ইতিহাস বলছে নতুন প্রস্তর যুগেই মানুষ প্রথম না জেনেই শস্য ফারমেন্টেড করে মদ বানিয়ে ফেলে।তখন মানুষ সদ্য চাষাবাদ শুরু করেছে, বুঝতে পেরেছে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর থেকে কোথাও স্থায়ী ভাবে বসবাস করা আরামদায়ক (কেন রে বাপু! কে বলেছিল অ্যাঁ?) তা তখন বিরাট সব মাটি, পাথরের জালায় করে শস্য জমিয়ে রেখে দিতেও শিখেছিল। তার থেকেই কোনটা গেঁজে গিয়ে এই কেলো। তা আমার মনে হয় এরকম হয়ত হয়েছিল (এই কেউ ডিম বা টম্যাটো ছুঁড়বেন না, এমন হতেই পারে, কেবল ইতিহাসবিদরাই কল্পনা করবে নাকি, আমরা কি ভেসে এসেছি?) তখন তো মানুষ টেনে পরিশ্রম করতো আর তারপর আনন্দ করতো। সেই রকম কোন আনন্দ অনুষ্ঠানের জন্য হয়তো কোন জালায় ফলের রস রেখে দিয়েছিল । তারপর মনে হয় ডেট পিছিয়ে গেছিল, আর ওরাও নিশ্চিন্তি ছিল যে রস তো করাই রয়েছে, সেটা যে গেঁজে যেতে পারে এসব ভাবেনি। সরল সোজা মানুষেরা, হায়! সে দিন ও গিয়াছে, এখন মানুষেরাও কেমন গেঁজে গেছে। যাহোক সময়ে সেই গাঁজানো রস খেয়ে সব বেতাল হয়ে গেছিল নিশ্চয়, আর খুব আনন্দ ও পেয়েছিল যে পরিশ্রমের কষ্ট উধাও হয়ে, মনও ফুরফুরে হয়ে গেছে দেখে। তারপর থেকেই ইচ্ছে করেই নির্ঘাত শস্য গ্যাঁজানো শুরু করে।
ইতিহাস বলছে যে চিনের হেনান প্রভিন্সের জিয়াহু গ্রামে প্রথম মদ তৈরির পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল আমার একটা সন্দ কিছুতেই যায় না, মানুষেরা কি সব সময়ই উল্টো পছন্দ নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসে! একদিকে তারা মাথা ঘামিয়ে বাঁচবার নতুন নতুন উপায় বার করে চলেছে, আরেকদিকে তারাই মগজকে অলস করে রাখতে ভালোবাসছে।এই সব ইতিহাস না ছাই পাশ তা জানি না। ব্যাপারটা হলো, এরা সেই কবে থেকে জ্বালিয়ে মারছে মদ নিয়ে লেখা চাই বলে, প্রথমে তো কিছুতেই বুঝতে পারি না, গুরুচন্ডা৯’তে একটা মাতালের টই ছিল, জনগণকে সেটা খুঁজে দিতে বলি, তা সে কে আর আমার কথা শুনছে! তার মধ্যে একদিন বললাম কাকু, পিসিকে জিগাইলে তো পারো, তার নাকি কম্পুতে সেই সব সাইট খোলে না (কী সাইট কে জানে, ম্যাগো), এই তো একটা কিছু বুঝলাম, তাই কপি-পেস্ট করে একগাদা জ্ঞান তাকে দান করে এলাম আর তাতে তিনি আরো খচে গেলেন। শেষে বুঝলাম ‘আমার লেখা’ লিখতে হবে মদ্য নিয়ে। যাব্বাবা! আমি কবে থেকে ধ্রুপদী মাতাল হলাম! তাও কেউ যে ভুল করে আমায়ও লিখতে বলতে পারে এই ভেবেই ভেবলে গেলাম আর কেবলে লিখতে শুরু করলাম। ওমা! তারপর দেখি অলরেডি প্রথম পর্বে কে যেন লিখেছেন, আর এত ভালো লিখেছেন, ওর পরে আমি কিছু লিখলে আওয়াজ খাওয়া থেকে কেউ আমায় বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু সে বলেও বাঁচা গেলো না। তাই এই অক্ষম চেষ্টা, কাকুকে জিগিয়ে-টিগিয়ে কিছু একটা লিখে ফেলবো ভাবলাম। কিন্তু আপনারা জানেন, আমার অত ধৈর্য নাই, কাজেই ভুলও প্রচুর থাকবে।
মনে পড়ে গেলো, আমি প্রথম মাতাল জ্ঞানে দেখি বেহালায় এসে। তার আগেও নিশ্চয় দেখেছি, কিন্তু মনে নেই বা বুঝিনি। সেখানে আমাদের বিস্তর আড়াল আবডালে রাখা হত। আমাদের যুগে কেমন ধারণা ছিল বাপ মায়েদের, যে বাচ্চাকে আড়াল আবডালে বড় করলেই সে আর বাজে কিছু জানবেই না, ভীষণ ভালো মানুষ হবে। সে যাগ্গে, প্রথম মাতাল দেখি আমাদের পাড়ার মোড়ে তখন সেই পার্কটা মোটেই ছিল না, ছিল একটা ময়লা ডিপো, সেখানে বেশ কয়েকঘর সাঁওতাল বাস করত কর্পরেশন কর্মী-টর্মি হিসাবে, তাদেরই একজন, রমেশ। ইয়া চেহারার সাজোয়ান মানুষ। তবে রমেশের সঙ্গে আমাদের ছোটদের বেজায় ভাবসাব ছিল। রমেশ পচাই খেয়ে ভাম হয়ে পড়ে থাকতো বিরাট অশ্বত্থ গাছটার তলায়। আমরা স্কুল যাবার, আসবার পথে তার সঙ্গে চাট্টি গল্প সল্প করে ফিরতাম। আর আমাদের মা-বাবাদেরও সে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না, সে বড় খাঁটি মানুষ ছিল। এবং আমরা এও জানি যে এইসব আদিবাসী মানুষেরা তাদের নিজস্ব এক জীবনাদর্শ নিয়ে চলে, যা আমাদের মতন শহুরে শিক্ষিতদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকে। আর একজন হিমেশ কাকু। এই দ্বিতীয় জনকে কিন্তু আমি বেজায় ভয় পেতাম। ওনার মেয়ে আমার বন্ধু ছিল। এমনিতে মানুষটি বেজায় ভালো, কিন্তু সন্ধে হলে আর নেশা ছাড়া থাকতে পারতেন না। রাস্তায় প্রায়ই ড্রেন ট্রেনে পড়ে যেতেন, আর কেউ না কেউ তুলে দিয়ে যেত। তখনও পাড়া কালচার অন্যরকম। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে একটু কাছাকাছিই বাস করত। তাতে সমস্যা অনেক ছিল, পারসোনাল স্পেসের গপ্প খুব একটা ছিল না, অ্যাট দ্য সেম টাইম কারোর কিছু হলে অন্যেরা প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, বাচ্চাদের সবাই চোখে-চোখে রাখত, শাসন করত আবার ভালোও বাসত। তখন উনি প্রায়ই সন্ধে থেকে হল্লা জুড়তেন। পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার, গালিগালাজ আর বৌ-মেয়ে পেটানো। অবশ্য আর কারোর ক্ষতি করতে দেখিনি (মানে বৃহত্তর স্বার্থে)।
কাজেই আমি ওনাকে দেখলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যেতাম। বেশ মনে আছে তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি, একা একাই গ্রুপে গেছি। আমাদের এইট বেহালা স্কাউট অ্যান্ড গাইড গ্রুপ ম্যান্টনে, আমাদের বাড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট হাঁটাপথ। ফিরছি হঠাৎ দেখি কাকু টাল খেতে খেতে ফিরছেন, আর সেই রাস্তাটা পুরো জনমানবহীন। এমনিতেই সেই সময় দেবালয় পার হলেই পথ বেশ নির্জন হয়ে যেত। আমি তো কাকুকে দেখেই উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করেছি। উনি বুঝতে পেরে কী এক আশ্বাসবাণী দিলেন, আর তখন তাতে কে বিশ্বাস করে, ধরে যদি পেটায়, এই ভয়েই দৌড়াচ্ছি। লাল পাঁচিলের কাছে এসে ধড়াম করে পড়ে গেলাম। হাঁটু, কনুই ছড়ে চারদিকে কালশিটে গজিয়ে গেলো। কাছেই একটা ডাক্তারখানা ছিল, কম্পাউন্ডার কাকু আর ডাক্তার চেনা মানুষ, ওরা শোরগোল দেখে আমায় তুলে নিয়ে গেলেন। ফার্স্ট এইড দিলেন। আর বললেন, মাতাল দেখে ভয় পাবি না কক্ষণও। ওদের গায়ে অত শক্তি থাকেনা, এক ঠ্যালা দিয়ে ফেলে দিবি। তারপর আরো অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি গেলাম। তখন থেকেই মনে গেঁথে গেছিল মাতাল মানেই বৌ পেটায়।
ইতিহাস আরো বলছে প্রথম অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্কস ছিল বিয়ার (মধু বা চাল থেকে তৈরি হত)ও ওয়াইন(আঙুর থেকে)। এদের উৎপত্তিস্থল মিডল ইস্ট। খুব সম্ভবত ওয়াইন তৈরি করে ইজিপ্সিয়ানরা। এদ্দিনে বুঝলাম ইজিপ্ট শুনলেই আমি আনচানিত হই কেন! ওয়াইন ভালোবাসি বলেই কিনা। জর্জিয়া, এনসিয়েন্ট ইজিপ্ট, ব্যবিলন, প্রি-হিসপ্যানিক মেক্সিকো আর সুদানে খ্রীস্ট জন্মের আগেই ওয়াইন তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে ঐতিহাসিকদের দাবি। এমনকী ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী নোয়াও জল নেমে যাবার পর একটা আঙুরবাগান বানিয়েছিল মাউন্ট আরাতের উপরে, যেটা কিনা এখন পূর্ব তুর্কিতে রয়েছে। এ ভাবে মদ্যের বিজয়াভিযান শুরু হয়ে গেলো। আর ব্যাপারটা হলো যত মানুষ সুসভ্য হয়ে উঠতে শুরু করলো, ততই স্থিতু হবার বাসনা প্রবল হলো তার আর ততই ধর্মের আচার, ভগবানের নানান রূপের বাড়বাড়ন্ত, কখনও তা সমাজকে বেঁধে রাখার জন্য আর কখনও সীমা ছাড়িয়ে বেশিরভাগ ভীতু, ভাবতে না চাওয়া অলস মানুষকে শোষণ করার ছল হিসেবে। সব প্রাচীন ধর্মেই সুরাপান ধর্মীয় আচার হিসেবে কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে। মনে পড়ে কপালকুণ্ডলা, সোমরস পান করে রক্ত চক্ষু তান্ত্রিকের গর্জন, কপালকুণ্ডলে!
আমাদের তান্ত্রিকেরা নাকি মানুষের মাথার খুলির আসনে পঞ্চমুণ্ডির আসন) বসে মাথার খুলিতে করেই সোমরস পান করতেন সাধনার পার্ট হিসেবে। আর দেখো না কেন, গেঁজেল নেশাখোর শিবের কত আদর। এমনি ইজিপ্টেও দেবতা ছিলেন যিনি নাকি বিয়ার বানানো আবিষ্কার করেন। ইজিপ্টে সেই সময় সতেরো রকমের বিয়ার আর চব্বিশ রকমের ওয়াইন বানানো হত। এর অনেক পরে আমরা দেখতে পাবো সতীদাহের জন্য মেয়েটাকে নেশায় ঝিম করিয়ে, যাতে সে প্রতিবাদের শক্তি না পায় বা পালাতে না পারে, তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে তো। খোজা বানানোর জন্য নেশায় চুর করে দেওয়া হবে, মানুষের তো হরেক চাহিদা! দিকে দিকে মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে রাখার জন্য, যাতে সে সুস্থভাবে ভাববার ক্ষমতায় না থাকে l মদ খাওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হচ্ছে (ভিয়েতনামে ফরাসিরা নিয়ম করে দিয়েছিল প্রতি গ্রামে মদ তৈরি মাস্ট আর সন্ধেয় তা খাওয়া বাধ্যতামূলক বা এমন কিছু)। অবশ্য সে সময় কঠিন অপারেশনের জন্যও অ্যালকোহল ব্যবহার করা হত, কোথাও মেডিসিন হিসেবেও। এমনকী গোটা হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্টও তো দাঁড়িয়ে আছে অ্যালকোহলের উপর।
আমার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। মাত্র মাসখানেক। একদম কচি আর নিপাট ভালো বউ। আমার শাশুড়ি মা আমাকে শিলিগুড়ি দিয়ে এলেন। যেদিন উনি ফিরে আসবেন, আমরা ওনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরছি, তিনি দেখি কী যেন একটা দোকান থেকে কিনে পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন ফেরার পথে। তারপর বাড়ি ফিরে গ্লাস সাজিয়ে বসলেন। আমার সব রোম্যান্স (প্রথম বরের সাথে একা থাকতে এসেছি) মাথায় উঠে গেলো, করুণ মুখ করে বসে আছি, যাহ! আমার কপালেও মাতাল বর, এবার আমায়ও প্রচুর পেটাবে। আর গুডি টাইপ ছিলাম বলে তেমন মার খেতে হয় নি কোনওকালে। এইদিকে চোখ ছলছল, আর ওদিকে আমার নতুন বর আমায় ভালোবেসে গ্লাস হাতে দিয়ে দিল। বললো ছোট্ট একটা সিপ নিতে। সেটা ছিল জিন, আমার মদখড়ির জন্য হালকা ব্যবস্থা। নাকের কাছে আনতেই মোটামুটি বমি ঠেলে এলো। আর তখন বেজায় ভদ্র আমি, অন্যজনকে অপ্রস্তুতে ফেলতে চাইনে, কাজেই ঢকঢক করে তেতো ওষুধ খাওয়ার মত পুরো খেয়ে ফেললাম। আর সাথে সাথেই মাথা ইঁটের মতন হয়ে গেলো। তারপর আর কতটা খেয়েছিলাম আর মনে নেই, কেবল তার হাঁ করা মুখটা বেশ মনে আছে। আর ক্রমশ আমার বডি টেম্পারেচার নামতে শুরু করে, তিনিও বোঝেন কী কাণ্ডটাই করেছেন। তারপর ঐ বডি টেম্পারেচার বাড়ানোর যে পন্থা তার মাথায় এলো, সেও চরম। পুরো শাস্তি হয়ে গেলো। এবং ঐ প্রথম দেখাতে(পড়ুন চাখাতে) আমি অ্যালকোহলের অপ্রেমে পড়ে গেলাম। ক্রমশ সেইরকম পার্টি-টার্টিতে গ্লাস জানলা দিয়ে বা টবে গোপনে ঢেলে দেবার অভ্যেস আয়ত্তও করে নিলাম, যাতে কারোর মনে আঘাত না লাগে।
অবশ্য মদ খেয়ে বর আমায় পেটায়নি, বরং একবার ভিয়েতনামে থাকাকালীন আমিই এমন আঁচড়ে, কামড়ে দিয়েছিলাম যে পরদিন গরমের মধ্যে দেখি বেচারি ফুল শার্ট পরে অফিস ঘরে গোমড়া মুখে বসে আছে। আমি অবশ্য তখন ভুলে গেছি সব, খুব ব্যস্ত হয়ে ঢুকে সেই দেখে বললাম, একীরে! গরমের মধ্যে ফুলশার্ট পরে বসে অছিস কেন! বেচারি দাঁত খিঁচিয়ে বললো, লোকে হাতের খিমচানোর দাগ দেখে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কী বলবো? বউ কামড়েছে! তারপর ভীষণ অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। আর আমার দুঃখু পাবার বদলে বেজায় হাসি পেয়ে গেলো। জানি, খুব খারাপ! এবং বলতে কি সমস্ত সোনালি ড্রিঙ্কসের প্রতি আমার চরম অনীহা, ব্লু লেবেলও ভালো লাগাতে পারিনি। কনিয়াককে এই লিস্টি থেকে বাদ রাখলাম। একবার তার ফেলে যাওয়া আধ বোতল কনিয়াকের এক সিংহভাগ আধখানা তরমুজ দিয়ে খেয়ে ফেলেছিলুম, আর ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম বলে কী হুজ্জুতই না সহ্য করতে হলো!
প্রথম মদ বানানোর রেসিপি মাটির টালিতে মেসোপটেমিয়ানরা লিখে গেছে আর হিন্দু আয়ুর্বেদিক বইতে এর উপকারিতা আর অপকারিতা নিয়ে গুছিয়ে লিখে গেছেন আয়ুর্বেদাচার্যরা। এখন অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্কস বলতে বোঝায় যে যেসব ড্রিঙ্কসে ইথানল থাকে তাদেরকে।আর গোদা ভাবে বিরাট মদ্যসাম্রাজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে, বিয়ার, ওয়াইন আর স্পিরিট বা ডিস্টিল্ড বেভারেজ। সাধারণত দানা শস্য, ফলের রস বা সব্জি থেকে মদ বানানো হয়। যেমন, বার্লি থেকে বিয়ার, বার্লি ওয়াইন, স্কচ হুইস্কি, আইরিশ হুইস্কি বানানো হয়, রাই থেকে ভদকা। আঙুরের রস থেকে ওয়াইন, ব্র্যান্ডি, কনিয়াক তৈরি হয়। আখের রস থেকে রাম তৈরি হয়, আলু থেকে ভদকা। এইসব। ভিয়েতনামে কিছু অদ্ভুত প্র্যাকটিস দেখেছিলাম। ওদের স্নেক ওয়াইন বলে একটা ড্রিঙ্ক হয়। লোকাল আর খুব সম্ভবত রাইস ওয়াইনে বিষাক্ত সাপ বা বিছে রেখে বোতলে। অ্যালকোহলের কনসেন্ট্রেশন মনে হয় সে পর্যায়েই থাকে যাতে পচন আটকায়। ওদের ধারনা এই পানীয় পৌরুষত্ব বাড়ায়।(সে বাড়াক গে, আমার কী লাভ!) এছাড়া ওদের সন্মানীয় অতিথিকে পানীয়ের মধ্যে জ্যান্ত সাপ কেটে তার বাইল বা হার্টটা দিয়ে দেয়। হার্টটা নাকি তখনও কিছুক্ষণ লাবডুব করতে থাকে। তবে এ আমার শোনা, দেখি নাই।
সেইবার আবার আমাদের লম্বা বিরহ শুরু হতে চলেছে, ঠিক হলো আমাদের ভিয়েতনামের বাসাবাড়ির ছাদে ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে আমরা দুজন বারবিকিউ পার্টি করবো। যেদিন ঠিক হল সেদিন আসলে চন্দ্রবলয় হয়েছিল, সেটা দেখতে ছাদে উঠেই ঠিক হলো এই ছোট্ট পার্টির। পার্টির দিন আমাদের মেডকে দিয়ে ছাদ পরিষ্কার করে দেওয়া হল। সকাল থেকে চারতলার ছাদে বারে বারে উঠে উনুন, কাঠ কয়লা, ইত্যাদি সব ছাদে রেখে আসা হল। এখানকার সব বাড়ি গায়ে লাগানো, দুই ধারের বাড়ি ছাড়া প্রত্যেক বাড়ি তাদের দু’দিকের দেওয়াল শেয়ার করে। কাজেই এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। একটাই রক্ষে, ছাদে বড় একটা কেউ ওঠে না বা অন্যের ছাদে উঁকি মারে না। সন্ধ্যে বেলায় বাকি সব জিনিস, যেমন স্যালাডের সব্জি, ছুরি, থালা, গ্লাস, চিকেন, তেলের ব্রাশ এইসব নিয়ে ছাদে উঠলাম। তাও প্রায় দশবার ওঠানামা করে। কিছু না কিছু ভুলেই যাচ্ছি। শেষে ল্যাপি নিয়ে, মনে পড়লো সেদিন বাড়িতে কথা বলার দিন। বোর্দোর বোতল খোলা হয়েছে। স্যালাড ও রেডি, এরমধ্যে উনুন ধরানো চলছে। আমি একটা অক্ষম চেষ্টা করলাম। এটা এখনও শিখে উঠতে পারিনি, নিশ্চয় কোনদিন শিখে যাব।
চিকেন পোড়ানো চলছে, এরমধ্যে প্রায় এক বোতল শেষ। তখন আবার আমি বাড়িতে কথা বলতে শুরু করলাম। কী বলছিলাম কে জানে, শুধু এটাই মনে আছে, বাবা খুব গম্ভীর ভাবে বললেন, কাল কথা বোলো, কেমন? তারপর দুজনে মিলে পুরো দেড় বোতল শেষ। তখন আমি মেঘের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেই ম্যানড্রেকের মেঘ-মানুষদের দেশে। এবং একবার ছাদের রাস্তার দিকের রেলিং পেরিয়ে চারতলা থেকে সটাং রাস্তায় নেমে চলে যাওয়ার ধান্দাও করছিলাম। কিন্তু ওই, সবসময় লোকজন না না করতেই ব্যস্ত। পিছন থেকে তিনি হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে আনলেন, আর ‘একিরে!’ বলে ঘাবড়ে চেয়ে রইলেন। তখন আবার তড়িঘড়ি নীচে নামার ব্যবস্থা শুরু হলো, আর যথারীতি আমি অত সিঁড়ি দিয়ে নামাতে চাইছিলাম না, ছোটবেলার মত সিঁড়ির রেলিং এর উপর দিয়ে স্লিপ খেয়ে নামতে চাইছিলাম, তাও একগাদা জিনিস সঙ্গে নিয়ে। বেচারা বরটা উনুন ধরিয়েছে, মাংস পুড়িয়েছে, আমি কি এতটুকু কষ্ট করতে পারি না! আর পিছন থেকে এবার আমার ল্যাপিটার সর্বনাশ হয়ে গেলো এরকম একটা আর্ত চিৎকারও শুনতে পেয়েছিলাম। তবে সেদিন নিজেই নেমে এসেছিলাম কিনা আর মনে নেই।শুধু উত্তাল মাতাল হয়েছিলাম মনে আছে। তারপর তো জীবনে যা যা হয় (সে কখনও হবেখন)। তো চলো বিশ্বমাতালেরা গ্লাস ভরো, আমিও দেখি কী কী রয়ে গেছে, মাংস তো পোড়াচ্ছিই। চিয়ার্স!
অলংকরণঃ সুমেরু মুখোপাধ্যায়