সমালোচক প্রশ্ন তুলেছিলেন, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি আসলে প্রতিষ্ঠান ভাঙার নামে আরেকখানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিনা?
যদি দাবি করা হয় যে ‘ক্রিয়া-ই সমস্ত শব্দের মূল’, তাহলে এক ঝটকায় এই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। এই শব্দার্থবিধি আসলে শব্দের অর্থগত নিরেট অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এই পথ বা পদ্ধতি ছাড়া (আপাতত) আর কোনও উপায়ে ‘কর’ শব্দের অর্থ কেন ‘কিরণ’, ‘হাতের তালু’, ‘শুল্ক’, ‘তাচ্ছিল্যার্থে নির্দেশ’, ইত্যাদি অথবা ‘ব্যাঘ্র’ শব্দের অর্থ কেন ‘বাঘ-পশু’ ছাড়াও ‘শ্রেষ্ঠ’, ‘এরেণ্ড বৃক্ষ’, ‘করঞ্জ ফল’ হয়ে ওঠে –তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায় না। বোঝা যায় না, কেনই বা ‘সিংহ’ শব্দটির উপস্থিতি স্বত্ত্বেও পশুটিকে চিহ্নিত করতে ‘মৃগেন্দ্র’, ‘গজারি’, ‘কেশরী’ –শব্দগুলির দরকার পড়েছিল!...
অর্জিত বিদ্যের পরিধির বাইরের প্রশ্নগুলিকে হামেশাই ‘ওপরওয়ালার লীলা’ অথবা ‘কেন ভাবতে যাব, দিব্বি কাজ চলছে’ –গোছের জবাব দিয়ে আমরা চুপ করিয়ে দিই। ‘শব্দের অর্থ খেয়ালখুশি মতো বদলায়’ –এই ধরণের চিন্তা হল সেই অভ্যেসের উত্তরাধিকার।
কখনও একই বিষয়/ বস্তুকে বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা, কখনও একই শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর বিষয়/ বস্তুকে প্রকাশ করা, -তা আসলে সূচিত করে যে, প্রচলিত শব্দার্থের অতলে ‘এমন কিছু’ আছে যা শব্দের ও অর্থের ভিন্নতার ও আপাত-ভিন্নতার ‘হারমনি’ বা ‘সাম্য’ বজায় রাখে। আর মার্কসীয় তত্ত্বের খেই ধরে বলতে গেলে, ‘সাম্য’ কখনই স্থিতাবস্থা হতে পারে না, তা হল একটি ‘প্র-ক্রিয়া’।...
এরপর সেই বিদগ্ধ সমালোচক আর শব্দতত্ত্বে পল্লবগ্রাহী অধম নিবন্ধলেখকের মধ্যে তর্ক বাঁধল।;-
- ‘ব্যাঘ্র’ মানে জানি গায়ে ডোরাকাটা দাগওয়ালা এক মাংসাশী প্রাণী। চলতি বাংলায় তার নাম বাঘ। এইটুকু বুঝতে খামোখা অত জটিল রাস্তায় যাব কেন বলতে পারেন?
- ‘ব্যাঘ্র’ শব্দের অর্থ ‘বিশিষ্ট রূপে আঘ্রাত হয় যা’। (একে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ, যা খুশি বলা হো’ক না কেন!) কোনও প্রাণীর প্রকৃতিতে যদি ‘বিশিষ্ট রূপে আঘ্রাত হওয়া’র গুণ থাকে তাহলে সে অবশ্যই ব্যাঘ্র।
- বাঘ কি তবে ‘বিশিষ্ট রূপে আঘ্রাতই হয়’ শুধু! আর কিছু করে না?
- কেন করবে না! তবে ‘ব্যাঘ্র’ শব্দের মাধ্যমে সেই সব গুণ বা ক্রিয়াবৈশিষ্ট প্রকাশ পায় না। বাঘ নামক জন্তুটিকে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে যতদূর সম্ভব চিনতে হলে তাকে বাকি যে সব নামে ডাকা হয়, ভাষা নির্বিশেষে সেই সব ক’টি শব্দের ভেতরকার ক্রিয়াগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। যেমন সংস্কৃত শার্দ্দুল (‘যার হিংসা ক্ষয়সাধন করে’ অর্থে, √শৃ ধাতু = ক্ষয়) বা আভেস্তান ‘টাইঘ্রী’ (যার অর্থ ধারালো, সূচালো অগ্রভাগ), ইত্যাদি।
- ‘ব্যাঘ্র’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ যদি একমাত্র আঘ্রাত হওয়াই বোঝায়, তাহলে তো তা ডিটারমিনিস্টিক!
- বরং উল্টো। গোলমালটা বাঁধছে ‘ব্যাঘ্র’ শব্দটি নিয়ে ভাবতে বসে ‘বাঘ’ জন্তুর ছবিটিকে কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না বলে। সমস্ত শব্দের মতো ‘ব্যাঘ্র’ শব্দটি ‘প্রকৃতিব্যঞ্জক’, যে প্রকৃতি কার্য্যত অসংখ্য আকৃতি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময়।
- এই তথাকথিত যুক্তিগুলি কিন্তু মোটা দাগের ভাববাদী কথাবার্তার মতো শোনাচ্ছে। -একদম ‘পোস্ট-ট্রুথ’1 কোনও থিওরির মতো!
- কোয়ান্টাম বিজ্ঞান বর্ণিত সম্ভাবনা (‘potential’ অর্থে) যদি ভাববাদী হয়, তাহলে তা-ই! এই সম্ভাবনাগুলিকে খারিজ করলে ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ হিসেবে যে ‘শ্রেষ্ঠ’, ‘এরেণ্ড বৃক্ষ’, ‘করঞ্জ ফল’, ইত্যাদি-কেও খারিজ করতে হয়-ই। কিন্তু তখন বিপদ হল, কোনও মানুষকে ‘বাংলার বাঘ’ বা ‘পরুষসিংহ’ ডাকলে তা ‘জানোয়ার বলা’র সমতুল্য হয় যে! অথবা ‘শব্দকল্পদ্রুম’ অভিধানে যখন দেখা যায় ‘কাশ্যপভার্য্যা দংষ্ট্রা হইতে ব্যাঘ্রের উৎপত্তি’ তখন পূর্বপুরুষদের ‘বিশুদ্ধ গাঁজাখোর’ ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না!
ভাষা মানুষের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অর্জন। আর ব্যাকরণ সেই প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের বিশ্লেষণ, তার রীতি-নীতি নিয়ম-কানুন বোঝার প্রচেষ্টা।... যকৃৎ বা পাকস্থলীর গঠন বা তার কাজ জেনে ওঠার হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ খাবার হজম করে আসছে। তাই বলে ‘Physiology’ বা ‘Anatomy’কে ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বলা যায় কি?
উনিশ শতকের শেষভাগে ফের্দিনঁ দ্য সোস্যুর নামের একজন ভাষাতাত্ত্বিক বললেন, -কোনও শব্দের অর্থ একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তু হতে পারে না। ‘ভাষাপ্রতীক বা শব্দ = বস্তু বা বিষয়’ –এই সমীকরণটি ভুল। কোনও শব্দ প্রত্যক্ষভাবে কোনও বিষয়/ বস্তু/ বিষয়বস্তুকে স্থাপন বা উপস্থাপন করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘বাঘ’, ‘সিংহ’, –শব্দগুলির মানে কেবলমাত্র ‘বাঘ’, ‘সিংহ’, –নামের জন্তুগুলি নয়। তাহলে শব্দগুলি শুনলেই সেই জন্তুগুলির ছবি মনে ভেসে আসে কেন?
সক্রেটিসের ‘শিষ্য’ গ্রীক দার্শনিক অ্যান্টিস্থিনিস বলেছিলেন, (সচেতন ভাবেই ‘ছাত্র’-এর বদলে ‘শিষ্য’ শব্দটি বলা হল।2 ) -‘আমি অশ্ব দেখতে পাচ্ছি, অশ্বত্ব দেখছি না।...’
‘গমন’ বা ‘ধাবনে’র মতো একটি বা দু’টি ক্রিয়ার নাম শুনলেই গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে জল, বাতাস, মানুষ, পশু-পাখি, জীবাণু, এমনকি ‘তড়িৎ-চৌম্বকক্ষেত্রে কম্পমান ইলেকট্রন’, ইত্যাদি অসংখ্য ‘গামী’র বা ‘ধাবমান’-এর ছবি ভেসে ওঠে। ‘ক্রিয়া’ নিজে অদৃশ্য, নিরাকার। ‘কারী’র বা ‘কৃতে’র ছবি ছাড়া তাকে ধরা কঠিন। আগে বলা হয়েছিল, ‘রিয়েলিটি’র দুটি পর্যায়, প্রকৃতি আর আকৃতি। এখানে গমন হল প্রকৃতি আর গামী হল আকৃতি। রক্তকরবীর অধ্যাপকের কথার খেই ধরে বলতে গেলে, প্রথমজন হল ‘উলঙ্গ’ আর দ্বিতীয়জন হল ‘বানিয়ে তোলা কাপড়ে’র ‘রাজা’ বা ‘ভিখিরী’। -অ্যান্টিস্থিনিসের অদৃশ্য ‘অশ্বত্ব’ আর দৃশ্যমান ‘অশ্ব’।
‘প্রকৃতি’ ইন্টেলেক্টের নয়, অনুভবের প্রতিপাদ্য। ঠিক যেমন এক ‘নাগরিক কবিয়াল’ নিজের গভীর অনুভব থেকে গেয়ে ফেলেন, ‘...করি গানের ধর্ম পালন। সকলে ভাবছে লিখছে সুমন, আসলে লিখছে লালন।’...
ওই সোস্যুর-মশায় আরও বললেন যে, ‘ভাষা ব্যবহারের সময় কোনো একটি শব্দ উচ্চারিত কিংবা লেখা হলে, একটি চিহ্ন দ্যোতক (signifier) হিসেবে কোনো একটি বস্তু বা বিষয়কে দ্যোতিত (signified) করে, অর্থাৎ একটি চিহ্নের দুই প্রান্তে দ্যোতক ও দ্যোতিতের অবস্থান থাকে অনেকটা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো।’3 বোঝা গেল যে ‘শব্দের অর্থের মধ্যে’ ও ‘বস্তু/ বিষয়ের নামকরণের মধ্যে’ এমন ‘কিছু একটি’ আছে যার ফলে অর্থ বা নামকরণ একটি পরিবর্তনশীল সত্তা।
আসলে পরিবর্তনশীলতা মানেই খামখেয়ালিপনা (arbitrariness) নয়। - একদল মানুষ একটি বস্তুকে জল নামে চেনে। কিন্তু, যেহেতু শব্দ-জল আর বস্তু-জলের মধ্যে পরিবর্তনশীল ‘কিছু একটি’ আছে বলেই তারা হঠাৎ বস্তু-জলকে ‘স্থল’ বলে ডাকতে শুরু করে না। নামকরণের সময় সচেতনে বা অবচেতনে তারা নামের মাধ্যমে বস্তু/ বিষয়টির কোনও একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য যেন প্রকাশ পায় (বা নাম থেকে বস্তু/ বিষয়টিকে কিছুটা হলেও চেনা যায়) –সে’টুকু খেয়াল অবশ্যই রাখে। এমনকি একজন ‘মাতাল’কে দেখে ‘পেটে জল পড়েছে’র মতো (ব্যঞ্জনামূলক) মন্তব্য করার সময়ও সে সচেতনে/ অবচেতনে বা অভ্যেসে (ঐতিহাসিক সংগঠন বজায় রেখে) মদ ও জলের পানযোগ্যতা, তাদের তরল অবস্থা, ইত্যাদি ধর্মের (ক্রিয়াবৈশিষ্টের) একটি তুলনামূলক সংশ্লেষ সেরে ফেলে।
সমালোচক বললেন, ‘ইটিমোলজীর প্রামাণ্যতা কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠিত হল না।’...
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।...
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য, তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার, অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।...”
(‘আমি’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
স্বভাবদোষে খানিক কাব্যি আওড়ে নিবন্ধলেখক চক-ডাস্টার হাতে ছবি আঁকতে শুরু করল!-
মনোবিদরা বলেন4, একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত বস্তু/ বিষয় সামনে এলে প্রথমেই আমাদের মস্তিষ্ক যার যার ব্যক্তিগত ‘স্থিতিমাপ’ বা ‘parameter’ অনুসারে (বেশিরভাগ সময় অবচেতনেই) নিজেকেই পরপর কয়েকটি প্রশ্ন করে (সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে) সেই বস্তু/ বিষয়টির ‘বর্গীকরণ’, ‘শ্রেণীবদ্ধকরণ’, ইত্যাদি সেরে ফেলে। এই পদ্ধতির শেষ ধাপে থাকে সুনির্দিষ্টভাবে বস্তু/ বিষয়টির ‘সনাক্তকরণ’। (ঠিক যেমন একজন অপরিচিত মানুষের মুখোমুখি হলে সে ‘পুরুষ না নারী, যুবক না বৃদ্ধ, স্বদেশী না বিদেশী, বাঙালি না অবাঙালি, হিন্দু না মুসলমান, বিবাহিত কি অবিবাহিত’... ইত্যাদি সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর মস্তিষ্ক নিজেই যতদূর সম্ভব খুঁজে নেয়। দেখা যায়, সংলাপ শুরুর আগেই মানুষটির সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ হয়ে গিয়েছে! এরপরে আসে মানুষটির ‘ব্যক্তিগত পরিচয়ে’র প্রসঙ্গ।) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার ‘Perception Engineering’-এর কাজেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
আজ যে পশুটিকে আমরা ‘সিংহ’ নামে চিনি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন প্রাথমিক পর্যায়ে সেই পশুটিকে ‘দেখেছিল’, তখন সম্ভাব্য বর্গীকরণ/ শ্রেণীবদ্ধকরণের পর্যায়ক্রম বা ধাপগুলি ‘রেখাচিত্র-১’-এ দেখানো হল।5
রেখাচিত্র-১: বিষয়/ বস্তুর বর্গীকরণ/ শ্রেণীবদ্ধকরণের ধাপ
আগেই বলা হয়েছে, বর্গীকরণের স্থিতিমাপ বা parameter-গুলি দর্শকের ব্যক্তিগত অবস্থান বা অভিজ্ঞতার ওপরে ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। ফলে, প্রতীকী রেখাচিত্রটিতে বর্গীকরণের ধাপগুলি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, আদতে তেমন না-ও হতে পারে। তবে সেই কারণে বর্গীকরণের ‘পদ্ধতি’র কোনও বদল হয় না।
“শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন। / যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন॥
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল। / ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল॥
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই। / শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই॥
ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনী। / কালসোনা নাম রাখে রাধা-বিনোদিনী॥...”
- ‘কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম’
নরোত্তম দাসের ‘কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম’ বা কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের ‘শিবের অষ্টোত্তর শতনাম’ –জাতীয় রচনাগুলি পড়লে দেখা যায়, সেখানে একশো আট জন করে ‘ব্যক্তি’র কাছে কৃষ্ণ বা শিবের যেমন যেমন ‘গুণ’ প্রকাশ পাচ্ছে, তারা সেই মতো কৃষ্ণ বা শিবের নাম রেখে চলেছে। (উদাহরণ হিসেবে বলা হল, প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য নয়।)
বিষয়/ বস্তুকে ‘সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্তকরণ’ পদ্ধতির ধাঁচ এনেকটা সেই রকম। মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায় অবধি বর্গীকরণের পর এই পদ্ধতি শুরু হয়। নামেই বোঝা যায়, এই পদ্ধতিটি পুরোপুরি ভাবেই দর্শক বা বক্তার (পারিপার্শ্বিক অবস্থানভিত্তিক) দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করে। ‘রেখাচিত্র–২’-তে যেমন দেখানো হয়েছে, ‘অচেনা-অজানা’ পশুটির যে যে বৈশিষ্ট্য/ গুণ/ প্রকৃতি যে যে দর্শকের ‘চোখে’ ধরা পড়ছে, তারা সেইমতো পশুটিকে চিহ্নিত (নামাঙ্কৃত) করছে। (ঠিক যেমন আমরা ‘নাম না জানা’ বিষয়/ বস্তুগুলিকে ‘লালফুল’/ ‘নীলপাখি’/ ‘বেঁটেলোক’ –হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলি।)
এই ‘গুণবাচক’/ ‘প্রকৃতিব্যঞ্জক’ নামগুলি কিন্তু কোনও একটি বিষয়/ বস্তুর জন্য একচেটিয়া হয়ে যায় না। অন্য কোনও বিষয়/ বস্তুর যদি একই গুণ বর্তমান থাকে, তাহলে সেই বিষয়/ বস্তুগুলিরও একই নাম হতে পারে। সিংহ-পশু অর্থে ‘কেশরী’ শব্দের ব্যবহারের পাশাপশি ‘মশলা বিশেষের রং’ অর্থে বা ‘পাঞ্জাবকেশরী’ শব্দগুলিকে খেয়াল করা যেতে পারে।
রেখাচিত্র–২ : সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্তকরণ ও নামকরণ পদ্ধতি
এই হল ফের্দিনঁ সোস্যুর বর্ণিত ‘দ্যোতক-দ্যোতিত’ (সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েড) বা ‘বস্তুনামের সাথে বস্তু’র সেই সম্পর্কের রূপ। -যাকে আপাতভাবে ‘arbitrary’ বা বিশৃঙ্খল মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা দ্যোতিতের (বস্তুর/ বিষয়ের) বিভিন্ন ক্রিয়া (‘verb’ অর্থে নয়)-এর ওপর নির্ভরশীল।
এই অবধি শুনে সমালোচক মশায় ‘simple harmonic motion’-এ তর্জনী নেড়ে উঠলেন, ‘দ্যোতক-দ্যোতিত বা নাম-নামীর সম্পর্কের সঙ্গে শব্দ-শব্দার্থের সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলছেন কিন্তু! প্রথমটি ‘signifier-signified’ -কে বোঝায়। দ্বিতীয়টি ‘semantics’ বা শব্দার্থতত্ত্বের বিষয়।’
নিবন্ধলেখক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, -মিছেই এত ‘হারমনি’র কথা বলা, এর চেয়ে হারমোনিয়াম সাধলে ভাল ছিল!... ‘দ্যোতিত’ বলতে বস্তু/ বিষয় ধরে বসে থাকলে এই সংশয় জীবনে ঘুচবে না। (এরজন্যই শুরুতে ভাবনায় ‘বস্তুনিষ্ঠতা’ ছাড়ার কথা তোলা হয়েছিল।) আরও একবার শুনুন, ‘নামে’র মাধ্যমে ‘নামী’কে নয়, নামীর ‘ক্রিয়াবৈশিষ্ট’ বা ‘গুণ’কে চিহ্নিত করা হয়। ‘নাম’ হল ‘শব্দ’ আর ‘নামীর ক্রিয়াবৈশিষ্ট’ হল ‘শব্দার্থ’। খাসা একখানি উদাহরণ দেখা যাক;-
রেখাচিত্র–৩ : ‘দ্যোতক-দ্যোতিত সম্পর্ক’ ও ‘শব্দ-শব্দার্থের সম্পর্কে’র মেলবন্ধন
যাই হোক, মহান সক্রেটিসের ইটিমোলজির শুদ্ধতা নিয়ে সংশয়ের উত্তরে বলা যেতে পারে, কোনও বস্তু/ বিষয়ের প্রতিটি নাম ‘বস্তু/ বিষয়টির এক-একটি গুণের পরিচয়’, ‘বস্তু/ বিষয়টির পরিচয়’ নয়। আর তাই নামের পথ ধরে বস্তু/ বিষয়কে জানতে গেলে সেই বস্তু/ বিষয়কে পৃথিবীর সব ভাষায় যে যে নামে ডাকা হয়, -সেই সমস্ত শব্দের বিচার করতে হবে। (যদিও ওতেও কুলোবে না, কারণ কোনও কিছুর ‘সবটা জেনে যাওয়া’ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধেই কি বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান বলেছেন, - খুব অল্প বয়সেই আমি ‘বিষয়ের নাম জানা’ আর ‘বিষয়টিকে জানা’র পার্থক্যটি বুঝে ফেলেছিলাম!)
তবে একটি কথা, হাল আমলের ‘নামবাচক বিশেষ্য’ বা ‘proper noun’-এর বেলায় নামের মধ্যে নামধারীর গুণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। শিশুর নামকরণের সময় বেশিরভাগ সময়েই তার ‘গুণবিচার’ করা হয় না। (খুব বেশি হলে গৌরকান্তি বালক/ বালিকার নাম গোরা/ গৌরী রাখা হয়।) কিন্তু, যে নামকরণ ‘জনসাধারণের সন্মিলিত ইচ্ছা’য় হয় (ভারতীয় দর্শনে যাকে ‘অপৌরুষেয়’ বা ‘ঈশ্বরেচ্ছা’ বলে,6) তখন আবার নামের সেই ‘গুণ-বচনে’র ধর্ম ফিরে আসে। -উদাহরণ হিসেবে মহাত্মা, কবিগুরু, বিদ্যাসাগর, বাংলার বাঘ, নেতাজী, মাস্টারদা, দেশবন্ধু, মহানায়ক, ইত্যাদি ‘পাওয়া-নাম’গুলির কথা ভাবা যেতে পারে।
সমালোচক মশায় মাথার দু’পাশের রগ টিপে ধরে বসেছিলেন;-
- যত্তসব ট্র্যাশ্ হাইপোথিসিস!... যাই হোক, ‘দু’টো প্রশ্ন আছে। এক: মৃগদের ওপর প্রভুত্ব করা থেকে যদি মৃগেন্দ্র নাম হয়, প্রশ্ন হল –জন্তুটা কি শুধু হরিণ খেয়েই বাঁচে! জেব্রার কপালে শিকে ছিঁড়ল না কেন? দুই: হরিণখোর হিসেবে গাড়োয়ালের চিতা আমাদের সোঁদরবনের বাঘমামার রেকর্ডও তো মন্দ নয়, সে’ বেচারাগুলি কোন দোষে মৃগেন্দ্র হল না?
- দর্শকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরও দু’টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বর্গীকরণ আর সনাক্তকরণের parameter-গুলি ঠিক হয়। সেগুলি হল স্থান ও কাল। আলোচনা হচ্ছে একটি ভারতীয় ভাষা নিয়ে, তাই যে’ সময়ে এই নামকরণগুলি হয়েছিল (বেশ কয়েক হাজার বছর আগে), তখন পৃথিবীর এই প্রান্তে হয়তো জেব্রা মৃগ বা হরিণের মতো সহজলভ্য ছিল না। তাই তাদের নজরে তেমন ভাবে পড়ে নি। ঠেলায় পড়লে সিংহ নিশ্চয়-ই আর অনেক পশুরই ভাবলীলা সাঙ্গ করে, কিন্তু মৃগভক্ষণের ঘটনা সংখ্যায় অনেক বেশি ঘটত বলে তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। (‘Statistical Probability’-এর হিসেবের সময় যেমন যে সম্ভাবনাগুলির মান বেশি, সেগুলি প্রাধান্য পায়, -সেই ধাঁচে।)
পুরো পদ্ধতিটির মধ্যে এই স্থান ও কালের ভূমিকা বেশ গভীর। -বোঝার জন্য দেশের (‘political territory’ অর্থে নয়) বা শতাব্দীর বদল অবধিও অপেক্ষা করতে হয় না। -এমনকি ভাষার বদল অবধিও না। স্থান-কালের সামান্য হেরফের হলেই দেখা যায়, একই ভাষার বিভিন্ন ‘dialect’ বা ‘বাচনভঙ্গী’ জন্ম নিয়েছে। Physical parameter-এর সামান্য বদলের কারণেই শরীর ‘শরীল’ হয়ে যায়, মেঘ হয়ে ওঠে ‘ম্যাঘ্’...।
আবার ‘জেব্রা’-নামক পশুটি বা ‘আলমারি’ নামক বস্তুটি যখন এদেশের মানুষজন প্রথমবার দেখল, পশুটির/ বস্তুটির ক্রিয়াবৈশিষ্ট বা গুণগুলিকে চিনে ওঠার আগেই/ পাশাপাশি তাদের ‘ভিনদেশি’ নামগুলি পেয়ে গেল। তখন নতুন করে নামকরণ না করে এদেশের মানুষ সেই নামগুলিকে নিজের ভাষায় স্থান দিল। -এই কাজ আসলে ‘অপরের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে আত্মস্থ করে’ নেওয়ার স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রবণতা। (জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে যে প্রবণতার অভাব হলেই ধর্মে-ধর্মে, দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে বিভেদ বাঁধে।)
নামকরণের পদ্ধতি মোটেই একবগ্গা সরলরেখা ধরে চলে নি/ চলে না, বরং তার ধাঁচ অনেকটা ‘বহু চলরাশিযুক্ত সমীকরণগুচ্ছ’ (Multivariable Equations) –এর মতো। যেখানে x-এর মান নির্ভর করে y–এর ওপর আবার y-এর মান নির্ভর করে z–এর ওপর...।
‘আরে ধুত্তোরি, আপনি ফাজলামি করছেন নাকি আমার সাথে!’ এবার তেড়ে ধমক লাগালেন সমালোচক ‘শব্দার্থ বোঝাতে সেই থেকে অঙ্কের কথা শোনাচ্ছেন কেন? কথায় কথায় অমন ‘মতো-মতো’ করে কোনও থিওরি প্রমাণ করা যায় না।’
নিবন্ধলেখক ধমক অগ্রহ্য করে বলে চলে;-
‘রেখাচিত্র-৪’-এ যে উদাহরণটি দেখানো হয়েছে, সেখানে দ্বিতীয় পশুটির নাম সরাসরি প্রথম পশুটির নামের ওপর নির্ভরশীল। আবার দ্বিতীয় পশুটির উপস্থিতির কারণেই প্রথম পশুটির ‘মরণের জন্য গমন’/ ‘গমনের ফলে মরণ’ হয়; -যার ফলে তার নামকরণে ‘মরণ’ ও ‘গমন’ এই ক্রিয়াদুটি মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এদিকে আরও গভীরে গিয়ে মরণ, গমন, প্রভুত্ব করা –এই ক্রিয়াগুলি কিভাবে যে ‘মৃ’, ‘গ’ বা ‘ইন্দ্র’ শব্দ(ধ্বনি)গুলির মাধ্যমে প্রকাশিত (represented) হচ্ছে. –তার তল খুঁজতে শুরু করলে শেষ অবধি পাওয়া যায় কিছু মৌলিক ‘শব্দবীজ’ বা মৌলিক ‘অর্থযুক্ত ধ্বনি’র, (বাংলাভাষায় এর পরিমাণ ৪৬,) যার লিখিত রূপ হল ‘বর্ণ’।
রেখাচিত্র-৪ : অর্থের জন্য বহু শব্দের পরষ্পরনির্ভরশীলতা
- আগে বললেন, প্রতিটি শব্দের মানে নাকি এক-একটি ক্রিয়া। এখন বলছেন শব্দের বীচিগুলির অর্থও নাকি ‘ক্রিয়া’! কী করে তা হল, সে’ প্রশ্ন পরে করছি। তক্কের খাতিরে আপাতত ধরেই নিলুম না হয়। কিন্তু, বীচি যদি ছেচল্লিশখানাই হয়, আর সেগুলির যদি অর্থ যদি এক-একটি ক্রিয়া হয়, তাহলে মাত্তর ছেচল্লিশখানা ক্রিয়া থেকে লাখ-লাখ ক্রিয়া বের হয় কিভাবে মশায়? –ভোজবাজি নাকি!
- উঁহু, শব্দবাজি বলতে পারেন।... শব্দবীজের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থের কথায় পড়ে আসা যাবে, আগে শুধু ‘খাওয়া’ আর ‘যাওয়া’ –এই আটপৌরে ক্রিয়াদু’টির থেকেই কতরকম ক্রিয়া তৈরী হতে পারে দেখা যাক;- (এক) খাওয়া ও যাওয়া, (দুই) খেতে যাওয়া, (তিন) গিয়ে খাওয়া, (চার) খেয়ে যাওয়া, (পাঁচ) খাদকের যাওয়া, (ছয়) গমনকারীর খাওয়া...। জানা-শোনার মধ্যে সবচে’ বড়ো দু’টি বাংলা শব্দ হল ‘নিশীথবনভ্রমণবিলাসিনী’ আর ‘মদনমদোন্মাদহলাহলকলসীতুল্য’-।
উড়ে এসে জুড়ে বসা একটি ভূত এতক্ষণ চুপচাপ আলোচনা শুনছিল। সে’ব্যাটা হঠাৎ নিবন্ধলেখককে মাঝপথে থামিয়ে ফস্ করে বলে বসল, - আমি আরও বড়ো দু’খানা শব্দ জানি, ‘কম্বুকন্ঠান্দোলিতপিবঢ়-যৌবনাভারাবনতদেহা’ আর ‘লশুনপলাণ্ডগুঞ্জনকুম্ভীশ্রা-পথন্নসুতকান্নাভোজ্যান্য-মধুমাংসমূত্ররেতোহমেধ্যাভক্ষভক্ষণে-গায়তর্যাষ্টসহ’।
ভূতের আচমকা ‘শব্দ-বাণে’ সমালোচক ও নিবন্ধলেখক –দু’জনেই বিষম খায়! কিছুক্ষণ পর প্রথমজন কোনওমতে বলে, -বঙ্কিমী ‘vocabulary’-এর উদাহরণ টানবেন না দয়া করে। সে’ বস্তু নামেই বাংলা, আসলে পনেরো আনা সংস্কৃত।
- বেশ, ‘নিশীথবনভ্রমণবিলাসিনী’-এর বদলে ‘বিলাস’ –শব্দটি ধরলে চলবে আশা করা যায়! শব্দটিতে মোট ছ’টি শব্দবীজ আছে (ব্+ই+ল্+আ+স্+অ)। গাণিতিক (Permutation) সূত্র ধরে বলা যায়, ছেচল্লিশটি শব্দবীজ থেকে একটিও শব্দবীজ পুনরাবৃত্তি না করেও মোট ‘ছয় অব্দ সাত অর্বুদ চার কোটি একচল্লিশ লক্ষ নয় হাজার ছ’শো আশিটি’7 (৬,৭,৪,৪১,০৯,৬৮০) শুধু ছয় ‘অক্ষরে’র শব্দ তৈরী করা যায়।8
শব্দের মধ্যে কোনও একটি শব্দবীজ একাধিকবার করে থাকলে (মানে, শব্দের মধ্যে একাধিক ‘অ’ বা একাধিক ‘ক্’, ইত্যাদি) থাকলে সম্ভাব্য শব্দের পরিমাণ হয় ৬,৭,৪,৪১,০৯,৬৮০-এর ‘ষষ্ঠঘাত’ (‘to the power six’)!... এই ভাবে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের সম্ভাব্য শব্দের পরিমাণ মেপে তা যোগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, -তা উচ্চারণ করতেই হয়তো টানা দু’-তিন দিন লাগবে!
বিদ্যাসাগরের বাংলাভাষার বর্ণমালা সংস্কারের সমালোচকেরা বাংলাভাষায় ‘ই-ঈ’ বা ‘উ-ঊ’ বা ‘স্-শ্-ষ্’ বা ‘ন্-ণ্’ –ধ্বনিগুলির পৃথক উচ্চারণ মানতে চান নি। এদিকে, হালে আমদানি হয়েছে একটি নতুন শব্দবীজ ‘জ়’–এর, যার উচ্চারণ অনেকটা ‘z’-এর মতো। সেক্ষেত্রে শব্দবীজের সংখ্যা ৪৬-এর বদলে ৪১ বা ৪২ ধরে হিসেব কষলেও সম্ভাব্য শব্দের পরিমাণ এমন কিছু কম হয় না।
আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের পিতৃপুরুষ আভ্রাম নোম চম্স্কির মতে, মানুষ যে গুটিকয় শব্দ দিয়েই অসংখ্য বাক্য বানাতে পারে, এই ক্ষমতা মানুষের প্রাকৃতিক অর্জন। -এই দর্শনের parameter ‘শব্দ’ থেকে ‘শব্দবীজ’ অবধি ছড়িয়ে দিলে ওই হিসেবে-নিকেশের মর্মার্থ আন্দাজ করা যায়।
সমালোচক মশায়ের চোখেমুখে তখন অবজ্ঞার হাসি;
- ‘ট্যাংলা’, ‘ঢিংচুকিচু’ বা ‘ফনিট্রোপর্ডিভ্যেয়াম’ –গোছের শব্দগুলি ‘mathematically’ সম্ভব হতে পারে, ভাষায় তাদের ঠাঁই আছে কি? শব্দের পরিমাণ বলতে গিয়ে ওই যে লম্বা-চওড়া সংখ্যা দেখালেন, তার সবগুলি তো অর্থবহ নয়। -তখন থেকে ফালতু কিছু অধিভৌতিক কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন!
- কোনও শব্দের অর্থ আছে কি নেই, আমরা তা ঠিক করি সেই শব্দের সাথে ‘associate’ করার মতো কোনও বস্তু বা বিষয় আমাদের বোধে আছে কি না, তার দ্বারা। অভিধানগুলিও সেইমত তৈরী।... একজন গড়পরতা মানুষের বোধ ‘দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা’র কার্তেসিয় ত্রি-মাত্রিক (Cartesian three-dimensional) খাঁচায় সীমাবদ্ধ। এর সঙ্গে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ‘সময়’-এর একটা ভাসা-ভাসা ধারণা থাকে বড়জোর। সেখানে বিজ্ঞান আজ অবধি সর্বাধিক ছাব্বিশখানা মাত্রা ‘থাকা’র সম্ভাবনার কথা বলেছে।9 এদিকে, সাকুল্যে ওই ‘সাড়ে-তিন’খানি মাত্রার বাইরে আমি-আপনি ঠিক মতো কল্পনাও করতে পারি না 10। তবে আমার-আপনার কল্পনাশক্তির বাইরে প্রকৃতিতে যে ‘কিছু’ নেই –এমন তো নয়। (ডাইনোসর বা পেট্রোলিয়ামের অস্তিত্ব আবিষ্কারের আগে এই ‘ত্রিমাত্রিক’ বস্তুগুলিও গড়পরতা মানুষের কল্পনাতে ছিল না।) তাই সারা বিশ্বের যাবতীয় অভিধানের বাইরের ‘শব্দ’গুলি মানুষের বোধে না থাকলেও ‘প্রাকৃতিক সম্ভাবনা’য়, কিন্তু আছে। আছে ‘পরাবাক’ হয়ে, -সংজ্ঞাহীন নৈঃশব্দের এলাকায়।11 তাদেরকে চিনতে বা বুঝতে না পারার দায় একমাত্র আমাদের।
- এবার বলুন তো, ওই ‘শব্দবীজে’র অর্থ থাকার কোনও পাথুরে প্রমাণ আছে? –মানে লিখিত কিছু, -for reference?
- হ্যাঁ এবং না। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তার উল্লেখ আছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে বিরোধিতাও আছে। আবার তন্ত্রশাস্ত্রে শব্দবীজের পরিবর্তে প্রতিটি ‘মাতৃকাবর্ণ’গুলির ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সে’ ব্যাখ্যায় এত বেশি রূপকের ব্যবহার, যে প্রকৃত অর্থ ধরা খুব কঠিন। আর তন্ত্রশাস্ত্রগুলি প্রচলিত পরিচয় বা ‘বদনাম’ সেগুলিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে অন্তরায়ও বটে।
তবে শব্দবীজের অর্থ নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘ক্রিয়াকারী’ বা ‘কৃত’-এর থেকে ‘ক্রিয়া’কে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে কোনও শব্দবীজের বিভিন্ন রকম ব্যবহারের ‘নমুনা’ নিয়ে ‘statistically’-ও শব্দবীজের অর্থ নিষ্কাশন করা যায়। এই যেমন ধরা যাক, ‘ক্’ ধ্বনিটির ব্যবহারগুলি;-
•ক-১ (ক) - ক্রি (সকর্মক) - বলা, কহা। {(সংস্কৃত) কথ্ > (প্রাকৃত) কহ্ > (বাংলা) কহ্ > কঅ > ক}
•ক-২ (ক) - বিশেষণরূপে ব্যবহৃত সর্বনাম - কয়েক, কতিপয়, কয় {(সং) কতি > (প্রা) কই > (বাং) ক}
•ক-৩ (ক) – বিশেষ্য {যেমন, ‘ক-অক্ষর গোমাংস’}
•ক-৪ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে - ক্, কোথাও কোথাও - ক) - বাংলা বিভক্তি, প্রত্যয়, প্রভৃতি রূপে ব্যবহৃত ‘ক'।
তদ্ধিত প্রত্যয় {ঢোল+ক = ঢোলক (ক্ষুদ্রার্থে), মড়+ক=মড়ক (বিশিষ্টার্থে), ইত্যাদি
ক্রিয়াপদের শেষের ‘ক'- বসিবেক, খাইবেক, লইবেক, ইত্যাদি। (সম্ভ্রমাত্মক অনুজ্ঞার রূপ)।
•ক-৫ (কো) - উপেক্ষা প্রবণতাজ্ঞাপক প্রত্যয়রূপে নাস্তিবোধক ‘না'-এর সঙ্গে ব্যবহৃত ক'। {‘থাকবো নাক বদ্ধ ঘরে’ – নজরুল}
•এইভাবেই ‘ক-৬’, ‘ক-৭’ ...
এই তালিকাটিকে যতদূর সম্ভব সম্পূর্ণ (comprehensive) করার পর তাকে বিশ্লেষণ করলে ‘ক্’-ধ্বনির অর্থ নিষ্কাশন করা যায়। তবে নমুনার পরিমাণ পরিমাণ যত বেশী হবে, নিষ্কাশিত অর্থ তত নির্ভুল হবে।
- কলিম খান আর রবি চক্রবর্তী নামের দু’জন লোক যে ‘ক্ মানে করণ’, ‘ট্ মানে টঙ্কারণ’, ‘হ্ মানে হওয়ন’, ইত্যাদি বলেছেন12 - statistically কি সেই সব প্রমাণ করা সম্ভব?
- সূচনা হিসেবে সে’কাজ অবশ্যই গ্রহণীয়। তবে সেই অর্থ-তালিকাটিকে আরও নিখুঁত করা যায়।
- আপনার স্ট্যাটিস্টিক্যাল রাস্তাখানাও কিন্তু বড্ড বেশী সংস্কৃতঘেঁষা।
- সে আমি-আপনি নিতান্ত নিরুপায় বলে। সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনও ভারতীয় ভাষায় শব্দের ‘ক্রিয়ামূল’ বা ধাতু নিয়ে মৌলিক চর্চা হয়েছে কতটুকু? বাংলাভাষায় সে’কাজ যদি করা হয়, তখন সংস্কৃতের গায়ে আর ঠেঁস দিতে হবে না।
সংস্কৃত নিজে কোনও ‘স্বাভাবিক ভাষা’ নয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পাণিনি প্রচলিত বিভিন্ন লোকভাষা থেকে উপাদান নিয়ে সে’গুলিকে ঘষে-মেজে ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে যে ‘নতুন’ ভাষার কাঠামো গড়েছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি বা বিক্রমাদিত্যের আমলে বররুচির মতো বৈয়াকরণেরা সেই ভাষার নামকরণ করেন ‘সংস্কৃত’। পাণিনির বহু আগে বেদ বা রামায়ণ-মহাভারত রচনা হয়ে গেলেও পতঞ্জলিদের ‘অষ্টাধ্যায়ী-ভাষ্য’ রচনার আগে ‘সংস্কৃত’ নামটি অবধি ছিল না।13
আর পাণিনি যেহেতু প্রচলিত লোকভাষাগুলি থেকেই উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন, তাই বাংলাভাষার ‘মাতা-মাতামহী’দের সঙ্গে তার কিছু যে সম্বন্ধ আছেই, -সেটা ধরে নেওয়াই যায়।... সে’কারণেই বলা হল যে, অন্ততঃ যতদিন না বাংলাভাষার একেবারেই নিজস্ব ‘অষ্টাধ্যায়ী’র সাথে তুলনীয় কোনও কাজ হবে, সেদিন থেকে আর সংস্কৃতের দরকার পড়বে না।
- সোস্যুর কিন্তু বলেছেন, ভাষা (langue) ও উক্তি (parole) –দু’টি ভিন্ন সত্তা। ভাষা হল অদৃশ্য অভ্যন্তরীণ কাঠামো, আর উক্তি হল বাস্তব বহিঃপ্রকাশ।14 ... আর ভাষাবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড স্যাপির ও লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের নাম শুনেছেন আশা করি। তারা ছিলেন ভাষাবৈজ্ঞানিক সংগঠনবাদের পুরোধা। তাঁরা ভাষার গবেষণায় ‘উপাত্ত’ বা ‘data’-ভিত্তিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর জোর দেন এবং বলেন যে ভাষাবিজ্ঞানের কাজ ভাষা কী ভাবে কাজ করে তা নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করা। ভাষা কী রকম হওয়া উচিত, তা নিয়ে গবেষণা করা ভাষাবিজ্ঞানের কাজ নয়।
- ‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি’র চর্চায় তার অন্যথা হচ্ছে কি? তিরিশ কোটি বাঙালির মুখের ভাষা বা তাদের শব্দভাণ্ডারকে বদলে দেওয়ার মতো বিদঘুটে দাবি করা হচ্ছে না মোটেই। বরং খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে শব্দের ভিতরকার এমন শক্তির, -যার সম্ভাবনা অসীম।
- যেখানে কথাবার্তা, কাব্য-সাহিত্য, সব কিছু দিব্বি চলছে, হঠাৎ এই শব্দের উৎস খুঁজতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে যাব কেন বলুন তো?
দীর্ঘকথনে ক্লান্ত নিবন্ধলেখক এবার যেন কিছুটা উত্তেজিত, -তা ঠিক। বোধ হয় এই মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিতেই ‘উৎস-অন্নে’
(উৎসন্নে বা উচ্ছন্নে) যাওয়ার অর্থ ‘উত্থান’কে বদলে নিয়ে ‘অধঃপতন’ ঠাওড়ানো হয়েছিল!15 ... যুগে যুগে কাঠামোবাদী (structuralist)16 -রা বুঝে/ না-বুঝে জ্ঞানপ্রাপ্তির (enlightenment-এর) বিরোধিতা করে গিয়েছেন। ভাগ্যিশ্ ভাষাতত্ত্বে একজন নোম চম্স্কি এসেছিলেন, নইলে ভাষাকে হয়তো ‘শুধুমাত্র সামাজিক অর্জন’ হিসেবেই চিনতে হত!17...
- ভাষার ক্ষেত্রে কাঠামোবাদে সমস্যা-টা কোথায়?
- সমস্যা নেই! ওই কাঠামোবাদী তত্ত্ব অনুসারে, ‘সমুদ্র’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই শব্দটি সংক্রিয়ভাবে মনের জগতে জল, মাছ, জাহাজ, ঢেউ, ইত্যাদি সরলরৈখিক চিন্তার জন্ম দেয়। আবার ‘আঁধার’ শব্দটি শুনলেই চিন্তায় ‘আলো’ শব্দটির বিপরীত এক ছবি তৈরী হয়। শেকলের মতো শব্দ নাকি আরেকটি শব্দকে ক্রমাগত অন্তর্গত করতে থাকে! ... এমন হলে ‘জনসমুদ্র’, ‘জনস্রোত’ –জাতীয় শব্দগুলি তৈরীই হত না, ‘মনের আঁধার’, ‘জ্ঞানের আলো’ বা ‘enlightenment’-কে কোনওদিন বোঝাই যেত না!... ‘পূর্ব’ শুনলে যদি ‘উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম’ মার্কা ভৌগলিক দিকগুলিই (physical directions) –যদি মাথায় হামলা করে, তাহলে ‘পূর্বপুরুষ’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘প্রশ্নোত্তর’ শব্দগুলি জন্মাল কেমন করে?
- বিনির্মাণ তত্ত্ব দিয়ে জাক দেরিদা এই কাঠামোবাদী তত্ত্বকে নাকচ করেছেন তো!
- বাঁচিয়েছেন। নইলে-!
- তা ওই ‘ক্রিয়াভিত্তিক টিয়ার ডিম’ অনুসারে ভাষা সামাজিক অর্জন, নাকি প্রাকৃতিক অর্জন?
- প্রাকৃতিক। কিন্তু অর্জনের সময় parameter–গুলি মানুষ তার সমাজ (পারিপার্শ্বিক) থেকে সংগ্রহ করে। সেই parameter-এর ভিন্নতা (বা আপাত-বিন্নতা) -এর কারণেই পৃথিবীতে বহু ভাষা, বহু dialect... এতক্ষণ ধরে তো সে’ কথাই বলার চেষ্টা চলছে!...
যাই হোক, অনেক তত্ত্বকথা হল। তার চেয়ে এখন একটি গল্প শোনা যাক বরং;-
‘হাফ্-ডে’ বাঁচাতে মেয়েটি পড়ি-মরি ছুটতে ছুটতে অফিস-বাড়িতে ঢোকে। হাতে মাত্র মিনিট তিনেক। আট তলা নড়বড়ে একখানা বাড়ি, আর তার ঘরঘরে লিফ্ট! -একবার ওপরে উঠলে নামতে পাক্কা দশ মিনিট! মেয়েটি কোনওমতে বন্ধ হয়ে আসা দরজার ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে শেষমুহূর্তে লিফ্ট থামায়। ভেতরে সেঁধিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতেই লিফ্টম্যানকে বলে, ‘একটু ২-এ দেবেন প্লীজ্।'... –বলতেই চাপা হাসির শব্দ আসে পেছন থেকে। তাকিয়ে দেখে, চারতলার সেই লোকটা! মেয়ে দেখলেই তার নন্-ভেজ ইয়ার্কি মারার স্বভাব। -খুব অস্বস্তিকর। লোকটার অযথা হেসে ওঠার কারণ মেয়েটির মাথায় ঢোকে না। -ও কী এমন বলল! অভ্যেসমতো কুর্তিটা টেনেটুনে ঠিক করে নেয়।
কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারে যে লিফ্টের লোকটা ‘২-এ দেবেন’-কে ‘দুইয়ে দেবেন’ করে নিয়েছে!... না, রাগ হয় না তেমন। এতদিনে এসব গা-সওয়া। আর সত্যি বলতে কি, -চাকরি, সংসার, সমাজ সবাই মিলে দুইয়ে-ই তো নিচ্ছে ওকে। -ওদেরকে। ‘নহ মাতা নহ কন্যা...’। কন্যা, দুহিতা -‘যাকে দোহন করা হয়’। গোড়ায় তা-ই ছিল, পরে হয়তো চক্ষুলজ্জায় বা দয়াপরবশঃ ‘নিপাতনে সিদ্ধ’18 করে ‘যে দোহন করে’ বলা হয়েছে! অভিধানে টিকাকার লিখেছেন19, ‘বেদের যুগে মেয়েরা দুধ দোয়াতো’ –কি হাস্যকর, পরিচয়ের জন্য একমাত্র সেটাই পাওয়া গেল! ‘বিবাহকালে পিতার ধনসম্পদ দোহন করে।’ –কি অপমানজনক!
‘দোহনকৃত’কে দেওয়া হল ‘দোহনকারী’র অপবাদ। বস্তাপচা হিঁদুয়ানির প্রভাব? কই, পালিভাষার ‘দুহিত্বা’ও20 অন্য কোনও পরিচয় দেয় নি। তাহলে কি আজও ইংল্যান্ড-আমেরিকার ‘ডটার্’, পারস্যের ‘দোখ্তার’, জার্মানির ‘দখ্তার’ গ্রীসের ‘দ্যিগাতেরা’ –তারা সবাই ওরই মতো ‘দোহনকৃত’? স্থান, কাল নির্বিশেষে এই দোহন মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই কি ভবিতব্য ছিল না!
‘দিদি শুনছেন?’ –শুভময়। মুখচোরা মানুষটি বয়সে ওর চেয়ে বড়ো-ই হবে, তবু ‘দিদি’ ডাকে। উদয়ান্ত খাটে, তাও কথায় কথায় বসের ধমক খায়। বোনের বিয়ে, ভাই-এর ইঞ্জিনীয়ারিং, বাবার হঠাৎ বাইপাস। -মাথায় একসঙ্গে তিন-চারখানা লোনের বোঝা নিয়ে চলতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খায়। শুনেছে, কোনও এক সময়ে এই শুভময়বাবুর একজন বান্ধবী ছিল। মাইনের টাকা-ক’টির ওপর বরাদ্দ সব যোগ-বিয়োগের অত্যাচারের পর যা পড়ে থাকে, তার ভরসায় ‘ঘর বাঁধা’ আর হয়ে ওঠে নি।
মেয়েটি শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। - তাহলে কি ‘দুহিতা হয়ে ওঠায়’ পুরুষ-নারীর ভেদ থাকে না?...
কিছুক্ষণের নীরবতার পর সমালোচক বললেন;-
- ইশারারও একটা ভাষা হয় জানেন তো, যাকে বলে ‘body language’। আপনার মতে সেটিও কি-?
- অবশ্যই। খেয়াল করলেই বোঝা যায়, ধ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রা21 ও অঙ্গচালনা থেকে শুরু করে মূক-বধিরের ‘sign language’ হয়ে বখাটে লোকের কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত অবধি, –সবকটি ক্ষেত্রে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আসলে কোনও না কোনও ক্রিয়াকেই অনুসরণ বা অনুকরণ করা হয়।... আশা করি সহমত হবেন।
- না, এখনও পুরোপুরি মানতে পারছি না। এই ক্রিয়াভিত্তিক মানেতত্ত্ব-কে বড়জোর একটি ‘সম্ভাবনা’ বলতে পারা যায়। তাকে ‘প্রমাণিত’ হয়ে উঠার রাস্তায় অনেক কাঠ-খড় এখনও পোড়ানো বাকি।
নিবন্ধলেখক হাসে, -পথে দেখা হবে আশা করি। পুরু-আলেকজ়ান্ডারের সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছে রইল।...
(... শেষ)
-
Post-truth: ‘Relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief.’ – Oxford English Dictionary
-
ছাত্র শব্দের অর্থ ‘যে গুরুর দোষ ঢেকে রাখে’! [‘ছত্রং গুরুর্দোষাণামাবরণং তচ্ছীলমস্যেতি’ (শব্দকল্পদ্রুম)। ‘গুরুর দোষাবরণশীল’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ)।] এই অপকর্মটি কিছু কিছু (বা বেশিরভাগ) ‘গুরু’র প্রতি অবশ্যকর্তব্য হতেই পারে। কিন্তু মনে হয় না, গুরু হিসেবে সক্রেটিসের তেমন কোনও প্রয়োজন ছিল।
-
সূত্র: ‘ইহা শব্দ’ – অধ্যাপক মঈন চৌধুরী।
-
Source: ‘How Humans Recognize Objects: Segmentation, Categorization and Individual Identification’, Edited by Prof. (Dr.) Chris Fields, New Mexico State University (Published at ‘Frontiers in Psychology’)
-
বর্গীকরণ/ শ্রেণীবদ্ধকরণের পর্যায়ক্রম বা ধাপগুলির ধাঁচ কিছুটা ‘Set Theory’-এর ‘Recursive Subsets’ বা ‘N ⊆ Z ⊆ Q ⊆ R ⊆ C’ –এই ‘expression’-এর মতো। -‘...মাংসাশী ⊆ স্তন্যপায়ী ⊆ চতুষ্পদ ⊆ প্রাণী ⊆ জীবজগত...’।
-
সূত্র: ‘শব্দার্থতত্ত্ব’ – রবীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য্য শিদ্ধান্তশাস্ত্রী পঞ্চতীর্থ।
-
‘একদশশতসহস্রাযুতলক্ষপ্রযুতকোটয়ঃ ক্রমশঃ। অর্বুদমব্দং খর্বনিখর্বমহাপদ্মশঙ্খশ্চ তস্মাৎ॥ জলধিশ্চান্ত্যং মধ্যং পরার্ধমিতি দশগুণোত্তরং সংজ্ঞাঃ। সংখ্যায়াঃ স্থানানাং ব্যবহারার্থঃ কৃতাঃ পূর্বৈঃ॥’ - আর্য্যভট্ট (৪৭৬-৫৫০ খ্রীঃ)। (১০০ → এক, ১০১ → দশ, ১০২ → শত, ১০৩ → সহস্র, ১০৪ → অযুত, ১০৫ → লক্ষ, ১০৬ → প্রযুত, ১০৭ → কোটি, ১০৮ → অর্বুদ, ১০৯ → অব্দ, ১০১০ → খর্ব, ১০১১ → নিখর্ব, ১০১২ → মহাপদ্ম, ১০১৩ → শঙ্খ, ১০১৪ → জলধি, ১০১৫ → অন্ত্য, ১০১৬ → মধ্য, ১০১৭ → পরার্ধ ... ১০৫৩ → তল্লক্ষণ, ১০১৪০ → অসংখ্যেয় ...।)
-
Permutation (action of changing the arrangement, especially the linear order, of a set of items) The number of ‘k’ (which is 6 here) permutations of ‘n’ (which is 46 here) is denoted by ‘P(n,k)’. ‘P(n,k) = n*(n-1)*(n-2)…(n-k+1)’.
-
তথ্যসূত্র: ‘The Little Book of String Theory’ by Prof. Steven S. Gubser, Princeton University
-
‘The idea of 10 dimensions might sound exciting, but they would cause real problems if you forget where you parked your car.’ - Stephen Hawking, ‘The Grand Design’
-
কৃতজ্ঞতা: ‘নীরবতার না-ভাষাতত্ত্বঃ লালনে’ –অধ্যাপক দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, Indian Statistical Institute
-
সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ (২০১১) - কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী।
-
সূত্র: ‘পাণিনি, চমস্কি ও তারপর’ – অধ্যাপক মনসুর মুসা, ‘বাঙলা শব্দের উৎস সন্ধানে’ – ডঃ ইন্দ্রজিৎ সরকার।... অধ্যাপক মুসা-এর মতে ‘গুপ্ত যুগে, পাল যুগে ও সেন যুগে এই অঞ্চলের ভাষা সাংকর্য ও ভাষা প্রমিতায়ন –এই দুটি ব্যাপার ঘটেছিল ব্যাপক ভাবে।’ এই প্রমিতায়নের প্রধাণ কারণ আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি! অন্য অবসরে সে’ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
-
Source: ‘Course in General Linguistics’ by Ferdinand de Saussure (translated by Wade Baskin)
-
উৎসন্ন = উত্থান, অধঃপতন(!) (সূত্র: ‘প্রকৃতিবাদ অভিধান’ (১৮৬৬) – রামকমল বিদ্যালঙ্কার।) নিবন্ধে ‘উৎসন্ন’ শব্দটিকে ‘উৎস-অন্ন’ –এই ভাবে দেখানো হয়েছে। ‘অন্ন’ শব্দের একটি অর্থ ‘আকাঙ্খাপূরক বস্তু’ (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ)।
-
Structuralism: ‘the belief that phenomena of human life are not intelligible except through their interrelations. These relations constitute a structure, and behind local variations in the surface phenomena there are constant laws of abstract culture’ – Source: ‘Oxford Dictionary of Philosophy’ (2008) by Simon Blackburn ...
-
‘…The language faculty, it will be said, appears to us as a faculty given to us by nature, whereas the language [langue], on the contrary, is something that is acquired and conventional. It cannot take precedence over natural phenomena, natural instincts.’ (Source: ‘Saussure’s Third Course of Lectures on General Linguistics’) … এর বিপরীতে চমস্কি বললেন, ‘…the steady state of knowledge attained [I-language] and the initial state S0 [universal grammar] are real elements of particular mind/brains, aspects of the physical world, where we understand mental states and representations to be physically encoded in some manner. ... Linguistics, conceived as the study of I-language and S0 [universal grammar], becomes part of psychology, ultimately biology.’ (Source: ‘Knowledge of Language: Its Nature, Origin, and Use.’)
-
সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯৩২-১৯৫১) – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
-
সূত্র: ‘প্রকৃতিবাদ অভিধান’ (১৮৬৬) – রামকমল বিদ্যালঙ্কার।
-
ত্বা, ত্বান, তূন ও য প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। তাই ‘দুহ' ক্রিয়ার অর্থ ‘দোহন করে/ করিয়া'।
-
ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে ২৪টি অসংযুক্ত হস্তের (এক হাতের) মুদ্রার উল্লেখ আছে। যথা: পতাক, কপিত্থ, চতুর, ত্রিপতাক, কটকামুখ, ভ্রমর, কর্তরীমুখ, সূচী, হংসাস্য, অর্ধচন্দ্র, পদ্মকোশ, হংসপক্ষ, অরাল, সর্পশীর্ষ, সন্দংশ, শুকতুণ্ড, মৃগশীর্ষ, মুকুল, মুষ্টি, কাঙ্গুল, উর্ণনাভ, শিখর, অলপদ্ম ও তাম্রচুড়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।