
ভারতকে খুঁজে পাই ছ'বছরের কিছু বেশি আগে, যখন সদ্য অ্যামেরিকা এসেছি। অক্সিজেনের ঘাটতি না হলে সেটা যে ছিল টের পাওয়া যায় না, আমার ভারতে পাওয়াও কিছুটা ওরকম। ভৌগোলিক ভারতবর্ষে থাকতে মনেপ্রাণে উপলিব্ধি করতাম, কলকাতাটাই আমার দেশ। বাকি এলাকাগুলো পাসপোর্ট-ভিসাহীন বিদেশ, আসলে দেশ আর ঘরের পার্থক্য বুঝিনি। যাই হোক, সেই পার্থক্য নিরূপণের জন্য এ লেখা নয়, তবে দেশ মানে কেবল ঘুম থেকে দাঁত মাজতে মাজতে পাড়া ঘোরার আরামটুকুই নয়, সেটাই হয়তো বাকি লেখায় বোঝার চেষ্টা করবো। অ্যামেরিকায় এসে যেটা খেয়াল করতে শুরু করি, যে, এদেশের বৈভব ও বিস্তারে আমার কোনও অধিকার নেই। অধিকার নেই আমার কলেজ যাওয়ার রাস্তার গা ছমছমে অঞ্চলটায় কেন পুলিশ থাকেনা জিজ্ঞেস করার কিম্বা সিম্পলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন হক করার। ভারতে এসব বললেও হাইলি কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পাত্তা দেবেনা, কিন্তু বলবার/করবার অধিকারটুকু আছে- এই অধিকার থাকা আর না থাকার বোধ একটাভাবে নিজের জীবনচর্যাটায় পার্থক্য এনে দিচ্ছিল- দেখছিলাম, সত্যিই বিদেশে আছি। কিন্তু এ গল্প দেশ ও বিদেশের, মহাভারতের নয়; তবে হয়তো এইখান থেকেই শুরু। কোনওভাবেই মানিয়ে নিতে পারিনি অ্যামেরিকান সমাজে। মানিয়ে না নিতে পারা অবশ্যই অক্ষমতা, আর, আর-পাঁচজন দেশির মতন আমিও অ্যাপার্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও দেশি পার্টিতে বন্দি হয়ে বছর কাটাতে লাগলাম। আর, এই জীবনটা খুব পীড়া দিচ্ছিল। ক্রমশঃ কোর্সওয়ার্ক ক্লাসরুম থেকে দূরে সরে এলাম যখন এদেশি বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কমলো, ফলে বিচ্ছিন্নতা বাড়লো- পুরো সমাজটার মধ্যে একদম বাইরের একজন অবজ়ার্ভার হয়ে থাকলাম। এবং এই পীড়াদায়ক বিচ্ছিন্নতা যেহেতু সবচেয়ে বাজে রাখে নিজেকে বারবার একটা খোঁজার জায়গা এলো, কোথায় আটকাচ্ছে বোঝার জায়গা এলো।
এইখান থেকে আমার ভারত দ্যাখার শুরু, অ্যামেরিকার বিশেষতঃ লুইসিয়ানার সমাজের প্রতিতুলনায়। আমি দেখছি অভিযাত্রী সমাজের এক উত্তরাধিকার, বন্দুকের বাঁটের থেকে রেড ইন্ডিয়ান রক্ত মুছতে যাঁরা রোববার রোববার চার্চ যেতে বাধ্য, আবার রক্তের প্রবাহে মিশে আছে গান ল, শিকার- এমন কী খোলা মাঠে মাং পোড়ানোর উদ্দাম বার্বিকিউ; আমি দেখতে পাচ্ছি শুক্রবার রাতের কে যে কার প্রেমিকা কে যানে পার্টি আর গ্রেট অ্যামেরিকান ড্রিম ভেঙে ভেঙে ফুটে ওঠা ক্রীতদাস প্রথার অবশেষ। আর, দুদিকেই তার আগের ইতিহাসটা ভুলে যাওয়া। অ্যামেরিকা নিয়ে বাজে বাজে কথাগুলো বললাম কারণ আমার বাজে থাকার জায়গা থেকে তুলনাটা আসছে, ভাল কথা চাইলে অজস্র বলা যাবে সেটাও বলে রাখলাম। যাই হোক, উল্টোদিকে আমরা ইতিহাসের অধীন, কম-বেশি মিলিয়ে কী করবো, কী করতে চাই আর কী কী করে থাকি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ইতিহাস দিয়ে, শুধু খাদ্যাভ্যাস দেখলে চোখে পড়ে, দেশের আদ্ধেকলোক নিরামিশাষী কেবলমাত্র তার পিতৃ-মাতৃবংশে কেউ আমিষ ভক্ষণ করেন নি বলে। আর এরকমটাই ধর্ম। ধর্ম অর্থে 'হিন্দু' নামের সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া শব্দটা বাদ দিয়ে বায়ুর ধর্ম, জলের ধর্ম, জীবনের ধর্ম - এই প্রসঙ্গে আসা ধর্মের কথা ভাবি, ছোটবেলা থেকে শুনেছি যা ধারণ করে রাখে, আর তা কখনওই রিলিজিয়ন হতে পারেনা। দেশের লোক ব্রহ্মবাদী থেকে তান্ত্রিক হয়েছে, প্রকৃতিপূজক থেকে বৌদ্ধ হয়েছে, বৌদ্ধ থেকে বৈষ্ণব-মুসলমান হয়েছে। রিলিজিয়ন পাল্টেছে কিন্তু ধরে রাখার ঐতিহ্য পালটায় নি। সেখানে ভারত খুব ব্যাপ্ত হয়ে যায়, কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে দক্ষিণভারত গেলে মেদিনিপুরী ডায়ালেক্ট ক্রমশঃ উড়িয়া, উড়িয়া ক্রমশঃ দ্রুতছন্দে উচ্চারিত হতে হতে তেলেগু হয়ে যায়; কিন্তু মানুষ কোনও এক জায়গায় এক থাকে। এই এক থাকাটাই ভারতবর্ষ- একটা অসম্ভব দেশঃ জাতীয়তা বা সংস্কৃতি বা অর্থনীতিতে দেখলে রাজনৈতিক ভাবে এদ্দিন দেশটার এক থাকার কোনও কারণই ছিল না। অথচ এক আছে, অথচ এক আছে কারণ কোনও এক অন্তর্নিহিত ঐতিহ্য তাকে 'কী করিতে হইবে' বলে দিচ্ছে- বংশ পরম্পরায় শূদ্র বিন্দুমাত্র রক্তপাত না ঘটিয়ে সেবা করে যাচ্ছে তিন উচ্চবর্ণের। রবীন্দ্রনাথ বলছেন 'য়ুরোপ খুব করে হতে চাইছে, আর আমরা চাইছি ভবের বন্ধন কাটাতে, না হয়ে যেতে'। আমরা দীন হতে চাইছি, বৈভবকে ঘৃণা করছি, এমনকী চারপাশের লোকজন আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালে লজ্জায় মাথা নিচু করছি। এই না হওয়াটা আমার এখানে এসে বোধে এল। পার্টিতে-উৎসবে চারপাশের লোকজনের থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখা কিম্বা পুরোপুরি ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্যের বাইরে থাকা একজন হওয়াটাই আমাদের আরাম-অঞ্চল। নিজের আনন্দ নিয়ে উচ্ছ্বাস আমাদের কাছে অতি-উচ্ছ্বলতা। নিজেকে ঢেকে রাখা হয়তো সবসময় সাপ্রেশনও নয়, ভেতর থেকে আসা কিছু। আমার কাছে ভারত বিস্তার করেছে এই না হয়ে ওঠার জায়গাটাতেই। ভূমণ্ডল এবং তদোর্ধএর অধিকারী সবিতার কাছে আমরা জ্ঞানসাধন প্রার্থনা করছি, জেনে বা না জেনে গায়ত্রী মন্ত্রে। আর ভারতের টিকে থাকা এই জ্ঞানসাধনে, সেখানে অগ্রাহ্য করা হয় মুহূর্তের উন্মাদনা, মানুষের বানিয়ে তোলা রূপরসগন্ধের কামনা, আনন্দের পশ্চিমি সংজ্ঞা। এই জন্যই তিনহাজার বছরের ইতিহাসে ভারত কখনো বিদেশে সৈন্য পাঠাতে পারেনা (শ্রীলঙ্কা কলোনাইজ় করতে অশোককে সৈন্যর বদলে শ্রমণ পাঠাতে হয়, সে অধিকার জ্ঞান-এর অধিকার বলেই) , নিজের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট স্বত্ত্বেও দলিত পারেনা ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। কারণ, এর সবগুলোতে নিজেকে বড়ো বেশি পাত্তা দেওয়া হয়ে যায়। কমিউনিটি হিসেবে এই নিজেকে নিজের ভিতর লুকিয়ে ফেলার মধ্যে বেশ বড়ো ধরণের একটা দেশ গড়ে ওঠে, যাঁরা ধর্মাচরণ করে যান জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে- ঘুম থেকে উঠে সূর্যপ্রণাম যেমন ধর্ম, সহমানুষের গায়ে পা লেগে গেলে নমস্কার করাও তেমনই ধর্ম সেখানে। আর, আরও বড়ো ধর্ম পার্থিব সুখভোগকে অগ্রাহ্য করার, কারণ তাঁদের মনে হয় ইন্দ্রিয়দমনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবী বা তারও বাইরের জিনিসগুলিকে বুঝে উঠতে পারার ম্যাজিক।
যাই হোক, এটা একটা উপলব্ধি, ভারত নামের অসম্ভব দেশটাকে ভারত থেকে বাইরে থাকার যন্ত্রণা নিয়ে একভাবে বোঝা, একভাবে ফ্যান্টাসাইজ় করাও- তবে এদেশ মহান নয়- এখানে খাপ পঞ্চায়েত থেকে বিনায়ক সেনের জেল সবই হয়। আর ভারত মানে শুধু আসমুদ্রহিমাচল ভূখণ্ডটিও নয়- খোদ অ্যামেরিকাতেও অনেক টুকরো টুকরো ভারত দেখেছি- দুহাজার বছরে দেশের ব্যাপ্তি খুব কম হয়না।
Blank | unkwn.***.*** | ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৬:০৩87000
d | unkwn.***.*** | ৩০ মার্চ ২০১৫ ১০:১৯87001
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ১০:২০87002
তাপস | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:০৪87003
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:০৮87004
pi | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:০৯87005
Atoz | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:১৭87006
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:১৯87007
তাপস | unkwn.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:২২87008
কল্লোল | unkwn.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫৯87009
ranjan roy | unkwn.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ১১:০৭87010
ranjan roy | unkwn.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ১১:০৮87011
dc | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৫87018
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:৩৯87012
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:৪০87013
dc | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:৫২87014
সোমনাথ | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:০২87015
dc | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:০৬87016
কল্লোল | unkwn.***.*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:২১87017
b | unkwn.***.*** | ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৫:১৭87019
lcm | unkwn.***.*** | ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৫:২২87020
d | unkwn.***.*** | ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৫:৩৬87021
dc | unkwn.***.*** | ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:২৩87022
dc | unkwn.***.*** | ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:২১87023
Jay | unkwn.***.*** | ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:৪১87024