এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কাঁথির উপকূল

    ডঃ সজল বিড়িং লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২২ নভেম্বর ২০০৯ | ৭০১ বার পঠিত
  • আমাদের এই আপাত নিস্তরঙ্গ জীবনে মাঝে মধ্যে এক একটা বেয়াড়া ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, যা আমাদের চিরাচরিত জীবনযাত্রার বাইরে ভাবতে বাধ্য করে। সম্প্রতি কাঁথির উপকূলে এমন-ই একটা ঢেউ নাড়িয়ে দিয়ে গেছে উপকূলবাসীর মন; সাদা মনে লেগেছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছাপ। এখন তাতে লাগছে রাজনীতির রং। আমরা ভুলে যাচ্ছি নিজেদের পরিচয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ - মেতে উঠেছি রাজনৈতিক কাজিয়ায়। এ সব কিছুই যাকে নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে, তা হল কাঁথির উপকূলে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন।

    কিছু মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত; প্রাণহানির শঙ্কা, জীবিকা হারানোর ভয়, জন্মভিটে থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়ার দু:স্বপ্ন তাদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই ভীতি অমূলক কিনা তা জানার আগে পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরী। কাঁথির মানুষ জানলেনই না পরমাণু বিদ্যুৎ জিনিসটা কি, খায় না গায়ে মাখে; অথচ, গণতান্ত্রিক কায়দায় তাঁদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বস্তুতই, এই মতামত রাজনীতিবিদদের চাপিয়ে দেওয়া। যেখানে যাদের জনবল বেশি, সেখানে তাঁদের মত প্রতিষ্ঠা পায়। যে কাজটা সরকারের তরফ থেকে করা উচিত ছিল - পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে গণসচেতনতা, আজকাল সেটা রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই করছেন একটু ভিন্ন কায়দায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে বুঝিয়ে চলেছে আমাদের। এমতাবস্থায় উপকূলবাসীগণ দ্বিধাবিভক্ত - এক, পরমাণু বিদ্যুৎ এর সপক্ষে; দুই, পরমাণু বিদ্যুৎ এর বিপক্ষে। বলাবাহুল্য, এই শিবির বিভাজন রাজনৈতিক মেরুকরণের-ই নামান্তর। এখানে কাঁথিবাসীর কথা ভাবা হয় নি, ভাবা হয়েছে রাজনৈতিক দলের স্বার্থের কথা। আশ্চর্যের কথা এই যে, একটি রাজনৈতিক মতাবলম্বী সকল মানুষ-ই গলা ফাটাচ্ছেন পরমাণু বিদ্যুৎ এর বিপক্ষে, আর অন্যদিকে বিপরীত মেরুর সকল মানুষ-ই পরমাণু বিদ্যুৎ এর সপক্ষে। এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এখানে সুস্থ চিন্তার অবকাশ নেই, রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছে-ই আমাদের মত। রাজনৈতিক কর্মীরা যে শুধু-ই ভয় দেখিয়ে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেন তা নয়, আজকাল তাঁরা পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে সহজ ক'রে বুঝিয়ে দেন সাধারন মানুষকে, যা তাঁরা নিজেরাই বোঝেন না; - পাশে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক মাথা চুলকে হয়তো ভাবতে থাকেন এটা বুঝি তাদের অধীত বিদ্যার বাইরে। আসলে সহজ ক'রে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না, রাজনৈতিক কর্মীরা হয়তো সেটা বেশ ভালভাবে রপ্ত করেছেন। তাই সঙ্গতকারণেই পার্টির ক্যাডার-রা পার্শ্বশিক্ষক পদের একমাত্র দাবিদার হয়ে থাকে। যাই হোক, রাজনৈতিক কর্মীরা এখন ব্যস্ত পরমাণু বিদ্যুৎ এর সপক্ষে ও বিপক্ষে শক্তিশালী যুক্তির অনুসন্ধানে। কেউ কেউ বলছেন, দাদা বেশ কিছু ঝাঁঝালো যুক্তি দিয়ে বিপক্ষদের বুঝিয়ে দিন না। লক্ষণীয় যে, ওঁদের নিজেদের বোঝার দরকার-ও পড়ে না, যেন-তেন-প্রকারেণ পার্টির দাদাদের নির্দেশ পালন-ই শেষ কথা। একবার-ও ভেবে দেখেন না যে, যদি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সত্যি-ই কোনো অঘটন ঘটে থাকে, তবে আমরা উপকূলবাসীরা-ই ক্ষতিগ্রস্ত হব, কলকাতাবাসী রাজনৈতিক দাদারা নয়। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন উচিত না অনুচিত তা ভাবার আগে আমাদের মনকে রাজনীতির আঙিনা থেকে দূরে রাখতে হবে।

    পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সারা বিশ্বে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। দুনিয়ার সব কিছুর মত এর-ও কিছু সুবিধাজনক ও ক্ষতিকর দিক রয়েছে। নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে শুধু-ই এর সুবিধাজনক বা ক্ষতিকর দিকটির ওপর জোর দেওয়া কেবল বোকামি-ই নয়, আত্মঘাতী হওয়ার সামিল। তবে কি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন উচিত না অনুচিত পর্যালোচনা করতে পদার্থবিদ্যার শুকনো তত্ত্বে গভীর জ্ঞান থাকা চাই? উত্তর না, পদার্থবিদ্যার তত্ত্বকথার কচকচানি ছাড়াই আমরা এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে পারি যদি আমরা সচেতনভাবে সাম্প্রতিক পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করি।

    পরমাণু বিদ্যুৎ-এর উৎস তেজস্ক্রিয় পরমাণুর অভ্যন্তরীণ শক্তি। এ সম্পর্কে ধারণা পেতে আমাদের পদার্থবিদ হ'তে লাগে না। পরমাণুর অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রকাশ আমরা দেখেছি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে। কী বিপুল পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে র‌্যেছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর ভেতর, সারা পৃথিবীবাসী সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলেন সবিস্ময়ে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পারমাণবিক শক্তির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ধ্বংসলীলায়। আসলে যে অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তি ধ্বংস ঘটায়, তারই নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ পরমাণু বিদ্যুৎ - মানবজীবনে শক্তির চাহিদা মেটায়। অতএব, মানুষের মনে এ প্রশ্ন অতি সহজেই জাগে, যদি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে কি আমরা আর একটা হিরোশিমা-নাগাসাকির সাক্ষী হব! উত্তর হ্যাঁ, আর তাই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে নিতে হয় বেশ কিছু পরীক্ষিত নিরাপদ ব্যবস্থা যা সারা পৃথিবীতে মেনে চলা হয়। তবুও যে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় নি, তার প্রমাণ ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র-এর বিস্ফোরণ। অনেকেই বলে থাকেন যে দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, ওতে ভয় পেলে তো সভ্যতার গতি রোধ ক'রে দিতে হয়। আসলে এই দুর্ঘটনা বাস, ট্রেন, বিমান বা বোমা-বিস্ফোরণ-এর মতো নয়, যেখানে এগুলির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। পারমাণবিক বিস্ফোরণ-এর ক্ষতি সুদূরপ্রসারী, এটা যে স্থান-কাল-এর গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকে না তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে - প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যাদের পিতা-প্রপিতামহ-ও প্রত্যক্ষ করে নি এই বিস্ফোরণ, তারাও শিকার হয়েছে এর। তাই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন-এর আগে, খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে যে উদ্বেগ জাগে তার নিরসন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র-এর লাভজনক দিকটি নয়, বরং এর ক্ষতিকারক দিকটি বেশি করে আলোচিত হওয়া উচিত, যাতে সাধারণ মানুষ-এর মনের কুয়াশা দূর করা যায়। অথচ সরকার থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা যৎসামান্য ও যথেষ্ট বিভ্রান্তিজনক। নিজেদের চিন্তাভাবনা একরকম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনসাধারণের ওপর। কাউকে কোনো নির্দিষ্ট রাস্তায় চলতে বাধ্য না ক'রে যদি সমস্ত পথের ভাল-মন্দ সর্বসমক্ষে তুলে ধরা হয়, তাহলে মানুষ নিজে থেকেই সঠিক রাস্তার সন্ধান ক'রে নিতে পারেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সরকার বা রাজনীতিবিদেরা তা না ক'রে অহেতুক অভিভাবকত্ব করেন, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মানুষের মনে উঁকি দেয় নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কাঁথির উপকূলে এর নির্মাণ-এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা। তাই এখানে কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক, তুলে ধরা যাক কিছু স্বাভাবিক প্রশ্ন - যার উত্তর সাধারণ মানুষ নিজেরাই সহজে দিতে পারবেন এবং সর্বোপরি খুঁজে নিতে পারবেন সেই প্রত্যাশিত পথ যা উপকূলবাসীর বিক্ষিপ্ত মনে এনে দেবে প্রশান্তি।

    পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই জাগে এর নিরাপত্তামূলক দিকটি। যেহেতু পৃথিবীর সর্বত্র এটি পরীক্ষিত, তাই স্বভাবতই প্রযুক্তিগত দিক থেকে এর নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রশ্ন ধোপে টেকে না। শুধু একটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে, ভিনদেশীদের মতো আমাদের কর্মীরাও নিরাপত্তার দিকটি কড়া নজরে দেখেন কিনা। "পাঁচু'র ওপর আপনার যদি সে ভরসা থাকে, তবে তো কথাই নেই। তবে কিনা এটা পশ্চিমবঙ্গ। এখানে রক্তপরীক্ষার কিট ও নিরাপদ নয়। মানুষ মারা যান শ'য়ে শ'য়ে। সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রীতিমতো একটা কর্মযজ্ঞ। আর এখানে একটু অসাবধানতা, ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা ঘটিয়ে দিতে পারে প্রলয়। অন্যদিকে "নিরাপদ' কথাটি খুবই আপেক্ষিক। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা বিভিন্ন দিক থেকে বিপদ-এর আশঙ্কা ক'রে তার অগ্রিম প্রতিকার-এর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু, কিছু কিছু বিপদ-এর অস্তিত্ব যে তাঁদের কল্পনায়ও থাকে না, তার প্রমাণ হ'ল সম্প্রতি ভূমিকম্পের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কাঁথির উপকূলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার আগে আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা সুনামির কবল থেকে কিভাবে একে রক্ষা করা যায় তা খতিয়ে দেখবেন কিনা আমাদের জানা নেই। কেননা কাঁথির উপকূল সুনামি-প্রবণ এলাকা, কাঁথির মানুষের সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা জানি প্রতিবছর দুর্গাপূজার মত এ রাজ্যে বান আসে ও ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল, আর ঘরছাড়া মানুষেরা এটাকে নিয়তি ব'লে মেনে নিয়ে আবার নতুন ক'রে ঘর বাঁধে। এত দীর্ঘ শাসনকালেও সরকার এই সমস্যার সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সেখানে সুনামির কবল থেকে কাঁথিবাসীকে সরকার রক্ষা করবেন ভাবাটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।

    এ তো গেল প্রাকৃতিক বিপদের আশঙ্কা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-এর নাম-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে বিপদটি, তার নাম তেজস্ক্রিয়তা। যেহেতু তেজস্ক্রিয় পরমাণুর অভ্যন্তরীণ শক্তিই বিদ্যুৎ-এর উৎস, তাই স্বভাবতই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ে মারণ বিকিরণ, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তিলে তিলে আমদের ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। আর্সেনিক মিশ্রিত জল খেলে আমরা যেমন বিষ খেলাম ব'লে বুঝতে পারি না, যার প্রকাশ ঘটে ভবিষ্যতে শারীরিক পঙ্গুত্বে, ঠিক তেমনি এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণও মৌনভাবে প্রজন্ম-এর পর প্রজন্মকে বেঁধে দেয় একই নিয়তির ফাঁসে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ যাতে না ছড়িয়ে পড়ে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে এটা জল নয় যে, একে ঘিরে রাখা যাবে। একে সম্পূর্ণ ঘিরে রাখা যায় না, বিকিরণ শক্তিটাকে কমানো যায় মাত্র। আর ঠিক সেইকারণেই, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-এর চারিদিকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের এলাকা জনমানবশূন্য ক'রে রাখতে হয়, যেখানে বিকিরণ শক্তি যথেষ্ট দুর্বল নয়। তার মানে দাঁড়ালো, আমরা কেউই কিন্তু এই বিকিরণ-এর বাইরে থাকছি না, কেউ বেশি, কেউ কম বিকিরণ শক্তির কবলে, - নির্ভর করছে আপনি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কত দূরে আছেন। কাঁথিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হ'লে কলকাতাবাসীরা এই বিকিরণ-এর শিকার হবেন না, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র-এর উৎপাদিত বিদ্যুৎ স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে পারবেন। তাই সরকার বিশ্বের সমস্ত কিছু কলকাতায় কেন্দ্রীভূত করতে চাইলেও কস্মিনকালে কলকাতার উপকন্ঠে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়বেন না, ওটা গড়তে চাইবেন হয় সুন্দরবনে, নয় মেদিনীপুরে। ঠিক যে ভাবে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়া হয়েছিল কোলাঘাটে। কোলাঘাটবাসীদের নাভিশ্বাস উঠেছে পোড়া কয়লার ছাই-এর স্তূপে, - রাস্তাঘাট থেকে শুরু ক'রে ভরে গেছে আকাশ-বাতাস। বিদ্যুতায়ন হয় নি কোলাঘাটের গ্রামে, বিদ্যুৎ কিন্তু পৌঁছে গেছে কলকাতায়। তাই কাঁথিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হ'লে, কাঁথিবাসীরা যে কোলাঘাটবাসীদের মতই দধীচীর ভূমিকা পালন করবেন সেটা বলাই বাহুল্য। যাই হোক, ফিরে আসা যাক তেজস্ক্রিয়তাজনিত বিপদের কথায়। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রে মজুত তেজস্ক্রিয় পদার্থই নয়, আমাদের খেয়ালে রাখতে হবে ঐ পদার্থগুলোর পরিবহণকালীন বিপদের কথাও। কাঁথির ভেতর দিয়েই আসবে যাবে এই সব সাংঘাতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। সামান্য পরিবহণজনিত দুর্ঘটনা কিন্তু কাঁথিকে চিরতরে মুছে দিতে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। অপরদিকে, তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণেরও কোনো সুষ্ঠু সমাধান সারা বিশ্বে নেই।

    এ তো গেল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধার কথা। এবার দেখা যাক, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচনের যৌক্তিকতা। যদিও সরকারিভাবে জানা গেছে, এখানে যে ধরণের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়া হবে, তার জন্য সমুদ্রের জল-এর প্রয়োজন হবে না, তবু কেন কোন অমোঘ কারণে যে সমুদ্রতীরবর্তী কাঁথি-কেই নির্বাচন করা হ'ল তা আমাদের অজ্ঞাত। সরকারের তরফ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমাদের জানিয়ে গেছেন, একদিকে সমুদ্র হওয়ায় বেশি মানুষকে উদ্বাস্তু হ'তে হবে না। অথচ জনঘনত্বের কথা মাথায় রাখলে এই পলকা যুক্তি অচিরেই গুঁড়িয়ে যায়। কেন যে এত জনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে সরকারের নজর পড়ল তা "দেবা ন জানন্তি'। আবার এখানকার অধিকাংশ মানুষই হয় মৎস্যজীবী নয় কৃষিজীবী। উপকূলবাসীরা সমুদ্র থেকে মাছ ধ'রে নিছক জীবনধারণ-ই করেন না, সারাদেশে মাছের যোগানের ক্ষেত্রেও এঁদের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। আর তারই স্বীকৃতিস্বরূপ কাঁথিতে গড়ে উঠেছে মৎস্যশিল্প, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে যার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাবতে অবাক লাগে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত লাভজনক শিল্পকে ধংস ক'রে কেনই বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে হবে কাঁথিতে, অন্য কোন জায়গাই কি পাওয়া গেল না! জানি সরকার উত্তরবঙ্গে গড়তে চায় না, কেননা সে বিদ্যুৎ হয়ত কলকাতায় আনা সহজ হবে না, অতএব তা অনভিপ্রেত। সম্প্রতি কাঁথিতে এক জনসভায় রাজ্যের মাননীয় এক মন্ত্রী জানিয়ে গেলেন সরকারের অভিপ্রায়। সরকার চায় না চাষার ছেলে চিরকাল চাষা থাকুক কিংবা মৎস্যজীবীর ছেলে চিরকাল মৎস্যজীবী হ'য়ে জীবন কাটান। তাই এঁদের জীবন পাল্টাতে এঁদের জীবিকা পরিবর্তন করাতে মরিয়া আমাদের "মরমিয়া' সরকার। সরকার খুব ভালো ক'রে জানে যে শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, তাই "রোগীকে মেরে রোগ আরোগ্যের' পথই বেছে নেওয়া হয়েছে। কৃষক আর মৎস্যজীবীর কাছ থেকে জোর ক'রে জমি ও সমুদ্রের অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে সরকার। তাহলে বোধহয় বাধ্য হয়েই এঁরা জীবিকা পরিবর্তন করবেন। তো পরিবর্তিত জীবিকা কি হবে এ প্রশ্নেরও সহজ ও সাবলীল উত্তর দেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে, অনেক সাহেব-সুবো এখানে এসে বসবাস করবেন। আর আমাদের মা-বোনেরা ওঁদের বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ পাবেন, পুরুষেরা পাবেন ফাই-ফরমাশের কাজ। বাহ, কী সহজ সমাধান। স্বাধীন জীবিকা ছেড়ে সানন্দে পরে নাও দাসত্বের শৃঙ্খল। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবিকা এইভাবে এক ঝটকায় পরিবর্তন করা যায় না। আমাদের গরিব-দরদী সরকার হঠাৎ ক'রে গরিবের ভাত মারতে উঠে পড়ে লেগেছেন কেন আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না।

    এতো গেল জীবিকার সমস্যা। এবার আসা যাক বাসস্থানের সমস্যায়। জন্মভূমির প্রতি টান মানুষের এক স্বাভাবিক অনুভূতি। যে যেখানে জন্মায় সেখানেই বেঁচে থাকতে চায়, - হয়তো বা তা জীবনধারণের প্রতিকূল। মরুভূমির মানুষ শত কষ্ট সত্ত্বেও চলে আসে না গাঙ্গেয় উপত্যকার উর্বর জমির খোঁজে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, উন্নত জীবনধারণের সব রকমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত দ্বীপ-এলাকার অধিবাসীরাও জন্মভিটে পরিবর্তনের কথা ভাবতেই পারে না। এমনকি গৃহপালিত গরুকেও অন্যের বাড়ীতে রেখে এলে ভোরবেলা দেখা যায় সে ঠিক পুরানো মনিবের গোয়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে। এমনই হল জন্মস্থলের প্রতি আমাদের টান। শহরবাসী মানুষ, যাদের কোন শিকড় নেই, তাঁরা তা বোঝেন না। তাঁদের আগ্রাসী মনোভাব গ্রাস ক'রে নেয় গ্রাম, গড়ে তোলে মেকী শহর, যেখানে সবাই পরবাসী, সবাই পরগাছা, - শুরু হয় মালিক-ভাড়াটিয়ার টানাপোড়েনের জীবন। তাই স্বভাবতই জন্মভূমি থেকে মানুষের মনের যোগাযোগ ছিন্ন ক'রে তাকে সমূলে উৎপাটিত করা যতটা না অমানবিক তার চেয়ে বেশি ঝুঁকিকর। এতটুকুও ভুল বোঝাবুঝি মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহী ক'রে তুলতে পারে, জন্ম নিতে পারে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কাঁথিতে প্রকাশ্য জনসভায় এখানে পারমাণবিক বোমা তৈরির আশঙ্কার কথা তোলেন এবং তাৎক্ষণিক হাততালির লোভে জোরালো দাবি জানান, যদি অন্যান্য দেশ পারমাণবিক বোমা বানিয়ে মানুষ মারতে পারে, আমরাই বা কম কীসে! আমরাও এখানে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারি বৈকি। হে ভগবান, এঁরা কি কলকাতা থেকে এসে আমাদের কাঁথিবাসীকে মানুষ মারাও শিখিয়ে যাবেন! অবশ্য আমাদের সরকার যে পারে, তা আমরা জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি নন্দীগ্রামে। আর নয়, সরকার বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অঙ্গুলিহেলনে না চলে কাঁথিকে বাঁচাতে কাঁথির মানুষই ঠিক ক'রে নিক তাঁদের ভবিষ্যৎ পন্থা।

    ২২ শে নভেম্বর, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২২ নভেম্বর ২০০৯ | ৭০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন