সন ২০১১, সেপ্টেম্বর মাস। প্রায় পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে মিলল পাসপোর্ট। বাড়িতে এলো ডাকযোগে। খুশি হওয়াই উচিত। ফুরফুরে মনে আড্ডা মেরে সন্ধ্যেবেলায় ফিরছি। পুজোর আগে আগে। বাড়ির সামনের মোড়ে জটলা, দুতিনটে বাইক দাঁড়িয়ে। তাদের কাগজ-পত্র পরীক্ষা করছে মাথায় কালো ফেট্টি, হাতে ছোটো ভারী লাঠি, কাঁধে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক - রিসার্ভ পুলিশ। হেলমেট না পরা রুখবার জন্য পু্লিশকে সাহায্য করতে এসেছে। এর আগেও কল্যাণীতে এদের দেখেছি। সেতো ভোট এর সময়। কিন্তু এবার ঘরের আঙ্গিনায় প্রায়। মুখটা একটু তেতো হয়ে গেলো। অথচ এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না বোধ হয়। পুলিশ-মিলিটারি তো মানুষের ভরসা উদ্রেক করবে। তাহলে কেন?
কারণ ততদিনে আমরা শুনে ফেলেছি আইরম শর্মিলা চানু-র কথা। শুনে ফেলেছি আফস্পা। জেনে গেছি জম্মু কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে বলবৎ হয়ে আছে এই আইন। তাই গুলি চালিয়ে হত্যা করার অধিকার থাকছে সেনা-অফিসারের। থাকছে ইম্যুনিটি। থাকছে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের ক্ষমতা। যার জোরে আসাম রাইফেলস গুলি চালিয়ে মেরে ফেলছে বাস স্টপে অপেক্ষারত দশজন সিভিলিয়ানকে। যাদের মধ্যে রয়েছেন এক বাষট্টি বছরের বৃদ্ধাও। হচ্ছে না কোনও তদন্ত। কেন দরকার হচ্ছে ১৯৫৮ থেকে চলে আসা এই আইনের? যাতে দেশটা ভেঙে-চুরে টুকরো টুকরো না হয়ে যায়।
দেশ কী? জানি না। জানি ওই ২০১১র সেপ্টেম্বর মাসে পাওয়া কাগজটা আমার দেশ এর পরিচয় বহন করে। জানি ১৯৪৭ সালে আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। এও জানি, ওই ১৯৪৭ এই কিছু মানুষের টেনে দেওয়া কতগুলো দাগের মধ্যবর্তী অংশকে সারা জীবন দেশ বলে মেনে নিতে হবে। অথচ আমি জানি, আমি যেখানে থাকি, তার একশ মাইলের মধ্যে এমন জায়গা রয়েছে, যেখানকার অধিবাসীরা আমার ভাষাতেই কথা বলে, আমি যা খাই, তাই খায়, একই বৃষ্টিতে ভেজে। কিন্তু তারা ওই দাগের অন্যপ্রান্তে। আমি এও জানি, এক হাজার মাইল দূরে রয়েছে আরও অনেক মানুষ, যারা একেবারে অন্যরকম। আমার সাথে তাদের কিছুই মেলে না। কিন্তু তারা আমার দেশবাসী।
জানতে পারছি, আমার মতো রয়েছে আরও বহু মানুষ। গোটা দেশের সঙ্গে কিছুই মিলছে না তাদের। কেউ জানছে না তাদের কথা। কেউ শুনছে না তাদের অভাব-অভিযোগ। শুধু পঁয়ষট্টি বছর আগে কেউ তাদের বলে দিয়ে গ্যাছে, আজ থেকে লাইনের ওপারে যাওয়া যাবে না। বাড়ির উঠোন দিয়ে চলে গ্যাছে সে লাইন। ধানক্ষেত এর মধ্যে দিয়ে। নদী-বিল-ডোবা-পুকুর ভাগ করতে করতে। পাহাড় সমতল পেরিয়ে। এতদিন ধরে যারা একসাথে ছিল, সেই ওপাশের ওরা আজ আলাদা। কেউ কেউ চুপচাপ শিখে গ্যাছে, মেনে নিয়েছে, আমার মতন। কিন্তু কেউ কেউ মানেনি। এই না মেনে নেওয়া সহ্য করা অসম্ভব ছিল রাষ্ট্রের পক্ষে। তাই আফস্পার দমননীতি হাতিয়ার হয়েছে রাষ্ট্রের। চিন আর পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে বছরের পর বছর খুন-জখম-ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে তুলে দেওয়া হয়েছে মিলিটারির হাতে। সাময়িকভাবে কমেছে সন্ত্রাসবাদ, মাথাচাড়া দিয়েছে অন্যখানে। বরং অধিবাসীদের বিশ্বাস হারিয়েছে রাষ্ট্রশক্তি। তারা বুঝে গ্যাছে, রাষ্ট্র তাদের জন্য নয়। এর চেয়ে বড় বিশ্বাসভঙ্গ আর কি হতে পারে? এর চেয়ে বড় ব্যর্থতাই বা কি হতে পারে রাষ্ট্রের পক্ষে?
ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আমাদের ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য। তবে কেন আমাদের সমস্ত ইতিহাস ষোড়শ মহাজনপদের? গুপ্ত বংশের? মৌর্য বংশের? দিল্লির তখত এর অধিকারীর? শশাঙ্ক, চোল আর বিজয়নগর বাহমনি বাদে কোথায় বাকি ভারতের কথা? নাকি ভারত বলতে আমরা বুঝি খালি উত্তর-পশ্চিম ভারত? তাই প্রাণপণে অভ্যাস করে নেবার চেষ্টা করি ওদের খাবার। শিখে নিতে চাই ওদের বুলি। এমনকি খিস্তিটা অবধি চাই ওদের মতো করে উচ্চারন করতে। বিচ্যুতি দেখলেই তাকে দাগিয়ে দিই। তাই দক্ষিণের হিন্দি না জানা তামিল ছেলেটিকে নিয়ে হাসাহাসি করি। তাই উত্তর-পূর্ব থেকে আসা মানুষদের বলি চিঙ্কি, চিন-কি। বিজাতীয়, বিদেশি।
কিন্তু কী আশ্চর্য! এঁদের হাতেই আমরা বিশ্বাস করে রাখি আমাদের ধন-সম্পদের ভার। ভারতের সব কটা মেট্রোতেই দেখা যাবে এঁরাই পাহারা দিচ্ছেন এটিএম, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক। সৎ, ভদ্র, কর্মনিষ্ঠ বলে বিশেষ পরিচিতি আছে এঁদের। অথচ কিছুতেই এঁদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না এঁদের নিজেদের রাজ্যটাকে, শহরটাকে, গ্রামটাকে। বিশ্বাস করতে পারি না তখন। পিছনে লেলিয়ে দিতে হয় মিলিটারি, আফস্পা। ক্রমশঃ কমতে থাকে পারস্পরিক বিশ্বাস এর পরিসর। বিচ্ছিন্নতাবাদ রুখতে যে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল হাতে, তা আরও বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। হাতিয়ার এক সময় শরীরের অঙ্গ হয়ে যায়, আফস্পা হয়ে যায় যাপনের অংশ। স্বাভাবিক আনন্দময় সুস্থ জীবন হয়ে যায় গল্পকথা।
তবুও আমরা একজাতি একপ্রাণ। পনেরই আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারি মাংস ভাতের ঢেঁকুর তুলতে তুলতে দেখি রোজা, দেখি লক্ষ্য, দেখি বর্ডার, সরফরোশ। ইম্ফলের ছেলে, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার, কল্যাণী বিয়ার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে আসা সুনীল সিংহকে প্রথম দর্শনেই জিগ্যেস করি জঙ্গিদের পাল্লায় কখনো পড়েছ কিনা, এবং সপাটে থাপ্পড় খাই তার উত্তরে – না, সেনার হাতে পড়েছি, কেউ যেন কখনো ওদের হাতে না পড়ে। উড়ো খবর ভেসে আসে, নৈহাটিতে শালওয়ালা সেজে লুকিয়ে ছিল একদল উগ্রপন্থী। ধরা পড়েছে। পরের দিন মাসকাবারি টাকা নিতে এলে সন্দেহের চোখে তাকাই দশ বছর ধরে বাড়িতে শাল সোয়েটার কম্বল জুগিয়ে যাওয়া জওহর কাকু-র দিকে। আর একটু একটু করে ছিনতাই হয়ে যেতে থাকে আমাদের বিশ্বাস, আমাদের নির্ভরতা।
চেন্নাইতে আলাপ হয় চেরিয়ানের সাথে। কলকাতা সেন্ট জেভিয়ারসের ছাত্র ছিল। বাবা তামিল। সৈন্য। মা নাগা। বাবার পোস্টিং হয়েছিল নাগাল্যান্ডে। সেইখানেই ওর মায়ের সাথে আলাপ হয় ওর বাবার। সান্ধ্য আসরে চেরিয়ান আমাকে বলে – আমি জানি না, আমার দেশ কোথায়? কোথায় আমার শিকড়? নাগাল্যান্ডে ছোটবেলা কেটেছে। কলকাতায় উচ্চশিক্ষা। এখন চাকরি করি চেন্নাইতে। কী হবে আমার, আমি কোন দেশে বাস করি জেনে? কী হবে এটুকু বুঝে, কোহিমা আর চেন্নাই একই দেশের মধ্যে? আমি যেখানেই যাই আমাকে জিগ্যেস করা হবে, আমার মুখ-চোখ চিনাদের মতো, আমার গায়ের রঙ কালো কেন? দেশ বলতে আমি নিজের কিছু পরিচিত মানুষ, গাছ-পালা ঘর-বাড়ির বেশী আর কিচ্ছু বুঝি না, যারা আমাকে চেনে-জানে, যাদের গন্ধ আমি পাই, যাদেরকে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না।
চেরিয়ান নিশ্চয়ই নেশার ঘোরে ভুল বলেছিল। রাষ্ট্র মানেই অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যাওয়া। পরিচয়পত্রে লেখা থাকবে সেইসব উত্তর।