- প্রথম পর্ব -
শুরুর কথা :
হ্যাঁ। এটা একটা রাজনৈতিক প্রবন্ধই বটে। অবশ্য ঠিক প্রবন্ধ বললে ভুল হবে। কারণ, একটা রাজনৈতিক প্রবন্ধের থেকে লোকের যা যা প্রত্যাশা থাকে সাধারণত:, যেমন - কিছু নতুন ধরণের তত্ত্ব, ব্যাখ্যা, বা মতামত - সেসব প্রত্যাশা এই লেখা থেকে পূরণ হবে - এরকম কোনও গ্যারান্টি দিতে পারছি না। তার চেয়ে বরং এই লেখাকে অনেক দিন ধরে জমা হতে থাকা কিছু একান্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, কিছুটা স্বগতোক্তির মত করেই যা আমি রাখতে চাইছি - সেভাবেই পাঠককে নিতে অনুরোধ করব। স্বাভাবিকভাবেই স্বগতোক্তির কোনও নির্দিষ্ট ক্রম থাকা মুশকিল। তাই ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরোগুলোকে জুড়ে নেওয়ার দায়টা এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নয়, পাঠকের উপরেই ছাড়া রইলো। :-)
এমন একটা সময়ে এই লেখা, যখন একদিকে ভারত রাষ্ট্র মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরণের সামরিক অভিযান ঘোষণা করেছে। আর অন্যদিকে মাওবাদীদের নেতা কিষেণজি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ২০৫০ সালের অনেক আগেই তাঁরা বিপ্লব এনে ফেলতে চলেছেন। দুপক্ষই নিজ নিজ বক্তব্যের সুর এমন উচ্চগ্রামে বাঁধছেন যার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে আমাদের মত ছাপোষা মধ্যবিত্তের ন্যাজে গোবরে অবস্থা। দুপক্ষই তাঁর তাঁর মত করে চাইছেন মানুষ পক্ষ নিক। এবং এই চাওয়াতে যে একেবারে কাজ হচ্ছে না - এমনটাও বলা যাবে না। বিভিন্ন পাব্লিক ফোরামে এবং মিডিয়ায় অনেকেই রাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে মাওবাদীদের 'মেরে ফেলব, কেটে ফেলব' - এরকম হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। এবং দু:খের বিষয় - এব্যাপারে অগ্রগণ্য ভূমিকা যে কেবল কংগ্রেস বা বিজেপি সমর্থকরা নিচ্ছেন - এমন নয়, বরং কোথাও কোথাও তাঁদের চেয়ে এককাঠি উপরে উঠে হম্বিতম্বি করছেন সিপিআইএম সমর্থকরা। ঠিক তেমনি কিষেণজি জানিয়েছেন রাষ্ট্র তার সন্ত্রাস বন্ধ না করলে তাঁরাও 'বিপ্লবী প্রতিহিংসা' চালিয়ে যাবেন। এই প্রসঙ্গে লেখার শুরুতেই কিছু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দেওয়া প্রয়োজন। পাঠক, তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শেরই সমর্থক হোন না কেন - 'মেরে ফেলবো, কেটে ফেলবো' - এই মানসিকতায় অবস্থান করলে তাঁর সাথে কোনওরকম কথোপকথনে এই লেখা অক্ষম। সেই অর্থে এই লেখা স্পষ্ট কথায় বললে পক্ষপাতদুষ্ট। পক্ষ মানে প্রথমত: রাষ্ট্রীয় সমরাভিযানের বিরোধী পক্ষ। কেন এই অবস্থান - সে আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বহু মানুষ নানা দিক থেকে নানা যুক্তিতে 'গ্রীন হান্ট' এর বিরোধিতা করেছেন। ইচ্ছে থাকলে সেই লেখাগুলো পড়া যেতে পারে। এই লেখায় বরং পক্ষপাতের আরও একটা দিক আছে। আর সেইটা হল - 'বিপ্লবী প্রতিহিংসা' দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে রোখার যে দাওয়াই মাওবাদীদের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে - এই লেখা পক্ষ নিচ্ছে তার বিরুদ্ধেও। তবে এইখানে একটা গ্যাঁড়াকল আছে। মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসে, সমস্ত লড়াই, সন্ত্রাস থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করাটা সহজ, কিন্তু কঠিন বাস্তবের সাথে তার সম্পর্ক সামান্যই। কাজেই 'সব মানুষের ভালো হোক' - কেবলমাত্র এরকম একটা সদিচ্ছা থেকে শান্তির পায়রা ওড়ালে, নিজের স্যাটিসফ্যাকশন ছাড়া লাভের লাভ কিছুই হয় না। সেকারণে মাওবাদীদের 'বিপ্লবী প্রতিহিংসা'-র বিরোধিতাকে শুধুমাত্র 'ওম শান্তি ওম' মার্কা মন্ত্রোচ্চারণের তাগিদ ভেবে নিলে পাঠকের সাথে এই লেখার কথোপকথনে একটা গোড়ায় গলদ রয়ে যাবে বলে মনে হয়। মূল বিরোধীতাটা বিপ্লবী প্রতিহিংসা'-র পিছনে যে রাজনীতি রয়েছে, তার প্রতি - এটা শুরুতেই পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।
রাষ্ট্রের অভিযানের বিরোধিতা যাঁরা করছেন তাঁরা সকলেই একই রাজনৈতিক অবস্থান থেকে করছেন - এমন নয়। বলা বাহুল্য, এই বিরোধীদের মধ্যে অবশ্যই আছেন মাওবাদীরা এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। রাষ্ট্রের যুদ্ধটা যেহেতু মাওবাদীদের বিরুদ্ধে, এবং মাওবাদীরাও বহু আগে থেকেই ঘোষিত ভাবেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁরাও স্বাভাবিকভাবেই চাইছেন রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানটা আরও আরও বেশী করে স্পষ্টভাবে মাওবাদীদের পক্ষের অবস্থান হয়ে উঠুক। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রও ঠিক সেটাই চাইছে। রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের পুরোটাকে এক বন্ধনীর মধ্যে ফেলতে পারলে রাষ্ট্রেরও লাভ। এই দুইএর গ্যাঁড়াকলে পড়ে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক অবস্থান সমাজে হাজির করাটা খুবই গোলমেলে হয়ে পড়েছে। মাওবাদীরা বা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা চাইছেন এরকম একটা সময়ে কোনোভাবেই যেন এই রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের মধ্যে থেকে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা উঠে না আসে। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলছেন - এরকম হলে রাষ্ট্র সেটাকে তার আগ্রাসী সামরিক অভিযানের পক্ষে কাজে লাগিয়ে নেবে। কথাটা ভুল নয় মোটেই। কিন্তু সম্পূর্ণও নয়। কারণ, এর মধ্যে সুপ্ত আছে রাষ্ট্রবিরোধীতার রাজনীতি এবং মাওবাদী রাজনীতিকে সমার্থক হিসেবে বৈধতা দেওয়ার আকাঙ্খাও। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের অভিযানের পক্ষে যুক্তি সরবরাহ যতটা মাওবাদ বিরোধীরা করছেন, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী করছেন মাওবাদীরা নিজেরাই। কীভাবে - সেটা আমরা একটু বিশদেই আলোচনা করব এই লেখায়। প্রসঙ্গটার উল্লেখ করলাম একটাই কারণে - সেটা হল - রাষ্ট্রের হাতে ব্যবহ্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও মাওবাদী রাজনীতির কিছু প্রাসঙ্গিক সমালোচনা আজকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। আর সেটাই এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য।
এই প্রসঙ্গে প্রথম যে প্রশ্নটা উঠবে - সেটা হল, মাওবাদীদের সমালোচনা তো কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূল - সমস্ত মূলধারার রাজনৈতিক দলই করছে। তাদের সাথে এই সমালোচনার তফাৎ কোথায়? হ্যাঁ, তফাৎ আছে। এবং সেটা পরিমাণগত নয়, গুণগত। মাওবাদীরা তাঁদের কর্মসূচীগতভাবেই এমন একটি দল - যাঁরা ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান বিরোধী। তাঁরা মনে করেন এই সংবিধান জনবিরোধী, ক্ষমতাসীন শ্রেণীর স্বার্থে নিয়োজিত এবং সেই কারণে তাঁরা তা মানেন না। তাই কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূলের মত দলগুলির চোখে মাওবাদীরা এমনিতেই রাষ্ট্রদ্রোহী, একটিও ল্যান্ডমাইন না ফাটালেও। সিপিএম সহ অন্যান্য বাম দলগুলিও কর্মসূচীগতভাবে সেরকমই, তফাৎ হল তাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন, মাওবাদীরা করেন না। তাই সংবিধান না মানার ব্যাপারটা তাঁদের কার্যক্রমের মধ্যে কোথাও ফুটে বেরোয় না, যতটা মাওবাদীদের ক্ষেত্রে সেটা প্রকট ভাবে দৃশ্যমান হয়। আমাদের এই লেখাটা একটা মোটামুটি বাম দৃষ্টিকোণ থেকে, তাই ভারতের সংবিধান প্রসঙ্গে মাওবাদীদের বা যেকোনও বামপন্থীদের বিশ্লেষণের সাথে মোদ্দাভাবে সহমত হয়েই আমরা পরবর্তী আলোচনায় ঢুকবো। তাই এই লেখা কোথাওই রাষ্ট্রদ্রোহের কাঠগড়ায় মাওবাদীদের দাঁড় করাবে না। বরং রাষ্ট্রদ্রোহকে বৈধতা দিয়েই আমাদের আলোচনা, সমালোচনা, সমস্তটা আবর্তিত হবে সেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধরণ নিয়ে, আর সেই কারণেই মূলধারার দক্ষিণপন্থী সমালোচনার সাথে এই সমালোচনাকে কোথাওই এক লাইনে বসিয়ে দেওয়া যাবে না।
সত্যি কথা বলতে যদিও এই লেখায় সামগ্রিকভাবে মাওবাদী রাজনীতির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইছি, কিন্তু লিখতে বসে মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে চাওয়াটা কিছুটা এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ হয়ে যাবে। ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খণ্ড - রাজ্য হিসেবে তো এরা এক একটা রত্ন বিশেষ। দূর থেকে দেখে যা মনে হয় - ঐসব জায়্গার গণতন্ত্র শব্দটার সং'¡ই বোধহয় আলাদা। তাই গণতন্ত্রের যে রেফারেন্স ফ্রেমটা মাথায় রেখে এই লেখার অবতারণা - তাতে ঐসব রাজ্য ও সেখানকার রাজনীতি নিয়ে বেশী কিছু বলতে না চাওয়াই মনে হয় ভালো। তাই আমরা আমাদের যাবতীয় আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে লালগড়ের আন্দোলনে মাওবাদীদের ভূমিকা নিয়ে। অবশ্যই সেটা একটা খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরবে, আবার তার মানে এই নয় যে সেখান থেকে মাওবাদের সামগ্রিক ধারা বা চরিত্র নিয়ে কোনও মন্তব্যই করা যাবে না।
আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা লালগড়ের আন্দোলনের গোটা পর্ব থেকে কয়েকটা গুরুত্বÄপূর্ণ ঘটনাকে বেছে নেব। সেই ঘটনাগুলো এবং সেখানে মাওবাদীদের ভূমিকা, তার পর্যালোচনা এবং সেখান থেকে কিছু জেনারালাইজেশন - এভাবে এগোলে হয়তো বুঝতে আর বোঝাতে সুবিধে হবে।
১) আন্দোলনের শুরু - শালবনিতে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ:
লালগড়ের মানুষ পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর যে আলোচনাটা একেবারেই কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে - সেটা হল পুলিশি নির্যাতনটা কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই ঘটনাটাকে খুঁড়ে তুলে আনতে হল কারণ আমার মতে এই ঘটনাটা মাওবাদী রাজনীতির কিছু সাধারণ ধারাকে বোঝা এবং তার সমস্যাগুলো ধরার জন্য একটা অত্যন্ত আইডিয়াল কেস স্টাডি। মাইনটি ফাটানোর পর মাওবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে সেটা তাঁরা ফাটিয়েছেন শালবনীর সেজ এর বিরুদ্ধে। খুব পরিষ্কার করে কোথাও না বললেও আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে তাঁদের ভাবনাটা হয়তো এরকম ছিল যে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মেরে ফেললে দুটো জিনিস হতে পারে। প্রথমত: যারা মুখ্যমন্ত্রীকে মেরে ফেলতে পারে, তারা আরও না জানি কী কী করতে পারে - এই আশঙ্কায় জিন্দালরা শালবনি সেজ থেকে পাততাড়ি গোটাতে পারে। দ্বিতীয়ত: ঐ অঞ্চলের (এবং গোটা বাংলার) যে সমস্ত গরীব মানুষ সিপিএম এবং সরকারের হাতে শোষিত নির্যাতিত হচ্ছেন প্রতিদিন, এই হত্যা তাঁদের সাহস যোগাতে পারে এবং একই সাথে মাওবাদীদের শক্তির প্রতি আস্থাশীল করে তুলতে পারে। এবার এরকম ভাবনার সমস্যাগুলো কী কী একবার দেখে নেওয়া যাক -
প্রথমত: এই গোটা ভাবনাচিন্তার ফ্রেমওয়ার্কটার মধ্যে শোষিত মানুষ, অর্থাৎ যাঁদের কথা ভেবে এতকিছু, তাঁদের ভূমিকা কী? বিগ জিরো। শালবনির সেজ যাঁদের প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করল - তাঁদের কোনোরকম অংশগ্রহণ, মতামত নেওয়া - ইত্যাদি ছাড়াই একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া হল। এমনকি ঘটনাটি ঘটবার আগে তাঁরা জানলেনও না। অর্থাৎ ভাবনাটা অনেকটা যেন এইরকম - একটি পার্টি, তারা ধরেই নিচ্ছে যে তারাই হল ঐ শালবনির সেজের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলির প্রতিনিধি, এবং সেই সুবাদে ঐ মানুষগুলির মতামত ব্যতিরেকে আন্দোলনের যে কোনও কর্মসূচী নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। হতেই পারে দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদীরা ঐ এলাকায় যাচ্ছেন, হতেই পারে ঐ এলাকার শোষিত মানুষের তাঁদের প্রতি প্রচুর সমর্থন রয়েছে, এমনকি এমনও হতেই পারে যে তাঁরাই ঐ মানুষগুলোর লড়াইএর একমাত্র প্রতিনিধি। কিন্তু তার পরেও কেবলমাত্র প্রতিনিধি বলেই সেই মানুষদের অন্ধকারে রেখে যে কোনও আন্দোলনের পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার তাঁদের জন্মায় কি? শুধু অধিকারেরও প্রশ্ন নয়, যে কোনও আন্দোলনের নেতৃত্ব যখন আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে কোনো পদক্ষেপ নেন, সেটা আন্দোলনের সাথে সেই মানুষদের একটা দূরত্ব তৈরী করে। মানুষ আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবেন এবং দূর থেকে দেখা ছাড়া অন্য কোনও ভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার কথা তাঁরা ভেবে উঠতে পারেন না। যে কারণে এত দিন ধরে ঐ এলাকায় যাতায়াত সত্ত্বেও শালবনীর সেজের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকরী প্রতিরোধ মাওবাদীরা গড়ে তুলতে পারেন নি। কারণ মানুষের বিক্ষোভকে তাঁদের সক্রিয়তার স্তর অনুযায়ী সংগঠিত করা মাওবাদীদের আন্দোলনের অভিধানে নেই। মিটিং, মিছিল, ডেপুটেশন - আন্দোলনের এই যে প্রথাগত ধাপ, যা কিনা জনমত গড়তে ও দাবীর সাথে মানুষের একাত্মতা তৈরীতে সাহয্য করে - সেগুলিকে টপকে তাঁরা প্রথমেই চলে যান ল্যান্ডমাইন ফাটানো, পুলিশ হত্যা বা এলাকার ত্রাস কোনো নেতাকে হত্যা করার দিকে। এই ধরণের দুর্নীতিপরায়ণ অত্যাচারী স্থানীয় নেতার মৃত্যু মানুষকে অনেক সময় সাময়িক স্বস্তি দেয়, মাওবাদীদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ে, কিন্তু তাঁদের সক্রিয়তার স্তরে যেটুকু¤ পরিবর্তন হয় সেটা খুবই সামান্য।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা এখান থেকেই উঠে আসে - সেটা মাওবাদীদের আর একটি ভাবনার সীমাবদ্ধতার দিকনির্দেশ করে। মাওবাদীরা ভাবেন (খুব সম্ভবত:) নিপীড়িত মানুষের সক্রিয়তা আটকে আছে কনফিডেন্সের অভাবে। অর্থাৎ যদি এলাকার ত্রাস একজন কাউকে মেরে দেওয়া যায়, মানুষের সক্রিয়তার রুদ্ধ আগল খুলে যাবে। সেই একই ভাবনা থেকে উৎসারিত হয় এই চিন্তা যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মেরে দিলে হয়তো নিপীড়িত জনতার ভিতরে বিপ্লবী উদ্যম চাগিয়ে উঠবে। দু:খের ব্যাপার হল - এই চিন্তাপদ্ধতিটা অত্যন্ত একমাত্রিক। মানুষের বিপ্লবী উদ্যম না থাকার হাজারো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক কারণকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে সমস্তটাকে অতিসরলীকৃত করে নামিয়ে আনা হল একটামাত্র কারণে - সেটা হল কনফিডেন্সের অভাব। আর কনফিডেন্স কিভাবে মানুষ পেতে পারে? অত্যাচারী ব্যক্তিকে মেরে দিলে। বলা বাহুল্য, এই চিন্তাপ্রণালী শেষত: যা জন্ম দেয় - তা হল একটি রবিন হুড সদৃশ পরিচিতি, অধিকাংশ যাকে মানুষ অকুন্ঠ সমর্থন করতে পারেন, কিন্তু নিজে সেই কাজটা করার কথা ভেবে উঠতে পারেন না।
তবে এই অনুমানগুলো নিতান্ত বাইরে থেকে দেখে করা। মাওবাদীদের কোনও লিখিত ডকুমেন্টে এই ধরণের তত্ত্বায়ন আছে কী না জানি না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ওনারা যখনই কিছু পদক্ষেপ নেন - সেটাকে জনগণ চেয়েছে, বা গণ আদালতে বিচার করে ঠিক হয়েছে - এরকম বলে থাকেন। আমরা সবাই জানি পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের যাতায়াত মূলত: তিনটে জেলায়। হতেই পারে সেখানে বেশ কয়েক হাজার মানুষ তাঁদের সমর্থন করেন। হতেই পারে সেই কয়েক হাজার মানুষের আদালতে সবাই চেয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গোটা পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ঐ তিনটি জেলার কয়েক হাজার মাওবাদী সমর্থক বাদে পশ্চিমবাংলার বাকী জনগণ বুদ্ধবাবুর হত্যা চেয়েছেন কিনা - সেকথা জানার কি প্রয়োজন মনে করেছেন মাওবাদীরা? করেন নি। অর্থাৎ ক্ষুদ্র একাংশের ইচ্ছেকে বহুর ইচ্ছে বলে ধরে নেওয়া এবং সেটাকে বহুর উপর চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষতিকারক প্রবণতা থেকে তাঁরা মুক্ত নন। গণ আদালত বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলেও নয়, না নিয়ে থাকলে তো নয়ই। কাজেই ডকুমেন্টেড না থাকলেও কর্মপদ্ধতি থেকে প্রবণতার বিচার এক্ষেত্রে অনেকখানিই করা যাচ্ছে এবং তা একেবারে আউট অফ নাথিং বলেও তো মনে হচ্ছে না।
তবে এর বাইরেও যে মারাত্মক সম্ভাবনাটা থেকে যাচ্ছে - সেটাও এখানে বলে রাখা ভালো। সম্প্রতি তেলুগু দীপকের বয়ানে একটি খবরের কাগজে বেরিয়েছে যে বুদ্ধদেবকে হত্যা করার কোনও পরিকল্পনা মাওবাদীদের ছিল না। ওটা ছিল ইচ্ছাকৃত ফলস অ্যাটেম্পট। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে প্রোভোক করা। এবং পুলিশ সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। অর্থাৎ খুব পরিশীলিত রাজনৈতিক ভাষায় বলতে গেলে রাষ্ট্রের দমনমূলক চরিত্রকে মানুষের কাছে এক্সপোজ করার উদ্দেশ্যে এই ল্যান্ডমাইন ব্লাস্ট। এখন এই ধরণের কাগজগুলোকে বা পুলিশকে মোটেই বিশ্বাস করা যায় না। এই পুলিশই রটিয়েছিল ছত্রধর মাহাতোর কোটি টাকার সম্পত্তি। তার পর প্রমাণ করতে না পেরে ঢোঁক গিলে নেয়। কিন্তু সমস্যা হল এই 'রাষ্ট্রের নিপীড়নকারী চরিত্রকে এক্সপোজ করার জন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা' - এটা অনেক মাওবাদী সমর্থককেও প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়। আর এটা যদি কোনোভাবে মাওবাদীদের চর্চার মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে তার আড়ালে রয়ে যাচ্ছে একটা নির্মম বাস্তব। সেটা হল দরিদ্র মানুষকে নিজেদের বিপ্লবী এজেন্ডার সপক্ষে টেনে আনার জন্য রাষ্ট্রের নিপীড়নের মুখে তাদের ফেলে দেওয়া। যা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। যদি দরিদ্র মানুষকে বিপ্লবী অবস্থান নেওয়ানোর জন্য দুর্দশা ফেস করানোটা লক্ষ্য হয় তাহলে সেই একই যুক্তিতে আমাদের সকলের উচিৎ বিজেপি কে ভোট দেওয়া। কারণ বিজেপি সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল পার্টি। তারা আসলে দাঙ্গা হবে, মানুষের দুর্দশা বাড়বে, মানুষের সামনে এই ব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচিত হবে এবং বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। একই যুক্তিতে উচিৎ ভিখারিকে ভিক্ষা না দেওয়া, আয়লা-দুর্গতদের ত্রাণ না দেওয়া - ইত্যাদি। এবং এই যুক্তিকাঠামোটা অতিবাম শিবিরে খুব দুর্লভ নয়। ভয় হয়, মাওবাদীরাও হয়তো এই যুক্তিকাঠামোতে বিশ্বাস রাখেন। কিছু কিছু এরকম ঘটনার পর এই সম্ভাবনার কথা মাথায় উঁকি না দিয়ে পারে না।
আসলে এতরকম সম্ভাবনা নিয়ে চর্চা করতে হচ্ছে একটাই কারণে। শালবনীর সেজ আটকানোর দাবীতে কোনোরকম মিটিং মিছিল জমায়েতের প্রোগ্রাম ব্যতিরেকেই হঠাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। সত্যিকারের মাওবাদীদের হাতের কাছে পাওয়া যায় না এই প্রশ্নগুলো জি'¡সা করার জন্য। আর তাঁদের সমর্থকরা আপন মনের মাধুরি মিশায়ে এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। যেগুলো অনেকক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী হয়ে যায়। যেমন একদল সমর্থক বলে থাকেন - মাওবাদীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। অতএব রাষ্ট্রের যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে তারা আক্রমণ করবে - এটাই তো স্বাভাবিক। জেতার লক্ষেই তো যুদ্ধে লড়া। রাষ্ট্র যেমন মাওবাদী নেতাদের পেলেই এনকাউন্টার করে দেয়, তেমনি মাওবাদীরাও সুযোগ পেলেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মারবে - এতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু এরই পাশাপাশি আর একদল বলে থাকেন মাওবাদীদের অস্ত্রধারণ পুরোটাই সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে আন্দোলনকারী আদিবাসী বা দরিদ্র জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য। সম্প্রতি অরুন্ধতী রায়ের একটি লেখাতে পড়লাম একজন সিনিয়র মাওবাদী নেতাও এরকমই খানিকটা বলেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী অন্ধ্রপ্রদেশে 'লাঙল যার জমি তার' এই আন্দোলন সত্তরের দশকে ভয়াবহ পুলিশী নিপীড়নের শিকার হয়। সেই কারণে সীতারামাইয়ার নেতৃত্বে আশির দশকে যখন জনযুদ্ধ গোষ্ঠী তৈরী হয়, তারা প্রথমেই জোর দেয় একটা সশস্ত্র, সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী তৈরী করার দিকে। কারণ না হলে এই ধরণের আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা যাচ্ছিল না। অর্থাৎ এই মত অনুযায়ী গণ আন্দোলনের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নটা হল কারণ, আর মাওবাদীদের সশস্ত্র হয়ে ওঠাটা হল ফল, বা প্রতিক্রিয়া বা আত্মরক্ষামূলক। ছত্রিশগড়ের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য সত্যি হলেও হতে পারে। ছত্রিশগড়ে সালওয়া জুডুমের আগে মাওবাদীদের যা গণভিত্তি ছিল, পরে তা অনেক গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ ঐ অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ফলশ্রুতিতে নিরুপায় হয়ে আদিবাসীরা আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র পথ ধরছেন - এরকম ভাবনার বাস্তব ভিত্তি থেকেই যায়। কিন্তু সর্বত্র ওটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ঐ আগের (যুদ্ধের সময়কার আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ ইত্যাদি সংক্রান্ত) বক্তব্যটাও দাঁড়ায় না, মুখ্যমন্ত্রীর উপর মাইন ফাটানোটাও ব্যাখ্যা করা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না অন্ধ্রপ্রদেশেও মুখ্যমন্ত্রীর উপর একই রকম আক্রমণের। আন্দোলনের এলাকায় পুলিশকে ঢুকতে না দেওয়ার জন্যে গেরিলা কায়দায় প্রতিরোধ করা তাও মেনে নেওয়া যায় আত্মরক্ষার অজুহাতে, বা গণ আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচানোর অজুহাতে। কিন্তু একজন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে আক্রমণ করে খুন করার চেষ্টাকে কিভাবে 'আত্মরক্ষা'র সাথে রিলেট করানো যায়? বুদ্ধবাবু মারা গিয়ে যদি নিরুপম সেন মুখ্যমন্ত্রী হতেন, সিপিএম বা রাষ্ট্রের চরিত্র কি তাতে বদলে যেত? নাকি রাষ্ট্র ঐ জঙ্গলমহল এলাকায় সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ করে দিত, বা দমনমূলক চরিত্র ছেড়ে বেরিয়ে এসে জনহিতকর হয়ে উঠত?
শালবনির মাইন ব্লাস্টের মত কিছু কিছু লক্ষণ থেকে এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষাটাই এধরণের অ্যাকশনের একমাত্র কারণ নয়। সবসময় এটাও সত্যি নয় যে গণ আন্দোলনের তীব্রতার স্বাভাবিক পরিণতিতে মানুষের ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হিসেবে এধরণের ঘটনা ঘটছে। ছত্রিশগড়ে বা অন্ধ্রে কী হচ্ছে সে নিয়ে মন্তব্য না করলেও এটুকু বলাই যায় যে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোতে লালগড় আন্দোলনের আগে পর্যন্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু স্কোয়াড নির্ভর অ্যাকশনই ছিল মাওবাদীদের মূল কার্যধারা। কর্মসূচী অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের যে 'দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ' - যেন সেটিই এখানে মুখ্য। যেখানে পারো রাষ্ট্রকে আঘাত করো। অস্ত্র লুঠ করে নিজের সামরিক ক্ষমতা বাড়াও। ইত্যাদি। এবং এই সশস্ত্র যুদ্ধের কর্মসূচীর স্বার্থে যেটুকু যা গণ আন্দোলন। গণ আন্দোলনের স্বার্থে সশস্ত্র হয়ে ওঠা নয়। বলা বাহুল্য এই দুটো অ্যাপ্রোচের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। তফাৎ হয় সামাজিক সম্মতিতেও। অরুন্ধতী রায় যখন দণ্ডকারণ্য ঘুরে এসে মর্মস্পর্শী বিবরণ লেখেন এবং আদিবাসীদের সশস্ত্র হয়ে ওঠাকে রাষ্ট্রের নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিত্রিত করেন, তখন তার প্রতি মানুষ যেভাবে সহানুভুতিশীল হতে পারে, যেভাবে নন্দীগ্রামে অসংখ্য আন্দোলনকারীর সশস্ত্র প্রতিরোধকে মানুষ অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছে, সেই একই মানুষ কিন্তু গণ আন্দোলন ও গণ অংশগ্রহণ বিচ্ছিন্ন স্কোয়াডনির্ভর আক্রমণমূলক অ্যাকশনগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে নেন। মাওবাদীরা যেহেতু তাঁদের কর্মসূচী অনুযায়ী 'যুদ্ধ'র মধ্যে রয়েছেন, তাই বিপক্ষের উপর যেকোনও রকম আক্রমণ সেই যুদ্ধের যুক্তিতে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেহেতু সেই 'যুদ্ধ'কে মাওবাদীদের মতন করে নিজের বলে এখনও ভাবেন না, তাই যে যে পরিমাণে এই অ্যাকশনগুলো আত্মরক্ষা থেকে আক্রমণমূলক হয়ে ওঠে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে স্কোয়াড নির্ভর হয়ে ওঠে, সেই সেই পরিমাণে রাষ্ট্র আরও দমনমূলক হয়ে ওঠার পিছনে একটা সামাজিক সম্মতি পেতে থাকে। একটি দল যদি ঘোষণা করে যে তারা সুযোগ পেলেই একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মেরে দেবে, এবং একবার সেই চেষ্টাটি একটুর জন্যে ফসকে যায়, সেই দলকে কেন রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করবে না, কেন সেই দলের সদস্যদের ধরে জেলে পুরবে না - যে সেন্সিটিভ মানুষজন নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে একসময় দুহাত তুলে সমর্থন করেছেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন হয়ে যায়।
২৩ মার্চ, ২০১০