লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের বিপর্যয়ের পর থেকেই বামপন্থার ভবিষ্যত ও বাম নেতৃত্বের সংকট প্রসঙ্গে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিপিআইএম পার্টির ভিতরে ও তার কর্মী-সমর্থক, দরদীদের পরিসরে এই বিতর্ক খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই বিতর্কে দুই রকম বক্তব্যই উঠে এসেছে। একদিকে, পার্টির নিচু তলা থেকে শুরু করে রাজ্য কমিটি অবধি নেতৃত্বের ভুল-ত্রুটি, দিশাহীনতা, ভ্রান্ত নীতি এবং আদর্শগত বিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নিচু তলা থেকে উঠে আসা সেই প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে পার্টি থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, পার্টি নেতৃত্বের তরফে সমষ্টিগত নেতৃত্বের কথা বলা হয়েছে, এবং প্রচার করা হচ্ছে যে নেতা বদল করার দাবী নাকি নৈরাজ্যের সৃষ্টি করছে। এই বিতর্কে সর্বশেষ সংযোজন শ্রদ্ধেয় অশোক দাশগুপ্তের লেখা ৮ই জুন তারিখের ‘নেপথ্য ভাষণ – আরও ভাঙন? নিতে পারিছ না’। এই ‘নেপথ্য ভাষণে’ ভ্রান্ত রাজনীতি এবং পার্টির কতিপয় নেতাকে আড়াল করার যে প্রচেষ্টা হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর এবং অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিচারিতা ও স্ববিরোধিতায় ভরা।
উক্ত ‘নেপথ্য ভাষণে’ বলা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র ভোট বাড়বে এটা নাকি সবাই জানত। কিন্তু লেখক ও তাঁর মত সবাই অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে বামেদের ভোটেই বিজেপি বড় আকারে থাবা বসিয়েছে, তৃণমূলের ভোটের তুলনায় অনেক বেশি। এর জন্য তিনি দায়ি করেছেন বাম কর্মীদের নীতিগত অবস্থানের দুর্বলতাকে এবং হালকা করে বলেছেন যে বাম কতটা ‘বাম’ আছে সে প্রশ্ন ওঠাও অসঙ্গত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাম-নেতৃত্বের ভূমিকার কথা তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। বামেদের ভোট বিজেপি’র দিকে যাওয়ার একটি বড় কারণ নির্বাচনের সময় রাজ্যের বাম নেতৃত্বের তরফে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারে চূড়ান্ত গাফিলতি। বামফ্রন্টের তরফ থেকে যেকটি নির্বাচনী পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে একটিও বিজেপি’র বিরুদ্ধে ছিল না। বরং বাম নেতাদের মধ্যে একটি দুরাশা জন্মেছিল যে বিজেপির উত্থানের ফলে তৃণমূলের ভোট কাটা যাবে এবং বামেরা তাঁদের আসন সংখ্যা বাড়াতে বা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন - এই ভ্রান্ত ধারণা বামপন্থীদের প্রচারেও প্রতিফলিত হয়।
নির্বাচনী প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গে এসে তথাকথিত বাংলাদেশি 'অনুপ্রবেশকারী' এবং দূর্গাপুজো করা 'শরণার্থীদের' মধ্যে তফাত টেনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরীর চেষ্টা যখন করলেন, তখন বাম নেতৃত্বকে তার সোচ্চার বিরোধিতা করতে শোনা গেল না। মোদীর 'গুজরাট মডেল' এর সমলোচনাও খুব একটা শোনা গেল না সিপিআইএম নেতৃত্বের মুখে। ছয় সাত বছর আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বিতর্কের সময় তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রীই তো বলে বেড়াতেন যে গুজরাটের থেকে এরাজ্যের বিরোধীদের শেখা উচিত কিভাবে সরকারের সাথে শিল্প স্থাপনে সহযোগিতা করতে হয়। এই মারাত্মক ভুলগুলির জন্যে 'নেপথ্য ভাষ্যকার' নির্দিষ্ট ভাবে কারোর দায়িত্ব নেওয়ার বিপক্ষে কেন?
এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: "বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নেতৃত্ব থেকে সরে গেলেই সুদিন ফিরবে? বিমান বসু অব্যাহতি চাইছেন রাজ্য সম্পাদকের পদ থেকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পার্টির সব পদ থেকে সরে গিয়ে একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে থাকতে চান। কমিউনিস্ট পার্টিতে এভাবে হয় না, পার্টি কংগ্রেসে ও সম্মেলনে বদল তো নানা স্তরে হবেই। প্রবীন নেতাদের প্রতি সম্মান কমিউনিস্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতির সম্পদ। তছনছ করে দেবেন না।" অথচ এই ভাষ্যকারই ২৫শে মে ২০১৪ তে লেখা তাঁর 'নেপথ্য ভাষণে' লিখেছিলেন: "ভুল পথে দলকে পরিচালিত করে সর্বনাশ ডেকে এনেছেন, মানেন কি? দায় স্বীকারও করবেন না? এই বাংলায় বসে বলতে পারি, চূড়ান্ত ক্ষতি করে গেলেন প্রকাশ কারাত। প্রতিনিধিত্ত্ব করছি বাম সমর্থকদের।"
কি আশ্চর্য্য, বিমান বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যর দায় স্বীকারের কথা উঠলেই সব তছনছ হয়ে যায়, কিন্তু বাম সমর্থকদের 'প্রতিনিধি' সেজে পার্টির সাধারণ সম্পাদককে কাঠগড়ায় দার করানোটা আবার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ! নেপথ্য ভাষ্যকারকে সবিনয় অনুরোধ যে এই সুবিদাবাদী, সংকীর্ণ দলবাজির রাজনীতি এবং দ্বিচারিতা বন্ধ করুন। এতে বামপন্থার কোনো লাভই হবে না। সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক পার্টির আজ এই বিপর্যয়ের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। তাঁর তথাকথিত 'থার্ড-ফ্রন্ট'-এর নামে মুলায়াম সিংহ-জয়ললিতার লেজুরবৃত্তিও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁকেও যেমন এই বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে, তেমনি এই রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, পার্টির রাজ্য সম্পাদক ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরও এই বিপর্যয়ের দায় মাথা পেতে স্বীকার করা উচিত। কারণ পশ্চিমবঙ্গে গত ছয় সাত বছর ধরে বামপন্থী রাজনীতির যে কদর্য অবক্ষয় আমরা দেখেছি - গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, রিজবানুরের অপমৃত্যু, মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য এবং সর্বপরি আক্রান্ত বামপন্থী কর্মীদের পাশে না দাঁড়াতে পারা - তার জন্য রাজ্যের বাইরের কাউকে দায়ী করা অনুচিত।
নেপথ্য ভাষ্যকার পার্টির 'ভিতরে' ও 'বাইরের' সমালোচনা নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁকে প্রশ্ন, যে তাঁর উল্লেখিত বিমানবাবু বা বুদ্ধবাবুর পদত্যাগ করতে চাওয়াটা কি পার্টির 'ভিতরের' প্রক্রিয়া না 'বাইরের'? যদি বাইরের হয় তবে তো তাঁরাও তো শৃঙ্খলাভঙ্গ করছেন। আর যদি 'ভিতরের' কথা হয়, তাহলে লেখক সেটাকে বাইরে এনে কার স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছেন? নেপথ্য ভাষ্যকার তো আর পার্টির 'ভিতরের' লোক নন। তবে তিনি এই সব 'ভিতরের' কথা জানছেনই বা কি ভাবে? রাজ্য-নেতৃত্বের ধামাধরা লোকেরা 'ভিতরের' বিতর্কে অংশগ্রহন করলে ক্ষতি নেই, আর 'বাইরে' থেকে পার্টি নেতাদের সমালোচনা করলেই পার্টি ভেঙ্গে যাবে বলে গেল গেল রব - এ কেমন যুক্তি?
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম-এর পার্টি সদস্য তিন লক্ষের আশেপাশে। কিন্তু এই দুর্দিনেও দেড় কোটি মানুষ বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছেন। বামপন্থা যখন আজ এক গভীর সংকটের সম্মুখীন, তখন কি শুধুই তিন লক্ষ পার্টি সদস্যদেরই মত প্রকাশের অধিকার আছে না কি ওই দেড় কোটি মানুষের মতামতকেও গ্রাঝ্য করা হবে? আর তিন লক্ষ্য পার্টি সদস্যদের মধ্যে কি শুধু নেতৃত্বের পক্ষে যারা তাদের কথাই শোনা হবে নাকি সমালোচক বা বিক্ষুব্দদেরও মতামতকেও শোনার প্রয়োজন আছে? অগণতান্ত্রিকভাবে যদি নিচুতলার মতামতকে দমন করা হয় তাহলে পার্টিতে বিদ্রোহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই আজ হচ্ছে।
নেপথ্য ভাষ্যকার জেএনইউ-ডিএসএফ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। ছাত্রনেতাদের প্রতি তাঁর আপাত-সহানুভূতির আড়ালে তিনি তাদের 'আবেগপ্রবণ' বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁকে স্বরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্থ কংগ্রেস সরকারের অর্থমন্ত্রীকে সমর্থনের স্বিদ্ধান্ত কেন সঠিক তাই নিয়ে আজ অবধি কোনো গ্রহনযোগ্য যুক্তি পেশ করতে সিপিআইএম-এর নেতৃত্ব ব্যর্থ। সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন যে এতে তৃনমূল আর কংগ্রেসের বিভাজন হবে। দেখা গেল যে অবশেষে তৃনমূল ও বামপন্থীরা দুজনে মিলেই প্রণববাবুকে ভোট দিলেন। আবার লোকসভা নির্বাচনে তৃনমূল আর কংগ্রেসের বিভাজন হওয়া সত্ত্বেও বামেদের ভোট কমল, তৃনমূল জিতলো আর বিজেপির ভোট বাড়ল। তাহলে কোন ভিত্তিতে নেপথ্য ভাষ্যকার এই স্বিদ্ধান্তকে এখনও সমর্থন করছেন? শুধুই নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য? না কি ভুল স্বীকার করার সত্সাহসের অভাব?
এও স্বরণীয় যে প্রণববাবুকে সমর্থন করতে গিয়ে বাম ঐক্যে ফাটল ধরে - সিপিআই এবং আরএসপি ভোটে অংশগ্রহন থেকে বিরত থাকে। আর জেএনইউ-র এসএফআই নেতৃত্ব এই স্বিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় গোটা গণসংগঠনের ইউনিটকেই 'বাইরে' করে দেওয়া হল। তার ফলাফল আজ সর্বজনবিদিত। এপ্রিল ২০১২তে কোঝিকোডে সিপিআইএম-এর বিংশতম পার্টি কংগ্রেসে, কংগ্রেস আর বিজেপির থেকে সমদুরত্ব রেখে বাম, গণতান্ত্রিক বিকল্পের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। সেই প্রস্তাবকে পার্টি নেতৃত্বই কিন্তু ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাঁদের এই শৃঙ্খলাভঙ্গের বিচার কে করবে?
নেতৃত্বের শৃঙ্খলাভঙ্গ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে নেপথ্য ভাষ্যকার আবার কিছু অসত্য কথাও বলে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সভায় ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছিলেন বটে কিন্তু তার জন্য তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। ভাষ্যকার ভুলে গেছেন যে ২০১২র পার্টি রাজ্য সম্মেলনে ভুল স্বীকারের পর আবার ২০১৩র ফেব্রুয়ারীতে ডাকা কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর ধর্মঘট কেন দুই দিনের এই নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আবার ধর্মঘটের বিরোধিতা করেন। ভাষ্যকার লিখেছেন যে "এবার ভোটের পর কংগ্রেসকে সমর্থন করা হতে পারে, এমন কথা মোটেই বলেননি তিনি।" গণশক্তির ইংরেজি ওয়েবসাইটএ এখনও পিটিআই কে দেওয়া সেই সাক্ষাত্কারের (২৩.০৩.২০১৪) রিপোর্ট আছে:
http://ganashakti.com/english/news/details/4808 তাতে এই বাক্যটিও আছে: "Asked if his party will support Congress if a situation like 2004 arose, Bhattacharjee said, "Only if a situation like 2004 arises and that there is no other way." পরদিন আনন্দবাজার শিরোনাম করেছিল: "২০০৪-এর অবস্থা হলে কংগ্রেসকে নিয়ে ভাববেন বুদ্ধ" আর এই সময়: "কংগ্রেসে 'ভরসা' বুদ্ধর"। সর্বজনশ্রদ্ধেও অশোক মিত্রও নির্বাচনের পর তাঁর বিশ্লেষণে লিখেছেন: "In the circumstances, when the poll campaign was at its height this year, one of these leaders — a member of the party’s politburo who also headed the Front government in its last, calamitous term — issued a statement to the effect that, should the necessity arise, the CPI(M) would help the Congress to form the new government in New Delhi following the outcome of the polls. Quite candidly, that did it." (A Sad Chronicle, The Telegraph, May 28, 2014) নেপথ্য ভাষ্যকার তাঁর পছন্দের নেতাকে আড়াল করতে গিয়ে এঁদের সবাইকে মিথ্যেবাদী প্রমান করতে চাইছেন।
নেপথ্য ভাষ্যকার রাগ দেখিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যারা পার্টির বাইরে গিয়ে সমালোচনা করছেন বা নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইছেন। অথচ তিনি ভাবছেন না যে যারা দীর্ঘ অনেক বছর ধরে পার্টির মধ্যে সংগ্রাম করেছেন তাঁরা কেন আজ পার্টির বাইরে মুখ খুলছেন। তিনি পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তিনি এটা বুঝতে চাইছেন না যে নিচু তলার কর্মীদের সমালোচনা কিছুতেই আর উপর তলায় পৌঁছয় না। সম্মেলন বা পার্টি কংগ্রেস-এর মঞ্চগুলিতে গণতান্ত্রিক বিতর্ক আর হয় না - নেতারা যা চান তাই হয়। না হলে উপর্যুপরি নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরেও নীতির অভিমুখ বদল হলো না কেন?
আজকে অগনিত পার্টিকর্মী সমর্থকরা এইটা বুঝতে পারছেন যে এই নেতৃত্বকে রেখে শুদ্ধিকরণ বা নীতি পরিবর্তন কোনটাই আর সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটেই শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তনের দাবি উঠে এসেছে, পার্টির ভিতর থেকেই। পার্টির বাইরে থেকেও যারা বামপন্থী সহযোদ্ধা বা শুভানুধায়ী, তারাও নেতৃত্ব পরিবর্তনের কথা বলছেন। এক্ষেত্রে 'ভিতর' ও 'বাহির' মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যেমন, অশোক মিত্র তাঁর উপরোক্ত প্রবন্ধে লিখেছেন: "The CPI(M) leadership in the state, even at this stage, either do not know or do not intend to abdicate. They are, let me kindly suggest, merely ensuring the party’s total exit from West Bengal’s political picture in not an altogether distant future. Instead of admitting their own faults and deviations that have led to the party moving away from the masses...they continue to quote party rules and procedures to justify their difficulty to effect crucial changes. What is farcical, those within the party who vocally speak for immediate reform and restructuring of the state leadership are being thrown out of the party: some of those who themselves deserve to be excluded from the party and its leadership sit in judgement, expelling those who want to save the party, its ideals and its traditions to mobilize the oppressed people against the exploiting classes." নেপথ্য ভাষ্যকার কি বলবেন? অশোক মিত্রের মত প্রাজ্ঞ বামপন্থী, প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রীও সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইছেন?
সবিনয়ে এই প্রশ্নও করার যে যখন গরীব চাষীদের থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল, যখন নন্দীগ্রামে গুলি চলল, যখন মহিলাদের সম্পর্কে অবমানণা সূচক বক্তব্য পার্টি নেতৃত্বের তরফ থেকে ক্রমাগত হতে থাকল, যখন গরিব মানুষের উপরে খবরদারি করে কিছু নেতা তাদের আখের গুছিয়ে নিল, যখন পার্টির অজস্র কমরেডদের আত্মত্যাগের পরেও নেতৃত্ব তাঁদের পাশে দাঁড়াল না, যখন শ্রমিক ইউনিয়নগুলি আন্দোলন ভুলে পার্টির লেজুড়ে পরিণত হল তখন সব তছনছ হয়ে যায়নি? তখন বিপর্যস্ত হয়নি বাম আন্দোলন? আজ যখন দলে দলে বাম কর্মী-সমর্থকরা কেউ তৃণমূলে কেউ বা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন তখন সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে না? আর যখন পার্টি কে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য নতুন করে নেতৃত্ব তুলে আনার কথা উঠছে, নতুন রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করার দাবী উঠছে, শুধু তখনই মনে হচ্ছে সব তছনছ হয়ে গেল? কেন?
নেপথ্য ভাষ্যকার বর্ষিয়ান কৃষক নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা বলেছেন। যিনি দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বামআন্দোলনের বিচ্যুতিগুলি সম্মন্ধে মুখ বুজে থেকেছেন এবং এতদিন সিপিআইএম নেতৃত্বের বামপন্থী ঘোমটার আড়ালে দক্ষিনপন্থী খ্যামটা নৃত্যকে সমর্থন করে এসেছেন, তাঁর থেকে রেজ্জাক মোল্লার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আশ্চর্যের নয়। রেজ্জাক মোল্লা পার্টির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে, শিল্পায়নের নামে বৃহৎ পুঁজির তাঁবেদারি করার প্রশ্নে বিতর্ক করেছেন। তিনি পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পার্টিতে বিকল্প দলিলও পেশ করেন - নেতৃত্ব সেটা আলোচনা না করে ওনাকে নানারকম ভাবে অপমান করেন। রেজ্জাক মোল্লা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিত-আদিবাসীদের মতন পিছিয়ে পরা অংশের পার্টি নেতৃত্বে প্রতিনিধিত্ত্ব নিয়েও যে প্রশ্ন তুলেছেন সেটি অত্যন্ত ন্যায্য। শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের কুলীন রাই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হবেন আর মুসলমান-দলিতরা শুধুই ক্যাডার, এটা তো চিরটাকাল চলতে পারে না।
নিজের ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে রেজ্জাক মোল্লা হয়ত কোথাও কোথাও এমন কথা বলেছেন যা বামপন্থীদের অপছন্দ হয়েছে। কিছু কথা তাঁরও বলা উচিত হয়নি। কিন্তু তাই বলে ওনার মতন এত দিনের একজন সংগ্রামী কৃষকনেতাকে শ্রেণী সংগ্রামের সাথে সম্পর্কহীন ভাবা নেপথ্য ভাষ্যকারের শ্রেণী চেতনার দৈন্যকেই প্রকট করে। রেজ্জাক মোল্লা কিছু ভুল মন্তব্য করে থাকতে পারেন, কিন্তু উনি গরিব, পিছিয়ে পরা মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনও কিছুই বলেননি বা করেননি। নেপথ্য ভাষ্যকার যাঁদের হয়ে কলম ধরেছেন, তাঁরা আজ পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-শহরের শ্রমজীবি মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত - সেই নন্দীগ্রামের গুলি চালানোর সময় থেকেই তাঁরা গরিবের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন।
সিপিআইএম-এর নেতৃত্বের পক্ষে লিখে নেপথ্য ভাষ্যকার নিজেকে বাম ঐক্যের ধ্বজাধারী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে বাম ঐক্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের আনুগত্যের উপর নির্মান করা যায় না। সুদৃড় বাম ঐক্য গঠিত হয় মতাদর্শ ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে ও লড়াই-আন্দোলন পরিচালনা করার মধ্যে দিয়ে। সিপিআইএম-এর বর্তমান নেতৃত্ত্ব মতাদর্শ-রাজনীতিগত ভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। বাম ঐক্যও যার ফলে বিপন্ন - তাকিয়ে দেখুন দেশের বামপন্থীরা আজ কত ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। এই অনৈক্যের জন্য দায়ী কারা? সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা কি এই পরাজিত, প্রত্যাখ্যাত নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব?
বাম আন্দোলনে জোয়ার আনতে তাই নতুন লাইন এবং নতুন মুখ দরকার। নতুন লাইন ও নতুন মুখের ভিত্তিতেই নতুনভাবে বাম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন। সেটা সিপিআইএম-এর 'ভিতরের' গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এলে ভালো। কিন্তু 'বাইরের' বামপন্থীরা তো আর তার আশায় চুপ করে বসে থাকবে না। তারাও সোচ্চার হয়ে সঠিক কথাগুলো মানুষের সামনে বলবেন। আর নেপথ্য ভাষ্যকারের মতন পার্টি ভেঙ্গে যাবার জুজু দেখিয়ে যদি এই নেতৃত্ব, তাদের লাইন বা তাদের চামচাদের আবার উপর থেকে বসাবার চেষ্টা হয়, তবে যা হওয়ার তাই হবে। নেপথ্যে বা প্রকাশ্যে হাজার ভাষণ দিয়েও তখন কোনো লাভ হবে না।