, কখনো অন্ধকার।
বাতিদারঃ বছরে বছরে এই গ্রহের আবর্তন গতি বেড়ে গেছে কিন্তু হুকুম বদলায়নি। এখন এই গ্রহ মিনিটে একবার ঘোরে, তাই আমার বিন্দুমাত্র বিশ্রামের সময় নেই। মিনিটে একবার আমাকে বাতি জ্বালাতে হয় একবার নেভাতে হয়।
বালকঃ ভারি মজার তো। তোমার গ্রহে তাহলে দিন মাত্র এক মিনিটের।
বাতিদারঃ মোটেও মজার নয়। এই যে আমরা কথা বলছি এর মধ্যে একমাস কেটে গেছে।
বালকঃ এক মাস!
বাতিদারঃ হুঁ। পুরো এক মাস। তিরিশ মিনিট। তিরিশ দিন। পাক্কা। শুভসন্ধ্যা।
বালকঃ আরিব্বাস। তার মানে তোমার এখানে দিনে এক হাজার চারশ চল্লিশ বার সূর্যাস্ত দেখা যায়!
রাহুর মত মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে বাতিদার।
বাতিদারঃ কী জানি? হবে ঐরকম কিছু একটা। সুপ্রভাত।
বালকঃ সুপ্রভাত। জানো, আমি জানি তুমি কি করলে বিশ্রাম পেতে পারো?
বাতিদারঃ আমি সব সময় বিশ্রাম পেতে চাই। তুমি থেকে যাও এখানে। তবে আমি আগেই বলে দিচ্ছি, যে কোন মানুষই একসঙ্গে বিশ্বস্ত ও অলস কিন্তু কোনদিনই হতে পারবে না।
বালকঃ না, না। থাকার কথা বলছি না। এই ছোট্ট গ্রহে গ্রহে আমি থাকতে পারবো না। তোমাকে একটা বুদ্ধি দিতে পারি আমি।
বাতিদারঃ কী?
বালকঃ তোমার গ্রহটা এত ছোট যে তুমি তিন পদক্ষেপে পুরোটা ঘুরে আসতে পারো। তুমি যদি সবসময় দিনের আলোয় থাকতে চাও তোমাকে শুধু ধীরে ধীরে হাঁটতে হবে। যখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন তখন হাঁটতে শুরু করবে- যত বড় দিন চাও সব তোমার হাতে- রাত না হলে আলো জ্বালানোর কোন প্রশ্নও সেখানে নেই!
বাতিদারঃ ধুস্। হাঁটলে আর বিশ্রাম হল কোথায়? জীবনে আমি সবচেয়ে ভালবাসি ঘুম।
বালকঃ তাহলে তোমার ভাগ্য সত্যিই খারাপ।
বাতিদারঃ খুব খারাপ। সুপ্রভাত।
আলো বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কালো হয়ে যায় বাতিদারের মুখ। বাতিদারের মাথার পিছনে সূর্য ওঠে। সার্সির ফ্রেমগুলিতে একাধিক সূর্য যেন আঁকা পটের মত মাথার পিছনে ছড়িয়ে।(VFX)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- সাতাশ-ক।।
রাজবাড়ির বারান্দায় রাজা রবীন্দ্রনাথ। হাতে একটা নেভানো লন্ঠন। তিনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মানুষ-জন ডাকছেন। কোটেশ্বরের নাম ধরেই তার বেশি খোঁজ।
রাজা রবীন্দ্রনাথ- এই কোটেশ্বর, কোটেশ্বর... প্রিয়া ফিরেছে? কেউ কিছু বলে যায় না! কোথায় যায় যে সব। সন্ধে হয়ে গেল, একটা কারুর হুঁশ নেই। একটা আলোও কেউ জ্বাললো না। এই কোটেশ্বর, বাবা কোটেশ্বর... এমনি করলে কী আমি পারি...
বিভিন্ন বারান্দার ভুলভুলাইয়ার ফাঁক ফোঁকরে দেখা যায় রাজা রবীন্দ্রনাথকে।
কাউকেই খুঁজে পান না তিনি।
হারিকেনটাও তাঁর হাত থেকে পড়ে সশব্দে ভেঙ্গে যায়।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- সাতাশ-খ।।
কল্যাণীদের বাড়ির উঠোনে দপ করে জ্বলে ওঠে আগুণ।
আলো ফুটলে দেখা যায় কুসুম ও কল্যাণী জড়ো করেছে অনেক খবরের কাগজ। সেগুলোই পোড়াচ্ছে তারা।
কুসুম এক একটা খবরের কাগজ খুলে মাকে দেখায়।
কুসুম- মা দ্যাখো, দ্যাখো। কীরকম সব কামান।
কল্যাণী- কামান নয় কুসুম, ট্যাঙ্ক। বিরাট বিরাট।
কুসুম- মা এতে করে অনেক মানুষ মারা যায়?
কল্যাণী- হ্যাঁ মা, প্রচুর (বলতে বলতে কেঁদে ফেলে)
কুসুম কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে আগুণের মধ্যে। আগুণ আবার দপ করে তেজীয়ান হয়।
কল্যাণী প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে।
কুসুম সব খবরের কাগজগুলি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে আগুনে।
আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে।
আগুনের ভেতরে দেখা যায়, মা ও মেয়েকে। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- সাতাশ-গ।।
বালক ঘুরে বেড়ায় টেবিলের চারপাশে যেন এই জায়গা ছেড়ে তার যেতে ইচ্ছে করছে না।
বালকঃ তুমি কি একেবারেই বিশ্রাম পাও না?
বাতিদারঃ হ্যাঁ একবার পেয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় আমার উপর হুকুম এসেছিল সমস্ত ব্ল্যাক আউট করে রাখার। সে মাত্র দশদিন। তোমার মত হিসেব করলে অবশ্য কুড়ি বছর।
বালক টেবিলের উপর দুই হাত দিয়ে চিতাবাঘের মত মাথা এগিয়ে প্রশ্ন করে-
বালকঃ তার মানে তুমি যুদ্ধপ্রিয়?
বাতিদার বালকের প্রশ্নে লজ্জা পায়, মাথা নিচু করে উত্তর দেয়-
বাতিদারঃ হ্যাঁ। মানে-
বালকঃ তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল জানো? মনে হয়েছিল তুমি নিজেরটা ছাড়াও অন্যের কথা ভাব। কিন্তু এখন-
বাতিদার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে change over switchটা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, মনে হচ্ছে কোন গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে সেখানে।
Music Starts- Preparation of War
বালকঃ... তোমাকে মনে হচ্ছে সেই আমার বন্ধু পাইলটের মতো, যে খুব দ্রুত তার বিমানটা মেরামত করে ফিরে যেতে চেয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। আরও কিছু বেশি মানুষ মারার জন্য!
বালক দেখছে চেষ্টারত বাতিদারের পিছনে অসংখ্য সার্সিতে অসংখ্য সূর্যের অস্ত যাওয়া। (VFX)
বাতিদার উঠে দাঁড়িয়ে change over switch পরিবর্তনের চেষ্টা করছে আর বালকের মাথার উপর দিয়ে একটা ঘড়ির দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
ঘড়িটা চলছে নিজের মতো।
একটা ঘড়ি তার উপর ভেসে আসছে বাতিদারের অশ্রাব্য গালাগাল।
দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘড়িটা দেখে গেলে তবে দেখা যায় সময়ের পরিবর্তন। এক মিনিট সময় পেরিয়ে গেছে যদিও তা মনে হয়েছে একটা দিনের মতই দীর্ঘ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য আঠাশ।।
একটা বিরাট গোল ডায়ালওয়ালা ঘড়ি। গির্জার ঘড়ি। ঘড়িটা কেউ ভিতরদিকে খুলে নিলে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। ঘড়ি ঘরের ভিতর, ফাদার রীভস্ ঘড়ি খুলে বের করে নেন ডায়ালটা।
১-১২ লেখা গোল ডায়ালটা মাটিতে পাতা। তার উপর এসে পড়েছে রঙ তুলি pastel এর আঁচড়।
স্বপ্নে দেখা কোন এক মানচিত্র আঁকছিলেন ফাদার পাগলের মত। উপর থেকে একটা মুখ এলে চমকে ওঠেন। বিমল এসে দাঁড়িয়েছে ফাদারের সামনে, ঘড়িঘরের স্বল্প উচ্চতার কারণে তার মাথা নিচু।
ছেলেমানুষের মত লজ্জা পেয়ে ঘড়ির ডায়ালটা লুকিয়ে ফেলেন ফাদার।
রীভসঃ তুমি নিচে যাও, আমি যাচ্ছি।
বিমলের উস্কো খুশকো চুল, একগাল সাদা-সাদা দাড়ি, মলিন পোশাক-পরিচ্ছদ। মুখে হাসি নেই। মনে হয় যেন অপরাধ করে ফেলেছে।
বিমলঃ আসলে, নিচে কাউকে দেখতে পেলাম না...
গির্জার মাথার শূন্যস্থান পূরণ করেছে ডায়াল ছাড়া এক ঘড়ি।
অসংখ্য নিস্পন্দ ও চলমান যন্ত্রপাতির জটিল স্থাপত্যের উপরেও ঠিক ঘুরে চলেছে দুটি কাঁটা।
ঘোরালো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন ফাদার রীভস্ ও বিমল, তাদের নেমে আসা যেন ঘড়ির কাঁটারই স্থানান্তর।
বিমলঃ জেল খুব দুঃসহ জায়গা। নরক বলে যদি কিছু থাকে তো জেলই সেটা। অথচ যীশু জানেন আমি নির্দোষ, আমাকে সেখানে এতদিন থাকতে হল, আমার পক্ষে সওয়াল করারও কেউ নেই। যেহেতু আমরা গরিব... তাই সব দোষ আমাদের।আমি পাপী হয়ে গেলাম, দূর, দূর করে তাড়িয়ে দিলো। তারই বাস মানুষ চাপা দিল, অথচ সে আরও তিনটে নতুন বাস নামিয়েছে, তার কোন শাস্তি নেই? পার্বতীর ইঞ্জিনে প্রব্লেম ছিল, পরীক্ষিত কতবার বলেছে তবু সারায়নি। দোষ তো তবু আমাদেরই নাঃ।
ঘোরানো সিঁড়ির নীচের ধাপে রীভস্ বসে আছেন, বিমলের ঠিক উপরে। বিমলের দেহ ভাগ- ভাগ হয়ে ছড়িয়ে আছে সাদা-কালো মেঝেতে।
বিমলঃ ফিরে এসে দেখলাম ইউনিয়নবাজি। নতুন হয়েছে, তাই আমি ইউনিয়নের কেউ না। মেম্বার তো হইনি, তারা আমার কথা শুনবে না। আমার আজ কোন কাজ নেই। এক্সিডেন্ট করার পর কেউ তাকে কাজ দেয়? অপয়া তো! হাতে কোন পয়সা নেই। বলুন ফাদার, আজ আমি কোথায় যাবো?
রীভস- বাড়ি? বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না তোমার?
বিমল-বাড়ির কথা মনেই পড়ে না এখন! সেই ছোটবেলায় পালালাম বাড়ি থেকে, ভেবেছিলাম ভূপর্যটক হব, বিমল মুখার্জীর মত দু চাকায় দুনিয়া দেখব। কাজ নিলাম এক সাইকেল গ্যারেজে। পালালাম, এবার সঙ্গে একটা সাইকেল। শুধু চলা আর চলা। চললেই তো হল না, খেতে হবে। কাজ চাই। এ কাজ ও কাজ করতে করতে এখানে-ওখানে ঘোরা। এলাম আপনাদের এখানে। কত মানুষ দেখলাম, কত কিছু জানলাম, এখন বুঝি সবাই দেশান্তরী।
রীভস- দেশ থাকলেই তো দেশান্তর। আমি তো আলাদা আলাদা দেশ বানানোরই কোন অর্থ খুঁজে পাই না।
বিমল-আমি পাই। আমি পেয়েছি। শুধু তো চলতেই চেয়েছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম সেটাই কি পেলাম না?
খয়েরি খয়েরি চেয়ারের উপরিভাগের রেখাগুলি রচনা করেছে এক বৃক্ষ। ব্যাঙ্গমা – ব্যাঙ্গমীর মত নিজেদের নিজেদের সুখ-দুঃখের আলাপচারিতায় মগ্ন বিমল ও ফাদার রীভস্।
রীভস্- আসলে কী জানো বিমল, চাওয়া আর পাওয়া যেন কিছুতেই মেলে না। রেললাইনের মত দুটো পরস্পর সমান্তরাল কিছু। একটু গম্ভীর শোনালেও এটাই বাস্তব।
বিমল-ফাদার আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম।
শূণ্য গির্জার অভ্যন্তরে তার কথা প্রতিধ্বনিত হয়।
শাপলা –শামুকে ছড়ানো দ্বীপে, দূরে একাকী গির্জায় প্রতিধ্বনিত হয় বিমলের কথা, উড়ে যায়- বক, শামুকখোল, পানকৌড়ি।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- উনত্রিশ।।
মন্দিরের টেরাকোটায় রাবণ কর্তৃক সীতাহরণের দৃশ্যাবলীর উপর আঙ্গুল বোলাচ্ছে রাজকুমারী।
নাকের অগ্রভাগ। গাল, কপাল ও ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করতে থাকে প্রাচীন টেরাকোটাগুলি।
দূর থেকে ভেসে আসে কোটেশ্বর মাহাতোর গলা-রাজকনিয়া...রাজকনিয়া।
ডাক শুনে চোখ খোলে প্রিয়াঙ্কা। তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়।
সে ধীরে ধীরে টেরাকোটার দেওয়ালের দিকে পিছন ফিরে বসে পড়ে। হাঁটু মুড়ে বসে সে। মাথা কোলে গুঁজে ফোপায়।
কোটেশ্বর এসে দাঁড়িয়েছে বাগানে গাছের তলায়। রাজকুমারীকে দেখতে পেয়ে পাগলের মত চেঁচিয়ে ওঠে আনন্দে।
কোটেশ্বরঃ রা-জ-ক-নি-য়া! দ্যাখ তুর জন্যি পাক্কা কামরাঙা আইনিছি।
সে লুঙ্গির কোচড় থেকে দুই হাতে কামরাঙ্গা তুলে দেখায়, পাকা হলুদ কামরাঙ্গা।
প্রিয়াঙ্কা কোল থেকে মুখ তুলে দ্যাখে কোটেশ্বর দুই হাতে কামরাঙ্গা তুলে নাচাচ্ছে।
রাজকুমারী রাগে ফুঁসে ওঠে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে।
প্রিয়াঙ্কাঃ খবরদার কোটেশ্বর! তুই মন্দিরে ঢুকবি না। আর এক পাও এগোবি না তুই।
কোটেশ্বর দুই হাত জড়ো করে কামরাঙ্গা দিয়ে ঢেকে রেখেছে তার মুখ। রাজকন্যার দিকে এগিয়ে চলেছে অল্প অল্প করে।
ক্রমাগত কোটেশ্বরকে শাসিয়ে চলেছে রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা। কোটেশ্বর ধীর লয়ে এগিয়ে চলেছে তার রাজকনিয়ার দিকে।
কোটেশ্বর হটাৎ একটা একটা করে কামরাঙ্গা তুলে ছুড়ে মারতে থাকে প্রিয়াঙ্কার দিকে।
দুই হাত মুখের সামনে এনে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে প্রিয়াঙ্কা। এক পা পিছু হটতে দেওয়ালে আছড়ে পড়ে সে।
একটি কামরাঙ্গাও প্রিয়াঙ্কাকে স্পর্শ করে না।
প্রিয়াঙ্কা আত্মরক্ষা ভুলে দুই দিকে হাত প্রশস্ত করে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে। কোটেশ্বর অনেকটাই এগিয়ে এসেছে তার দিকে। আর দক্ষ ড্যাগার থ্রোয়ারের মত রাজকুমারীর চারপাশে ছুঁড়ে চলেছে পাকা কামরাঙ্গা।
কামরাঙ্গা শেষ হয়। কোটেশ্বর লোভী মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে লাফিয়ে ওঠে মন্দিরের চাতালে।
প্রিয়াঙ্কা আতঙ্কিত হয়ে চাতালের অন্যদিক বরাবর ছুটে যায়।
কোটেশ্বরও ছোটে পেছন পেছন।
মন্দিরের মাঠ জনশূণ্য। দূর থেকে দেখা- মন্দিরের চাতাল বরাবর মনে হয় চোর-পুলিশ খেলছে বালক বালিকা। নদীর ধারে কাত হয়ে পড়া মন্দির জুড়ে আর্তধ্বনি ও হাসাহাসি।
কোটেশ্বর দক্ষ কবাডি খেলোয়াড়ের মত ঝাঁপ দেয়।
তার মাথা গিয়ে পড়ে শতাব্দী প্রাচীন টেরাকোটায়।
সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত ছাড়িয়ে রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কা মন্দিরের চাতাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে।
কোটেশ্বর তার রক্তাক্ত মুখ তুলে দেখে তার রাজকনিয়ার শাড়ির আঁচল ছিড়ে আটকে আছে অনেকটা নীচে গাছের ডালে। সে আবার অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মন্দিরের চাতালে।
দৃশ্যান্তর
।।বিশ্রাম।।
দৃশ্য- তিরিশ।।
গ্রামের হেলথ সেন্টারে উজ্বল আলোর নীচে ট্রেচারে শায়িত রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কার দেহ। হাত মুখ সবই ক্ষত-বিক্ষত। তার দেহে ব্লাউজ ও পেটিকোট তাও ছিন্ন।
দূরবর্তী দরজা দিয়ে ডাক্তার দ্রুত পায়ে প্রবেশ করেন। প্রিয়াঙ্কাকে দেখে তিনি হতচকিত হয়ে পড়েন। তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর ভেসে ওঠে।
ডাক্তারঃ রাজকন্যা!
বাতি দুলে ওঠে। হেলথ সেন্টারের দেওয়াল দূরগামী হয়।
ডাক্তার দৌড়ে এসে প্রিয়াঙ্কার পোশাকের দিকে চোখ পড়ে থতমত খেয়ে যান। উঠে যাওয়া পেটিকোট কাঁপা কাঁপা হাতে নামান। আলো দোলে।
প্রিয়াঙ্কার নাকের সামনে প্রথমে হাত ও পরে নিজের গাল নামিয়ে প্রিয়াঙ্কার উষ্ণ নিশ্বাস নিতে থেকেন।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- একত্রিশ
গির্জার অভ্যন্তর। মোমের আলোয় আলোকিত। সন্ধ্যে।
চেয়ারে বসে বিমল পাতা ওল্টাচ্ছে হাতে লেখা জাব্দা বাইবেলের। পাতায় পাতায় আঁকা ছবি।
রীভস-তুমি কি ছোটবেলায় কখনও ছবি এঁকেছো? আমি দেখতে পাচ্ছি, প্রবলভাবে দেখতে পাচ্ছি, সেটাই চাইছি। কিন্তু হচ্ছে না, ধরা দিচ্ছে না, আমি খাতায় সেটা পাচ্ছি না।
বিমল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
রীভস- এই রকম তোমার মনে হয় বিমল? বুঝতে পারছি চাকাটা লোকটার মাথাটা থেঁতলে দিয়ে যাবে, কিন্তু আমার গা শিরশির করছে না। তাহলে কি আমার অনুভূতি কম? সত্যি সত্যি যদি ঘটনাটা আমার সামনে ঘটে আমি হয়তো সহ্যই করতে পারতাম না, এই যে ক্রুশবিদ্ধ যীশু দেখ কেমন সহজ স্বাভাবিক, অথচ সত্যিই কি আমি আমাদের যীশুর রূপ দেখে যন্ত্রণা পেতে চেয়েছিলাম যার অভাববোধ আমাকে এই মুহূর্তে পীড়া দিচ্ছে?
বিমলঃ ফাদার রীভস, আপনি কথা বলছেন কি রকম বিদেশি ভাষায় মনে হচ্ছে!
রীভস্- সেটা তুমি আমায় বিদেশি ভাবতে চাইছ বলে। আমার জন্ম এখানে; তুমি জানো বিমল আমার মাতৃভাষা বাংলা? কেবল ধর্মের কারণে তুমি আমায় বিদেশি ভাবছ? ধর্মের ভিত্তিতে তো কোন রাষ্ট্র হয় না... তা আমরা কোনদিনই চাইনি। ভাবনার কোন দেশ-বিদেশ নেই। দুটো কাঁটাতারের বেড়া, মধ্যে কিছুটা নিষ্ফলা জমি, অনর্থক। আমরা কেউই চাইনি বাংলাদেশ দুই খণ্ড হয়ে কাঁটাতারের দুই দিকে চলে যাক, তবু তাই হল। বুঝলে বিমল, চাওয়া আর পাওয়া যদি একই হোত তাহলে ডিকশনারিতে একটাই শব্দ থাকত দুটো নয়!
সাদা কালো খোপকাটা মেঝের উপর হাত বুলাচ্ছে একটা হাত। বিমলের হাত ঘোরাফেরা করছে মসৃণ মেঝের উপর দিয়ে। হাত উপনীত হয় দেওয়ালের প্রান্তে। ক্রমশ, সাদা দেওয়ালের উপরে ঘসে ঘসে চলে এক কৃষ্ণবর্ণ হাত।
বিমল অস্ফুটে বলে ওঠে-
বিমল- আমাগো বাড়ি সিল বাংলাদ্যাশে। জমি জমা নাই। সে এক বিশাল নদীর চর। পাতার ছাউনি। একেকবারে ভানগে আর আমরা অন্য চরে নতুন বাসা বানাই। বাপরে মনে নাই। আমার মায়ের নামই সিল সাত ভাঙ্গির মাইয়া।
রীভস্: প্রত্যেকের তার ক্ষমতা অনুসারে ইতিহাস রচনা করেছে, কিন্তু আমার কাছে বরাবরই সেটা একপেশে। আটএর দশকের শেষ দিকে মিশেল ফুকোর কথা শুনলাম বুঝলে বিমল। সে সব বিরাট ব্যপার। ইতিহাস বলতে শুধু বই নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতাও এক ইতিহাস! অনেকেই ডায়েরী লেখে। রোজকার ঘটনা টুকে রাখে। তুমি লিখেছো কখনো? পারো তো লিখো, ঐ ছোট্ট জমিটার উপর তোমার অবস্থান অন্য কারও পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
গির্জার একপাশের দেওয়ালে রঙিন বড় বড় কাঁচের জানালা।বিভিন্ন রঙের ছটা ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ও পোশাকে। দুইজনে বসে দুই জানালার বাতায়, মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।
রীভস্- এই যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশ অথচ সেখানে আমার কোন ভূমিকাই নেই। এই সামাজিক অবস্থান আমাকেই লিখে রেখে যেতে হবে। অন্তত একটুও- যে আমার কিচ্ছু করার ছিল না। তুমি কি আমার আঁকা মানচিত্র কখনো দেখেছে? দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি আমি। আসলে এগুলোই আমার ডায়েরি। এখানেই আমি আমার মত করে ইতিহাস লিখে যাচ্ছি।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য-বত্রিশ।।
গ্রামের হেলথ সেন্টারে চড়া আলোর নীচে ব্যান্ডেজ বাঁধা রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কা। গায়ে সাদা চাদর টানা। অল্প অল্প জ্ঞান ফিরছে। শক্ত করে ধরে আছে ডাক্তারের হাত। ঠোঁটে যন্ত্রণার কাতরতা।
বাইরে হৈ চৈ শোনা যায়।
ট্রেচারে করে একটি দেহ প্রবেশ করে। কোটেশ্বর মাহাতো, মুখ রক্তাক্ত হলেও চেনা যায় তার পেশীবহুল শরীর।
ডাক্তার তাকে দেখে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ান।
আলো দুলে ওঠে পাশাপাশি দুটো ট্রেচারে রাখা দুটো দেহ।
রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কা ও কোটেশ্বর।
ডাক্তার কোটেশ্বরের হাতের মুঠো থেকে খুলে নেন এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়।
তুলে ধরেন আলোয়, এই শাড়ির অংশ তার চেনা, রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কার শাড়ি।
তিনি তাকান প্রিয়াঙ্কার দিকে। প্রিয়াঙ্কাও যন্ত্রণা ভুলে তাকিয়ে রয়েছে ডাক্তারের মুখের দিকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- তেত্রিশ।।
রাজবাড়ির জনশূন্য বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে রাজা চেঁচান।
রাজা রবীন্দ্রনাথঃ আজ কি কেউ বাতি জ্বালবেনা? কেউ কি আছে রাজবাড়িতে? প্রিয়া.... প্রিয়াঙ্কা কোথায় যে যায় সব। ওরে তোরা কি কেউ নেউ। বুড়ো মানুষটা হোঁচট খেয়ে মড়ে পড়ে থাকবে তো রে। ওরে তোরা কি কেউ আছিস। আমার কথা শুনছিস। এই শয়তানের বাচ্চা, কোটেশ্বর... সাড়া দিচ্ছিস না কেন?
কেউ সাড়া দেয় না।
তার কথা প্রতিধ্বনি হতে থাকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য- চৌত্রিশ।।
সোমনাথ হোড়ের ভাস্কর্যের মত রুগ্ন হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গাছ। পাতা ঝরে যাওয়ায় এখন সে সম্পূর্ণ নেড়া। দূরে জলের রেখা চিকচিক করছে। শুকনো পাতা আসন পাতা জমিতে তাতে বসে আছে বিমল, গাছের কাণ্ডে মাথা লাগিয়ে।
একটি টিলার পেছন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসেন ফাদার। কোলে রঙিন টিভির বাক্স। বাক্স থেকে উঁচিয়ে আছে রোল করা করা সব কাগজ, যেন বৃহৎ কোন কৃত্রিম ফুলদানী।
বিমলের পাশে বৃহৎ শিলাকৃতি, নিকষ কালো রঙের, তার উপর মেটে রঙের দাগ কাটা, বাঘবন্দীর খোপ। বিমলের অন্যমনস্ক আঙ্গুল দাগ ধরে ধরে এগিয়ে চলেছে। রীভস্এর কথায় কেঁপে ওঠে বিমলের আঙ্গুল।
রীভস্ (O.V)- এক্কেবারে প্রথম দিকে জানো তো ম্যাপ আঁকার প্রচলন ছিল না। এখনও পর্যন্ত যেটা সবচেয়ে প্রাচীন পৃথিবীর ম্যাপ বলে স্বীকৃত সেটা নাকি একটা টেরাকোটার টেবিল, পোড়ামাটি বুঝলে...
দুজনে নিরাসক্তের মত বসে সেই গাছতলায়। দূরে জলের রেখা। নেড়া গাছে রয়ে যাওয়া সবুজ পাতাগুলি ঝরে পড়ছে। ধীরে পড়ছে। রীভস্ পাশে রাখা টিভির বাক্স থেকে এক এক করে roll করা আর্ট পেপারগুলো মাটিতে ঘাসের উপর/ শুকনো পাতার উপর সাজিয়ে রাখছে।
রীভস্- ... বুঝলে সেই Babylonian map of the world, খ্রীষ্টের জন্মেরও আগের, তখন ধারণা ছিল পৃথিবী একটা চ্যাপ্টা থালার মত, এরপর কেউ পৃথিবীকে এঁকেছে সরার পিঠে। কেউ দেখিয়েছে বীজের উপর, যেন ঠিক ডানামেলা প্রজাপতি। ...
দীর্ঘ কাণ্ডের নীচে বিমলের মাথা, চোখ বুজে সে শুনছে রীভস্এর কথা। গাছের ছাল শুকিয়ে ওঠা ওঠা, যেন আর এক মানচিত্র, তার উপর দিয়ে হেঁটে যায় পিঁপড়ের সজয়ায়। জলের উপার থেকে ভেসে আসে কমলেকামিনী পালার গান, চাঁদসদাগরের কথা- কথকতা।
রীভস্(O.V)- ... তারও বহু আগে মানুষ শিকার করতে শিখল। গুহার দেওয়ালে আঁকল হরিণ, বাইসন, শোননি আলতামিরার কথা? সেই প্রথমদিককার গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষ... the hunter and fishermen of this age made maps or charts for guidance in hunting expeditions…এঁকে ফেললো গুহার দেওয়ালে... প্রশান্ত মহাসাগরে... মার্শাল দ্বীপবাসীরা খেজুরপাতা ঝিনুক সাজিয়ে বানিয়ে নিল সমুদ্রে তাদের যাত্রাপথের নক্সা... এস্কিমোরা গাছের তন্তু আর সীলমাছের চামড়া দিয়ে চিহ্নিত করে ফেলেছে নিজেদের যাত্রাপথ... এসব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার কথা...
শুকনো বড় বড় পাতা সারা জমিতে ছড়িয়ে, গুঁড়ো মাটি... ওঠা,... ওঠা... মনে হয় পিঁপড়ের বাসা, একসার পিঁপড়ে ফিরে চলেছে বাসার দিকে, পিঁপড়ে ধরে এগোলে পিঁপড়েরা নেমে আসছে শিলের আকৃতির এক পাথরের উপর থেকে সার বেঁধে।
কালো রঙের শিলের আকৃতির এক পাথর যার উপর আঁকা আছে মেটে রঙের বাঘবন্দী্র খোপ, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পিঁপড়ের সারি।
ম্রীয়মান শালুক-পদ্মের পাতা। পাখিহীন।
রীভস্(O.V)-টার্কির আনাতোলিয়া্য ৬২০০BC দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল টাউন ম্যাপ সেটা দেখতে অনেকটা সাপলুডো খেলার নক্সার মত। তখনো মনে রেখো কাগজই আবিস্কার হয়নি। সেটা হলো চীনে, গ্রীসে ব্রোঞ্চের উপর এনগ্রেভ করা শুরু হয়েছে। তার আগে আছে সেই আশ্চর্য করা প্রথম পৃথিবীকে ধরার চেষ্টা। Babylonian map of the world ...
সবুজ ঘাসের উপর ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন আকৃতির রং-বেরঙের মানচিত্র। হাওয়ায় ক্রমশ উড়তে থাকে শুকনো পাতার মত, বাতাসে সেগুলো প্রজাপতির মত উড়ছে।
রীভস্ তাদের ধরে এনে গুটিয়ে ভরছেন টিভির বাক্সটার মধ্যে, আবার দৌড়াচ্ছেন অন্য একটার পেছনে। একটা উড়ন্ত ম্যাপের নীচে নীচে ছুটছে বিমল, সেটা ধরার চেষ্টা করছে দৌড়ে দৌড়ে।
কিন্তু মানচিত্রটা উড়তে উড়তে এসে পড়ে জলে। এক অদ্ভূত পৃথিবীর মানচিত্র, ভারতের চেহারা অঙ্কে বড় করে দেখানো। হাওয়া ঢুকে কেমন ম্যাপের মাঝখানটা কেমন ফুলো, চারপাশের কাগজ ক্রমশ ভিজে ডুবে যাচ্ছে জলের তলায়।
বিমল জলের তলায়। ডুব সাঁতার কাটতে গিয়ে তার হাতে ঠেকে একটা চাকা।(Special requirement–Under water shoot)
জলতল তোলপাড় হয়। ভিজে ফুলে ওঠা কাগজের মাঝখানটা ক্রমশ ফুলে উঠছে, আর একবিন্দু থেকে এক অর্বাচীন কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।(VFX)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পঁয়ত্রিশ।।
ফুলে ওঠা প্রায় গোলাকৃতি কমলা রঙের ম্যাপটা হয়ে যায় এডিডাস লেখা এক water polo ball সেটা জলে ভাসছে।
চারদিক থেকে আটটা হাত ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটার অধিকারে।
নতুন লেখা গান।।
গানের সংগে পুরো imageগুলি বিভিন্নভাবে সাজানো... নেগেটিভ ইমেজ, সাউন্ড স্টকের ইমেজ। কোথাও শুধু ল্যাম্পের দপদপ। neon drawings.
ম্যানিকুইনের পোশাকে কোরিওগ্রাফড নাচ।
কয়েকটি স্ট্রিপে এনিমেটেড দৃশ্য। (VFX)
গানের বিষয়-
Four thousand years ago the Babylonians were skilled astronomers who were able to predict the apparent motions of the moon and the stars and the planets and the sun upon the sky, and could even predict ancient Greens who were the first to build a cosmological model within which to interpret these motions.
সপ্তম গ্রহ পৃথিবী। তবে পৃথিবী মোটেই সাধারণ গ্রহ নয় এখানে আছে ১১১০জন রাজা(এখনও), ৭০,০০০জন ভৌগলিক, ৯০লক্ষ ব্যবসায়ীক মানুষ, ৭৫০লক্ষ মাতাল, ৩০কোটি ১১লক্ষ দাম্ভিক লোক- তা সব মিলিয়ে ২০০০কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ!
পৃথিবীটা অবশ্য বেশ বড়। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে ছয়টা মহাদেশে কেবল রাস্তার আলো জ্বালাবার জন্যে দরকার হত ৪৬লক্ষ দুই হাজার ৫শ ১১জন বাতিদারের এক বিশাল বাহিনী। তারা উর্দি পরে মই কাঁধে ঘুরত আর রাস্তার আলো জ্বালতো।
দৃশ্যটা বেশ মজার। এতজন বাতিদারের নড়াচড়া যেন ছিল ব্যালে নৃত্য। প্রথমে কাজ শুরু করে নিউজিলান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বাতিদারেরা। তারা আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতে যাবে। তাদের পরে নাচের তালে প্রবেশ করবে চীন আর সাইবেরিয়ার বাতিদারেরা। তারা বেরিয়ে গেলে আসবে রাশিয়া আর ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা। অতঃপর আফ্রিকা আর ইউরোপের বাতিদারের ভূমিকা, তারপর দক্ষিণ আমেরিকা আর উত্তর আমেরিকার পালা। আরও দারুণ ব্যপার মঞ্চে আবির্ভাবের সময়টা বাতিদারেরা কখনও ভুল করে না। এক কথায় অসামান্য।
উত্তর মেরুর একটা মাত্র ল্যাম্পপোস্ট জ্বালানো যে লোকটার কাজ, আর তার দক্ষিণ মেরুর সহকর্মী- এই দুজন কেবল থাকবে সুখে-স্বস্তিতে। কারণ বছরে মোটে দু’বার তাদের কাজ করতে হবে।
[VO- Father Reevs- মজা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে সত্যের অপলাপ হয়ে যায়। বাতিদারদের কথা বলতে গিয়ে কিছুটা অসত্য এসে গেছে। পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহের যেসব মানুষ এই সিনেমা দেখবে বিশেষত যারা আমাদের এই গ্রহ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানে না তারা হয়ত ভুল করে উলটো পালটা ধারণা করে বসবে।]
আসলে পৃথিবীতে মানুষ খুব অল্প জায়গা নিয়ে বাস করে। যদি ২০০০কোটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ পাশাপাশি গা-ঘেঁষে দাঁড়ায়, ব্রিগেডের মত কোন জনসমাবেশে, তাহলে অনায়াসে ২০০ ২০০ মেইল কোন গড়ের মাঠে তাদের জায়গা হয়ে যাবে। প্রশান্ত মহাসাগরের কোন ছোট্ট দ্বীপে সমগ্র মানুষ জাতি ধরে যাবে ঠাসাঠাসি করে।
[VO- Father Reevs - এসব কথা বড়রা বিশ্বাস করতে চাইবে না। তারা ভাবে যে তারা অনেক জায়গা নিয়ে বাস করে। ওরা নিজেদের বটগাছের মত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ওদেরকেই বলা ভাল যে তোমরা হিসেব-নিকেশ করে বল! ওরা অঙ্কের সংখ্যা খুব পছন্দ করে, খুশি হবে। আমাদের এই অতিরিক্ত অঙ্কের মধ্যে ঢুকে দরকার নেই। একদমই দরকার নেই।]
VISUAL শেষ হয় real footage এ। মন্তাজঃ সবাই হিসেব করছে।
বাজারের মাছওয়ালা হিসেব করছে, ট্রামে কন্ডাক্টর হিসেব করছে, মোড়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ হাত বাড়িয়ে নেওয়া পয়সা হিসেব করছে। নাল-নীল উল বুনতে বুনতে কেউ আঙ্গুলের করে ঘর হিসেব করছে। বাচ্চা নামতা পড়ছে। সুপার লোটোর কাউন্টারে সপ্তাহান্তের ভীড়। দরজি শরীরের মাপ নিচ্ছে। নার্স ব্লাড প্রেশার চেক করছে। কলেজে রোল কল হচ্ছে। রসায়নাগারে ট্রাইট্রেশন হচ্ছে। বিধান সভায় বাজেট পড়া হচ্ছে (TV Footage)। কোন সাইবারক্যাফেতে প্রচুর লোক একসঙ্গে ইন্টারনেট সার্ফ করছে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছত্রিশ।।
হাতের চেটোর মত আঁকা বাঁকা রেখায় টানা মরুভূমি। তার কোন রেখা ধরে হেঁটে চলেছে যেন এক পিঁপড়ে যদিও সে এক মানুষ, বৃদ্ধা।
বৃদ্ধার বয়স হয়েছে, পৃষ্ঠে কুঁজ ফলে সে কেমন নোয়ানো। হাতে লাঠি, সূর্য কিরণে চিকচিকে বালির মধ্যে মধ্যে থেকে সে ক্রমশ এগিয়ে আসছে সামনে। সাদা পোশাক মলিন। মুখের রেখায় বয়স ও প্রকৃতির চিহ্ন।
বালির ঢিবিগুলি যেন পিরামিড, শোকের মতই স্তব্ধ চরাচর। দিনের বেলায় মাঝে মাঝে রাতচরা পাখির ডাক। এই রকমই দুই পিরামিডের অচেনা দেশ থেকে আবির্ভূত হয় কুঁজি বুড়ি এবং আশ্চর্য বালক।
বৃদ্ধাঃ ওলো, তুমি আমার ছেলেকে দেখেছো?
বালকঃ এখানে? কেউ নেই ফাঁকা! আমি কোন গ্রহে এসেছি?
বৃদ্ধাঃ আমি আমার ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়েছি। সেই যে গেল এখনো তো ফিরল না? ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই গো!
বালকঃ আপনার ছেলে কোথায় গেছে?
বৃদ্ধাঃ সে গেল পার্টির কী একটা কাজে। সেই জঙ্গল-পাহাড়ের দ্যাশে।
বালকঃ যুদ্ধে? এটাও বুঝি পৃথিবী? পৃথিবীতে তো দেখছি মানুষেরা খুব যুদ্ধ করে!
বৃদ্ধাঃ না বাছা, ও তো পেত্তম গেল শহরে, চাকরির খোঁজে। চাকরি, টাকা, শান্তি সবই পাওয়া যায় শহরে। আমাদের গ্রামে ওসব কিচ্ছু নেই। সেখান দিয়েই নে গেসে তারে। তবে যুদ্ধেও শুনেছি অনেক লোক লাগে...। চাকরি আছে...।
বুড়ির হাতের আঁকা বাঁকা লাঠিরও কেমন সোজা ছায়া পড়েছে বালির উপর।
সেটা চলতে শুরু করলে এঁকে-বেঁকে সরীসৃপ হয়ে যায়। (VFX)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য সাঁইত্রিশ।।
বিশাল বালুচরে হেঁটে চলেছে একবিন্দু সরীসৃপ।
কাছে এলে বোঝা যায় সেটা একটা কচ্ছপ।
নদীতীরে পা ভাঁজ করে, হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কা। সে অন্যমনস্ক থাকায় তার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে কচ্ছপটা গুটি গুটি এগিয়ে চলেছে নদীর দিকে।
প্রিয়াঙ্কার সামনে বালির ভেঙ্গে পড়া বাড়ি। প্রিয়াঙ্কার অন্যমনস্ক ডান হাত তাকে আরও ভেঙ্গে দেয়।
কচ্ছপটা জলরেখা স্পর্শ করার আগে, হয়ত মুহূর্ত থামে। দূরে প্রিয়াঙ্কা যেন মুছে যাওয়া কোন রঙ।
কচ্ছপের নকশা কাটা পিঠটা আস্তে আস্তে ডুবে যায় জলের মধ্যে। জল। জলের ঢেউ-এ কোথা থেকে ভেসে আসে একটা শুকনো পাতা। গোলাকার। বুঝিবা একটা কচ্ছপ ভেসে উঠল এই।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য আটত্রিশ।।
শাঁখা-পলা পরা একটা মেয়েলি হাত মাটি থেকে তুলে নেয় একটা পাতা।
পাতাটা মুখের সামনে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। যেন মুখ দেখছে কল্যাণী, হাতের আয়নায়।
একটা অশোক গাছের তলায় বসে আছে কল্যাণী। চারিদিকে ঝরে পড়ছে লাল অশোকফুল আর কিছু শুকনো পাতা। সাদা গাউনে পাদ্রী রীভস্কে দেখা যায় কল্যাণীর সামনে এসে দাঁড়াতে।
রীভস্- তোমাকে আগেই বলেছিলাম, এরা কিছু জানে না।
কল্যাণীঃ আপনি আমাকে সত্যি বলছেন না।
রীভস্- আমি কেন তোমাকে মিথ্যে কথা বলব। ওরা দিল্লিতে যোগাযোগ করেছিল কিন্তু সেখান থেকেও কিছু জানা যায়নি...।
কল্যাণীঃ তার মানে ও নিখোঁজ? কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না?
রীভস্- কী যা তা বকছ্? খবর পাঠানো হয়েছে দু-এক দিনের মধ্যে জানা যাবে। আমি নিজে এসে খবর নিয়ে যাবো।
কল্যাণীঃ না। আমিও আসব আপনার সাথে।
কল্যাণীর বাহু স্পর্শ করেন ফাদার। উড়ে যায় শুকনো পাতারা।
রীভস্- বেশ তো এসো। এখন ওঠো। চল দেখি কুসুম কোথায় গেল?
কল্যাণীকে একপ্রকার টেনেই মাটি থেকে তোলেন রীভস্। কল্যাণী উঠে দাঁড়ালেও তার হাত ছাড়েন না। হাত ধরেই হাঁটতে থাকেন ধীরে ধীরে। কল্যাণীও হাত ছাড়িয়ে নেয় না, মাথা নীচু করে সেও হাঁটছে।
ফাদার ও কল্যাণী বিন্দুর মত মিলিয়ে যায় দূরে, পড়ে থাকে একাকী গাছ, সীতার বিরহকাতর অশোকগাছ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য উনচল্লিশ।।
শেওলা সবুজ রঙের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে ওঠছে ছোট্ট কুসুম। হাল্কা রঙের ফ্রক পরনে।
মাটি থেকে অনেকটাই উঠে পড়েছে সে। সরু সিঁড়ি বেয়ে সে উঠছে সীমান্তরক্ষীদের টঙ্ ঘরে[watch tower] ।
ছোট্ট টঙ ঘরে একা কুসুম। কোন পরিত্যক্ত টঙ্ ঘর। ময়লা লাল হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ ছাড়া কিছুই নেই সেখানে।
ঘরের মধ্যের ছোট্ট চৌকো জানালায় চোখ লাগায় কুসুম।
কিছু গাছ পালা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না তার। গাছ পালার মধ্যে আরও দু’চারটে এই রকম টঙ্ ঘর (watch tower), অন্যরকম রঙ হয়ত সেগুলির সীমান্তের ওপারের।
নিচ থেকে খাড়া উঠে গেছে টাওয়ার, যেন রণপা মেলে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট্ট সবুজ ঘর। তার জানালায় দেখা যায় ছোট্ট কুসুমের মুখ, সে তাকিয়ে আছে উর্ধ্বমুখে।
কুসুম চ্যাঁচায়ঃ বাবা তুমি কোথায়?
দূরে কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছপালা আর ভিনরঙা কিছু ওয়াচ টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মতন। সেসব থেকে প্রতিধ্বনি ফিরে আসেঃ বাবা তুমি কোথায়?
বাবা তুমি ফিরে এসো।
বাবা তুমি ফিরে এসো।।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চল্লিশ।।
কোন এক অখ্যাত জনশূন্য স্টেশনের ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে ডাক্তার। মলিন পোশাক, কাঁধে ঝোলা। বেঞ্চিতে একা বসে ডাক্তার।
আওয়াজ তুলে ধীরে ধীরে চলেছে মালগাড়ি। ডাক্তার অপলকে দেখছে মালগাড়ির যাওয়া।
মালগাড়ির কামরাগুলি চলেছে খুবই আস্তে আস্তে, যেন তাদের কোন গন্তব্য নেই। মালগাড়ির কামরার দরজাগুলো খোলা। নজর করলে বোঝা যায় প্রতিটা কামরাতেই আছে বেশ কতগুলো করে মহিষ। কোন কোন কামরার ভিতর দিনের বেলাতেও জ্বলছে টিমটিম করে লন্ঠন।
ডাক্তার লক্ষ্য করেন একটি কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে ছোটেলাল। দু’জনেই দুজনকে দেখছে স্থিরভাবে।
আবহে মালগাড়ির আওয়াজের সঙ্গে ভেসে আসে ঘাঁটুগান-
শ্মশানঘাটে একটি কন্যা রোদন করে কী কারণ।
শ্মশানঘাটে একটি কন্যা রোদন করে কী কারণ। (ধুয়া)
ছুঁইলে নারী পাপী হয়, না ছুঁইলেও নারী গর্ভবতী হয়।
সেই নারীরই সন্তান হইলে গো, পিতা কারে বলতে হয়।
আরে, শ্মশানঘাটে একটি কন্যা রোদন করে কী কারণ।
শ্মশানঘাটে একটি কন্যা রোদন করে কী কারণ। (ধুয়া)
চলন্ত গাড়ির কামরা থেকে দেখা যায় জনশূন্য স্টেশনের এক বেঞ্চিতে বসে ডাক্তার। তার মুখ প্রাপ্তিতে উদ্ভাসিত। ক্রমশ ডাক্তারকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যায় শূন্য প্লাটফর্মের উপর দিয়ে।
লম্বা মালগাড়িটার শেষ কামরাটা আস্তে আস্তে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। শেষে গার্ড সবুজ পতাকা নাড়ছেন অভ্যস্ত হাতে।
ডাক্তার স্থানুবৎ বসে দেখতে থাকেন ট্রেনের চলে যাওয়া।
ট্রেনের আওয়াজ কমার বদলে বেড়ে গিয়ে গ্রাস করে আবহের ঘাঁটু গান।
ট্রেন চলে গেলে উলটো দিকের বেঞ্চে বসে নব বিবাহিত দম্পতি। টোপর, ধুতিতে বর বেশে কোটেশ্বর মাহাতো। পাশে নব বিবাহিত বধূর মুখ বেনারসীর ঘোমটার আড়ালে ঢাকা।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য একচল্লিশ।।
সিমেন্টের বাঁধানো ধাপ কাটা কাটা লম্বা লম্বা সিঁড়ি খাড়া নেমে গেছে নদীর দিকে। সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে নামছে আশ্চর্য বালক। জলের থেকে বেশ কয়েক ধাপ উপরে সে থামে। তার দৃষ্টি জলের ঠিক উপরের ধাপে বসা দুই নারীর দিকে।
দুই নারী যেন দুই বোন। বাক্যরহিত দুজনেই। বড় বোনের হাতের হাতের শাঁখা আধলা ইঁটের ঘায়ে গুড়িয়ে দিচ্ছে অবিবাহিত ছোট বোন, নির্মম ভাবে। বড় বোন উদাস সাশ্রু, তাকিয়ে আছে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে।
ভয়মাখা রক্তশূন্য মুখ বালকের, ইঁটের আওয়াজে সে শিউরে ওঠে, পিছু হটে। শাঁখা ভেঙে ছিটকে পড়ে কাদায়, সিমেন্টে, জলে। একটা নিরাভরণ হাত থরথর করে কাঁপছে।।
আবহে বিচ্ছেদী গান শোনা যায়-
বহুদিনের পিরীত গো বন্ধু একই দিনে ভাইঙ্গো না,
একই দিনে ভাইঙ্গো ন গো, একই দিনে ভাইঙ্গো না।
একটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে বালকের। দেওয়ালে কাঠকয়লায় করা শ্মশানযাত্রী, শববাহীদের আঁকিবুকি-নজর করলে বোঝা যায় গুয়েরনিকার উপর কাঠকয়লার কাটাকুটি-অজস্র মোবাইল নম্বর লেখা। নদীর অপার থেকে মাইকের আওয়াজ ছাড়া ছাড়া ভেসে আসছে, চলতি কোন গান। মিশে যায় পূর্ববর্তী গানের ক্রমশ নিঃশব্দ হয়ে পড়ে সব।
বালকের (খালি পা) পায়ের তলায় সারসার শ্বেত পাথরের ফলক বসানো, বিভিন্ন স্বর্গীয় ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আত্মীয় পরিজনদের স্মৃতিফলক।
একেকটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে একেকটি আবহ যুক্ত হয়-ওপারের চলতি গান, এপারের হরিনাম সংকীর্তন আকাশে এরোপ্লেনের আওয়াজ, নীচে জলের শব্দ কেমন যেন ট্রাপিজিয়ামের সংকীর্ণতা তৈরি করে।
নদীর এপার থেকে দেখা অন্যপাড়। স্কুল ইউনিফর্মে প্রচুর মেয়ে পিকনিকে ব্যস্ত। গান, আনন্দ, দৌড়াদৌড়ি যেন ঢেকে দেয় এরোপ্লেনের আওয়াজ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য বিয়াল্লিশ।।
দু’পাশে ডানা মেলে একটা ফড়িং ছুটে আসে সোজাসুজি ঠিক যেন এরোপ্লেন। দুটো বাচ্চা হাত প্রবেশ করে ঠিক সামনে যেন মুঠোর মধ্যে আনতে চায় সেই প্রাণটাকে, কিন্তু দুই হাতের ফাঁক গলে পালায় সেটা।
একটা ফড়িং উঠে যায় জল, শালুকপাতা, শালুকফুলের উপর দিয়ে।
কাজল জল, লাল-শাদা শা্পলাফুল। ভিন্ন ভিন্ন গোলাকৃতি সবুজে-ম্যাজেন্টায় সাজানো থালা। যেন ভোজসভা। সাদা বক, শামুকখোল, মাছরাঙারা অতিথি সেখানে। একটু উপরে দিয়ে উড়ে বেড়ায় অজস্র ফড়িং। যুদ্ধের কোন নিষ্ঠুর স্পর্শ নেই সেখানে।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দূরে দাঁড়িয়ে একাকী গির্জা। সামনের বড় বড় ঘাসের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে অজস্র ফড়িং। ফড়িং ধরার জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে কুসুম। দূরের ছোট্ট কুসুমকে মনে হয়ে রঙিন প্রজাপতি।
জলের মধ্যে অর্ধেক ঢুকে থাকা ঘাসে ডগায় বসে একটা সুন্দর ফড়িং। দুটো ফর্সা অল্পবয়স্ক মেয়েলি পা এসে ডুবে যায় জলের তলায়। দুটো হাত দু’দিক থেকে এসে ধরে ফেলে ফড়িং এর লেজ। ফড়িংটা ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে, ছটফট করে ডানা ঝাপটায়। হাত দুটো আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলে বোঝা যায় সে কুসুম। (VFX)
কুসুম ডানা দুটো ধরে সুতোর ফাঁস আটকে দেয় ল্যাজে। ফড়িংটা উড়তে উড়তে একসময় টান পায় ল্যাজে।(VFX)
জলাশয়ের ধারে রাখা ছোট্ট নৌকার উপর চোখ পড়ে কুসুমের। পান্সির উপর বসে অদ্ভূত এক বালক। সে নৌকার উপর বসে আছে হাঁটুতে মুখ গুঁজে।
নৌকাটা মৃদু মন্দ দুলছে জলের ধাক্কায়, আশ্চর্য বালকের কোন হুঁশ নেই। হাঁটু দুটো আধ-ভাঁজ করে তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে বসে আছে সে কিংবা ঘুমিয়েই পড়েছে সে। একটা হাত এসে স্পর্শ করতে সে চমকে তাকায়।
বালকঃ তুমি কে?
কুসুম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বালকের দিকে। মাথার পিছন দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জলভরা সাদা মেঘ।
কুসুমঃ আমি কুসুম। তুমি আমার সঙ্গে খেলবে?
বালকঃ আমার খেলতে ইচ্ছে করছে না। আসলে আমার মন খুব খারাপ।
কুসুমঃ কেন?
বালক কোন উত্তর দেয় না চোখ নামিয়ে সে দেখে কুসুমের হাতে সুতো। সুতোয় বাঁধা এক ফড়িং, কষ্ট করে সে উড়ছে। এসে বসছে নৌকার বাতায়। (VFX)
কুসুমঃ তুমি আমার বন্ধু হবে?
বালকঃ আমিও বন্ধু খুঁজতে বেরিয়েছিলাম জানো? আচ্ছা আমাকে তোমার বন্ধু হতে হলে কী করতে হবে?
কুসুমঃ জানি না। নেমে এস।
কুসুম ডান হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বালক সেটা ধরে না। টাল-মাটাল পায়ে উঠে দাঁড়ায় নৌকার একেবারে শেষ কিনারায়। উঠতে উঠতে তর্জনী দিয়ে দেখায় কুসুমের মুঠোয় করা বাঁ হাতের দিকে।
বালকঃ ওকে বেঁধে রাখলে কিন্তু ও কোনদিনই তোমার বন্ধু হবে না। ওকে ছেড়ে দাও।
কুসুমের হাতের মুঠো। একটা গুলির আওয়াজ শোনা যায়। মুঠোটা আলগা হয়ে যায়।
আওয়াজের সাথে সাথে ভারসাম্য হারিয়ে আশ্চর্য বালক পড়ে যায় জলে।
ছোট্ট সুতো সমেত উড়ে যায় ফড়িংটা।(VFX)
বালকের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। কিছু বুড়বুড়ি কাটে জল।
কুসুম নৌকার ধারে গিয়ে ডাকে- ‘বন্ধু’
জল আগের মত শান্ত। স্থির শাপলা পাতায় মথ ফড়িং এর ওড়াওড়ি। দূরের গির্জা থেকে ছুটে আসছেন ফাদার রীভস্। গুলির শব্দের জন্যে উৎকন্ঠিত তিনি।
রীভস্- আবার এসেছে শয়তানগুলো... পাখি মেরে মেরে সব ফাঁকা করে দেবে... গুলি করে শামুকখোল মারছে... মাছের কান্কোয় বিষ দিয়ে বক মারছে... তোরা তো রাক্ষসদেরও ছাড়িয়ে গেলি...
নৌকার এক কোণায় হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে ভীত কুসুম, ঠিক যেভাবে কিছুক্ষণ আগে বসেছিল আশ্চর্য বালক।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তেতাল্লিশ।।
সশব্দে খুলে যায় একটা পেল্লায় সিন্দুকের দরজা, দরজায় জমকালো নক্শা।
কাঁপা কাঁপা হাত (বৃদ্ধ রাজা রবীন্দ্রনাথের হাত) ঢুকে যায় সিন্দুকের মধ্যে, টেনে বের করে আনে কিছু কাগজপত্র।
কুষ্ঠ আক্রান্ত হাত দিয়ে কাগজগুলো বিছিয়ে দেন একটা শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর।
হ্যারিকেনের শিখাটা আরেকটু বাড়িয়ে দেন।
কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখা যায় কাগজগুলো সব দলিল। সেগুলোতে উই ধরার ছাপ, মাটির পলেস্তারা।
কুষ্ঠে বেঁকে যাওয়া আঙ্গুল দিয়ে ভাঙতে থাকেন উইয়ের বাসা।
দিশেহারা উইয়ের দল বেরিয়ে আসে ভেঙ্গে যাওয়া বাসা থেকে।
তাদের ডানা গজায়। উড়তে থাকে হারিকেনের চারপাশে।(VFX)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চুয়াল্লিশ (ক)
আয়নার দিকে পিছন ফিরে বসে রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা। তার সারাদেহে জমকালো সব অলংকার। প্রচুর অলঙ্কার পরে বসে আছে সে। সামনে টেবিলে জ্বলছে একটা মোমবাতি। অন্যমনস্ক প্রিয়াঙ্কা বারবার তর্জনী বাড়িয়ে ছ্যাঁকা খাচ্ছে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চুয়াল্লিশ (খ)
সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রায় মিশে যাওয়া রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কোটেশ্বর মাহাতো। গায়ে উজ্জ্বল নতুন পোশাক। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে সে চ্যাঁচায়।
কোটেশ্বরঃ রাজকনিয়া তু নেমে আয়।
মত্ত কোটেশ্বর সারা উঠোন ঘুরে ঘুরে চ্যাঁচায় আর কাঁদে। একটি দেহাতী মেয়ে/ ঘোমটা খুলে পড়ে যাওয়া বৌ ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করে তাকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য চুয়াল্লিশ (গ)
রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কাকে দেখা যায় তার মায়ের বিয়ের জীর্ণ বেনারসী পরতে।
আবহে ঝপাং ঝপাং করে ঝাঁটার আওয়াজ শোনা যায়।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পঁয়তাল্লিশ।।
ক্ষীণ আলোয় দেখা বাঁ হাতের তর্জনীর ডগটুকু বাদ দিয়ে বাকিটা চেপে ধরে থাকে ডান হাত। ডগটুকুতে এসে জমা হয়েছে একবিন্দু রক্ত।
Music Destruction theme starts.
ডাক্তার দ্রুতহাতে স্লাইড বারে করে তাতে মুছে নেন রক্তটা।
হাত বাড়িয়ে সুইচ টেপেন।
মাইক্রোস্কোপের বিচিত্র আলো জ্বলে ওঠে। বাল্বটির হোল্ডারের গাত্রছিদ্র দিয়ে বিন্দু বিন্দু আলো, সারা ঘর, দেওয়াল, টেবিল, ডাক্তারের মুখ ও জামা কাপড়, সর্বত্র ছড়িয়ে।
ডাক্তার মাইক্রোস্কোপে স্লাইড লাগিয়ে চোখ ঠেকান মাইক্রোস্কোপে।
মাইক্রোস্কোপের মধ্য দিয়ে দেখা জমে যাওয়া রক্তের ছবি। মনে হয় যেন প্রচুর মানুষ সেখানে। ছোটাছুটি করছে। প্রথমে ভেসে আসে কোন ফুটবল মাঠের শব্দ সমষ্ঠি। এরপর ভেসে আসে বাজারের শব্দ এরপর পরবর্তী দৃশ্যে হই চই।
জীর্ণ বেনারসীতে আলুলায়িত চুলে সালঙ্কারা রাজকন্যা প্রিয়াঙ্কা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের ওপর। চেয়ার সমেত ডাক্তার ছিটকে পড়েন।
Suddenly theme music destruction stops.
স্লাইডগুলি পর্দাময় ছড়িয়ে পড়ে।(VFX)
কানে আসে আসে কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য ছেচল্লিশ।।
[পূর্বে দেখা বাসস্ট্যান্ড। যদিও কালের নিয়মে তা বহুলাংশে পরিবর্তিত। নিয়ন আলোয় পেপসি-কোকাকোলা বোর্ড, কোয়াক ডাক্তারের প্লাস চিহ্ন সহ অনেক বোর্ড- ব্যানারে জমজমাট বাজারের চেহারা। পার্টি অফিসের উপর ঝাণ্ডা, ভাতের হোটেলের বোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘হিন্দু’ শব্দটা, মাইক্রোফোনে লটারি বিক্রেতার গলা সব মিলিয়েই এই জায়গা এখন আধা শহর। ]
বহু উঁচু থেকে দেখা সারিবদ্ধ নড়াচড়া দূর থেকে দেখে ক্রোমোজমের চলন বলে ভ্রম হয়।
তাদের যৌথ সঞ্চারণে মায়োসিস কোষ বিভাজনের বিভিন্ন দশা সূচিত হয়।
একেক গ্রামের প্রশেসন একেক গাড়িতে। গরুর গাড়িতে চেপে চলেন গুরু, গুণীন। সারা গায়ে জড়ানো বিষধর সাপ। শিষ্যরা চলেন পিছনে পিছনে তাদেরও গলায় জড়ানো বিষধর সাপ। তারা গায় মনসা ভাসানের গান।
রাস্তার দু’পাশে প্রচুর লোকের জটলা। কেউ কেউ পয়সা ছুঁড়ে মারে চলন্ত গরুর গাড়িতে।
রাস্তায় গড়িয়ে পড়া পয়সা কুড়োয় ছেলেছোকরার দল। তাদের সঙ্গে দেখা যায় বিমলকে, লম্বা চুল-দাড়িতে অপ্রকৃতিস্থ চেহারায় লোকের পায়ের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে পয়সা কুড়ায়।
জনতা ‘হিন্দু’ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ফাদার রীভস্ ও কুসুম কোকাকোলার বোতল থেকে স্ট্র লাগিয়ে কোকাকোলা খেতে খেতে দেখছে প্রসেশন।
তার পাশেই পার্টি অফিসের জানালা। পার্টি অফিসের মধ্যে কালার টিভিতে চলছে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে/ম্যাট্রিক্স ধরণের কোন সিনেমা। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে তার প্রবল আওয়াজ। পয়সার ঝনঝন, যুদ্ধের রিলিফ ফান্ডের ডেইলি কালেকশনের গণনা চলছে।
মাঝে মাঝে গরুর গাড়ি থামিয়ে শিষ্যদল খেলা দেখায়, মুখের মধ্যে আগুন পোরে, জিভে ছুঁচ বেঁধায়।
বাচ্চারা হাততালি দেয়, বড়রা পয়সা ছোঁড়ে।
শেষ গাড়ির পিছন পিছন বেশ কিছু লোক হাঁটে।
আস্তে আস্তে ভিড় ফাঁকা হয়। দু একটা জটলা কারা সেরা তাই নিয়ে আলোচনা চলে।
কুসুম রীভস্এর হাত ধরে এগোয় বাড়ির দিকে।
গাছতলায় বিমল পা ছড়িয়ে বসে খুলছে কোকাকোলার ছিপি। কিছু অশ্বত্থ পাতা আর ছিপি তার সামনে ছড়িয়ে।
বিমলঃ আমি পেরেছি ফাদার’দা... এই দেখুন এটা আমি, এখানে বসে আর এটা আমাদের এলাকার ম্যাপ... আমি ঠিক এইখানটায় বসে... সব যে পালটে গেল ফাদারদা... সমস্ত এঁকে রেখে যাবো... এদের সমস্ত বদমায়িশি আমি ফাঁস করে দেবো...
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রীভস্ একটু থামেন, বিমলকে দেখেন।
বিমল হাত পেতে দেয় রীভস্এর সামনে।
বিমলঃ দুটো টাকা হবে স্যার?
ফাদার বিনা বাক্যব্যায়ে গাউনের পকেট থেকে দুটো টাকা বার করে বিমলের হাতে দেয়।
রীভস্ টাকাটা দিয়ে এবার কুসুমের বাড়ির দিকে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে কল্যাণী।
ফাদার ও কুসুম বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, দরজা খুলে আছে কল্যাণী। বিমল প্রবল উৎসাহে অশ্বত্থের একপাশে ঢালু চাতালে কোল্ডড্রিঙ্কসের গুটি সাজিয়ে সাজিয়ে মানচিত্রের মত কিছু পরিখা তৈরির চেষ্টা করছে। গাছ থেকে ঝোলানো একটা মস্ত টায়ারের দোলনায় সশব্দে দোল খাচ্ছে একটা দশ-বারো বছরের ছেলে। রাস্তার ওপারের পার্টি অফিসের ভিতর থেকে আসছে সিনেমার উচ্চস্বর।
সাইকেলের ক্যারিয়ারে আটকানো ঢোল বাজাতে বাজাতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলে যায় রামেশ্বর। সাইকেলের হাতলে সে হাত দেয় না, ঢোল বাজাতে বাজাতে অদ্ভূত ব্যালেন্স নিয়ে প্যাডেল করে আর গান গায়। তার দেশজ গান তার অবয়বের মতই ছোট্ট ছোট্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়।
অফ ভয়েস শোনা যায় বিমলের কন্ঠস্বর।
বিমলঃ পারবি? তোদের র্যাম্বোকে কাশ্মীরে পাঠাতে পারবি? মেরে ঠান্ডা করে দিক সকলকে-... তোদের র্যাম্বো রে... ঐ কাশ্মীরটা নিয়ে একটু কনফিউশন আছে... এঁকে ফেলব রে এঁকে ফেলব ভারতের ম্যাপটাও এঁকে ফেলব... যা... যা...
অফ ভয়েসে সমবেত কন্ঠে-
সমবেতঃ মার, মার শালাকে... পাকিস্তানি চর শালা...
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য সাতচল্লিশ।।
গির্জার ঘড়ি, ডায়ালে মোমরং দিয়ে আঁকা পৃথিবীর মানচিত্র। অবিশ্রান্ত ঘড়ির কাঁটা সঞ্চরণশীল সেই মানচিত্রের উপর (স্লো স্পিডে নেওয়া)। ভেসে আসছে রেডিওতে প্রচারিত খবর, যুদ্ধের খবর।
ঘড়িঘরের ভিতর, অদ্ভূতভাবে একাকী অন্ধকারে শুয়ে ফাদার রীভস্, বুকের উপর যেন ছোট্ট কালো বেড়ালছানা, রেডিও। যুদ্ধের খবরে হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
ফাঁকা গির্জার অভ্যন্তর। প্রায় অন্ধকার। মেরীমুর্তির পাদদেশে একটা একটা করে মোমবাতি জ্বালান রীভস্ একা হাতে।
রীভস্ নিপুণভাবে ট্রেসিং পেপার কেটে তাতে আঠা লাগিয়ে সেঁটে দেন; ছিঁড়ে যাওয়া বাইবেলের পাতায়। ট্রেসিং পেপারের ভেতর ফুটে ওঠে বাইবেলের আবছা অক্ষর।
গির্জার বিশাল ছাদে একা রীভস্। একা চোখ লাগিয়ে বসে আছেন টেলিস্কোপে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ধীরে ধীরে বেড়ে চলে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য আটচল্লিশ।।
নিকষ কালো রাত্রির মধ্যে কয়েকটি আলোকবিন্দু, রাতের আকাশ।
ক্রমশ সেটা রঙ পরিবর্তন করে হয়ে যায় সাদার মধ্যে কালো যেন সাদা পাতায় কয়েকটি কালির ফোঁটা, যেন বিশাল কোন বিমূর্ত চিত্রকলার নমুনা।
ক্রমশ সেটা রঙ পরিবর্তন করে হয়ে যায় সাদার উপর কয়েকটি লাল বা বেগুনি বিন্দু। এগুলি পর্যায়ক্রমে আরবিসি ও ডব্লিউবিসি-র মাইক্রোস্কোপে দেখা রূপ।
ডাক্তারের ঘরে মাইক্রোস্কোপ। চোখ লাগিয়ে তন্ময় প্রিয়াঙ্কা। অচেনা জগতে প্রবেশের লোমহর্ষতা তার চোখে-মুখে। আচ্ছন্নভাবে প্রিয়াঙ্কা বিবরণ দিয়ে চলেছে কিছু অপার্থিব-অবর্ণনীয় রূপের।
একটু দূরে প্রজেক্টর দেওয়ালে সেট করতে ব্যস্ত ডাক্তার, নির্লিপ্ত মুখে লাবণ্যের বর্ণনার জবাবে বলে চলেছেন কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ, ব্যাখ্যা। নিতান্তই সাদামাটা মামুলি পার্থিব। এবং কিছু জাগতিক প্রশ্ন: রাজা-কচ্ছপ ও বঙ্কিম ও ঘর গেরস্থালি, রসালাপ।
দেওয়ালে ক্রমান্বয়ে স্লাইড পড়ে- neutrophil eosinophil basophil, lymphocyte এবং monocyte. কিছু মেঘ কালো, সাদা, লাল, বাদামী, ধূসর ক্রমান্বয়ে অস্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ মেঘ সরে ধু ধু নীলাকাশ, কোন দেওয়াল নেই, শুধু নীল আকাশ। পশ্চাতে কথোপকথন চলতেই থাকে, আমরা এগিয়ে যেতে থাকি সেই নীল আকাশের দিকে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য উনপঞ্চাশ।।
আকাশ যত কাছে আসে, মেঘেরা সরে যায় দ্রুত। জলেতে ছবি ভাসে সৃষ্টি, ইতি উতি শাপলা ফুল, পাতা, সাদা বক, মাছরাঙা।
সেই ছবির মধ্যে ছবি ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে পান্সি, একরত্তি এক নৌকা। নিজের হাতে বৈঠা বাইছেন আলবার্ট রীভস্, সাদা গাউনে। মধ্যে বসে কল্যাণী উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকাশের দিকে। কল্যাণীর গলায় গান বিরহের বার্তা নিয়ে ধরতে চাইছে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে।
গানঃ আছো অনলে অনিলে চির নভনীলে
ভূধরে সমীরে গগনে
আছো বিটপীলতায় জলদের গায়
শশীতারকায় স্বপনে
নৌকার সামনের দিকের অগ্রভাগে বসে কুসুম। একটু ঝুঁকে, অন্যমনস্ক। তার হাত জল ভাঙছে দাঁড়ের মত।
কল্যাণীর দৃষ্টি স্থির, আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় গাইছে গান।
জলে বৈঠা পড়ে, যেন গানের তালে তালে।
কুসুমের হাতে কিছু একটা লাগায় সে চমকে যায়। একটা প্লাস্টিকের তৈরি প্যানপাইপ কুসুমের হাতে ধাক্কা খেয়ে অন্যদিকে চলে যায়। কুসুম ছোট্টুর প্যানপাইপটা চিনতে পেরে আনন্দে নৌকার পিছনে তাকায়। কল্যাণীর চোখ বুজে উদাস গলায় গাওয়া গান কুসুমের বাক্রোধ করে দেয়।
কুসুম তাকিয়ে থাকে প্যান পাইপের দিকে। প্যানপাইপটা ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
কিছু অনুচ্চ টিলা, মধ্যে দাঁড়িয়ে এক গির্জা। চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে গান।।
কুসুম দাঁড়িয়ে আছে জলের ধারে, একা। মাথার উপর উড়ে যাচ্ছে অজস্র ফড়িং। কোথা থেকে হাড় কাঁপানো উড়োজাহাজের শব্দ ঢেকে দেয় গানের শেষ কথাগুলো। সেই উড়োজাহাজের শব্দ ছাপিয়ে নামে বৃষ্টি।
নৌকার উপর শুয়ে কুসুম একা একা জলে ভিজছে।
বৃষ্টিতে ভিজছে অখণ্ড চরাচর মধ্যিখানে একা দাঁড়িয়ে গির্জাটা ভিজছে দেশলাই বাক্সের মত।
শূন্য গির্জার মধ্যে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, পাঁক মেরে উঠে গেছে উপরে। উপরের পা’দানির থেকে নীচে ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে নামে জল। একের পর এক পা’দানিতে গড়িয়ে নামে জল, এক সময় খেয়াল হয়, সেই জল রঙিন।
গির্জার ছাদের দরজার কাছে পাতা এক মানচিত্র, সেটারই জলরং ধুয়ে গড়িয়ে পড়ছে লোহার সিঁড়িতে। সেখান থেকে দৃষ্টি সরে পড়ে টিভির বাক্সটার উপর, সেটাও ভিজে, ফেঁসে এলিয়ে পড়েছে। তার মধ্যে রাখা মানচিত্রগুলো সারা ছাদে ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রায় সাদা। সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে, ছড়ানো মানচিত্রগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে কল্যাণী ও রীভস্। রীভসের বুকে মাথা রেখে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে চলেছে কল্যাণী। রীভসের সাদা গাউনে কল্যাণীর শাড়ির বিভিন্ন রঙের ছোপ। বৃষ্টির মধ্যে থরথর করে কাঁপছে দুটি দেহ।
গির্জার প্রধান দরজা দিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে একটা কচ্ছপ ঢুকে যাচ্ছে গির্জার মধ্যে, বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ক্রমশ সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়।
কল্যাণীর রঙিন শাড়ি ভিজে ছড়িয়ে পড়ে আছে ছাদে, যেন নতুন আঁকা মানচিত্র।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য পঞ্চাশ।।
সাদা, চারিদিক ছেয়ে আছে বরফে।
গাঁইতি খুঁড়ে কে যেন বেরিয়ে আসে বরফ ফাটিয়ে। এক পাইলট। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার বরফ আচ্ছাদিত প্লেনের দিকে। গাঁইতি চালিয়ে চাকাগুলো বরফমুক্ত করে পাইলট।
ক্ষতিগ্রস্থ বিমানের একটা পাখা খুব ধীরে ধীরে ঘুরছে।
পিছনে দপ্ দপ্ করছে একটা লাল আলো। সেই আলো বরফকেও করে তুলছে লাল কিছুক্ষণ অন্তর।
আবহ- ট্রাঞ্জিস্টারে কাটাকাটা সিগিনালের মাঝে গোলাগুলির প্রবল আওয়াজ ভেসে আসে।
বিমানের পেটের তলায় ঢুকে সেটাকে সারানোর চেষ্টা করছে সেই পাইলট।
দূর থেকে বরফে আটকে পড়া যুদ্ধ বিমানটা দেখে দৌড়ে আসছে আশ্চর্য বালক, বরফের উপর দ্রুত পা ফেলে।
বালক বিমানের নীচে উঁকি মারে। দুজনেই দু’জনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়।
বালকঃ ও মা তুমি এখনো যাওনি? তোমার প্লেনটা কি এখনো ঠিক হয়নি?
লোকটি খুব অদ্ভূত ভাষায় কথা বলে। ইশারায় বোঝায় সে বালকের কোন কথা বুঝতে পারছে না।
হতবাক বালকের মুখের উপর দপদপ করে লাল আলো।
বালকঃ আমারই ভুল। আমি তোমাকে আমার পুরনো বন্ধু ভেবেছিলাম। ... তোমার পোশাক দেখে বোঝা উচিৎ ছিল... তোমার ভাষা... তুমি বোধ হয় অন্য দেশের পাইলট!
লোকটি আবার ইশারায় বোঝায় সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বেরিয়ে আসে বিমানের তলা থেকে। সে বিমানটা দেখিয়ে বিদেশি ভাষায় কিছু বলে।
বালকটি তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে, সেও কিছু বুঝতে পারছে না।
লোকটি একটা পট দেখিয়ে কিছু বলে।
বালকটি ঘাড় নেড়ে বলে সে কিছু বুঝতে পারছে না।
লোকটি ইঙ্গিত করে বোঝায় খাওয়ার জলের কথা। পটটি উলটে দেখায় সেটি খালি।
বালকটি ঘাড় নেড়ে জানায় তার জলের দরকার সেটা সে বুঝেছে কিন্তু [চারিদিক দেখিয়ে বলে] কোথায় জল আছে সে জানে না। তাকে ইশারায় বলে তার সঙ্গে যেতে।
বিচ্ছিন্ন তুষার ক্ষেত্রের মধ্যে হাটতে থাকে দুইজনে, চারিধার আচ্ছন্ন নীরবতায়।
তারা হাঁটতে হাঁটতে ধীরে ধীরে আকাশে তারারা ফুটে ওঠে।
তারা হাঁটতে হাঁটতে ধীরে ধীরে সকাল হয়ে যায়। বরফের বদলে পায়ের তলায় চিকচিক করছে বালি।
হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা কুয়ো দেখতে পায়। কুয়োটা ভীষণ অদ্ভূত এই নির্জন জায়গায় দড়ি, বালতি সমেত কুয়োটা দুজনকেই অবাক করে দেয়।
পাইলট একটু হাসেন।
বালকঃ এটা অনেকটা গ্রামের কুয়োর মত। হয়ত গ্রাম ছিল এখানে, যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে।
বালতি এসে পড়ে জলে। কপিকল ঘড়ঘড় শব্দ করে ওঠে। পাইলট টেনে তোলে বালতি। কপিকলের গান বাতাসে ভাসে।
কুয়োর জলে চিকচিক করে সূর্য।
বালতির জলে চিকচিক করে সূর্য।
বালক আঁজলা ভরে তোলে জল তাতেও চিকচিক করছে সূর্য, মুঠোর মধ্যে।
বালকঃ জানো তোমাদের গ্রহের লোকেরা একটা বাগানে ৫হাজার গোলাপ ফুল ফোটায় কিন্তু অত ফুলের মাঝেও তারা খুঁজে পায় না কি চায়!
পাইলট বালতি কাত করে করে জল ঢালে শূন্য পাত্রে। মুখভঙ্গী করে বোঝায় সে বালকের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না।
বালকঃ হয়ত ওরা যা খুঁজছে তা পেয়ে যেতে পারে একটা মাত্র ফুলের মধ্যেই বা এক আঁচলা জলে।
কুয়োর জলের ভিতর পাইলট ও বালকের ছায়া যেন গোলাকার পৃথিবীর দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে দুজন।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য বাহান্ন।।
প্রশস্ত খাটে শুয়ে কল্যাণী ও কুসুম। মা তার ছোট্ট মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই পড়েছে ঘুমিয়ে।
বিছানা থেকে সন্তর্পণে উঠে পড়ে কুসুম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঁকি মারে বাইরে, দেড়তলা থেকে। বিরাট অশ্বত্থ রাত্রি ঘন করে দাঁড়িয়ে। বাসস্ট্যান্ডে চার-পাঁচটা বাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। শহর থেকে শেষ বাস এখনো ফেরেনি। গুমটি ও পার্টি অফিস, পাইস হোটেলে জ্বলছে ক্ষীণ সব আলো সাইকেলে গান গাইতে গাইতে পরিচিত দৃশ্যে রামেশ্বর। সাইকেলের হাতলে সে হাত দেয় না। কেরিয়ারে আটকানো ঢোল বাজাতে বাজাতে সে সাইকেল চালায় আর গান গায়।
দূরে চোখে পড়ে দুটো আলো। শেষ বাস ফিরছে শহর থেকে।
ধীরে ধীরে একটা দুটো করে আলো মুছে যায়। পাইস হোটেলে বাসন মাজার আওয়াজ আসে। পেপসি লেখা নিয়ন বোর্ড মুছে যায়।
গুমটির উল্টোদিকে একটা মোটরগাড়ি রিপেয়ারিং এর একচালা দোকানে এখনো ক্ষীণ আলো। দোকানের সামনে বসে একটা ১০/১২ বছরের ছেলে গ্যাস আগুন দিয়ে কিছু ঝালছে। তার পাশে পড়ে এক দীর্ঘকায় ছায়া। সে চমকে তাকায়।
বিমল এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটির সামনে। ছেলেটির হাতে এক দুমড়ানো চাকা, মাস্ক, গ্যাস আগুন এমনি এমনি জ্বলে যায়। বিমল পুরোপুরি পাগল চুল-দাড়ি-চেহারায়।
বিমলঃ হ্যাঁরে কলম্বাসকে দেখলি নাকি? হেঁটে গেল?
বালকটি ভয় পেয়ে একটু গোঙায়, সে বোবা, কথা বলতে পারে না।
বিমলঃ জানিস, আমি যখন ভাস্কো ডা গামা ছিলাম, কালিকটে মহারাজা আমাকে কি দিয়েছিল জানিস...
প্রশস্ত খাটে শুয়ে কল্যাণী ও কুসুম। মা ও মেয়ে দুজনেই ঘুমে আচ্ছন্ন। দূর থেকে ভেসে আসে বিমলের আস্ফালন, কিছু কুকুরের চীৎকার।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তিপান্ন।।
প্রচন্ড শব্দে বনবন করে ঘুরছে যুদ্ধবিমানের পাখা।(VFX) বালিয়াড়ির মধ্যে আটকে পড়া যুদ্ধবিমান প্রচণ্ড শব্দ তুলে প্রাণ এনেছে মরুভূমিতে। বিমান থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে বালক চেঁচিয়ে পাইলটটিকে ডাকেঃ বন্ধু
পাইলট যুদ্ধবিমানের জানলার কাঁচ সরিয়ে বালকটিকে দেখে। ইঙ্গিতে বোঝায় বিমানটা ঠিক হয়ে গেছে। - বুড়ো আঙ্গুলে দেখায়- ওকে।
Theme Music- Friendship 3- separation starts
ইশারায় বিমানে উঠে আসতে বলে আশ্চর্য বালককে।
বালক ঘাড় নেড়ে বলে – না
পাইলট বিরক্ত হয়। ইশারায় ঘড়ি দেখায়, তাড়াতাড়ি উঠে আসার ইঙ্গিত করে বালকটিকে।
বালক ঘাড় নাড়ে-না। বরং হাত নেড়ে বিদায় জানায় পাইলটকে।
চারদিকে বালি উড়তে থাকে। সমস্ত কিছু ঢেকে যেতে থাকে।(VFX) বালক হাত নেড়ে বিদায় জানাতে ব্যস্ত।
পাইলট মুখের সামনে, কাঁচের জানালা টেনে দেয়।
চারদিকে বালির ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বালক দেখে ক্ষুদ্র হয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। (VFX)
বালক একটু হেসে আবার শুরু করে পথচলা।
Music theme previous one mixes into another- The Journey theme.
বালির উপর চলতে চলতে হারিয়ে যায় উড়োজাহাজের আওয়াজ। হঠাৎ বালির উপর দাঁড়িয়ে পড়ে। কুড়িয়ে পায় একটা প্লাস্টিকের প্যানপাইপ। সেটা তুলে ফুঁ দিলে তার থেকে খসে পড়ে বালি, অদ্ভূত সুর বেজে ওঠে চরাচরে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তিপান্ন-ক।।
কল্যাণী শুয়ে ঘুমোচ্ছে। প্যান পাইপের আওয়াজে জেগে ওঠে কুসুম। ধীরে ধীরে উঠে সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
প্রশস্ত খাটে একা শুয়ে কল্যাণী। আলুলায়িত চুলে যেন প্রতীক্ষারতা উমা (Reference Image- নন্দলাল বসু- বেঙ্গল স্কুল)
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তিপান্ন-খ।।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে কুসুম। চারপাশ থেকে উজ্জ্বল আলো এসে তাকে ঢেকে দেয়।
দেখা যায় সমুদ্রের তীরে সে সূর্যের দিক থেকে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে।
সে নেমে ছুটতে থাকে বালির ওপর দিয়ে, প্যান পাইপের আওয়াজ লক্ষ্য করে।
দৃশ্যান্তর
দৃশ্য তিপান্ন-গ।।
The Journey theme continues till the end.
বালির উপর আনুক্রমিক রেখায় অক্লান্ত হেঁটে চলেছে আশ্চর্য বালক। কুসুম চলতে থাকে তার পিছন পিছন। প্যানপাইপ নিয়ে অন্য এক মজার খেলায় মেতে উঠেছে আশ্চর্য বালক। তার আভাস ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে।
সমুদ্রের তীর বরাবর হেঁটে চলেছে প্যান পাইপ বাজাতে বাজাতে। তার পিছনে কুসুম। পপ ইন করে কিছুটা পিছনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ডাক্তার ও রাজকুমারী প্রিয়াঙ্কা। বেশ কিছুটা পেছনে পপ ইন করে হাঁটতে থাকে পূর্বে দেখা (বালিয়াড়ির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া) রাজার পোশাকে পাগল বিমল, তার হাতে (জলের তলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া) একটা চাকা। তার পেছনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছোটেলাল, তার পরণে মাওবাদীদের মত জংলাছাপ পোশাক, মাথায় বাঁধা গামছা। কাঁধে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান। তার বুলেটবিদ্ধ পা থেকে রক্ত পড়তে থাকে বালির উপর। সবার আগে পপ ইন করে চলতে থাকে ছাগলছানা।
এন্ড স্ক্রোল উঠতে শুরু করে।
তারা ক্রমশ ছোট্ট হয়ে গেলেও সুর ভেসে আসে বহুদূর থেকে কিংবা অদৃশ্য হওয়ার পরও প্যানপাইপের অনুরণন।
শেষ